অন্ধকার ল্যাবে হঠাৎ আলো:এক্স–রে আবিষ্কারের কাহিনি

09 Oct 2025 08:01:15 AM

 ল্যাবে হঠাৎ আলো:এক্স–রে আবিষ্কারের কাহিনি

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

 

১৮৯৫ সালের এক শীতল নভেম্বর রাত। বাইরে কুয়াশায় ঢেকে গেছে উইর্‌ৎসবুর্গ শহর। সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণে এখনো জ্বলছে ক্ষীণ এক আলো।জার্মানির উইর্‌ৎসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণায়, একা এক বিজ্ঞানী মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছেন। নাম তাঁর ভিলহেল্ম কনরাড রন্টগেন। চারদিকে ঘন অন্ধকার, শুধু টেবিলের ওপর কয়েকটি যন্ত্রপাতি—ক্যাথোড রশ্মি নল, পর্দা, কিছু তার, ও একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র। রন্টগেন আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্যাথোড রশ্মির অনুসন্ধানে ব্যস্ত।

রন্টগেন তখন ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন—এমন এক রশ্মি, যা নলের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালালে সৃষ্টি হয়।তিনি চেয়েছিলেন জানতে, এই রশ্মি কাচের দেয়াল ভেদ করে বাইরে বেরোয় কি না। তাই তিনি নলটিকে কালো কাপড়ে ঢেকে দিলেন, যাতে আলো বাইরে না বের হয়। ল্যাবের আলো নিভিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১১টা পেরিয়েছে।তিনি নিভিয়ে দিলেন ল্যাবের আলো, যেন বাইরের কোনো আলো পরীক্ষায় বাধা না দেয়। ঘর এখন একেবারে অন্ধকার। শুধু তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ, আর যন্ত্রের মৃদু গুঞ্জন।

তিনি সুইচ টিপলেন— “টিক!”এক মুহূর্তেই নল থেকে ঝলকে উঠল এক ফিকে আলো। হঠাৎ—ঘরের এক কোণে রাখা ফটোগ্রাফিক পর্দা নিজে থেকেই জ্বলে উঠল!রন্টগেন হতবাক।“এটা কীভাবে সম্ভব? আলো তো কাপড়ে ঢাকা! বাইরে আসবে কী করে?”

রন্টগেন থমকে গেলেন। তিনি ভাবলেন, হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। কিন্তু যতই পরীক্ষা চালালেন, পর্দাটি ততবারই জ্বলে উঠল—যখনই তিনি সেই রশ্মিযুক্ত নলটি চালু করলেন। আশ্চর্যের বিষয়, আলোটা নলের দিক থেকেই আসছে, অথচ মাঝখানে রয়েছে কাচ, কাঠ, এমনকি পুরু বই—কিছুই তাকে বাধা দিতে পারছে না!

এই আলোটা কী?” রন্টগেন নিজের কাছে বললেন।
তিনি যতই পরীক্ষা করলেন, এই আলো আচরণ করল অপরিচিতভাবে। এটি কোনো পরিচিত আলো বা রশ্মির মতো নয়।

রন্টগেন ভাবলেন—যে রশ্মি এত রহস্যময়, যা কিছু ভেদ করতে পারে, কিছু পারে না—এটি কি এক পরিচিত রশ্মি? না। তিনি এটি কোনো পূর্বের নামের সাথে মিলিয়ে দিতে পারলেন না।

অতএব, তিনি নাম রাখলেন “এক্স–রে”।এক্স মানে অজানা, রশ্মি মানে রশ্মি। তিনি লিখলেন:“আমি এই রশ্মিটিকে জানি না, তাই এর নাম দিলাম এক্স–রে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উদ্ঘাটন করবেন।”

এরপর তিনি একে একে বিভিন্ন জিনিস এই রশ্মির সামনে রাখলেন—কাঠ, কাগজ, ধাতু—দেখলেন, কিছু পদার্থ ভেদ করে এই রশ্মি সহজেই যেতে পারে, কিছু পারে না। 

প্রফেসর ভিলহেল্ম কনরাড রন্টগেন ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর পরীক্ষার দিকে। তখন ডিসেম্বর ১৯৮৫। কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি এক রহস্যময় রশ্মির খোঁজে দিন-রাত এক করে কাজ করছেন। যে রশ্মি কাচ ভেদ করতে পারে, কাঠের মধ্য দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অদৃশ্য—চোখে দেখা যায় না।

আজ তিনি নতুন কিছু পরীক্ষা করতে চান। তাঁর স্ত্রী বের্থা রন্টগেন পাশে দাঁড়িয়ে, কৌতূহলী চোখে দেখছেন।বের্থা হাসলেন, “তুমি তো কয়েকদিন ধরে এই অদ্ভুত আলো নিয়ে ব্যস্ত আছো, এবার কী করতে যাচ্ছো?” রন্টগেন শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আজ আমি জানতে চাই, এই রশ্মি জীবন্ত শরীরের ভেতর পর্যন্ত যেতে পারে কি না।” এ জন্য তোমার সাহায্য লাগবে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? 

বের্থা একটু ভয় পেলেন, কিন্তু স্বামীর চোখে যে উজ্জ্বলতা, তাতে ভয়টা মিলিয়ে গেল।তিনি চুপচাপ তাঁর হাত রন্টগেনের সামনে রাখলেন—আঙুলে ঝুলছে বিয়ের আংটি।রন্টগেন একটি ফটোগ্রাফিক প্লেট পর্দার পেছনে রাখলেন, সামনে চালু করলেন সেই রহস্যময় নল। ল্যাবের আলো নিভে গেল।
পুরো ঘর অন্ধকার, শুধু মৃদু নীলচে আলো ঝলকাচ্ছে।

কয়েক মিনিট কেটে গেল। বাতাসে শোনা যাচ্ছে কেবল মেশিনের হালকা গুঞ্জন।শেষমেশ, রন্টগেন যন্ত্র বন্ধ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটটি আলতো করে তুললেন। ধীরে ধীরে তা ডেভেলপ করলেন পানির মধ্যে।এবং—এক মুহূর্তে তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেল।প্লেটের ওপর ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত চিত্র—বের্থার হাতের হাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!
আর মাঝখানে এক গাঢ় বৃত্ত—বিয়ের আংটি।

রন্টগেনের চোখে বিস্ময়ের ছায়া, ঠোঁটে নিঃশব্দ আশ্চর্য।“বের্থা, দেখো... এটা তোমার হাতের ভেতর!”বের্থা ছবিটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ধীরে বললেন,“আমি যেন আমার নিজের কঙ্কাল দেখছি...”

সেই মুহূর্তে রন্টগেন বুঝলেন—তিনি এমন এক আবিষ্কার করেছেন, যা মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমা ভেঙে দেবে। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা এটাই সেই মুহূর্ত, যা বদলে দেবে পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস।

১৮৯৬ সালের জানুয়ারি।জার্মানির এক ছোট শহর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত খবর—“এক বিজ্ঞানী অন্ধকারে এমন আলো আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে মানুষের শরীরের ভেতর দেখা যায়!”

মানুষ প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারল না। “দেহের ভেতর দেখা যায়? সেটা আবার কেমন?”—এমন প্রশ্নে সংবাদপত্র ভরে গেল। তবে যখন রন্টগেনের স্ত্রীর হাতের সেই ছবিটি ছাপা হলো—সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল।

ছবিতে দেখা গেল এক নারীর হাতের হাড়, আর আঙুলে ঝুলছে আংটি।মানুষ তাকিয়ে রইল—এ কি জাদু, না বাস্তব?রন্টগেন তখনও তাঁর ল্যাবের ঘরে নীরবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি জানতেন, এখন পৃথিবী নতুন এক যুগে প্রবেশ করছে।

ইউরোপের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন শুরু হলো। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করতে লাগলেন রন্টগেনের পরীক্ষাটি পুনরায় করতে। তারা সফল হলেন, এবং সবাই অবাক হয়ে দেখলেন—এই রশ্মি সত্যিই পদার্থ ভেদ করে যেতে পারে, আর ফটোগ্রাফিক প্লেটে তার ছায়া রেখে যায়।

চিকিৎসা জগৎ যেন নতুন প্রাণ পেল।হাড় ভাঙা রোগীর শরীর কাটার আগেই দেখা সম্ভব হলো কোথায় ভাঙন। গুলিবিদ্ধ সৈনিকের শরীরে গুলি কোথায় আছে—তা বের করা গেল সহজে।

মানুষ তখন একে “জাদুর আলো” বলত। কেউ ভয় পেত, ভাবত, এই আলো দিয়ে কি কেউ মানুষের গোপন চিন্তাও দেখতে পারবে? কেউ আবার রন্টগেনকে “দৃষ্টির জাদুকর” বলে ডাকতে শুরু করল।রন্টগেন শান্তভাবে বলেছিলেন—“আমি কোনো জাদু করিনি। আমি শুধু প্রকৃতির এক রহস্যকে খুঁজে পেয়েছি।”

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি এশিয়াতেও এক্স–রে প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালগুলোতে এক্স–রে মেশিন বসানো শুরু হলো। চিকিৎসাবিজ্ঞানে শুরু হলো এক নতুন যুগ—নির্ণয়ের যুগ।

রন্টগেন কখনো তাঁর আবিষ্কারের জন্য পেটেন্ট নেননি। তিনি বলেছিলেন,“বিজ্ঞানের জগতে কোনো আবিষ্কারই ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; এটি মানবজাতির জন্য।”

১৯০১ সালে, আবিষ্কারের ছয় বছর পর, রন্টগেন পেলেন ইতিহাসের প্রথম নোবেল পুরস্কার (পদার্থবিজ্ঞান)।কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন—“এই পুরস্কার শুধু আমার নয়; এটি সেই অজানার জন্য, যা মানুষকে জানতে আহ্বান জানায়।”

আজও হাসপাতালের প্রতিটি এক্স–রে রুমে যখন সেই মৃদু নীলচে আলো জ্বলে ওঠে, তখন যেন শোনা যায় রন্টগেনের সেই রাতের ফিসফিসানি—“জ্ঞান শুধু চোখে দেখা নয়, আলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে অদেখা পৃথিবী।”

এক অন্ধকার ল্যাব থেকে জন্ম নেওয়া সেই আলো আজ ছুঁয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের জীবন।
অজানাকে জানার যে আকাঙ্ক্ষা এক বিজ্ঞানীর হৃদয়ে জ্বলে উঠেছিল, তা আজও বিজ্ঞানের প্রতিটি নতুন আবিষ্কারে জ্বলে ওঠে— অন্ধকারের ভেতর থেকে আলোর পথে।