Apple এর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস এর সফলতার রহস্য
Apple এর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস এর সফলতার রহস্য
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
সময়টা ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সালের একটি সাধারণ দিন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর এক ছোট হাসপাতালে জন্ম নিল এক শিশু। তার নাম রাখা হলো স্টিভ জবস। তার আসল মা ছিলেন জোয়ান শিবল (Joanne Schieble), আর আসল বাবা ছিলেন অবদুলফাত জন্দালি (Abdulfattah Jandali)।
জোয়ান শিবল ছিলেন কলেজ শিক্ষিকা। অবদুলফাত জন্দালি ছিলেন সিরীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।তারা দুজনই তখন পড়াশোনা করছিলেন এবং খুবই যুবক ছিলেন।
জোয়ান ও অবদুলফাত তাদের বাবা-মায়ের চাপের কারণে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে স্থির করতে পারছিলেন না যে, শিশুটি বড় হবে কিভাবে। তখনকার সমাজে এক অবিবাহিত মায়ের জন্য সন্তান রাখাটা কঠিন এবং জটিল বিষয় ছিল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন শিশুটিকে এমন এক দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হবে, যারা তাকে ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ পরিবেশ দিতে পারবে।
তাই জন্মের পরপরই তাকে দত্তক দেওয়া হয়—এক সাধারণ দম্পতি, পল জবস ও ক্লারা জবস-এর কাছে। তারা ধনী ছিলেন না, কিন্তু মন ছিল সমৃদ্ধ। পল ছিলেন একজন মেকানিক।তারা একটি গাড়ির গ্যারেজ ছিল। যিনি পুরোনো গাড়ি মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, আর ক্লারা ছিলেন বুক টাইপিস্ট।
ছোটবেলা থেকেই স্টিভ ছিল অদ্ভুত এক ছেলে—সে জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসত। অন্য বাচ্চারা যখন খেলনা নিয়ে খেলত, স্টিভ তখন খেলনা ভেঙে ফেলত—দেখত ভিতরে কী আছে, কীভাবে কাজ করে। পুরোনো রেডিও, টেলিভিশন, ঘড়ি—সব খুলে দেখতেন কিভাবে কাজ করে। তার দত্তক বাবা কখনও বকতেন না। বরং বলতেন, “যে কাজ করবে, সেটি নিখুঁতভাবে করো। এমনভাবে করো যেন সারা জীবন সেটাই তোমার শিল্প।”
এই কথাটা ছোট স্টিভের মনে গভীরভাবে গেঁথে যায়। স্টিভের বয়স যখন দশ, তখনই তার ভেতরে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত প্রশ্ন করার অভ্যাস। সে যা দেখত, তা নিয়ে প্রশ্ন করত— “কেন এমন হয়?” “এই জিনিসটা আরেকভাবে করা যায় না?” “যদি এটা এমনভাবে বানানো যায়, তাহলে কি ভালো হবে না?” এই অবিরাম প্রশ্নই ছিল তার কৌতূহলের শুরু।
তার দত্তক বাবা একদিন গ্যারেজে তাকে নিয়ে বললেন, “দেখো স্টিভ, এটা একটা পুরোনো গাড়ি। এখন আমরা এটাকে নতুন করে বানাব।” স্টিভ অবাক হয়ে দেখত, কিভাবে এক টুকরো লোহাকে তার বাবা যত্ন আর মনোযোগ দিয়ে নতুন রূপ দেন। তখন সে প্রথম শেখে— “সৌন্দর্য কেবল বাইরের নয়, ভিতরের কাজের নিখুঁততাতেও।”
স্টিভের দত্তক মা তাকে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন, কিন্তু স্কুলে সে সবসময় নিয়মমাফিক ছাত্র ছিল না। শিক্ষকরা বলতেন, সে বুদ্ধিমান, কিন্তু “অতি প্রশ্নবাজ”। সে প্রথা মানতে চাইত না। বরং ভাবত—
“নিয়ম যদি উন্নতির পথে বাধা হয়, তাহলে নিয়মটাই পাল্টে ফেলতে হবে।”
একবার তার শিক্ষক বলেছিলেন, “তুমি অদ্ভুতভাবে চিন্তা করো, সবাই যেমন ভাবে, তুমি তেমন ভাবো না।”স্টিভ তখন মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিল, “হয়তো একদিন এই ভাবনাই দুনিয়াকে বদলে দেবে।”
বাড়িতে ফিরে গ্যারেজই ছিল তার প্রিয় জায়গা। রেডিও, ঘড়ি, টেলিভিশন—যা পেত তাই খুলে ফেলত। কখনও কাজ করত, কখনও নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু তার বাবা রাগ করতেন না। বরং বলতেন,
“ভয় পেও না, ভুল থেকেই শেখা যায়।” এইভাবেই ছোট স্টিভ শিখেছিল— ভয় না পেয়ে চেষ্টা করতে হবে, ব্যর্থতা মানে শিক্ষা।
তার শৈশবের গ্যারেজই ছিল তার প্রথম ল্যাবরেটরি, তার বাবার কাজের বেঞ্চই ছিল প্রথম কর্মশালা, আর সেই কৌতূহলই হয়ে ওঠে একদিন পৃথিবী বদলে দেওয়ার প্রেরণা।
সে জানত না, একদিন সেই কৌতূহলই তাকে এমন এক পথে নিয়ে যাবে, যেখানে একটি সাধারণ গ্যারেজ থেকে জন্ম নেবে Apple, আর তার নাম উচ্চারিত হবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী উদ্ভাবকদের তালিকায়।
সময়টা তখন ১৯৭২ সাল।স্টিভ জবস তখন ক্যালিফোর্নিয়ার হাই স্কুল থেকে পাস করে ভর্তি হলেন রিড কলেজে (Reed College) — ওরেগনের একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তিনি দ্রুত বুঝলেন — এটা তাঁর জায়গা নয়।
রিড কলেজে পড়াশোনার খরচ ছিল অনেক। তাঁর বাবা-মা সীমিত আয়ের মানুষ, তবু ছেলেকে ভালো জায়গায় পড়ানোর জন্য সব সঞ্চয় ব্যয় করছিলেন।
স্টিভ বুঝতে পারলেন, তিনি যা পড়ছেন, তা তাঁর জীবনের স্বপ্ন বা আগ্রহের সঙ্গে মেলে না।
তাঁর আগ্রহ ছিল সৃষ্টিতে, নতুন কিছু বানানোতে — কিন্তু কলেজে সবকিছুই যেন যান্ত্রিক ও নির্দিষ্ট পথে বাঁধা।
একদিন রাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন— “আমি এমন কোনো পথ চাই না যেখানে আমার মনে আগুন জ্বলে না। আমি এমন কিছু শিখতে চাই যা সত্যিই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।” তাই তিনি সাহস করে কলেজ ছেড়ে দিলেন।
সবাই অবাক হলো—একজন মেধাবী ছাত্র, নামী কলেজে ভর্তি হয়ে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে?
বন্ধুরা বলল, “তুমি পাগল!” কিন্তু স্টিভ হাসলেন আর বললেন, “আমার মনে হয়, আমি নিজেই নিজের পথ খুঁজে নেব।”
কলেজ ছেড়ে দিলেও তিনি কলেজের আশেপাশে ঘুরতেন, লাইব্রেরিতে যেতেন, আর যেসব ক্লাস তাঁর ভালো লাগত—বিনা খরচে সেগুলোতে বসে পড়তেন।
একদিন তিনি ক্যালিগ্রাফির একটি ক্লাসে গেলেন— যেখানে শেখানো হচ্ছিল অক্ষরের নকশা, রূপ ও সৌন্দর্য। তিনি অবাক হয়ে গেলেন— অক্ষরও এত সুন্দর হতে পারে! তিনি শিখলেন, প্রতিটি অক্ষরের বাঁক, ফাঁক, এবং সৌন্দর্যের গভীরতা কত সূক্ষ্মভাবে তৈরি হয়।
সেই সময় তিনি জানতেন না, একদিন এই শিক্ষা কাজে লাগবে। কিন্তু বছর দশেক পর, যখন তিনি Apple Computer তৈরি করবেন, তখন সেই ক্যালিগ্রাফির জ্ঞান দিয়েই প্রথম কম্পিউটার বানাবেন যেখানে সুন্দর বাংলা ও ইংরেজি ফন্ট থাকবে।যা পরবর্তীতে পুরো কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রির ধারা পাল্টে দেয়।
রিড কলেজে থাকার সময় তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও বেঁচে ছিলেন। কখনও বন্ধুর ঘরে মেঝেতে ঘুমাতেন, খাওয়ার জন্য খালি বোতল জমা দিতেন।
এক রবিবারে ৭ মাইল হেঁটে যেতেন হরে কৃষ্ণ মন্দিরে, শুধু বিনামূল্যে একটি ভালো খাবারের আশায়। তবু তাঁর মনে কোনো হতাশা ছিল না।
একদিন এক বন্ধুকে বলেছিলেন, “আমি হয়তো এখন গরিব, কিন্তু আমি স্বাধীন। আমি আমার স্বপ্নকে অনুসরণ করছি।” এটাই ছিল স্টিভ জবসের জীবনের মোড়। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন— জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেকে জানা, নিজের ভালো লাগার কাজ খুঁজে পাওয়া।
তিনি বলেন, “You can’t connect the dots looking forward; you can only connect them looking backward.”
অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ বোঝা যায় না, কিন্তু অতীতের প্রতিটি ঘটনার কারণ পরে গিয়ে পরিষ্কার হয়।
তাঁর কলেজ ত্যাগ, তাঁর কৌতূহল, তাঁর ক্যালিগ্রাফি শেখা—সবকিছুই একদিন তাঁকে তৈরি করবে সেই মানুষে, যিনি প্রযুক্তির ইতিহাসে এক বিপ্লব আনবেন।
সময়টা ১৯৭৬ সাল। স্টিভ জবস তখন কেবল এক তরুণ, বয়স মাত্র একুশ। তাঁর হাতে কোনো বিশাল পুঁজি ছিল না, কিন্তু মনে ছিল বিশাল এক স্বপ্ন— “প্রযুক্তিকে মানুষের হাতে সহজভাবে তুলে দেওয়া।”
তাঁর বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াক (Steve Wozniak) ছিলেন এক মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার। তিনি কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ জোড়া লাগাতে পারতেন চোখ বন্ধ করেই।জবসের মাথায় ব্যবসার চিন্তা, আর ওজনিয়াকের হাতে ছিল কারিগরি দক্ষতা।
এই দুই প্রতিভা মিলে একদিন ঠিক করলেন—তারা এমন এক কম্পিউটার বানাবেন, যা শুধু বিশেষজ্ঞদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও হবে। কিন্তু সমস্যা ছিল—তাদের কোনো অফিস নেই, কোনো বড় জায়গা নেই, কোনো বিনিয়োগকারীও নেই।
তখন জবস বললেন, “যদি বড় জায়গা না থাকে, ছোট জায়গা দিয়েই শুরু করা যাক। স্বপ্ন বড় হলে জায়গা ছোট কোনো ব্যাপার নয়।” তারা শুরু করলেন তাঁর বাবার গ্যারেজে। হ্যাঁ, একটি সাধারণ গ্যারেজ—যেখানে সাধারণত পুরোনো গাড়ি রাখা হয়, সেই জায়গাতেই জন্ম নিল ভবিষ্যতের Apple Company।
গ্যারেজের ছোট টেবিলে বসে তারা হাতে হাতে বানাতে শুরু করলেন কম্পিউটারের সার্কিট, স্ক্রিন, কীবোর্ড। কখনও রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করতেন।
গ্যারেজের বাতাসে তখন মেশে ধাতুর গন্ধ, গরম সোল্ডারের ধোঁয়া, আর স্বপ্নের ঘ্রাণ।
তাদের প্রথম পণ্যটির নাম ছিল Apple I. এটি ছিল একেবারে নতুন ধরনের কম্পিউটার—ছোট, সহজে ব্যবহারযোগ্য, আর দেখতে আকর্ষণীয়। তারা নিজেরাই তৈরি করলেন, নিজেরাই প্যাক করলেন, নিজেরাই বিক্রির চেষ্টা করলেন।
স্টিভ জবস নিজে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে বলতেন,“এই কম্পিউটার ভবিষ্যৎ বদলে দেবে।” প্রথম দোকান থেকে মাত্র ৫০টি কম্পিউটার অর্ডার পেলেন।রাতে তিনি ও ওজনিয়াক মিলে গ্যারেজে বসে তা তৈরি করলেন, প্যাক করে নিজে পৌঁছে দিলেন।
দিনগুলো ছিল কঠিন, কিন্তু আশা ছিল আগুনের মতো। তাদের চোখে জ্বলত ভবিষ্যতের আলো—একটা পৃথিবী, যেখানে প্রযুক্তি থাকবে প্রতিটি ঘরে। আর ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন সত্যি হতে লাগল।
“Apple I” এর পর এলো “Apple II”, যা বাজারে বিপ্লব ঘটাল। মানুষ প্রথমবার বুঝল—কম্পিউটার মানে শুধু গবেষণাগারে বসে থাকা যন্ত্র নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে পারে।
Apple-এর বিক্রি বাড়তে লাগল, নাম ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বজুড়ে। স্টিভ তখনও ছিলেন সেই তরুণ, যিনি গ্যারেজে বসে হাত ময়লা করতেন, কিন্তু ভাবতেন বিশাল ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি সব সময় বলতেন—
“We started with nothing but a dream. And dreams are powerful.”
(“আমরা কিছুই দিয়ে শুরু করিনি, শুধু একটি স্বপ্ন দিয়ে। আর স্বপ্নের শক্তি অপরিসীম।”)
এইভাবেই এক সাধারণ গ্যারেজ থেকে জন্ম নেয় এক অসাধারণ প্রতিষ্ঠান — Apple, যা পরে হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রযুক্তি কোম্পানি। যে মানুষ ছোট জায়গা থেকেও বড় স্বপ্ন দেখতে জানে, সেই-ই একদিন বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। কারণ বড় সাফল্য সব সময় ছোট সূচনা থেকেই জন্ম নেয়।
সময়টা ১৯৮৫ সাল। “Apple” তখন বিশ্বজুড়ে এক পরিচিত নাম। মানুষ জানে — এই কোম্পানিই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বদলাবে। আর সেই কোম্পানির মুখ্য ব্যক্তি — তরুণ, উদ্যমী, অদম্য এক নেতা — স্টিভ জবস।
কিন্তু যত দ্রুত সাফল্য আসে, তত দ্রুতই সমস্যাও দেখা দেয়। Apple বড় হতে হতে একটি বিশাল কোম্পানিতে পরিণত হলো। অনেক নতুন পরিচালক, বিনিয়োগকারী, ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা এসে যোগ দিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে স্টিভের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত ছিলেন না।
কারণ, স্টিভ ছিলেন অন্যরকম—তিনি নিয়মের ভেতরে থাকতে পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন প্রতিটি পণ্যে হোক নিখুঁততা, সৃজনশীলতা, আর নতুনত্ব।তিনি একদিন এক মিটিংয়ে বলেছিলেন, “আমরা কেবল কম্পিউটার বানাচ্ছি না, আমরা ভবিষ্যৎ তৈরি করছি।”
কিন্তু বোর্ড সদস্যদের অনেকে ভাবতেন—“জবস অনেক বেশি স্বপ্নবাজ, বাস্তব নয়।” এই দ্বন্দ্ব ক্রমে তীব্র হতে লাগল। Apple-এর নতুন CEO (যাকে স্টিভ নিজেই নিয়োগ দিয়েছিলেন) একসময় স্টিভের সঙ্গে তীব্র মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন। কোম্পানির মিটিংয়ে, যার নেতৃত্বে Apple একদিন সৃষ্টি হয়েছিল, সেই স্টিভ জবসকে বলা হলো — ‘তোমার আর প্রয়োজন নেই।’
সেই দিনটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন।
নিজ হাতে তৈরি সন্তান Apple থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলো। স্টিভের বয়স তখন মাত্র ৩০। তিনি একদম নিঃস্ব অনুভব করছিলেন। এক বন্ধুকে বলেছিলেন, “আমি আমার জীবনের ভালোবাসা হারিয়েছি। মনে হচ্ছে সবকিছু শেষ।”কিন্তু এই মানুষটা ভেঙে পড়লেন না। বরং কয়েকদিন একা থেকে নিজের মনকে প্রশ্ন করলেন — “আমি এখন কী করব?” উত্তর এল হৃদয় থেকে — “যা ভালোবাসি, তাই করব।”
স্টিভ জবস যখন নিজের কোম্পানি Apple থেকে বেরিয়ে গেলেন, তাঁর ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল।যে মানুষ একদিন কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা ছিলেন, সেই এখন একা— কোনো অফিস নেই, কোনো দল নেই, কোনো নামও নেই। তবুও, তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং তিনিভাবলেন, “যদি আজ আমি মাটিতে পড়ে যাই, তবে এখান থেকেই আবার উঠে দাঁড়াব।” এই মানসিকতা নিয়েই শুরু হলো তাঁর নতুন যাত্রা।
প্রথমে তিনি একটি নতুন কম্পিউটার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন — NeXT Inc. এটি ছিল তাঁর নতুন স্বপ্ন, যেখানে তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগারগুলোকে নতুন প্রজন্মের শক্তিশালী কম্পিউটার দিতে।
তিনি NeXT-এ দারুণ সব প্রযুক্তি আনলেন, যেমন নান্দনিক ডিজাইন, শক্তিশালী সফটওয়্যার, আর সহজ ব্যবহারযোগ্য ইন্টারফেস। কিন্তু বাজার তখন প্রস্তুত ছিল না। NeXT বাণিজ্যিকভাবে তেমন সাফল্য পেল না।
তবে স্টিভ জবস বুঝেছিলেন— “প্রত্যেক ব্যর্থতা ভবিষ্যতের সফলতার পাঠ।” এবং পরে, Apple আবার যখন তাঁকে ফিরিয়ে নেয়, তখন NeXT-এর সফটওয়্যারই পরবর্তীতে Apple-এর macOS হয়ে ওঠে! অর্থাৎ, সেই ব্যর্থ কোম্পানির প্রযুক্তিই ভবিষ্যতে সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করেছিল।
NeXT-এর পাশাপাশি, ১৯৮৬ সালে স্টিভ আরেকটি ছোট কোম্পানি কিনলেন — নাম ছিল Pixar।তখন এটি Lucas film-এর একটি ছোট বিভাগ মাত্র, যেটা কম্পিউটার অ্যানিমেশনে কাজ করত।
তখনকার দিনে, কেউ বিশ্বাসই করত না যে, কম্পিউটারে তৈরি অ্যানিমেশন সিনেমা জনপ্রিয় হতে পারে। কিন্তু স্টিভের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্যরকম। তিনি বলেছিলেন, “যদি আমরা গল্পটা সঠিকভাবে বলি, প্রযুক্তি গল্পের ভিতরেই হারিয়ে যাবে।” Pixar-এর টিম দিনরাত কাজ করতে লাগল। স্টিভ নিজের সব অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করলেন — এমনকি অনেক সময় নিজের বাড়ি বন্ধক রাখতে হয়েছে।
অনেকে তাঁকে বলেছিল, “তুমি পাগল হয়ে গেছো! অ্যানিমেশন দিয়ে টাকা আয় করা যায় না।” কিন্তু স্টিভ বিশ্বাস করতেন— “যেখানে সৃজনশীলতা আছে, সেখানে সম্ভাবনাও আছে।”
অবশেষে, বছরের পর বছর পরিশ্রমের পর ১৯৯৫ সালে Pixar মুক্তি দিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার অ্যানিমেটেড সিনেমা — 🎥 “Toy Story”
এটি ইতিহাস সৃষ্টি করল। মানুষ অবাক হয়ে গেল — চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত! সিনেমাটি শুধু সফলই হলো না, বরং বিশ্বের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিকে পুরোপুরি বদলে দিল। Pixar হয়ে উঠল এক নতুন যুগের সূচক, আর স্টিভ জবস হয়ে গেলেন দ্বিতীয়বারের মতো কিংবদন্তি উদ্যোক্তা।
এই সময়ে স্টিভ জবস জীবনের প্রতি নতুনভাবে তাকাতে শিখলেন। তিনি বুঝলেন— “জীবনের প্রতিটি ঝড় কোনো না কোনোভাবে তোমাকে তোমার গন্তব্যের কাছে নিয়ে যায়।”
Apple থেকে বাদ পড়া, NeXT-এর ব্যর্থতা, একাকিত্ব — সবই তাঁকে তৈরি করেছিল নতুন করে।
তিনি নিজের ভাষায় বলেছিলেন, “Apple থেকে আমাকে না বের করলে, হয়তো আমি কখনো নতুনভাবে শুরু করার সাহস পেতাম না।”
Pixar শুধু Toy Story-ই নয়, পরবর্তীতে তৈরি করল Finding Nemo, Cars, The Incredibles, Monsters Inc. — প্রতিটি সিনেমাই বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলো।
২০০৬ সালে Pixar কে কিনে নিল Disney, আর স্টিভ জবস হয়ে গেলেন Disney-এর সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত শেয়ারহোল্ডার। একসময় যে মানুষ নিঃস্ব ছিলেন, সেই এখন দুটো বৃহত্তম কোম্পানির (Apple ও Disney) গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১. প্রত্যেক পতনই নতুন উত্থানের শুরু:
Apple থেকে বহিষ্কৃত হওয়া ছিল স্টিভের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।
২. যেখানে মানুষ অসম্ভব দেখে, সেখানেই সুযোগ লুকিয়ে থাকে:
Pixar-এ তিনি যা দেখেছিলেন, অন্য কেউ তা কল্পনাও করেনি।
৩. ভালোবাসা ও সৃজনশীলতা — এই দুই-ই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
৪. জীবন সব সময় একদিকে চলে না, কিন্তু প্রতিটি বাঁকেই থাকে শিক্ষা।
শেষ পর্যন্ত, Pixar-এর গল্প আমাদের শেখায় —
“যদি তুমি নিজের কল্পনাকে বিশ্বাস করো, তবে একদিন পৃথিবীও সেই কল্পনাকে বাস্তব বলবে।”
১৯৯১ সালের কথা। স্টিভ জবস তখন জীবনযুদ্ধে অনেক কিছু জিতে এসেছিলেন, আবার অনেক কিছু শিখেছেন। Apple থেকে বহিষ্কার হওয়া, Pixar-এর যাত্রা শুরু, NeXT-এর চ্যালেঞ্জ — সব কিছুই তাঁকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
একই সময় তাঁর জীবনে প্রবেশ করল লরেন পাওয়েল (Laurene Powell)। লরেন তখন স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন,
মেধাবী, স্বতঃস্ফূর্ত, এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি একনিষ্ঠ।
স্টিভ ও লরেন প্রথম দেখা করেন একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠানে। স্টিভ তখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। লরেন তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হন — কেবল প্রযুক্তি বা ব্যবসার জন্য নয়, স্টিভের মধ্যে সেই বিশেষ দৃষ্টি, জীবন ও সৃষ্টির প্রতি আগ্রহ তাঁকে আকৃষ্ট করে।
স্টিভ জানতেন, ব্যক্তিগত জীবনে স্থিতিশীলতা দরকার — কারণ তিনি সবসময় নতুন কিছু তৈরির মধ্যে মগ্ন থাকতেন। লরেন বুঝতেন, স্টিভ এমন একজন ব্যক্তি, যার জন্য কাজ ও স্বপ্নই প্রথম।
তাদের মধ্যে বোঝাপড়া এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হলো।
১৯৯১ সালের মার্চ মাসে, স্টিভ জবস ও লরেন পাওয়েল বিয়ে করেন। সাধারণ বা বড় কোনো অনুষ্ঠান নয়, বরং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরিবারের উপস্থিতিতে, শান্ত ও প্রীতি-পূর্ণ পরিবেশে।
স্টিভের জীবন তখন নতুন করে সাজানোর সময়।
Apple বা Pixar-এর সাফল্য থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল পরিবার ও ভালোবাসার জায়গা।তাদের সংসারে জন্ম নিল তিনটি সন্তান — রিড, ইভা ও এফ্রিম। পরিবারিক এই জীবন স্টিভকে স্থিতিশীলতা, আনন্দ এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিল।
তিনি তাঁর সন্তানদের চিঠি লিখতেন, যাতে তারা জানে— তাদের বাবা শুধু একজন উদ্যোক্তা ছিলেন না, একজন মানুষও ছিলেন, যে জীবনের অর্থ খুঁজছিল।তিনি বলেছিলেন, “আমার সন্তানদের আমি শুধু টাকা দিতে চাই না, বরং এমন একটি পৃথিবী দিতে চাই যেখানে তারা নিজেদের ভালোবাসার কাজ করতে পারবে।”
১️⃣ জীবনের ব্যস্ততা ও সাফল্যের মাঝেও ভালোবাসার জায়গা তৈরি করা সম্ভব।
২️⃣ ভালোবাসা মানে শুধু অনুভূতি নয়, বোঝাপড়া, সমর্থন ও সম্মান।
৩️⃣ স্থিতিশীল ব্যক্তিগত জীবন একজনকে সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী করে তোলে।
সময়টা ১৯৯৬ সাল। Apple তখন ভীষণ সংকটে।যে কোম্পানি একসময় প্রযুক্তি জগতের রাজা ছিল, এখন তা প্রায় দেউলিয়া। পণ্যের মান কমেছে, বাজারে প্রতিযোগীরা এগিয়ে গেছে, আর নতুন কোনো উদ্ভাবন নেই।
Apple-এর বোর্ড সদস্যরা তখন বুঝতে পারলেন —
“আমাদের এমন কাউকে দরকার, যিনি Apple-কে আবার বাঁচাতে পারবেন।” আর তখনই তারা মনে করল সেই মানুষটির কথা, যিনি একসময় তাদের কোম্পানিকে জন্ম দিয়েছিলেন, কিন্তু যাকে তারা একদিন কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছিল — স্টিভ জবস।
Apple তখন NeXT কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।এই NeXT-ই ছিল স্টিভ জবসের “দ্বিতীয় জীবন”-এর সৃষ্টি। কিন্তু NeXT কেনার আসল উদ্দেশ্য ছিল শুধু প্রযুক্তি নয় — স্টিভ জবসকে ফিরিয়ে আনা।
১৯৯৭ সালে তিনি Apple-এ ফিরে এলেন — যে জায়গা একদিন তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গায় এবার তিনি ফিরলেন নতুন আত্মবিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
যখন তিনি প্রথম Apple অফিসে ফিরলেন, তিনি নীরবে চারদিকে তাকালেন — পুরনো সেই কোম্পানি যেন আর আগের মতো নেই। কিন্তু তাঁর চোখে ছিল আগুনের মতো দৃঢ়তা। তিনি বললেন, “আমি ফিরে এসেছি Apple-কে আবার মহান করতে।”
ফিরেই তিনি পুরনো অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্টগুলো বাতিল করলেন। তিনি বললেন, “আমাদের ১০০টা মাঝারি মানের প্রোডাক্টের দরকার নেই, আমাদের দরকার ৪টা অসাধারণ প্রোডাক্ট।” এভাবেই শুরু হলো Apple-এর পুনর্জন্ম।
প্রথমে তিনি বাজারে আনলেন iMac, একটি সুন্দর, রঙিন, ব্যবহারবান্ধব কম্পিউটার। এটি Apple-কে নতুনভাবে উপস্থাপন করল — শুধু প্রযুক্তি নয়, স্টাইলও হতে পারে আকর্ষণের অংশ। মানুষ বলল, “Apple আবার ফিরে এসেছে।”
কিন্তু স্টিভ এখানেই থামলেন না। তিনি ভাবলেন, “কম্পিউটার যদি মানুষকে কাজে সাহায্য করতে পারে, তবে কি আনন্দেও পারে না?” সেই ভাবনা থেকেই ২০০১ সালে তৈরি করলেন iPod — একটি ছোট ডিভাইস, যেখানে হাজার হাজার গান রাখা যায়!তার স্লোগান ছিল — “১০০০ গান তোমার পকেটে।”
iPod ও iTunes মিলে সঙ্গীত জগতকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। মানুষ সঙ্গীত শুনতে, কিনতে ও ভাগাভাগি করতে শুরু করল এক নতুনভাবে। Apple আবার বিশ্বমঞ্চে শীর্ষে উঠে এল।
তবে স্টিভ জবসের মনের ভেতর তখনও একটা আগুন জ্বলছিল। তিনি চেয়েছিলেন এমন কিছু তৈরি করতে, যা প্রযুক্তির ইতিহাসে একেবারে নতুন অধ্যায় হবে।
২০০৪ সালের দিকে তিনি Apple-এর টিমকে বললেন, “আমরা এমন একটি যন্ত্র বানাবো, যেটা মানুষের হাতের এক্সটেনশন হয়ে যাবে। ফোন, কম্পিউটার, মিউজিক প্লেয়ার — সব একসঙ্গে।”
অনেকে ভেবেছিল, এটা অসম্ভব। তবুও তিনি থামলেন না। তিনি প্রতিটি ডিটেইল নিয়ে কাজ করলেন — কিভাবে বোতাম থাকবে, স্ক্রিনে টাচ কেমন হবে, শব্দ কেমন শোনা যাবে।
তিন বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর, ২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি, সান ফ্রান্সিসকোর এক মঞ্চে তিনি দাঁড়ালেন। মঞ্চের আলোয় তিনি বললেন, “আজ আমি তিনটি নতুন প্রোডাক্ট ঘোষণা করছি —
একটি হলো ওয়াইডস্ক্রিন iPod, একটি হলো বিপ্লবী ফোন, আর একটি হলো ইন্টারনেট কমিউনিকেটর।
কিন্তু এরা তিনটি আলাদা জিনিস নয় — তারা একটাই ডিভাইস।”
তারপর তিনি হাসলেন এবং বললেন — “আমরা একে বলছি — iPhone।” মুহূর্তেই হলভর্তি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা জানত — ইতিহাস তৈরি হলো।
iPhone শুধু একটি পণ্য নয়, এটি ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। মানুষের জীবন, যোগাযোগ, ব্যবসা, শিক্ষা — সব কিছু বদলে গেল এক যন্ত্রের স্পর্শে। Apple এখন শুধু একটি কোম্পানি নয়, এটি হয়ে গেল এক বিপ্লবের প্রতীক।
স্টিভ জবস প্রমাণ করলেন, “যদি তুমি ভবিষ্যৎকে কল্পনা করতে পারো, তবে তুমি সেটি সৃষ্টি করতেও পারবে।”
পরবর্তীতে স্টিভ জবস বলেছিলেন, “জীবনের বিন্দুগুলো সামনে তাকিয়ে মেলানো যায় না, কেবল পেছনে তাকালে বোঝা যায়— প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি ব্যর্থতা আমাকে এখানে এনেছে।”
তিনি দেখিয়ে দিলেন — যে মানুষ নিজের ভালোবাসা ও বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাকে কখনো হারানো যায় না।
১. ফিরে আসা সম্ভব — যদি তুমি নিজেকে বিশ্বাস করো।
২. দৃষ্টিভঙ্গিই সাফল্যের চাবি।
৩. উদ্ভাবন মানে শুধু নতুন কিছু বানানো নয়, বরং পুরনো জিনিসকে নতুনভাবে দেখা।
৪. যে নিজের কাজকে ভালোবাসে, সে ইতিহাস তৈরি করে।
সময়টা ২০০৩ সাল। স্টিভ জবস তখন জীবনের শীর্ষে — Apple আবার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তি কোম্পানি, iPod, iPhone, iPad — সবকিছুই তাঁকে আধুনিক যুগের প্রতীক বানিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু ঠিক তখনই জীবনের অপ্রত্যাশিত একটি খবর এলো। ডাক্তাররা তাঁকে জানালেন, তাঁর প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার (Pancreatic Cancer) হয়েছে। এই খবর শোনার পর স্টিভ কিছু সময় নীরবে বসে রইলেন। তিনি বলেছিলেন,“জীবনে এত পরিকল্পনা করেছি, অথচ মৃত্যু আমাকে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ডাকছে।”
প্রথমে তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, তাঁর সময় হয়তো সীমিত। তবে তিনি হতাশ হননি। বরং শুরু করলেন লড়াই — চিকিৎসা, ধ্যান, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন — সবকিছু চেষ্টা করলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি নিজের ভেতরেও এক গভীর পরিবর্তন অনুভব করলেন।
স্টিভ একবার বলেছিলেন, “যখন তুমি জানবে তোমার সময় সীমিত, তখন তুমি জীবনের সত্যিকারের মূল্য বুঝবে।” তিনি বুঝলেন, টাকা, খ্যাতি বা প্রযুক্তি—সবকিছুই শেষ পর্যন্ত তুচ্ছ। যা আসল, তা হলো ভালোবাসা, সৃষ্টিশীলতা, আর সময়ের সঠিক ব্যবহার।
২০০৫ সালে, তিনি আমন্ত্রিত হন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।
তাঁর সেই বক্তৃতা পরবর্তীতে ইতিহাস হয়ে যায়।
তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— “তোমরা যা ভালোবাসো, তা খুঁজে বের করো। আর যদি এখনো না পাও, খুঁজতে থাকো, থেমো না। হৃদয়ের কথা শুনো — কারণ সেটিই জানে তুমি সত্যিই কী হতে চাও।”
তিনি নিজের জীবনের তিনটি গল্প শেয়ার করেন —
১️⃣ বিন্দুগুলো মেলানো (Connecting the dots),
২️⃣ ভালোবাসা ও হারানো (Love and loss),
৩️⃣ মৃত্যু সম্পর্কে উপলব্ধি (Death).
আর শেষে বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তিটি— “Stay Hungry, Stay Foolish.”
(ক্ষুধার্ত থেকো, কৌতূহলী থেকো।) এটাই ছিল তাঁর জীবনদর্শনের সারসংক্ষেপ — সব সময় নতুন কিছু জানতে চাও, নতুনভাবে ভাবো, আর কখনো আত্মতুষ্ট হয়ো না।
২০১১ সালের দিকে তাঁর শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তবুও তিনি অফিসে যেতেন যতদিন পারতেন। তিনি বলতেন, “যে দিন আমি কাজ করতে পারব না, সেই দিনই আমি সত্যি মারা যাব।”
শেষ দিকে তিনি নিজের ঘরে, পরিবার ও নিকটজনদের মাঝে ছিলেন। তাঁর চোখে তখনও সেই শান্তি ছিল — যেন সব বুঝে গেছেন। যেন তিনি মৃত্যুর ওপারে আরেকটি নতুন বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছিলেন।
২০১১ সালের ৫ অক্টোবর, স্টিভ জবস পৃথিবীকে বিদায় জানালেন। তিনি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এমন এক উত্তরাধিকার যা পৃথিবীর প্রতিটি হাতে স্পর্শযোগ্য — একটি Apple কোম্পানি, একটি iPhone, একটি MacBook, একটি ভাবনা, একটি স্বপ্ন।
আজও তাঁর সৃষ্টি, তাঁর দর্শন, তাঁর চিন্তাধারা আমাদের শেখায়— “তুমি যদি পৃথিবী বদলাতে চাও, তবে শুরু করো নিজের ভেতর থেকে।”
১️⃣ জীবনের সময় সীমিত — তাই অন্যের মতো বেঁচো না।
২️⃣ ভালোবাসা ও কাজ — এই দুটোই জীবনের অর্থ।
৩️⃣ ব্যর্থতা, মৃত্যু, বেদনা — সবই জীবনের শিক্ষক।
৪️⃣ যা করছো, তা যেন তোমার হৃদয়ের কাজ হয়।
শেষ পর্যন্ত, স্টিভ জবস প্রমাণ করে গেছেন —
একজন মানুষ চলে গেলেও, তাঁর চিন্তা চিরকাল বেঁচে থাকে।
“The people who are crazy enough to think they can change the world,
are the ones who do.”
একসময় ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট এক শহরে জন্ম নিল এক ছেলেশিশু। সে জানত না, একদিন সে পুরো পৃথিবীর প্রযুক্তি বদলে দেবে।শিশুটির নাম — স্টিভ জবস।
ছোটবেলায় স্টিভ ছিল অদ্ভুতরকম কৌতূহলী।
খেলনা ভেঙে ভিতরের অংশ দেখতে চাইত,
পুরনো রেডিও খুলে আবার জোড়া লাগাত।একদিন তাঁর বাবা রেগে গিয়ে বললেন,
“তুমি সব ভেঙে ফেলো কেন?”
স্টিভ শান্তভাবে উত্তর দিল,“আমি বুঝতে চাই, জিনিসগুলো কাজ করে কীভাবে।” এই ছোট্ট কৌতূহলই একদিন তাকে “Apple” নামের এক কোম্পানি বানাতে সাহায্য করবে— যা বিশ্বকে শেখাবে, প্রযুক্তিও হতে পারে সুন্দর। জীবনে যা কিছু জানো না, সেটিই তোমাকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে— যদি তুমি জানতে চাও।
যৌবনে সে তার বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে গ্যারেজে বসে তৈরি করল প্রথম কম্পিউটার।
সেই গ্যারেজ থেকেই জন্ম নিল Apple।
Apple দ্রুত জনপ্রিয় হলো। কিন্তু সাফল্যের মাঝেই একদিন কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে স্টিভকে জানানো হলো — “তোমার আর প্রয়োজন নেই।”
নিজের তৈরি কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যেতে হলো।
তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০। তাঁর মনে হলো, জীবন শেষ। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি ভাবলেন, “আমি হয়তো Apple হারিয়েছি, কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন হারাইনি।”
সেই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নিল Pixar আর NeXT —
দুটোই একদিন তাঁর ভাগ্য ঘুরিয়ে দেবে। যা তোমাকে ভেঙে দেয়, সেটিই তোমাকে গড়তে পারে — যদি তুমি হাল না ছাড়ো।
Pixar-এ কাজ শুরু করলেন তিনি।
তখন সবাই বলত, “কম্পিউটার অ্যানিমেশন দিয়ে সিনেমা বানানো অসম্ভব।” কিন্তু স্টিভ হাসতেন।
তিনি বলতেন, “অসম্ভব মানে, এখনো কেউ চেষ্টা করেনি।”
বছরের পর বছর চেষ্টা করে তৈরি হলো Toy Story — বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার অ্যানিমেটেড সিনেমা। এটি শুধু সিনেমা নয়, ইতিহাস।
মানুষ যা বিশ্বাস করে না, সেটাই একদিন তাদের বিস্মিত করে। কয়েক বছর পর Apple দেউলিয়া হওয়ার পথে। তখন তারা সেই মানুষটির দ্বারস্থ হলো, যাকে একসময় তারা বের করে দিয়েছিল। স্টিভ ফিরে এলেন Apple-এ — অভিমান নিয়ে নয়, ভালোবাসা নিয়ে।
তিনি বললেন, “আমি প্রতিশোধ নিতে নয়, স্বপ্ন বাঁচাতে ফিরেছি।” ফিরে এসে তিনি তৈরি করলেন iMac, iPod, iPhone — যা শুধু Apple নয়, পুরো পৃথিবীর জীবনধারা বদলে দিল।
সত্যিকারের ভালোবাসা প্রতিশোধ নয়, পুনর্জন্মের শক্তি দেয়। জীবনের শেষদিকে স্টিভ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। ডাক্তাররা বললেন, সময় কম।
তিনি শান্তভাবে বললেন, “যখন তুমি জানবে তুমি মরবে, তখনই তুমি শিখবে কীভাবে বাঁচতে হয়।”
তিনি তখনও কাজ করতেন, ভাবতেন, স্বপ্ন দেখতেন।মৃত্যুর মুখেও তাঁর চোখে ছিল শান্ত আলো।শেষ কথা ছিল,“Oh wow… Oh wow… Oh wow…” জীবন ক্ষণিক, তাই প্রতিটি মুহূর্তে ভালোবাসা দাও, অর্থ নয়।
স্টিভ জবস আমাদের শিখিয়ে গেছেন—
১️⃣ কৌতূহলকে ভয় পেয়ো না।
২️⃣ ভালোবাসা দিয়ে কাজ করো, টাকা দিয়ে নয়।
৩️⃣ ব্যর্থতা আসবে, কিন্তু তুমি থামবে না।
৪️⃣ নিজেকে বদলাতে পারলে, পৃথিবীও বদলাবে।
৫️⃣ জীবন ছোট — তাই নিজের পথে চলো, অন্যের নয়।
শেষ পর্যন্ত, তাঁর জীবনের গল্প আমাদের শেখায় — “তুমি যদি পৃথিবী বদলাতে চাও, তবে শুরু করো নিজের ভেতরের মানুষটিকে বদলানো দিয়ে।”