নিউটনের আপেলের গল্প: এক চিন্তার জন্ম
নিউটনের আপেলের গল্প: এক চিন্তার জন্ম
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার প্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম উলসথর্প (Woolsthorpe)। গ্রামজুড়ে তখন শীতের কনকনে হাওয়া, আকাশে ধূসর মেঘ, আর চারদিকে নিস্তব্ধতা। ১৬৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি, এক মধ্যরাতে গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম নিল এক শিশু — যাকে দেখে দাইমা হতভম্ব হয়ে বলল, “এত ছোট, এত দুর্বল! এ বাচ্চা হয়তো সকাল পর্যন্তও বাঁচবে না!”
মায়ের মুখে উদ্বেগ, দাদীর চোখে পানি।
বাইরে তখন ঠান্ডা এত বেশি যে জানালার কাচে বরফ জমে গেছে।কিন্তু সেই ক্ষীণকায় শিশু — আইজ্যাক নিউটন — যেন মৃত্যুকে উপহাস করল।
সে বেঁচে রইল, খুব নরম শ্বাসে, ধীরে ধীরে। কে জানত, এই দুর্বল শিশুই একদিন প্রকৃতির গোপন রহস্য উন্মোচন করবে!
নিউটনের বাবা, আইজ্যাক সিনিয়র, ছিলেন সাধারণ কৃষক; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তিনি নিউটনের জন্মের আগেই মারা যান। অতএব, শিশু নিউটন জন্মের মুহূর্ত থেকেই এক ধরনের বাবাহীন শূন্যতা নিয়ে পৃথিবীতে এল। মা হান্না আইস্কফ তাঁর সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিলেন সন্তানের ওপর।কিন্তু অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সামাজিক চাপের কারণে যখন নিউটনের বয়স মাত্র তিন বছর, তখন তিনি আরেকটি পরিবারে বিয়ে করেন।
ছোট্ট আইজ্যাককে রেখে যান তাঁর দাদীর কাছে।তিন বছরের শিশু তখনো জানে না, “ত্যাগ” শব্দের মানে কী। কিন্তু যখন মা চলে গেলেন, তার চোখে জমে থাকা প্রশ্নগুলো উত্তরহীন রয়ে গেল।সে একা হয়ে গেল— ঘরের কোণে বসে কাঠের খেলনা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতো। অনেক সময় সে বাতাসে উড়ে যাওয়া ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবত,“ওটা কেন ওভাবে উড়ে? বাতাস কি তাকে টানে?”
দাদীর বাড়ির উঠোনে ছিল একটি পুরনো কলের ঘর।নিউটন সেখানে নিজ হাতে বানাতেন ছোট ছোট মেশিন, কাঠের ঘড়ি, বাতাসে ঘোরা চাকা।
গ্রামের লোকজন যখন তাকে দেখত, হাসতে হাসতে বলত — “এই ছেলেটা একটু পাগল!”
কিন্তু তারা জানত না, সেই "পাগলামির" মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক বিজ্ঞানীর জন্ম।
নিউটন নিজেকে নিয়ে কথা বলেছিলেন একবার, অনেক পরে — “আমি সবসময় আশ্চর্য হতাম, কেন জিনিসগুলো যেমন হয়, তেমন হয় না কেন?”
এই প্রশ্নই ছিল তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি।
যেখানে অন্য শিশুরা খেলনা ভাঙলে কাঁদত,
নিউটন সেটি খুলে দেখত — ভেতরে কীভাবে কাজ করে! গ্রামের রোদে, ঝড়ের দিনে, কিংবা শীতের কুয়াশায়, নিউটন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত একা, কিছু না ভেবে, আবার সব ভেবে।
মনে হতো, সে অন্য এক জগতে বাস করে —
যেখানে প্রশ্নই ছিল খেলার নাম, আর কৌতূহল ছিল তার খেলনা। দাদীর ঘরের পাশে ছিল এক টালির ছাদওয়ালা ঘর, যেখানে ছোট্ট জানালা দিয়ে সকালের সূর্য ঢুকত।নিউটন একদিন সূর্যের আলোয় কাচ বসিয়ে দেখল— আলোর রঙ বদলে যাচ্ছে!
সে তখনও জানত না, একদিন এই রঙের খেলার রহস্যই তাকে করবে আলোকবিজ্ঞানের জনক।
তখনই বোঝা যাচ্ছিল, এই ছেলেটি আলাদা।
তার চিন্তা ছিল গভীর, তার চোখে ছিল পৃথিবীর ভেতর তাকানোর ক্ষমতা। দুনিয়া তখনো জানত না,
এই একাকী শিশু একদিন আপেল পড়া দেখে মহাকর্ষ আবিষ্কার করবে।
সময় তখন ১৬৫০ সালের দিকে।ছোট্ট আইজ্যাক নিউটন তখন প্রায় সাত বছর বয়সী। গ্রামের শিশুদের মতো সেও এক সময় গরু চরাতে যেত, কিন্তু মন থাকত অন্য জগতে। যখন বন্ধুরা নদীতে সাঁতার কাটত বা গাছে উঠত, নিউটন তখন বসে থাকত— কাগজের টুকরো, কাঠের চাকা আর পেরেক হাতে নিয়ে কিছু বানানোর চেষ্টা করছে।
সে একবার একটি বায়ুর সাহায্যে ঘোরা বাতাসের চাকা বানিয়ে ফেলল। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল— ছোট্ট ছেলেটা কাঠের যন্ত্র দিয়ে কিভাবে ঘূর্ণায়মান চাকা চালায়! তখন থেকেই সবাই বুঝল, এই ছেলেটি অন্যরকম।
ইংল্যান্ডের গ্রানথামের ছোট্ট গ্রাম উলসথর্প। সময়টা ১৬৫৩ সাল। গ্রামজুড়ে হালকা কুয়াশা আর ঠান্ডা হাওয়া বইছে। মাত্র ১১ বছরের আইজ্যাক নিউটন তখন গ্রামের স্কুলে পড়ে। বুদ্ধিমান, নির্লিপ্ত, একটু চুপচাপ। তাঁর মা, হান্না, নিউটনের বয়স ৩ বছর থাকাকালে আবার বিয়ে করে চলেগিয়েছিলেন। আর সেই থেকে আইজ্যাক নিউটন কে একা বড় করছিলেন তাঁর দাদী মার্গেরি অ্যাসকাফ।
দাদী ছিলেন ছেলেটির একমাত্র ভরসা — যিনি তাঁকে খেতে বসাতেন, গল্প শোনাতেন, আর ঘুম পাড়াতেন মৃদু গলায় প্রার্থনা করে। কিন্তু ১৬৫৩ সালের এক সকালে সবকিছু বদলে গেল। দাদী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গ্রামের ওঝা এলেন, কিন্তু তাতে লাভ হলো না।কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যুর ছায়া নেমে এলো নিউটনের ঘরে।
সেই শীতল সন্ধ্যায়, যখন গ্রামের চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠল,তখন ছোট্ট আইজ্যাক বুঝে গেল — তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি চিরতরে চলে গেছেন।দাদীর শেষকৃত্যের দিন ছেলেটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে। তাঁর চোখে জল ছিল না, কিন্তু মনটা যেন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিল।সেই মুহূর্তে সে একা হয়ে গেল। কেউ তাকে আর গল্প শোনাবে না, কেউ বলবে না “আইজ্যাক, পড়াশোনা করো।” দাদীর উষ্ণ হাতের স্পর্শ হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
কিন্তু এই দুঃখই আইজ্যাকের মনে তৈরি করল এক নীরব প্রতিজ্ঞা। সে ভাবল —“আমার পাশে কেউ না থাকলেও, আমি থামব না।আমি এমন কিছু করব, যাতে দাদী গর্বিত হতেন যদি বেঁচে থাকতেন।” সেই প্রতিজ্ঞাই ধীরে ধীরে তাঁকে নিয়ে গেল এক অনন্ত পথে — যেখানে অপেক্ষা করছিল জ্ঞানের আলো, বিজ্ঞান, আর মহাবিশ্বের রহস্য।
বছর কেটে গেল, নিউটন হলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।কিন্তু যখনই তিনি কোনো নতুন সূত্র আবিষ্কার করতেন,তিনি নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলতেন—“দাদী, দেখো, আমি তোমার কথাই রাখছি।”
সময়টা ১৬৫৪ সাল।ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের ছোট্ট গ্রাম উলসথর্প তখন শান্ত, সবুজে ঘেরা।
দাদীর মৃত্যুর পর থেকে ছোট্ট আইজ্যাক নিউটন আরও একাকী হয়ে পড়েছে।তাঁর মা হান্না আবারও দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রামে ফিরে এসেছেন।
আর ছেলেকে এবার ঠিক করলেন— “আইজ্যাকের জীবন কৃষিকাজে নষ্ট করা যাবে না। তাকে গ্রামে রাখা যাবে না, শহরে নিতে হবে। ওর মাথায় যে আগুন আছে, তা শিক্ষা দিয়েই জ্বালাতে হবে।”
একদিন সকালে, ১৬৫৪ সালের শেষের দিকে,
হান্না নিজের হাতে ছেলেকে পরিষ্কার জামা পরিয়ে বললেন, “চলো, আজ থেকে তুমি শহরে পড়বে, গ্রান্থামের কিংস স্কুলে।”আইজ্যাক তখন কেবল ১২ বছর বয়সী।একটা ছোট ব্যাগে কয়েকটি বই, দোয়াত আর কলম নিয়ে সে মা’র সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পথ পেরিয়ে গেল গ্রান্থামের দিকে।
গ্রান্থামের কিংস স্কুল তখন লিংকনশায়ারের বিখ্যাত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল ১৪৫৯ সালে, আর সেখানে পড়ত ইংল্যান্ডের ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা।কিন্তু আইজ্যাক ছিল ভিন্ন— সে ছিল এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে,
যে এসেছিল জ্ঞান আর স্বপ্ন নিয়ে, সম্পদ নয়।
স্কুলে তাঁকে ভর্তি করান তাঁর মা হান্না আইসকাউ,
তবে ভর্তি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় যাজক উইলিয়াম অ্যাসকাফ, যিনি ছিলেন নিউটনের আত্মীয় ও দাদীর পরিচিতজন। তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলেছিলেন— “এই ছেলেটি অন্যদের মতো নয়, একে ভর্তি করে নিন। একদিন ও নাম করবে।”
প্রথম দিকে আইজ্যাক স্কুলে খুব সাধারণ ছাত্র ছিল।
সহপাঠীরা তাকে নিয়ে মজা করত, কারণ সে চুপচাপ থাকত, বেশি কথা বলত না। কিন্তু একদিন এক সহপাঠী তাকে ধাক্কা দেয়, আর তাতেই বদলে যায় সবকিছু। নিউটন চুপ করে ঘরে ফিরে গিয়ে ঠিক করল— “আমি প্রমাণ করব, আমি সবার চেয়ে ভালো।”
সেই প্রতিজ্ঞা থেকে শুরু হলো নিউটনের অদম্য পরিশ্রমের গল্প।রাতভর পড়া, নিজে নিজে অঙ্ক ও বিজ্ঞানের নিয়ম বুঝতে চেষ্টা করা — একটি গ্রামের ছেলে ধীরে ধীরে হয়ে উঠল বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র।তার শিক্ষকরা মুগ্ধ হয়ে বলতেন, “নিউটনের চোখে আমরা দেখি জ্ঞানের অদ্ভুত আলো।”
১৬৬১ সালে, বয়স তখন ১৮ বছর।
নিউটন ভর্তি হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে (Trinity College, Cambridge)। সেখানে তাঁর হাতে প্রথম আসে গ্যালিলিও, কেপলার, ডেকার্ট, ও বেকন–এর লেখা বই। এই বইগুলো তাঁর চিন্তার জগৎ পাল্টে দেয়।
রাত জেগে তিনি ভাবতেন— “প্রকৃতি কেন এমন? নক্ষত্রগুলো কি কোনো অদৃশ্য শক্তির টানে ঘুরছে?”
অন্য ছাত্ররা ক্লাসে যা শিখত, নিউটন তা বইয়ের বাইরে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতেন। তিনি নিজের হাতে বানালেন প্রিজম দিয়ে আলো ভাঙার যন্ত্র,
আর দেখলেন— সূর্যের সাদা আলো আসলে সাত রঙে বিভক্ত!
১৬৬৪ সালে, তিনি প্রথমবারের মতো ক্যালকুলাস নামের জটিল গাণিতিক ধারণার সূত্র তৈরি করতে শুরু করেন, যা পরে আধুনিক গণিতের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
১৬৬৫ সাল। ইংল্যান্ডজুড়ে তখন মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছে।শহর–বন্দর–গ্রাম— সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ বিউবনিক প্লেগ (Bubonic Plague)। মানুষ মরছে শত শত, রাস্তাঘাট শুনশান, বাতাসে ভয় আর কান্নার গন্ধ।কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে গেল। অসহায়ভাবে তরুণ ছাত্রদের সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হলো।
তখন নিউটনের বয়স মাত্র ২২ বছর। তিনি সামান্য কিছু বই, কাগজ, আর একটি ছোট টেলিস্কোপ নিয়ে ফিরে এলেন নিজের জন্মস্থান উলসথর্পে (Woolsthorpe Manor)।
চারপাশে যখন আতঙ্ক, মৃত্যু আর হতাশা— তখন নিউটন একা তাঁর গ্রামীণ বাড়ির ঘরে,একটি ছোট জানালার পাশে বসে চিন্তার জগতে ডুবে গেলেন।
তিনি যেন বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর ভেতরের পৃথিবী তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
দিন কাটত তাঁর অদ্ভুত নিয়মে— ভোরে উঠেই সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকানো, আলোর রঙ ভাঙার পরীক্ষা, বিকেলে মাঠে হাঁটাহাঁটি, আর রাত জেগে কাগজে অজস্র সূত্রের হিসাব।তিনি নিজেই পরে বলেছিলেন,“সেই বছরগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময় ছিল।”
বাইরে মৃত্যু, ভয়ের পরিবেশ, কিন্তু ঘরের ভেতরে নিউটন দিনরাত গবেষণায় মগ্ন। তিনি লিখছেন অজস্র সূত্র, করছেন পরীক্ষা, মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে একা হাঁটছেন,গাছের নিচে বসে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন,চোখে এক গভীর প্রশ্ন—“প্রকৃতিকে কে চালায়?কেন সবকিছু মাটির দিকে পড়ে?”
সেই নির্জন সময়েই জন্ম নেয় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার — মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের সূচনা। প্লেগের সময়ের সেই নির্জনতা নিউটনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন, প্রকৃত শিক্ষা কেবল বই থেকে নয়— বরং চিন্তা থেকে জন্ম নেয় সত্যিকার জ্ঞান।
সেই চিন্তার ফলেই এক গ্রামীণ স্কুলছাত্র,যে একসময় উপহাসের পাত্র ছিল। সে হয়ে উঠল বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
এক বিকেলবেলা, ১৬৬৬ সালের গ্রীষ্ম। উলসথর্প গ্রামের বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। দূরে মাঠে পাখির কিচিরমিচির, গরুর ঘণ্টাধ্বনি, আর পশ্চিম আকাশে সূর্য তার শেষ সোনালি আলো মেলে দিচ্ছে।
নিউটন একা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলেন তাঁদের বাড়ির পিছনের ছোট বাগানে। এ বাগানের একটি পুরনো আপেল গাছ ছিল তাঁর খুব প্রিয়— বয়সে পুরোনো, কিন্তু ফলভারে নত হয়ে আছে ডালপালা।
নিউটন গাছের নিচে গিয়ে বসে পড়লেন, হাতে একটা ছোট নোটবই।চারপাশ ছিল শান্ত।শুধু বাতাসে পাতার মৃদু সড়সড় শব্দ।
তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি নামালেন মাটির দিকে। হঠাৎ তাঁর মনে ভেসে উঠল নানা প্রশ্ন—আলো কেন সরলরেখায় চলে, রঙ কেন ভাঙে, কেন সূর্য প্রতিদিন ওঠে আর ডোবে—
এইসব প্রশ্নে তাঁর মন ছিল সদা ব্যস্ত।কিন্তু ঠিক তখনই, একটি আপেল গাছের ডাল থেকে আলগা হয়ে পড়ল এক পাকা আপেল। “ঠুস” করে মাটিতে পড়ার শব্দে নিউটনের মনোযোগ ভেঙে গেল।
তিনি চমকে উঠলেন, চোখ রাখলেন আপেলটির দিকে।
এক মুহূর্তের জন্য পৃথিবী যেন থেমে গেল।
বাতাস স্থির, চারপাশ নিস্তব্ধ। নিউটন ধীরে ধীরে আপেলটি তুললেন হাতে, তাকিয়ে রইলেন অবাক দৃষ্টিতে।“কেন এটি নিচে পড়ল?কেন ওপরের দিকে গেল না? কে একে নিচে টানল?”
এই প্রশ্নগুলো যেন আগুনের মতো তাঁর মনে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি কাগজে কিছু লিখতে শুরু করলেন—
তাঁর কলমের গতি বেড়ে গেল, চোখে জ্বলে উঠল অদ্ভুত এক আলো। তিনি ভাবলেন— যদি পৃথিবী আপেলটিকে টানে, তাহলে পৃথিবী কি নিজেও কোনো শক্তি ব্যবহার করছে? আর যদি এই টানার শক্তি থাকে, তাহলে কি এই একই শক্তিই চাঁদকেও টেনে রাখছে কক্ষপথে? সূর্য কি একই শক্তিতে গ্রহগুলোকে নিজের চারপাশে রাখে?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন— কিন্তু উত্তর তখনও অজানা। তবু সেই মুহূর্তেই জন্ম নিল এক অমর ধারণা, যা একদিন বদলে দেবে সমগ্র মানবসভ্যতার চিন্তার ধারা।
নিউটন নিজে হয়তো তখনও জানতেন না, কিন্তু ইতিহাস জানত—সেই বিকেলের আপেলটি কেবল মাটিতে পড়েনি, পড়ে গিয়েছিল মানবজ্ঞান-এর এক নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে।
বছর কয়েক পর, এক বন্ধু যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল— “তুমি কীভাবে মাধ্যাকর্ষণের ধারণা পেলে?”
নিউটন মৃদু হেসে বলেছিলেন, “আমি তখন এক বিকেলে বাগানে বসেছিলাম। একটি আপেল নিচে পড়ল। আর আমি ভাবতে শুরু করলাম, কেন জিনিসগুলো সবসময় নিচের দিকেই পড়ে?”
সেই ছোট্ট প্রশ্নই হয়ে উঠল বিশ্ববিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় জাগরণ। এক তরুণের কৌতূহল পৃথিবীকে দিল এক নতুন চোখে দেখার ক্ষমতা। সেই আপেল এখন ইতিহাসের পাতায় শুধু ফল নয়— এটি এক চিন্তার প্রতীক, এক মুহূর্তে জেগে ওঠা মানব মস্তিষ্কের বিজয়ের প্রতিধ্বনি।
পরবর্তী দুই বছর (১৬৬৫–১৬৬৭) নিউটন প্রায় একা কাটালেন উলসথর্পে। বন্ধুবান্ধব নেই, শিক্ষক নেই,শুধু তাঁর নিজের মন আর প্রকৃতির নীরবতা।
কিন্তু এই একাকীত্বই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
তিনি লিখতে শুরু করলেন তাঁর সূত্রগুলো— গতি, বল, ও টানার নিয়ম নিয়ে। ধীরে ধীরে সেই চিন্তা রূপ নিল এক অদ্ভুত তত্ত্বে— “মাধ্যাকর্ষণ (Gravity)”।যে শক্তি আপেলকে টানে,বসেই একই শক্তি চাঁদকে কক্ষপথে রাখে, গ্রহগুলোকে সূর্যের চারপাশে ঘোরায়,এমনকি মহাবিশ্বের প্রতিটি কণাকে এক অদৃশ্য বন্ধনে যুক্ত করে রাখে।
এক নির্জন গ্রামের এক তরুণ,যার হাতে কোনো আধুনিক যন্ত্র নেই,কিন্তু যার চিন্তা পৌঁছে গেল মহাকাশের প্রান্তে— এটাই ছিল নিউটনের সত্যিকারের জন্ম।
বাইরে যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছিল,
নিউটন তখন জীবনের নতুন সংজ্ঞা লিখছিলেন।
মানুষ যখন দরজা বন্ধ করেছিল ভয় থেকে,
তিনি তখন নিজের দরজা খুলে দিয়েছিলেন চিন্তার মুক্ত আকাশে।“যেখানে ভয়, সেখানে চিন্তার মৃত্যু। কিন্তু যেখানে নির্জনতা, সেখানে সৃষ্টি জন্ম নেয়।”
সেই নির্জন উলসথর্পেই, এক আপেলের পতনে জন্ম নিয়েছিল— এক চিন্তার উত্থান, এক বিজ্ঞানের বিপ্লব।
বছরটি ১৬৬৬। ইংল্যান্ড তখন এক অশান্ত সময় পার করছে। প্লেগে শহর লন্ডন প্রায় অচল। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, সবাই ঘরে ফিরেছে। কিন্তু এই নির্জন সময়টিই হয়ে উঠল এক তরুণ ছাত্রের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যয়নকাল।
সেই তরুণ — আইজ্যাক নিউটন, বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর। অন্যেরা যখন ভয় ও হতাশায় দিন কাটাচ্ছিল, নিউটন তখন একা বসে ছিলেন তাঁর গ্রামের ছোট ঘরে, বাইরে প্লেগের ভয়, ভিতরে জ্বলে উঠেছিল চিন্তার আগুন।রাতের পর রাত তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন —চাঁদ কেন আকাশে ঝুলে থাকে, কেন সে পড়ে যায় না?
সূর্য, গ্রহ, তারা — এরা কীভাবে এক নিয়মে ঘুরছে?
এদের মধ্যে কী অদৃশ্য কোনো বন্ধন কাজ করছে?
তখনই তাঁর মাথায় ফিরে এল সেই বিকেলের আপেল পড়ার দৃশ্য। তিনি মনে মনে বললেন,“যে শক্তি আপেলটিকে নিচে টানে, হয়তো সেই একই শক্তি চাঁদকেও টেনে রাখছে আকাশে!”
এই ভাবনা যেন তাঁকে পাগল করে তুলল। দিনরাত তিনি গণনা করতে লাগলেন— দূরত্ব, বেগ, সময়, ভর — সবকিছু মিলিয়ে এক গাণিতিক সম্পর্ক খুঁজতে লাগলেন। তিনি কাগজে লিখলেন শত শত সমীকরণ, কখনও মোমবাতির আলোয়, কখনও সূর্যেরআলোয়, চোখ লাল, কিন্তু মন থামছে না।
অবশেষে, একদিন তাঁর নোটবুকে ফুটে উঠল ইতিহাসের এক অমর সূত্র — “প্রত্যেক বস্তু অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করে, তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে।”
এটাই হলো মাধ্যাকর্ষণের সর্বজনীন সূত্র।একটি আপেলের পতন থেকে জন্ম নিল এমন এক ধারণা,
যা বোঝালো কেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে।
কেন সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা হয়,এমনকি কেন আমরা মাটিতে স্থির হয়ে হাঁটতে পারি!
বছর কয়েক পর, ১৬৮৭ সালে,নিউটন প্রকাশ করলেন তাঁর বিখ্যাত বই — “Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica”,যা সংক্ষেপে পরিচিত “Principia” নামে।এই বইতে তিনি উপস্থাপন করলেন তিনটি গতি সূত্র এবং মাধ্যাকর্ষণের সূত্র। যা হয়ে উঠল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি।
তাঁর সূত্র প্রমাণ করল — একই নিয়মে চলে আপেল, চাঁদ, গ্রহ, এমনকি সমগ্র মহাবিশ্ব।একই শক্তি পৃথিবীতে বস্তু ফেলে দেয়, আর একই শক্তি সূর্যকে ঘিরে রাখে গ্রহদের অনন্ত কক্ষপথে। বিজ্ঞান তখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। মানুষ প্রথমবার বুঝল — প্রকৃতি কেবল রহস্য নয়, এটি যুক্তি, গাণিতিক নিয়ম, আর মহাজাগতিক সঙ্গীতের এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণ।
নিউটনের জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায় —
মহান আবিষ্কার হঠাৎ আসে না;এটি আসে অবিরাম চিন্তা, ধৈর্য ও কৌতূহল থেকে।তিনি নিজে বলেছিলেন,“আমি প্রতিভাবান নই, আমি শুধু অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরে ভাবি।”একটি আপেলের পতন পৃথিবীকে যে শিক্ষা দিয়েছে,
তা হলো — প্রতিটি ছোট্ট ঘটনা, যদি মনোযোগ দিয়ে দেখা যায়, তাহলে সেটিও হতে পারে জ্ঞানের এক মহাবিস্ফোরণ।
বছর ১৬৮৭।লন্ডনের এক ছোট্ট ছাপাখানায় ছাপা হচ্ছিল এমন এক বই, যা চিরতরে বদলে দেবে মানব সভ্যতার চিন্তার দিকনির্দেশনা।
বইটির নাম — “Philosophiæ Naturalis Principia Mathematica”,লেখক — আইজ্যাক নিউটন।
প্রথমে অনেকে বুঝতেই পারেনি বইটির গুরুত্ব।
কিন্তু বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদরা যখন বইটি হাতে নিলেন, তখন যেন পৃথিবী নতুন চোখে দেখা শুরু করল। প্রথমবার মানুষ জানল — আকাশে গ্রহের চলা, সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা,এমনকি একটি আপেলের মাটিতে পড়া — সবই একই শক্তির অধীন, একই নিয়মে বাঁধা মহাবিশ্বের সঙ্গীতে।
নিউটনের আগে মানুষ ভাবত— আকাশের জগৎ আর পৃথিবীর জগৎ আলাদা। একদিকে দেবতাদের আবাস, অন্যদিকে মানুষের পৃথিবী। কিন্তু নিউটন দেখালেন— না, মহাবিশ্ব একক নিয়মে পরিচালিত হয়। যে শক্তি আপেলকে টানে, সেই শক্তিই চাঁদকে তার কক্ষপথে ধরে রাখে।
এ যেন ঈশ্বরের সৃষ্টি বোঝার এক নতুন চাবিকাঠি।
তখনকার প্রখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়া লিখেছিলেন— “নিউটন প্রকৃতির মন্দিরের পর্দা সরিয়ে দেখালেন ঈশ্বরের কারিগরি।”
নিউটনের সূত্র কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি।এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী শতাব্দীতে জন্ম নেয় নতুন নতুন আবিষ্কার:
-
জেমস ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন (১৭৬৯)
-
গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন
-
আধুনিক যান্ত্রিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল
-
এমনকি মহাকাশযাত্রার সূত্রপাত
১৮৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে পূর্বাভাস দিতে শুরু করলেন— নতুন গ্রহ, নতুন তারার গতিপথ! এমনকি ১৮৪৬ সালে যখন নেপচুন গ্রহ আবিষ্কৃত হয়, তখন সেটির অবস্থান ঠিক নির্ধারণ করা হয়েছিল নিউটনের সমীকরণ দিয়েই!
নিউটনের সূত্র এত শক্তিশালী ছিল যে, পরবর্তী দুই শতাব্দী বিজ্ঞান প্রায় পুরোপুরি তাঁর নিয়মে চলেছে।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ না করা পর্যন্ত বিজ্ঞানের মন্দিরে নিউটনের আইনই ছিল প্রধান ধর্মগ্রন্থ। আইনস্টাইন নিজেও বলেছিলেন, “নিউটন আমার কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন,
তাঁর ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পেতাম না।”
নিউটনের সূত্র ছাড়া চাঁদে মানুষ পাঠানো, স্যাটেলাইট স্থাপন, অথবা রকেটের পথ নির্ণয় — কিছুই সম্ভব হতো না। প্রতিটি গণনা, প্রতিটি প্রক্ষেপণ আজও শুরু হয় তাঁর সূত্রের ওপর ভিত্তি করে।
আইজ্যাক নিউটনের মৃত্যু হয় ৩১ মার্চ ১৭২৭ সালে,
কিন্তু তাঁর চিন্তা আজও জীবন্ত। তিনি ছিলেন না কোনো রাজা বা যোদ্ধা,কিন্তু তাঁর কলমের এক সূত্র বদলে দিয়েছিল সভ্যতার পথ। একটি আপেল মাটিতে পড়েছিল, আর সেই আপেলের পতনে মানুষ খুঁজে পেয়েছিল মহাবিশ্বের নিয়ম।
আজও যখন কোনো শিশু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “তারা কেন পড়ে না?”, সেই প্রশ্নের উত্তর নিউটনের সূত্রেই লুকিয়ে আছে।
নিউটনের জীবন আমাদের শেখায় - বুদ্ধি নয়, ধৈর্য আর কৌতূহলই সবচেয়ে বড় শক্তি।তিনি নিজে বলেছিলেন “আমি পৃথিবীর তীরে খেলতে থাকা এক শিশুর মতো, মাঝে মাঝে কোনো সুন্দর নুড়ি বা ঝিনুক খুঁজে পাই, অথচ আমার সামনে পড়ে আছে এক বিশাল সত্যের মহাসাগর।”
বছর ১৭২৭।লন্ডনের ঠান্ডা সকালে, আইজ্যাক নিউটন চোখ বন্ধ করলেন চিরদিনের মতো।
তাঁর বয়স তখন ৮৪ বছর। কিন্তু মৃত্যু যেন তাঁকে ছুঁতে পারেনি।তাঁর দেহ শায়িত হলো ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে— রাজা-রানির পাশে, কারণ রাজাও জানত—এই মানুষটি নিজের চিন্তায় জগৎ জয় করেছেন।
সেদিন কেবল এক বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়নি, বরং জন্ম নিয়েছিল এক অমর উত্তরাধিকার।বছর গড়িয়ে গেল। নিউটনের লেখা বইগুলো ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল,ছাত্ররা তাঁর সূত্র মুখস্থ করত, আর বিজ্ঞানীরা তাঁর ভাবনা দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করতে লাগল।
এক তরুণ স্কটিশ ছেলেটি— জেমস ওয়াট,
নিউটনের গতি সূত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানাল বাষ্প ইঞ্জিন (১৭৬৯)। সেই ইঞ্জিন থেকেই শুরু হলো শিল্প বিপ্লব— মানুষের শ্রমের বদলে যন্ত্র কাজ করতে শুরু করল।
একজন জ্যোতির্বিদ, রাতের আকাশে দূরবীন তাকিয়ে নিউটনের সমীকরণ দিয়ে গ্রহের গতিপথ হিসাব করলেন, আর ১৮৪৬ সালে নেপচুন গ্রহের অস্তিত্বের পূর্বাভাস দিলেন— সবই নিউটনের সূত্র থেকে!তাঁর চিন্তা যেন সময়ের সীমা ছাড়িয়ে নতুন নতুন আবিষ্কারে পুনর্জন্ম নিতে লাগল।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, মানুষ যখন প্রথম রকেট বানাতে শুরু করে, বিজ্ঞানীরা আবার ফিরলেন নিউটনের বইয়ে। তাঁর তিনটি গতি সূত্র না জানলে
রকেট কতটা বেগে উঠবে, কোন কক্ষপথে যাবে—
কিছুই হিসাব করা সম্ভব ছিল না।
১৯৬৯ সালে যখন নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখলেন,
তখনও বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন—“এই চাঁদের পাথরে নিউটনের ছায়া আছে।”আজও মহাকাশে যে হাজারো উপগ্রহ ঘুরছে,যে GPS আমাদের পথ দেখায়, যে রকেট মহাকাশে খাবার পৌঁছে দেয়— সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে নিউটনের একটিমাত্র সূত্রের ওপর: “Force = Mass × Acceleration”
নিউটনের আবিষ্কার শুধু মহাকাশ নয়, প্রভাব ফেলেছে পদার্থবিজ্ঞান, প্রকৌশল, কম্পিউটার, এমনকি AI পর্যন্ত।
যখন কোনো প্রকৌশলী সেতু তৈরি করে,
যখন রোবট হাত তুলতে শেখে, যখন বিজ্ঞানী কোনো উপগ্রহের গতি নির্ধারণ করে— তারা প্রত্যেকেই নিউটনের সন্তানদের মতো তাঁর সূত্র অনুসরণ করে। একটি আপেলের পতন থেকে শুরু হওয়া সেই চিন্তা আজ আমাদের হাতে এনে দিয়েছে স্মার্টফোন, স্যাটেলাইট, এমনকি মহাবিশ্বের দূরতম গ্রহের ছবি।
নিউটনের জীবনের কাহিনী শুধুই বিজ্ঞানের নয়,
এটি এক অটল মনোযোগ ও ধৈর্যের গল্প।একবার তাঁর একজন ছাত্র জিজ্ঞাসা করেছিল,
“স্যার, আপনি এত কিছু কিভাবে আবিষ্কার করলেন?”নিউটন হেসে বলেছিলেন—“আমি কেবল বেশি সময় ধরে ভাবতে পারি।”
এই সরল উত্তরই তাঁর জীবনদর্শন। তিনি কখনো তাড়াহুড়ো করেননি,তিনি কখনো নিজের অক্ষমতাকে ভয় পাননি।বরং ছোট একটি ঘটনার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন মহাবিশ্বের নিয়ম।
নিউটন কখনো আপেলের পতনকে “সাধারণ ঘটনা” ভাবেননি।তিনি প্রশ্ন করেছিলেন—“কেন?”এই “কেন” শব্দটিই তাঁকে ইতিহাসে অমর করে তুলেছে।
আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য এটিই প্রথম শিক্ষা —
প্রশ্ন করতে ভয় পেও না।প্রত্যেক বড় আবিষ্কার শুরু হয় একটি সাধারণ প্রশ্ন থেকে।তুমি যদি সাহস করে প্রশ্ন করো, তাহলেই তুমি চিন্তা করতে শিখবে,আর চিন্তাই একদিন তোমাকে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
যখন প্লেগে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো, তখন সবাই ভয় পেয়ে পালাল, কিন্তু নিউটন সেই নির্জন সময়টিকে রূপ দিলেন সৃষ্টির সময়ে। তিনি ঘরে বসে আবিষ্কার করলেন গতি, আলো, আর মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে নতুন নতুন ধারণা।
আজ যখন অনেক শিক্ষার্থী বলে— “সময় নেই”, “পরিস্থিতি ভালো না”, তখন নিউটনের জীবন বলে দেয়— সুযোগের অপেক্ষা কোরো না, সময়কে সুযোগে পরিণত করো। তোমার কষ্ট, একাকীত্ব বা ব্যর্থতাই হতে পারে তোমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
নিউটন একদিনে বিখ্যাত হননি।তিনি অসংখ্য রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন, বারবার ভুল করেছেন, আবার শুরু করেছেন।তিনি বিশ্বাস করতেন —“প্রতিভা নয়, অবিরাম পরিশ্রমই সাফল্যের রহস্য।” আজকের যুগে যেখানে সবাই দ্রুত ফল চায়, সেখানে নিউটন শেখান— ধৈর্য ধরো, জ্ঞান সময় নেয়। একটি সূত্র তৈরি হতে যেমন বছর লাগে, তেমনি একটি চরিত্র গড়তেও লাগে সময়, ধৈর্য ও নীরব অধ্যবসায়।
একটি আপেল থেকে জন্ম নিয়েছিল মাধ্যাকর্ষণ সূত্র,যা বদলে দিয়েছে সমগ্র বিশ্ববিজ্ঞান। তুমি আজ যেটিকে তুচ্ছ ভাবছো— সেই বিষয়ই হতে পারে তোমার জীবনের বড় পরিবর্তনের কারণ।
তাই কখনো ছোট কিছু অবহেলা করো না। একটি ভাবনা, একটি পর্যবেক্ষণ, অথবা একটি ব্যর্থতাও তোমার ভবিষ্যতের সিঁড়ি হতে পারে।
জীবনের শেষ দিকে এক ছাত্র নিউটনকে বলেছিল,
“স্যার, আপনি তো সবচেয়ে মহান বিজ্ঞানী।”
নিউটন মৃদু হাসলেন এবং বললেন— “আমি শুধু সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশু, মাঝে মাঝে কোনো সুন্দর নুড়ি বা ঝিনুক খুঁজে পাই, অথচ আমার সামনে পড়ে আছে এক বিশাল সত্যের মহাসাগর।”