ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের অগ্নিশিখা: কর্নেল স্যান্ডার্সের কেএফসি সাম্রাজ্য
ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের অগ্নিশিখা: কর্নেল স্যান্ডার্সের কেএফসি সাম্রাজ্য
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার হেনরিভিল (Henryville, Indiana) নামের এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম নিল এক ছেলে— নাম হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। বাড়ি বলতে ছিল কাঁচা কাঠের তৈরি একটিমাত্র ঘর, চারপাশে খামার আর ধূলিময় রাস্তা। তার বাবা ছিলেন কৃষক, মায়ের দায়িত্ব ছিল তিন সন্তানকে মানুষ করা।
শৈশব থেকেই স্যান্ডার্সের জীবন শুরু হয়েছিল দারিদ্র্যের ছায়ায়। কিন্তু আরও ভয়ানক সময় এল যখন তিনি মাত্র ৬ বছর বয়সী। তার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। মায়ের চোখে জল, ঘরে রুটি পর্যন্ত নেই। সেই দিন থেকে ছোট্ট হারল্যান্ড বুঝে গেল— জীবন তাকে সহজ কিছু দিতে আসেনি, তাকে তা নিজের হাতে গড়তে হবে।
মা কাজ করতে যেতেন কাছের কারখানায়। ঘরে থাকত ছোট ভাই-বোন, আর দায়িত্ব পড়ল হারল্যান্ডের ওপর। ছয় বছর বয়সে তিনি চুলা ধরতে শিখলেন, হাঁড়ি-পাতিল সামলাতে লাগলেন।
প্রথম প্রথম হাত পুড়তো, ভাত পুড়ে যেত, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
একদিন, মা বাড়ি ফিরে এসে খেতে বসলেন।
হারল্যান্ডের হাতে তৈরি সাধারণ খাবার—
ভাজা মুরগি, আলু আর সামান্য সবজি।
এক চুমুক খেয়েই মায়ের চোখ ভিজে গেল।
তিনি বললেন, “হারল্যান্ড, তুমি শুধু ভালো রান্না করোনি, তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ।”
সেই মুহূর্তেই বোধহয় জন্ম নেয় তার রন্ধনপ্রেমের বীজ। চুলার ধোঁয়ার ভেতর, ক্ষুধার তাড়নায় তৈরি খাবার থেকেই একদিন জন্ম নেবে এমন এক স্বাদ,
যা জয় করবে পুরো পৃথিবী।
১২ বছর বয়সে, তিনি স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলেন।
কারণ পরিবারে টাকার অভাব চরমে পৌঁছেছিল।
খামারে কাজ করা, দোকানে মালপত্র তোলা, গরু চরানো— যা-ই কাজ হোক, হারল্যান্ড করতেন নিষ্ঠা আর সাহস নিয়ে।
১৪ বছর বয়সে তিনি চাকরি পেলেন ট্রামে কনডাক্টরের সহকারী হিসেবে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করতেন, আর রাতে ক্লান্ত দেহে মাটিতে শুয়ে ভাবতেন— “একদিন আমিও কিছু একটা হব।”
তারপর ১৫ বছর বয়সে, তিনি রেলওয়ে কোম্পানিতে যোগ দিলেন আগুন জ্বালানোর কাজ করতে।চুল্লিতে কয়লা ঢালা, ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া মুখ— এই ছিল তার প্রতিদিনের বাস্তবতা। তবুও সেই অন্ধকারের ভেতরও তিনি দেখতেন আলো— নিজের ভেতরের আলো।
এই বয়সে তার কাছে জীবন ছিল এক শিক্ষক, যে শিখিয়েছে কষ্টের ভেতর টিকে থাকতে, অন্যের সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে দাঁড়াতে।প্রতিদিন সকালবেলা নিজের হাতে বানানো শুকনো রুটি খেয়ে কাজে যেতেন। একদিন সহকর্মী তাকে ঠাট্টা করে বলল, “এই খাবারও কেউ খায়?”হারল্যান্ড হাসিমুখে উত্তর দিল, “আজ এই খাবার সাদামাটা, কিন্তু একদিন আমার রান্না মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবে।”তখন কেউ হাসল, কেউ অবিশ্বাস করল— কিন্তু ইতিহাস জানে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী একদিন সত্যি হয়েছিল।
১৯০৬ সাল, হারল্যান্ডের বয়স তখন ১৬। তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন নতুন জীবনের সন্ধানে। পেছনে ফেলে গেলেন মায়ের চোখের জল আর শৈশবের দরিদ্র ঘর, কিন্তু সাথে নিলেন এক অমূল্য সম্পদ— অদম্য পরিশ্রম, বিশ্বাস, আর রান্নার ভালোবাসা।সেই দিন তিনি জানতেন না, এই পদক্ষেপই একদিন তাকে নিয়ে যাবে এক গ্যারেজ থেকে শুরু হওয়া বিশ্ববিখ্যাত সাম্রাজ্যের দিকে।
জীবনের কঠিন শুরুই প্রায়শই মহান গন্তব্যের পূর্বভূমিকা।ছোটবেলায় শিখে নেওয়া দায়িত্ববোধ ও পরিশ্রমই মানুষকে গড়ে তোলে শক্ত করে।যাদের জীবন অন্ধকারে শুরু হয়, তারাই আলোয় সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।
১৯০৭ সালের এক ভোরবেলা। সূর্যের আলো তখনো পুরোপুরি উঠেনি। ছোট্ট এক ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন ১৬ বছরের এক কিশোর — হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। তার চোখে স্বপ্নের ঝিলিক, কিন্তু বুকভরা ভয়ও আছে। তিনি জানেন, আজ থেকে শুরু হচ্ছে সংগ্রামের জীবন। স্কুল ছাড়তে হয়েছে দারিদ্র্যের কারণে। পেটের ভাত জোগাতে হবে নিজের হাতে।
প্রথম চাকরি রেলওয়ে কোম্পানিতে — আগুন জ্বালানোর কাজ। দিনভর কয়লার ধোঁয়া আর ঘামে ভিজে থাকতেন। কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় এক যাত্রী সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর চাকরি হারালেন।
সেই রাতে তিনি ট্রেনলাইনের পাশে বসে নিজের ভাগ্যকে প্রশ্ন করলেন, “প্রভু, আমি কি সবসময় ব্যর্থই হব?”
কিন্তু স্যান্ডার্সের ভিতরে যে আগুন ছিল, তা কখনো নিভে যায়নি।তিনি নিজেকে বললেন,“একটা কাজ হারানো মানে আমার জীবন শেষ নয়। আমি আবার শুরু করব।”
এরপর শুরু হলো একের পর এক চেষ্টা — একের পর এক ব্যর্থতা। তিনি কখনও ছিলেন বিমা বিক্রেতা, কখনও টায়ার বিক্রেতা, কখনও স্টিমবোট চালক।যেখানেই গেছেন, সেখানে কিছুদিন ভালো গিয়েছে, তারপর কোনো না কোনো কারণে সব ভেস্তে গেছে।
১৯১০ সালের দিকে, তিনি এক বীমা কোম্পানিতে ভালো করছিলেন। কিন্তু নিজের স্বাধীনচেতা মন তাকে স্থায়ী হতে দিল না। একদিন বস তাকে বললেন, “হারল্যান্ড, তুমি ভালো মানুষ, কিন্তু তুমি নিয়ম মানতে পারো না।” স্যান্ডার্স শান্ত গলায় বললেন, “স্যার, আমি নিয়ম মানতে পারি, কিন্তু যদি নিয়মই আমাকে আমার স্বপ্ন থেকে দূরে রাখে, তবে আমি সেই নিয়ম মানতে পারব না।”চাকরি গেল। আবার বেকার জীবন।
১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর্মিতে যোগ দিলেন, কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে আসতে হলো।এরপর শুরু হলো ছোট ছোট ব্যবসা — একবার টায়ারের দোকান, একবার ল্যাম্প বিক্রি, একবার স্টিমবোট সার্ভিস।প্রতিবারই ব্যর্থতা।
মানুষ হাসতো, “স্যান্ডার্স? ওর কাজ টিকে না। ও ব্যর্থ মানুষ।” এই কথা তার বুকের ভেতর আগুনের মতো পুড়ত। কিন্তু তিনি চুপ থাকতেন। তার চোখে তখন একটাই প্রতিজ্ঞা — “একদিন আমি এমন কিছু করব, যা মানুষকে আমার নাম শ্রদ্ধা করে উচ্চারণ করতে বাধ্য করবে।”
১৯২০ সালে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের গাড়ি গ্যারেজের পাশে একটা ছোট খাবারের দোকান দেবেন। “এবার হবে,”—তিনি নিজেকে বললেন।
তিনি নিজের হাতে রান্না শুরু করলেন। রান্না তার কাছে শুধু পেশা ছিল না, এটি ছিল এক ধরনের শিল্প, এক ধরনের ভালোবাসা।গ্রাহকেরা অবাক হতো তার সাদামাটা খাবারে অদ্ভুত এক স্বাদ পেয়ে।
১৯৩০ সালের দিকে কর্নেল স্যান্ডার্সের জীবন ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছিল। তিনি তখন কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের করবিন (Corbin, Kentucky) শহরে এক ছোট্ট রেস্টুরেন্ট চালাতেন, যা তিনি একটি পেট্রোল পাম্পের পাশে খুলেছিলেন।সেখানে যাত্রীরা এসে শুধু গাড়িতে তেলই নিত না—স্যান্ডার্সের হাতে রান্না করা খাবারের স্বাদ নিতে থামতেও ভুলত না।
তার তৈরি “Southern Fried Chicken” এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। রোজ রোজ ভিড় বাড়ছিল, আর স্যান্ডার্স ভাবছিলেন, “হয়তো এবার সত্যিই আমি সফল হব।”কিন্তু ভাগ্য তখনো তাকে পরীক্ষা নিতে ছাড়েনি।
১৯৩২ সালের শুরুর দিকে, একদিন তিনি নিজের গাড়িতে করে সরবরাহ আনতে যাচ্ছিলেন কাছের শহরে। রাত ছিল ঘন অন্ধকারে মোড়া, রাস্তায় বাতি ছিল খুব কম। ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে আসা এক ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে এসে ধাক্কা মারল।
দারুণ শব্দে গাড়ি দু’টো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লেগে গেল।স্যান্ডার্সের গাড়িটি উল্টে গিয়ে পাশের খাদে পড়ে গেল। মুহূর্তেই যেন সব শেষ- রক্তাক্ত দেহ, ভাঙা হাড়, আর অচেতন স্যান্ডার্সকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
ডাক্তাররা বললেন, “আপনাকে অনেকদিন বিশ্রামে থাকতে হবে, নইলে পা আর কখনও আগের মতো কাজ করবে না।” স্যান্ডার্স হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দিন কাটালেন ব্যথা আর হতাশায়। রেস্টুরেন্টে তিনি যেতে পারলেন না, আর তার অনুপস্থিতিতে ব্যবসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। কর্মচারীরা ছিটকে গেল, খাবার নষ্ট হলো। ক্যাশবক্স ফাঁকা— আর তিনি অসহায় হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন নিজের ভেঙে পড়া স্বপ্নের দিকে।
অনেকেই ভাবল—এই দুর্ঘটনাই বুঝি কর্নেল স্যান্ডার্সের গল্পের শেষ। কিন্তু তিনি ভাবলেন উল্টোটা।হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি নিজেকে বললেন,“আমি যদি এখন হেরে যাই, তাহলে এই দুর্ঘটনা আমার জীবনের শেষ অধ্যায় হয়ে যাবে।কিন্তু আমি যদি উঠে দাঁড়াই, তাহলে এটি হবে নতুন অধ্যায়ের শুরু।”
শরীর ধীরে ধীরে সেরে উঠল, আর স্যান্ডার্স আবার ফিরলেন তার পুরনো দোকানে। কিন্তু তখন ততদিনে সব শেষ— বিক্রি বন্ধ, গ্রাহক হারানো, দোকানের চুলা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তিনি পুনরায় দোকান চালু করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেই অর্থ আর জোগাড় হলো না।অবশেষে বাধ্য হয়ে ১৯৩২ সালেই দোকানটি বন্ধ করে দেন।
জীবন যতবার ভাঙে, ঠিক ততবারই আমাদের সুযোগ দেয় নতুন করে গড়ার।এক দুর্ঘটনা হয়তো ব্যবসা বন্ধ করতে পারে,কিন্তু ইচ্ছাশক্তিকে বন্ধ করতে পারে না। কর্নেল স্যান্ডার্সের জীবনের এই অধ্যায়ই পরবর্তীতে তার ভেতরে জন্ম দিয়েছিলসেই আগুন, যেখান থেকে “KFC”-র সাম্রাজ্য জেগে উঠেছিল।
১৯৩০ সালের দিকে, বয়স তখন প্রায় ৪০। বন্ধুরা বলত, “হারল্যান্ড, তোমার জীবন তো শেষ হয়ে গেছে। এত বছর পরও তুমি কিছুই করতে পারলে না।” তিনি শুধু মৃদু হেসে বলতেন, “আমি এখনও হাল ছাড়িনি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের সেরা সময়টা কখনও দেরিতে আসে না।”
তার চোখে তখনও সেই আগুন — যে আগুন একদিন তাকে বানাবে বিশ্ববিখ্যাত কর্নেল স্যান্ডার্স, যার রেসিপি ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়ার ১৫০টিরও বেশি দেশে। কিন্তু এখন, ১৯৩০ সালের এই মুহূর্তে,
তিনি শুধু একজন সাধারণ মানুষ — যার স্বপ্ন চাপা পড়ে আছে ব্যর্থতার পাহাড়ের নিচে। তবে সেই পাহাড়ই ছিল তার পরীক্ষার অগ্নিকুণ্ড, যেখান থেকে একদিন জেগে উঠবে সাফল্যের অগ্নিশিখা।
ব্যর্থতা আসলে শেষ নয়, এটি সাফল্যের আগমনী ধ্বনি।যারা একশো বার পড়ে গিয়েও একশো একবার উঠে দাঁড়ায়, তারাই ইতিহাস তৈরি করে।জীবন যত কঠিন হয়, মানুষ ততই শক্ত হয়—ঠিক যেমন আগুনে ইস্পাত তৈরি হয়।
১৯৩০ সাল। মহামন্দার ভয়াবহ ছায়া তখন পুরো আমেরিকাজুড়ে। ব্যবসা ধসে পড়ছে, মানুষ কাজ হারাচ্ছে, ক্ষুধা আর হতাশা যেন আকাশ ছুঁয়েছে।
এই ভয়াবহ সময়ে, কেন্টাকির ছোট্ট শহর করবিন-এ এক মধ্যবয়সী মানুষ নিজের শেষ সাহসটুকু জড়ো করে নতুন করে শুরু করলেন জীবনের অধ্যায়—
তিনি হারল্যান্ড স্যান্ডার্স।
তার বয়স তখন ৪০ ছুঁই ছুঁই।অর্থ নেই, সম্পদ নেই, কিন্তু আছে একটিমাত্র বিশ্বাস - “যতক্ষণ আমি চেষ্টা করছি, ততক্ষণ আমি পরাজিত নই।”
তিনি একটি পুরনো তেল স্টেশন (Shell Service Station) ভাড়া নিলেন। সেখানে তিনি গাড়িতে তেল ভরার পাশাপাশি যাত্রীদের ছোটখাটো খাবার পরিবেশন করতে শুরু করলেন। চুলা, হাঁড়ি, আর একটিমাত্র প্যান—এই সামান্য উপকরণ দিয়েই শুরু হলো তার “রান্নার বিপ্লব”।
প্রথম দিনেই তিনি রান্না করলেন ফ্রায়েড চিকেন।
মুরগির টুকরো, ময়দা, লবণ, মরিচ আর কয়েকটা গোপন মশলার মিশ্রণ— এত সহজ জিনিসে এত স্বাদ তৈরি হবে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। দূর দূর থেকে ট্রাকচালকরা আসতে শুরু করল শুধুমাত্র “স্যান্ডার্সের চিকেন” খেতে।
একদিন, ১৯৩২ সালের এক সন্ধ্যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী এক গ্যাস স্টেশন মালিক তার দোকানের সামনে বিজ্ঞাপন টাঙাতে বাধা দিল। বিতর্ক এতটাই বেড়ে গেল যে একসময় বন্দুক বের হলো। সেই ঘটনায় এক ব্যক্তি নিহত হলো, আর স্যান্ডার্সের জীবনে এল ভয়ঙ্কর ধাক্কা। কিন্তু স্যান্ডার্স আবারও প্রমাণ করলেন,তিনি ভয় পান না। তিনি পিছু হটেন না।
তার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি স্থির থাকলেন।
তিনি গ্যাস স্টেশনের পাশেই একটি ছোট্ট ঘর বানালেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে রান্না করে যাত্রীদের খাওয়াতেন। তিনি হাসিমুখে বলতেন,
“এখানে শুধু পেট ভরানো নয়, মন ভরানোও হয়।”
তার এই মানবিকতা, আন্তরিকতা আর সুস্বাদু রান্না ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ১৯৩৫ সালের দিকে স্থানীয় সাংবাদিকরা তার দোকান নিয়ে প্রতিবেদন করতে শুরু করলেন। এমনকি কেন্টাকি রাজ্যের গভর্নর রুবি লাফুন তার রান্না খেয়ে এতই মুগ্ধ হলেন যে, স্যান্ডার্সকে দিলেন সম্মানসূচক উপাধি —
“কেন্টাকি কর্নেল”। এটাই সেই মুহূর্ত, যেখান থেকে “হারল্যান্ড স্যান্ডার্স” হয়ে গেলেন “কর্নেল স্যান্ডার্স”।
১৯৩৭ সালে, ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে স্যান্ডার্স নিজের রেস্টুরেন্ট খুললেন — “Sanders Café”। এটি ছিল করবিন শহরের এক কোণে, যেখানে প্রতি রাতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত শুধু এক বাটি চিকেন খেতে। তাঁর রেস্টুরেন্টে কোনো চাকচিক্য ছিল না, কিন্তু ছিল ঘরোয়া আন্তরিকতা, যত্ন, আর অনন্য স্বাদ।
তিনি প্রতিটি গ্রাহকের সাথে কথা বলতেন, হাসতেন, পরামর্শ নিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন —
“একটি ভালো খাবারের পেছনে শুধু রেসিপি নয়, দরকার ভালোবাসাও।” এই সময়েই তিনি তৈরি করলেন তার বিখ্যাত “১১টি হার্বস অ্যান্ড স্পাইসেসের গোপন রেসিপি” — যা আজও বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষিত ব্যবসায়িক রহস্যগুলোর একটি।
১৯৩৯ সালে, তার রেস্টুরেন্ট এত জনপ্রিয় হয়ে গেল যে গড়ে প্রতিদিন শত শত গ্রাহক আসত। তবে, একই বছরেই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এবং সাথে সাথে কমে গেল যাত্রী চলাচল।বিক্রি কমে গেল, ব্যবসা টলতে শুরু করল।
কিন্তু স্যান্ডার্স হাল ছাড়লেন না। তিনি নিজের গ্যারেজে দাঁড়িয়ে এক রাতে বলেছিলেন, “এই রান্নাই আমাকে বাঁচাবে, এই মুরগির স্বাদই একদিন আমায় চেনে দেবে পুরো পৃথিবিকে।”
সাফল্যের প্রথম ধাপ শুরু হয় সাহসী একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে।প্রতিকূল সময়ে যারা নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগায়, তারাই এগিয়ে যায়।ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও মানই শেষ পর্যন্ত ব্যবসার ভিত্তি।
১৯৫০ সালের শীতকাল। কেন্টাকির করবিন শহরে তখন হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। তবে ঠান্ডার চেয়েও কঠিন ছিল হারল্যান্ড স্যান্ডার্সের জীবনের সময়টা।
তার বয়স তখন ৬০ বছর। চুলে পাকা রূপালি রঙ, মুখে বয়সের রেখা, কিন্তু চোখে এখনো সেই একগুঁয়ে স্বপ্নের দীপ্তি।
কিন্তু ভাগ্য যেন শেষ আঘাতটা মারল এবারই। নতুন একটি হাইওয়ে (Interstate 75) তৈরি হলো—যা শহরের মাঝ দিয়ে নয়, বরং তার রেস্টুরেন্টের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ফলাফল? যে রেস্টুরেন্ট একসময় দিনে শত শত গ্রাহকে ভরপুর থাকত, সেখানে এখন প্রতিদিন খদ্দের আসে হাতে গোনা কয়েকজন।আয় বন্ধ। খরচ চলছে। ঋণ জমছে।
১৯৫২ সালে, স্যান্ডার্স বাধ্য হয়ে তার প্রিয় “Sanders Café” বিক্রি করে দিলেন। সবকিছু হারিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন রেস্টুরেন্টের সামনে— চোখে জল, হাতে একটি পুরনো প্রেসার কুকার, আর একটি নোটবুক যাতে লেখা তার গোপন রেসিপি।
তিনি চুপচাপ বললেন,“হয়তো আমার রেস্টুরেন্ট শেষ হয়েছে... কিন্তু আমার রেসিপি এখনো বেঁচে আছে। এটাই আমার অস্ত্র।”
১৯৫৫ সালের দিকে, যখন তার বয়স ৬৫ বছর, বেশিরভাগ মানুষ তখন অবসর নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনে চলে যায়।কিন্তু স্যান্ডার্স বললেন, “আমি এখনই শুরু করব। এই বয়সেই আমার সময়।”তিনি নিজের গাড়িতে রেসিপি ও কিছু তাজা মুরগির টুকরো নিয়ে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ঘুরতে লাগলেন। রাতে গাড়ির ভেতরেই ঘুমাতেন, দিনের বেলা এক রেস্টুরেন্ট থেকে আরেক রেস্টুরেন্টে যেতেন।
তিনি মালিককে বলতেন, “আমার রেসিপিতে একবার এই মুরগি ভেজে দেখুন, যদি ভালো না লাগে, আমি এখান থেকেই চলে যাব।” অনেকে হাসতো, কেউ দরজা বন্ধ করে দিত, কেউ উপহাস করত।
রাত তখন গভীর। বয়স ৬৫ ছুঁইছুঁই। অন্ধকার ঘরে একা বসে কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স ভাবছেন—
“এখন আর নতুন করে কিছু শুরু করার বয়স নেই…”।তার পেট্রোল পাম্প বন্ধ হয়ে গেছে, রেস্টুরেন্ট বিক্রি হয়ে গেছে, হাতে সামান্য কয়েক ডলার,আর জীবনজুড়ে জমে থাকা হতাশা।
কিন্তু তার মাথায় তখনও একটাই চিন্তা ঘুরছে— তার গোপন চিকেন রেসিপি।এটা সেই রেসিপি, যা তিনি বছরের পর বছর ধরে বানিয়েছেন, শতবার পরিবর্তন করেছেন। আর শেষে পেয়েছেন এমন এক স্বাদ, যা খেলে কেউ ভুলতে পারবে না।
১৯৫৫ সালের এক সকালে, স্যান্ডার্স তার পুরনো গাড়িতে (একটি সাদা ফোর্ড) ব্যাগ ভরে নিলেন ময়দা, মশলা, আর তার রেসিপির কাগজ। তিনি স্থির করলেন, “আমি এই রেসিপি বিক্রি করব রেস্টুরেন্টগুলোর কাছে।তারা আমার মতো করে রান্না করবে, আর বিক্রি হলে আমি সামান্য কমিশন নেব।”
এই ভাবনাই ছিল “Kentucky Fried Chicken”-এর সূচনা বিন্দু—যদিও তখন কেউই সেটিকে গুরুত্ব দেয়নি।
তিনি গাড়ি চালিয়ে গেলেন শহর থেকে শহরে, রাজ্য থেকে রাজ্যে।প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে বলতেন— “আমি এক বিশেষ চিকেন রেসিপি এনেছি। একবার চেষ্টা করে দেখুন।”কিন্তু প্রায় সবাই হেসে বলত— “বাবা, আমরা নিজেরাই রান্না করি। তোমার রেসিপি লাগবে না।”
কেউ কেউ বিনয়ের সঙ্গে না করত, আবার কেউ কেউ সরাসরি দরজা বন্ধ করে দিত মুখের ওপর। তিনি পরের শহরে যেতেন, আবার চেষ্টা করতেন।
এভাবেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়… শততম রেস্টুরেন্টেও ব্যর্থ হলেন।কিন্তু তিনি থামলেন না।এক এক করে সংখ্যা বাড়ল… ৫০০, ৭০০, ৮০০ বার প্রত্যাখ্যান
তার বয়স বাড়ছিল, গাড়িটা প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল,
কিন্তু তিনি প্রতিদিন ভোরে রওনা দিতেন। কখনও হোটেলের বারান্দায় ঘুমাতেন, কখনও গাড়ির ভেতরেই রাত কাটাতেন। তিনি জানতেন- “একবার কেউ হ্যাঁ বললেই সব বদলে যাবে।”
প্রতিটি “না” শুনে তিনি বলতেন, “ঠিক আছে, আপনি না বললেন, আমি পরের জনের কাছে যাব।” ১০০৯তম চেষ্টায় ও ব্যর্থ।অবশেষে উটাহ (Utah) অঙ্গরাজ্যের এক ছোট রেস্টুরেন্ট মালিক তার রেসিপিটি চেষ্টা করতে রাজি হলেন। তিনি নিজেই রান্না করলেন সেই চিকেন,আর প্রথম কামড়েই অবাক হয়ে বললেন—“বাহ! এই স্বাদ তো অনন্য! আমি এটা আমার দোকানে বিক্রি করব!”
এই মুহূর্তেই জন্ম নিল Kentucky Fried Chicken (KFC) ব্র্যান্ডের প্রথম অনুমোদিত ফ্র্যাঞ্চাইজি।এরপর একের পর এক রেস্টুরেন্ট যোগ হতে থাকল।কয়েক বছরের মধ্যেই সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ল স্যান্ডার্সের চিকেন সাম্রাজ্য।
বয়স যখন ৭৩, তখন তিনি তার KFC ব্যবসা বিক্রি করেন প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার মূল্যে, যা সেই সময়ে ছিল এক বিশাল অঙ্ক। কিন্তু তিনি কখনও ব্যবসা থেকে দূরে যাননি— তার সাদা স্যুট, কালো টাই, আর হাসিমুখ হয়ে উঠেছিল KFC-এর প্রতীক।
১০০৯ বার ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং সাফল্যের আগের দরজাগুলো।স্যান্ডার্স দেখিয়েছেন, বয়স, দারিদ্র্য বা প্রত্যাখ্যান—কোনোটাই বাধা নয়,
যদি তোমার বিশ্বাস অটল থাকে নিজের স্বপ্নে।তিনি প্রমাণ করেছেন, “সফলতার চাবি হচ্ছে চেষ্টা—আর চেষ্টা থেমে গেলে স্বপ্নও থেমে যায়।”
এভাবেই তিনি শুরু করলেন KFC (Kentucky Fried Chicken)-এর প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসা।
১৯৫২ সালে ইউটাহ রাজ্যের পিট হারমান নামের এক রেস্টুরেন্ট মালিক প্রথম তার রেসিপি ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করলেন।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল এই ব্র্যান্ড।
মাত্র ৮ বছর পর—১৯৬০ সালের দিকে, পুরো আমেরিকা জুড়ে তার ২০০টিরও বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি হয়ে গেল! লোকজন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকত “Finger Lickin’ Good” চিকেন খাওয়ার জন্য।
কর্নেল স্যান্ডার্স তখন নিজেই এক কিংবদন্তি। তার সাদা স্যুট, কালো টাই, আর হাসিমাখা মুখ হয়ে উঠল সাফল্যের প্রতীক।
তবে এর পেছনে ছিল অকল্পনীয় পরিশ্রম ও ত্যাগ।
প্রায় ১,০০৯ বার তিনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, তিনি ১,০০৯ বার ব্যর্থ হয়েছিলেন—কিন্তু ১,০১০তম বার সফল হলেন!এই অধ্যায়ের প্রতিটি মুহূর্ত যেন প্রমাণ করে—
ব্যর্থতা যত বড়ই হোক, মনোবল যদি অটুট থাকে, সাফল্য একদিন না একদিন দরজায় কড়া নাড়বেই।
১৯৬৪ সালে, যখন তার বয়স ৭৪ বছর, KFC এত বড় হয়ে গিয়েছিল যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগকারী আগ্রহ দেখাতে লাগল। অবশেষে তিনি তার কোম্পানি বিক্রি করলেন ২ মিলিয়ন ডলারে,তবে নিজের ছবি ও মুখের অধিকার রেখে দিলেন,কারণ তিনি বলেছিলেন— “আমি আর হয়তো কোম্পানির মালিক নই, কিন্তু এই হাসিমুখটাই তার আত্মা।”
বাকি জীবন তিনি হয়ে উঠলেন KFC-এর প্রতীক,
যে হাসিমুখ এখন প্রতিটি দোকানের লোগোতে দেখা যায়।১৯৬৫ সালের দিকে তার KFC ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া— সবখানে।
একজন বৃদ্ধ, যিনি জীবনে একশোবার ব্যর্থ হয়েছিলেন, শেষ বয়সে হয়ে উঠলেন এক বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের মুখ ও প্রেরণা।ব্যর্থতা যতবারই আসুক, যদি মনোবল অটুট থাকে, সাফল্য অনিবার্য। বয়স কোনো বাধা নয়; যে মন চায়, সেই মনই ইতিহাস লিখে।সত্যিকারের ফিনিক্স পাখি হলো সেই মানুষ, যে বারবার পড়ে গিয়ে আগুন থেকে নিজেকে নতুন করে তৈরি করে নেয়।
১৯৬৫ সালের এক সকালে, কর্নেল স্যান্ডার্স সাদা স্যুট পরে আয়নায় তাকিয়ে হেসে বললেন, “আমি হারিনি, আমি শুধু অনেকবার শিখেছি।” আর আয়নার সেই প্রতিফলনে দেখা যাচ্ছিল—
একজন মানুষ নয়, এক জীবন্ত কিংবদন্তি,
যিনি প্রমাণ করেছেন, ফিনিক্স আগুনেই জন্ম নেয়।
১৯৬৫ সাল। বিশ্ব তখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে—চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি, প্রযুক্তির বিপ্লব, নতুন চিন্তার যুগ।
আর এই সময়েই, এক সাদা পোশাক পরা বৃদ্ধ তার অনন্য হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেএফসি রেস্টুরেন্টের সামনে, মাথা উঁচু করে বলছেন—
“আমি যা করেছি, তা শুধু একটি মুরগি ভাজার রেসিপি নয়; এটি মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখার গল্প।”
তিনি আর কেবল কর্নেল স্যান্ডার্স নন, তিনি হয়ে উঠেছেন সফলতার জীবন্ত প্রতীক, একজন মানুষ যিনি প্রমাণ করেছেন — “জীবন শুরু হয়, যখন সবাই ভাবে সব শেষ।”
১৯৬৬ সালের দিকে, KFC আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল কানাডা, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো ও অস্ট্রেলিয়ায়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে KFC হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল রেস্টুরেন্ট চেইন।যে বৃদ্ধ একসময় নিজের গাড়িতে ঘুমাতেন, আজ তার মুখের লোগো ঝুলছে হাজার হাজার রেস্টুরেন্টে, শহরের ব্যস্ততম রাস্তায়।আর তার নাম হয়ে গেছে “গুণমান ও পরিশ্রমের প্রতীক”।
১৯৬৭ সালে, KFC-এর ফ্র্যাঞ্চাইজি সংখ্যা ছাড়াল ৬০০। ১৯৭০ সালের মধ্যে, সেই সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৩,০০০! প্রতিদিন লাখো মানুষ তার তৈরি সেই গোপন “১১টি মশলার রেসিপি”র স্বাদ নিচ্ছে।তিনি প্রায়ই বলতেন—“আমি ধনী হতে চাইনি, আমি শুধু এমন এক খাবার তৈরি করতে চেয়েছিলাম যা মানুষকে সুখী করবে।”
৭৫ বছর বয়সেও তিনি বিশ্রাম নেননি।প্রতিদিন সাদা স্যুট পরে দেশ-বিদেশে যেতেন, নতুন রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করতেন, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতেন,
আর সর্বত্র বলতেন—“যা করো, মন দিয়ে করো। নইলে সেটি শুধু কাজ, সৃষ্টিকর্ম নয়।”তিনি এমনভাবে অনুপ্রাণিত করতেন কর্মীদের, যে অনেকেই বলতেন, “কর্নেল শুধু ব্যবসায়ী নন, তিনি এক শিক্ষক।”
১৯৭৬ সালে, মার্কিন ম্যাগাজিন “The Gallup International” তাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক পরিচিত মুখ হিসেবে ঘোষণা করে (প্রথম ছিলেন এলভিস প্রেসলি)।এটাই ছিল তার জনপ্রিয়তার শিখর— একজন বৃদ্ধ, যিনি কোনো চলচ্চিত্র তারকা নন, রাজনীতিবিদ নন, তবু সারা পৃথিবী তাকে চিনে তার সাদা দাড়ি ও হাসি দিয়ে।
১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাস। কর্নেল স্যান্ডার্স তখন ৯০ বছর বয়সে। তিনি অসুস্থ, তবু মনটা এখনো তরুণের মতো উচ্ছ্বসিত। একদিন তিনি বললেন এক সাংবাদিককে, “আমি যখন যাব, তখন চাই না মানুষ বলুক আমি ধনী ছিলাম। আমি চাই তারা বলুক— আমি চেষ্টা করেছিলাম।”
১৬ ডিসেম্বর ১৯৮০, তিনি শান্তভাবে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। কিন্তু তার হাসি, তার সাদা স্যুট, তার রেসিপি — সবকিছু রয়ে গেল ইতিহাসে।তার মৃত্যুর পরও, KFC থেমে থাকেনি। আজ তার রেস্টুরেন্ট ছড়িয়ে আছে ১৫০টিরও বেশি দেশে,প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি মানুষ তার তৈরি খাবারের স্বাদ নিচ্ছে। আর প্রতিটি প্যাকেট, প্রতিটি দোকানের লোগোতে যেন এখনো সেই বার্তা লেখা— “Keep trying. Never give up.”
কর্নেল স্যান্ডার্সের জীবন একটাই শিক্ষা দেয়—ব্যর্থতা আসলে আমাদের পরাজিত করে না,আমরা পরাজিত হই যখন হাল ছেড়ে দিই।তিনি শতবার ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েননি। ৬৫ বছর বয়সে আবার শুরু করেছিলেন।আর প্রমাণ করেছিলেন—“জীবনের শেষ বয়স নয়, শেষ আশা-ই মানুষের প্রকৃত মৃত্যু।”আজও তার গল্প মানুষকে শেখায়,যে কোনো স্বপ্নই বড় নয় যদি হৃদয়ে আগুন থাকে,যদি বিশ্বাস থাকে নিজের হাতে।
ব্যর্থতার ছাই থেকে জন্ম নেয় সাফল্যের আগুন,
আর সেই আগুনেই তৈরি হয় মানুষ, যেমন তৈরি হয়েছিল— কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স, KFC-এর অমর প্রতীক।
কর্নেল স্যান্ডার্সের জীবন আমাদের শেখায়—বয়স কোনো বাধা নয়, যদি মন জ্বলন্ত থাকে। ব্যর্থতা কখনও শেষ নয়, বরং নতুন শুরু। সাফল্য তাদেরই হয়, যারা ১০০৯ বার না শুনেও ১০১০তম বার চেষ্টা করতে ভয় পায় না। একজন বৃদ্ধ মানুষ, হাতে মশলার ব্যাগ আর মুখে হাসি নিয়ে, ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন তার স্বপ্ন — আজ সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে আছে ১৫০টিরও বেশি দেশে, হাজার হাজার KFC রেস্টুরেন্টে।এটাই তো সত্যিকারের অনুপ্রেরণার গল্প — ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের অগ্নিশিখা।