গরিবের সন্তান থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট: আব্রাহাম লিংকনের উত্থান

20 Oct 2025 08:09:33 PM

গরিবের সন্তান থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট: আব্রাহাম লিংকনের উত্থান

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

 

১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, কেন্টাকি রাজ্যের একটি ছোট কাঠের কুঁড়েঘরে জন্ম নেন আব্রাহাম লিংকন। তার পরিবার ছিল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বাবা থমাস লিংকন কাঠুরে ছিলেন, আর মা ন্যান্সি হ্যানকক লিংকন ঘরে কাজ করতেন। ঘরের ভেতর ছিল খুব সামান্য আসবাবপত্র, বই প্রায় নেই, আর খাবার প্রায়ই অভাবের মধ্যে।

ছোট আব্রাহাম ছিলেন চতুর, কৌতূহলী ও গভীর চিন্তাবিদ। মাত্র কয়েকটি গ্রামের বই, পত্রিকা ও যেগুলো তার কাছে পৌঁছেছে, সেগুলোই তার জ্ঞানার্জনের মূল মাধ্যম। নিজে নিজে লেখাপড়া শিখতে শুরু করলেন। কখনও কখনও রাতের আঁধারে মোমবাতির আলোতে বসে বই পড়তেন, যখন অন্য সবাই ঘুমোত।

ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ন্যায়বোধ ও মানবতার প্রতি অনুভূতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গ্রামের খেলাধুলা ও মেলায় দেখা অন্য শিশুদের সঙ্গে তার স্বভাবগত তর্কবিতর্কের ক্ষমতা তাকে আলাদা করত। তিনি অন্যদের সমস্যা বুঝতেন এবং সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করতেন।

শারীরিক পরিশ্রমও তার জীবনের অংশ ছিল। সকালে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন, কাঠ কাটতেন, পশুদের দেখভাল করতেন। এই কঠোর পরিশ্রম তাকে ধৈর্য্য, সহনশীলতা এবং শক্তিশালী মনোবল শেখায়।

তার শৈশবের এই কঠোরতা, দারিদ্র্য, সীমিত সুযোগ এবং স্বল্প শিক্ষার মধ্যেও আব্রাহাম লিংকন ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে এক অদম্য আত্মবিশ্বাস ও ন্যায়বোধ তৈরি করতে লাগলেন, যা পরবর্তীতে তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথে চালিত করবে।

১৮১৬ সাল। লিংকনের বয়স তখন মাত্র ৭ বছর। বাবা থমাস লিংকন পরিবারসহ ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের জঙ্গলে নতুন এক জায়গায় বসতি গড়েন। আশেপাশে কোনো ভালো স্কুল নেই, নেই কোনো বইয়ের দোকান। ছোট্ট কাঠের ঘরে, গরিব কৃষকের সন্তান হিসেবে লিংকনের জীবনে শুরু হয় শিক্ষা—সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়।

লিংকনের প্রথম স্কুল ছিল এক কাঠের ঘর, যার দেয়াল ছিল কাদা আর গাছের ডাল দিয়ে বানানো। শিক্ষক ছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি, যিনি নিজেও খুব বেশি পড়াশোনা জানতেন না। লিংকন পরে স্মরণ করে বলেছিলেন,“আমি মোটে এক বছরের মতো স্কুলে যেতে পেরেছিলাম, তাও মাঝে মাঝে।”

কিন্তু স্কুলে না গেলেও তার জানার আগ্রহ ছিল তীব্র। তিনি গরিবের সন্তান ছিলেন, কিন্তু জিজ্ঞাসা ছিল রাজাদের মতো বড়।

লিংকনের বাড়িতে তখন কোনো বই ছিল না, শুধু একটি বাইবেল।তিনি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বই ধার করে পড়তেন।


যেসব বই তার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছিল, তার মধ্যে ছিল—

  • The Bible

  • Aesop’s Fables (ঈসপের গল্প)

  • The Pilgrim’s Progress — জন বানিয়ানের বিখ্যাত ধর্মীয় উপন্যাস

  • Robinson Crusoe — সাহসী অভিযাত্রীর কাহিনি

  • Life of George Washington — আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টের জীবন

তিনি কাঠের আলোর নিচে বসে রাতে বই পড়তেন, আর সকাল হলে গরুর গাড়ি চালাতে যেতেন বাবাকে সাহায্য করতে।তার বই ছিল অল্প, কিন্তু তিনি পড়তেন গভীর মনোযোগে।


একবার তিনি এক প্রতিবেশীর বই ধার নিয়েছিলেন, দুর্ঘটনাক্রমে সেই বই বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়।
তখন লিংকন নিজের পরিশ্রম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করেন—তিন দিন মাঠে কাজ করে বইয়ের দাম পরিশোধ করেন।এই ছোট্ট ঘটনাই তার সততা ও অধ্যবসায়ের প্রমাণ হয়ে ওঠে।

এই সময় লিংকন নিজের হাতে লেখার চর্চা শুরু করেন। তিনি মাটিতে, কাঠের টুকরোতে, এমনকি কয়লার ছাইয়েও লিখতেন।স্কুলে শিক্ষকরা তাকে বলতেন,“এই ছেলেটা বড় কিছু করবে একদিন।”

যখন অন্য ছেলেরা খেলাধুলায় ব্যস্ত, লিংকন তখন নিজের খাতায় নতুন শব্দ শেখেন, আইন ও রাজনীতি বিষয়ে বই পড়েন। তখন থেকেই তার ভেতরে জন্ম নেয় বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস।তিনি বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প বলতেন, মানুষকে হাসাতেন, ভাবাতে পারতেন।

গ্রামের লোকেরা প্রায়ই আব্রাহামের তর্কবিতর্ক এবং জ্ঞানার্জনের আগ্রহ দেখে অবাক হতেন। ছোট ছোট বিতর্কে সে প্রায়ই বড়দের যুক্তি চ্যালেঞ্জ করত, কিন্তু সবসময় ভদ্র এবং বিনয়ীভাবে। এই ছোট মুহূর্তগুলো তার নীতিশাস্ত্র ও ন্যায়বোধের মূল ভিত্তি গড়ে তোলে।

একদিন, গ্রামের এক বিতর্ক সভায় আব্রাহাম প্রশ্ন করল, “মানুষ কি তার অধিকার রক্ষা করতে পারবে যদি সে জানে না তার অধিকার কোথায়?”—এই প্রশ্নে সবাই স্তম্ভিত। সে তখন বুঝতে পারল, জ্ঞান এবং ন্যায়বোধ একসাথে থাকলে মানুষ সত্যিই পরিবর্তন আনতে পারে।

১৮২৮ সালে, মাত্র ১৯ বছর বয়সে, লিংকন প্রথমবার মিসিসিপি নদী পাড়ি দেন নৌকায় করে — এক কাঠের নৌকা চালিয়ে পণ্য বিক্রি করতে যান।
এই যাত্রাই তার জীবনের বাস্তব শিক্ষা দেয় — তিনি দেখেন সমাজে ধনী-গরিবের বিভাজন, অন্যায়ের শিকড়, দাসপ্রথার অমানবিক চিত্র।এই অভিজ্ঞতাই পরে তার চিন্তা ও নেতৃত্বে গভীর প্রভাব ফেলে।

১৮২৯ সালের দিকে, আব্রাহাম তার পরিবারকে সাহায্য করতে আরও মাঠে কাজ করতে শুরু করে। কাঠ কাটা, গবাদিপশুর দেখভাল, নদীতে মাছ ধরা—সবই তার দৈনন্দিন কাজের অংশ। তবে প্রতিটি কাজের মাঝেও তিনি নিজের শিক্ষাকে থামাতেন না। কখনও কখনও রাতে মাটির ফাঁক ধরে মোমবাতির আলোতে বই পড়তেন।


জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি বই, প্রতিটি পরিশ্রমই তাকে গড়ে তুলেছিল আমেরিকার ইতিহাসের এক মহান নেতা হিসেবে। “I will study and get ready, and perhaps my chance will come.” — আব্রাহাম লিংকন

১৮৩১ সাল।বয়স তখন ২২ বছর। গরিব কৃষকের সন্তান আব্রাহাম লিংকন এবার নিজের ভাগ্য গড়তে ঘর ছাড়লেন। হাতে সামান্য কাপড়, মনভরা স্বপ্ন, আর মাথায় একটাই চিন্তা— “আমি বড় কিছু করব, নিজের পরিশ্রমেই।”

লিংকন কাজের খোঁজে Illinois (ইলিনয়) রাজ্যের New Salem গ্রামে এলেন।এখানেই শুরু হয় জীবনের মোড় ঘোরানো অধ্যায়।তিনি এখানে দোকানের চাকরি করেন, পরে ডাকঘরের কর্মচারী হন, এমনকি কাঠ কাটা আর হিসাবরক্ষকের কাজও করেন। কিন্তু তার আসল ভালো লাগা ছিল পড়াশোনা আর মানুষকে বোঝা।

গ্রামের মানুষ লক্ষ্য করত, লম্বা, গম্ভীর এই যুবকটা রাতে একা বসে বই পড়ছে— গণিত, আইন, ইতিহাস, ও বক্তৃতার বই।তখনো তার কোনো শিক্ষক নেই—  নিজের শিক্ষক নিজেই।

এক সন্ধ্যায়, গ্রামের একটি বড় জমায়েতের সময় তিনি বলেছিলেন, "যে ব্যক্তি শুধু নিজের জন্য চিন্তা করে, সে কখনও সত্যিকারের নেতা হতে পারবে না। আমাদের উচিত দেশের মানুষের জন্য দাঁড়ানো।"
এই সংলাপটি তখনকার উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে এবং আব্রাহামের মনোবল আরও দৃঢ় করে।

১৮৩২ সালে, আব্রাহাম লিংকনের বয়স তখন মাত্র ২৩।  তিনি Black Hawk War-এ অংশ নেন (একটি স্থানীয় যুদ্ধ), কিন্তু যুদ্ধ শেষে ফিরে আসেন নিঃস্ব অবস্থায়।একই বছর তিনি স্থানীয় নির্বাচনে দাঁড়ান—প্রথমবারের মতো রাজনীতিতে পা রাখেন। ফলাফল? সম্পূর্ণ পরাজয়।
তবে জনগণের কাছে তার সততা ও সাহস সবার নজর কাড়ে।

লিংকন হাল ছাড়েননি। তিনি বুঝে ফেলেছিলেন—
“বিজয় নয়, শিক্ষা বড় জিনিস।” পরাজয়ের পরের দুই বছর তিনি গ্রামের মানুষের চিঠি লেখায় সাহায্য করেন, হিসাব শেখেন, এবং নিজের আইন পড়া শুরু করেন।

১৮৩৪ সালে, বয়স ২৫, লিংকন দ্বিতীয়বার নির্বাচনে দাঁড়ান—  এইবার Illinois রাজ্যের আইনসভায় (State Legislature)। এবার তিনি জয়ী হন!
এটাই তার জীবনের প্রথম বড় সাফল্য।সেই দিনটি ছিল তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

একই সময়ে তিনি আইন বিষয়ে গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তখন কোনো ল’ কলেজে ভর্তি হননি—
নিজে নিজেই বই পড়ে আইন শেখা শুরু করেন।
তার প্রিয় বই ছিল William Blackstone-এর “Commentaries on the Laws of England” — ইংরেজি আইনের মূল ভিত্তি।

তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়ে নোট বানাতেন, প্রতিটি বিষয় মুখস্থ করতেন।বন্ধুরা বলত,“লিংকন পড়ার সময় খায় না, ঘুমায় না, শুধু বইয়ের পাতায় হারিয়ে যায়।”

গ্রামের সেই সহজ জীবন থেকে, যেখানে রাতের আলোতে বই পড়া ছিল একমাত্র আশ্রয়, লিংকন ধীরে ধীরে দেশের মানুষের জন্য কাজ করার দায়িত্বে প্রবেশ করলেন।

এ সময় তিনি আইন শিখতে শুরু করেন। নিজে নিজে পাঠ করে, স্থানীয় আদালতের কোর্টে বসে মামলার রায় লক্ষ্য করতেন, আদালতের নথি পড়তেন এবং বিচারকদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করতেন। গ্রামীণ জীবন এবং স্বল্প শিক্ষার সীমাবদ্ধতা তাকে কখনো বাধা দেয়নি; বরং এটি তাকে আরও সতর্ক, গভীর চিন্তাশীল এবং বিচক্ষণ করে তুলেছে।

একবার একটি জমি সংক্রান্ত বিরোধের মামলা চলাকালে লিংকন প্রমাণ করেন যে, সাধারণ মানুষের আইনগত অধিকার অতি সহজভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে। তার যুক্তি, দৃঢ়তার সঙ্গে বক্তব্য এবং সততার কারণে, বিচারক এবং স্থানীয় মানুষরা অবাক হয়ে যান। সেই দিন থেকে লিংকনের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পায়।

১৮৩৬ সালে তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সরকারি অনুমতি পান আইনচর্চার। এভাবেই তিনি আব্রাহাম লিংকন, Esquire — একজন সরকারি স্বীকৃত আইনজীবী হয়ে ওঠেন।

১৮৩৭ সালে লিংকন Illinois-এর রাজধানী Springfield শহরে চলে আসেন।এখানে তিনি বিখ্যাত আইনজীবী John Stuart-এর সঙ্গে চেম্বার খুলে আইনচর্চা শুরু করেন। তিনি দরিদ্র মানুষের মামলা অল্প ফিতে বা বিনা টাকায় লড়তেন।তার সততা এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে শহরের মানুষ তাকে ডাকত “Honest Abe” — অর্থাৎ “সৎ আব্রাহাম।”

এই সময়ই তার জীবনে আসে এক নতুন অধ্যায় —
মেরি টড (Mary Todd) নামে এক বুদ্ধিমতী তরুণী, যিনি পরে তার স্ত্রী হন।তাদের পরিচয় হয় Springfield-এর এক বন্ধুর বাসায়। কিছু বছর প্রেম, দ্বিধা ও দূরত্বের পর ৪ নভেম্বর ১৮৪২ সালে লিংকন ও মেরি টড বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

এই সময় লিংকনের জীবন ছিল ভারসাম্যের এক মিশ্র ছবি— দিনে আদালত, রাতে বই আর বক্তৃতার চর্চা।তিনি বিশ্বাস করতেন,“শিক্ষা শুধু স্কুলে নয়, জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতায় লুকিয়ে থাকে।”

১৮৪৩ সাল। আব্রাহাম লিংকন তখন Springfield শহরের পরিচিত আইনজীবী।তার মামলার যুক্তি, সরল ভাষা, আর গভীর সততা মানুষকে মুগ্ধ করে।কিন্তু তার হৃদয়ে ছিল আরও বড় স্বপ্ন— নিজ দেশের অন্যায়, দাসপ্রথা ও বিভাজন দূর করা।

লিংকন রিপাবলিকান দল তখনো গঠিত হয়নি; সে সময় তিনি Whig Party-এর সদস্য ছিলেন।
তিনি ১৮৪৩ সালে কংগ্রেসের নির্বাচনে দাঁড়ালেও প্রথমে জয় পাননি।কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও জনসংযোগের পর ১৮৪৬ সালে নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হিসেবে (U.S. House of Representatives)।এটাই ছিল তার প্রথম জাতীয় পর্যায়ের পদ।

ওয়াশিংটনে যাওয়ার পর তিনি রাজনীতির বড় মঞ্চে পা রাখেন।সেখানে তিনি জনপ্রিয় হন তাঁর সৎ বক্তব্য, যুক্তি ও সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতার জন্য।

কংগ্রেসে লিংকন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেন। তখনও আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে দাসপ্রথা চালু ছিল। তিনি বলেন— “দাসত্ব কেবল এক জাতিকে নয়, পুরো মানবতাকে কলুষিত করে।”

তিনি মেক্সিকো যুদ্ধের বিরুদ্ধেও কথা বলেন, কারণ তিনি মনে করতেন—  এই যুদ্ধ অন্যায় ও লোভের ফল।  কিন্তু তার অবস্থান তখন জনপ্রিয় ছিল না;
অনেকেই তাকে সমালোচনা করে, তবুও তিনি সত্যের পথ ছাড়েননি।

১৮৪৯ সালে কংগ্রেসের মেয়াদ শেষ হলে তিনি রাজনীতি থেকে কিছু সময় দূরে সরে যান।
কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন — “কাজের আগে যোগ্যতা অর্জন দরকার।”

এই সময়ে লিংকন আবার আইনচর্চায় ফিরে আসেন।তিনি Springfield-এ বিখ্যাত আইনজীবী হয়ে ওঠেন। তার সততা এমনই ছিল যে অনেকেই বলত— “যদি তোমার সত্যিকারের বিচার চাও, লিংকনকে নাও।”

কিন্তু চারদিকে তখন এক অস্থির সময়— দাসপ্রথা, রাজ্য বিভাজন, আর মানবাধিকারের প্রশ্নে আমেরিকা জ্বলছে।

১৮৫৪ সালে মার্কিন কংগ্রেস Kansas-Nebraska Act পাশ করে,যার ফলে নতুন রাজ্যগুলোতে দাসপ্রথা চালু করার অধিকার দেওয়া হয়।
এই আইন লিংকনের অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়।

তিনি আবার রাজনীতিতে ফিরে আসেন—
এইবার নিজের বিশ্বাস নিয়ে, নিজের দলের আহ্বানে।তিনি বলেন,“এক দেশ একই সঙ্গে অর্ধেক দাস আর অর্ধেক মুক্ত থাকতে পারে না।”

এই সময় তিনি যুক্ত হন নতুন গঠিত Republican Party-তে ১৮৫৪ সালে। রেপাবলিকান পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার স্বপ্ন সামনে রেখে কাজ শুরু করেন।

এটাই ছিল আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কিংবদন্তি অধ্যায়। ১৮৫৮ সালে ইলিনয়ের সিনেট নির্বাচনে লিংকনের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন Stephen A. Douglas।

ডগলাসের সঙ্গে ৭টি জনসভায় বিতর্কের মাধ্যমে তিনি দেশের জনগণের সামনে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, ন্যায়বোধ এবং নেতৃত্বের প্রতিভা প্রমাণ করেন। লিংকনের বক্তৃতা ছিল যুক্তি, ন্যায়, ও মানবতার আলোকিত ভাষা। তিনি বলেন— “A house divided against itself cannot stand.” অর্থাৎ — “একটি বিভক্ত ঘর টিকে থাকতে পারে না।”

যদিও সে নির্বাচনে তিনি জয় পাননি, তবে দেশবাসীর মধ্যে তার সুনাম আর আস্থা বৃদ্ধি পায়। এই সময়ই তাকে বোঝায়—ব্যক্তিগত ব্যর্থতা কখনো চূড়ান্ত ব্যর্থতা নয়; সংগ্রামই জীবনের মূল।এই সময়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে পরিচিত হতে শুরু করেন। বিভিন্ন পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, বিতর্ক ও নির্বাচনী প্রচারণা—সবই তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।

১৮৬০ সালে রিপাবলিকান পার্টি তাকে মনোনয়ন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে।
অন্য প্রার্থীরা ছিলেন ধনী, শিক্ষিত ও অভিজাত বংশের, কিন্তু লিংকন ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ—গ্রামের ছেলে, কাঠুরে, আত্মশিক্ষিত আইনজীবী।তার প্রচারণার মূল কথা ছিল— “সবার জন্য স্বাধীনতা, সবার জন্য সমান অধিকার।”

৮ নভেম্বর ১৮৬০ সালে, আব্রাহাম লিংকন নির্বাচনে জয়ী হন — আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট।
এক কাঠের ঘরে জন্ম নেওয়া ছেলেটি পৌঁছাল হোয়াইট হাউজে!

১৮৬১ সালে, আব্রাহাম লিংকন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পদার্পণের সময় দেশ ছিল গভীর বিভাজনের মধ্যে। দক্ষিণ ও উত্তর রাজ্যগুলোর মধ্যে দাসপ্রথা এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলছিল।

লিংকন জানতেন—এখন শুধু রাজনৈতিক দক্ষতা নয়, ন্যায়বোধ, ধৈর্য্য এবং দৃঢ় মনোবলই দেশকে একত্রিত রাখবে। তিনি রাতভর পরিকল্পনা করতেন, দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য সেনাদের রিপোর্ট পড়তেন এবং দেশের মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখতেন। কখনও কখনও তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেন যা বিপজ্জনক হলেও ন্যায়ের জন্য প্রয়োজন।

১৮৬১ সাল।ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে এক বিষণ্ণ নীরবতা।দেশ তখন গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে — উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে দাসপ্রথা নিয়ে ভয়ানক বিভাজন।রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন দিনরাত ব্যস্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি, সংসদের চাপ আর জাতির সংকটে।

কিন্তু একদিন সন্ধ্যায়, যখন চারপাশে আলো কমে এসেছে,লিংকন একা বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন।বাগানে তার ছোট ছেলে ট্যাড খেলছে, আর দূরে স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে বড় ছেলে রবার্ট টড লিংকন।

ওই দৃশ্য দেখে লিংকনের মনে হঠাৎ এক প্রশ্ন জাগল—  “আমার ছেলেটা কী শিখছে?
শুধু বইয়ের জ্ঞান?  নাকি জীবনেরও শিক্ষা পাচ্ছে?”

লিংকন ছিলেন রাষ্ট্রপতি, কিন্তু তার ভেতরে ছিল এক কোমল হৃদয়—একজন পিতা, যিনি সন্তানদের মানুষ করতে চান ন্যায়, দয়া আর সততার আলোয়।

তিনি জানতেন, দেশের যুদ্ধ একদিন থামবে,
কিন্তু যদি নতুন প্রজন্ম ভালো মানুষ না হয়, তবে কোনো যুদ্ধই আসল জয়ের নয়।রবার্ট তখন নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। একজন স্নেহময় পিতা হিসেবে লিংকনের হৃদয়ে ছিল ভয়— রাজনীতির কূটচালে ভরা পৃথিবীতে তার ছেলেটি যেন নিষ্পাপতা হারিয়ে না ফেলে।

সেই ভাবনা থেকেই এক রাতে, লিংকন নিজের টেবিলে বসে একটি চিঠি লেখা শুরু করলেন রবার্টের শিক্ষকের কাছে।

তিনি চিঠিতে রাষ্ট্রপতির ভাষা ব্যবহার করেননি,
বরং এক পিতার কণ্ঠে লিখেছেন মমতার অনুরোধে ভরা কিছু লাইন। তিনি লিখেছেন— “আমার ছেলে আজ স্কুলে ভর্তি হলো। আমি জানি, পৃথিবী আজ কঠিন,যেখানে প্রতারণা, ভয় আর লোভ মানুষকে দুর্বল করে দেয়।তাই আমি চাই, আপনি তাকে শুধু পড়া নয়, মানুষ হওয়া শেখাবেন।”

তিনি লেখেন—“তাকে শেখাবেন,সকল মানুষ বন্ধুত্বের যোগ্য নয়, তবুও তাদের ভেতরে ভালো কিছু খুঁজে নিতে।শেখাবেন, জয়ী হওয়ার চেয়ে সৎ থাকা বড়। শেখাবেন, হাসির পেছনে যেন করুণা থাকে,আর কান্নার পেছনে যেন শক্তি থাকে।

শেখাবেন, যেন সে অন্যায়কে ঘৃণা করে,  কিন্তু অন্যায়কারীকে নয়।”

এই শিক্ষা যদি দিতে পারেন, তবে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।”

এই কয়েকটি বাক্যেই প্রকাশ পেয়েছিল একজন পিতার ভালোবাসা, একজন শিক্ষকের প্রতি বিশ্বাস,
আর একজন রাষ্ট্রনায়কের মানবিক দৃষ্টি।

লিংকন জানতেন, বইয়ের শিক্ষা মানুষকে বুদ্ধিমান করে, কিন্তু জীবনের শিক্ষা মানুষকে মহান করে।এই চিঠি ছিল সেই “মহান হওয়ার শিক্ষা”র প্রতীক।

চিঠি লেখা শেষে লিংকন সেটি নিজের হাতে ভাঁজ করে রাখলেন। 

পরের দিন সেই চিঠি পাঠানো হলো স্কুলে। আর এই চিঠি পরবর্তীতে হয়ে ওঠে
“একজন পিতার মানবতার ঘোষণাপত্র।”

১৮৬৩ সালে, লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য ঐতিহাসিক ইম্যান্সিপেশন প্রোক্লামেশন ঘোষণা করেন। এটি ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। সেই সময় অনেকেই তাকে সমালোচনা করেছিল, কিন্তু লিংকনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—“মুক্তি ও ন্যায় ছাড়া কোনো দেশের ভিত্তি স্থায়ী হতে পারে না।”

গৃহযুদ্ধ চলাকালীন, লিংকন ব্যক্তিগতভাবে সৈন্যদের সাহস বাড়াতেন। তিনি তাদের চিঠি লিখতেন, প্রয়োজনমত স্বাক্ষরিত কপিগুলো পাঠাতেন এবং জনগণকে যুদ্ধের সঠিক কারণ বোঝাতেন। তাঁর নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিকও ছিল।

১৮৬৫ সালের দিকে, গৃহযুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে আসলেও লিংকনের দায়িত্ব কখনো সহজ ছিল না। তিনি দেশের পুনর্গঠন, দারিদ্র্য ও বিভাজিত সমাজকে একত্রিত করার কাজের পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি জানতেন, দেশকে সত্যিকারের শান্তি ও সমতার দিকে নিয়ে যেতে হলে নেতৃত্বের প্রতিটি পদক্ষেপ সততা, ন্যায় এবং ধৈর্য্য দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

লিংকনের এই অধ্যায় প্রমাণ করে—কিভাবে শৈশবের সংগ্রাম, যুবক বয়সের অধ্যবসায়, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতা তাকে এক নেতারূপে গড়ে তুলেছে, যে দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তিনি শুধু রাষ্ট্রপতি নয়, এক মানবতার প্রতীক, ন্যায়ের রক্ষক ও স্বাধীনতার অমোঘ প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল, লিংকন পরিবারসহ ওয়াশিংটনের ফোর্ড থিয়েটারে যান। তারা গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে দেশকে একত্রিত করার পরবর্তী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে যাচ্ছিলেন। সেই রাতটি ছিল সাধারণ এবং উৎসবমুখর, কিন্তু ছদ্মবেশী হত্যাকারী জন উইলকস বুথ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জন বুথ একজন দক্ষিণপন্থী সমর্থক এবং লিংকনের মৃত্যুর মাধ্যমে রাজনৈতিক অশান্তি সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিলেন। রাতের একটি মুহূর্তে, বুথ লিংকনের পেছনের দিকে গিয়ে তাকে একটি বন্দুক দিয়ে গুলি চালান। গুলিটি লিংকনের মাথায় লাগে।

লিংকন গুরুতর আহত হন। থিয়েটারের লোকজন তাকে দ্রুত বাইরে নিয়ে যান এবং পাশের প্যাট্রিক হেনরি হসপিটালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা সমস্ত চেষ্টা করলেও, ১৫ এপ্রিল ভোরের দিকে, লিংকন মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৫৬ বছর।

লিংকনের মৃত্যু পুরো দেশকে শোকগ্রস্ত করে। মানুষ তাদের নেতা, ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রপতি, এবং মানবতার প্রতীককে হারানোর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে।

লিংকনের জীবন ও নেতৃত্ব শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার এক চিরন্তন উদাহরণ হয়ে থাকে।

লিংকনের জীবন দেখিয়েছে, দারিদ্র্য, সীমিত শিক্ষা, ব্যর্থতা—কোনোটিই চূড়ান্ত বাধা নয়। শৈশবের সংগ্রাম থেকে শুরু করে যুবক বয়সের কৌতূহল, আইনজীবী হিসেবে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা, রাজনীতিবিদ হিসেবে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা—সবই তাকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথে প্রস্তুত করেছিল।

তার নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক ও নৈতিক দিক থেকেও অনন্য। গৃহযুদ্ধের অন্ধকারে, দাসপ্রথার বিলুপ্তি এবং দেশের পুনর্গঠনে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, সঠিক আদর্শ, অধ্যবসায় এবং অটল ন্যায়বোধ মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।

আব্রাহাম লিংকনের জীবন কেবল একজন রাষ্ট্রপতির গল্প নয়, এটি হলো এক মানুষের সংগ্রামের গল্প—যে সংগ্রাম আশা, স্বপ্ন এবং ন্যায়ের প্রতি অটল বিশ্বাসে ভরা। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়— সীমাবদ্ধতাগুলি কোনো বাধা নয়; এগুলোই মানুষকে শক্তিশালী করে এবং বিশ্বের জন্য পরিবর্তন আনে।

আজও লিংকনের নামের সঙ্গে যুক্ত আছে ন্যায়, মানবতা এবং স্বাধীনতার প্রতীক। গরিবের সন্তান থেকে জাতির নেতা হয়ে ওঠা তাঁর যাত্রা, সারা পৃথিবীর মানুষকে অনুপ্রাণিত করে—যে কোনো স্বপ্ন সম্ভব, যদি মানুষের মনোবল এবং ন্যায়বোধ দৃঢ় হয়।