মানবতার ডাক: মাদার তেরেসার সেবার গল্প

18 Oct 2025 11:23:48 PM

মানবতার ডাক: মাদার তেরেসার সেবার গল্প

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

 

১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। বালকান উপদ্বীপের ছোট্ট শহর স্কোপিয়ে—সেই সময় এটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। গ্রীষ্মের ভোরে সূর্যের আলো ছুঁয়ে যায় লাল টালির ছাদগুলো, মসজিদ ও গির্জার ঘণ্টাধ্বনি একসাথে মিশে যায় বাতাসে। সেই শান্ত শহরেই জন্ম নিল এক কন্যাশিশু—অ্যাগনেস গনজা বোজাহিউ।“গনজা” শব্দটার অর্থই হলো ফুল। সত্যিই, যেন এক কোমল ফুল ফুটে উঠল মানবতার বাগানে।

তাঁর বাবা নিকোলা বোজাহিউ ছিলেন এক উদ্যমী ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক, আর মা দ্রানাফিলে ছিলেন গভীর ধর্মপ্রাণ ও সহানুভূতিশীল নারী। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে গনজা ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা থেকেই তাঁর চোখে ছিল জিজ্ঞাসার আলো—কেন কেউ খেতে পায় না, কেন কেউ রাস্তায় ঘুমায়?

এক সন্ধ্যায়, দরজার কাছে এক ভিখারির কড়া নাড়ার শব্দে মা দ্রানাফিলে তৎক্ষণাৎ রান্না ঘর থেকে খাবার এনে তাঁকে দিলেন। গনজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মা, আমরা তো অনেক গরিব, তবুও তুমি কেন ওকে দিলে?” মা মৃদু হেসে বললেন, “আমরা যতটুকু পেয়েছি, তা ঈশ্বরের দান। সেই দান ভাগ করে দিলে তবেই ঈশ্বর খুশি হন।”সেই কথাগুলো গনজার মনে গেঁথে গেল চিরদিনের মতো।

স্কোপিয়ে শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে করতে গনজা হয়ে উঠলেন বুদ্ধিমতী ও নরম হৃদয়ের এক মেয়ে। গির্জার সংগীত দল “কোয়ার”-এ তাঁর কণ্ঠ ছিল সবার প্রিয়। প্রার্থনা শেষে তিনি প্রায়ই বলতেন—“আমি বড় হয়ে ঈশ্বরের জন্য কাজ করব।”

বাবা নিকোলা ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। তিনি প্রায়ই গরিবদের জন্য অর্থ সাহায্য করতেন, সভায় বক্তৃতা দিতেন—“নিজের সুখ নয়, মানুষের সুখের জন্য বাঁচো।” কিন্তু ১৯১৯ সালে, গনজার বয়স তখন মাত্র ৮, হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন বাবা।
সেদিন থেকে ছোট্ট গনজার জীবনে নেমে এলো এক গভীর ছায়া।

তবু মা তাঁকে ভেঙে পড়তে দিলেন না।
প্রতি রাতে তাঁরা প্রার্থনা করতেন, আর মা বলতেন— “যে কষ্ট পায়, সে-ই বোঝে অন্যের কষ্ট।”

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গনজার মনে বাড়তে লাগল এক অদ্ভুত টান—তিনি বুঝতেন না কেন দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের দেখলে তাঁর বুক ভার হয়ে যায়। গির্জার পাদ্রী একদিন বললেন, “ঈশ্বরের কাজ শুধু গির্জায় হয় না, মানুষের সেবাতেও হয়।” এই কথাগুলো যেন আগুনের মতো জ্বেলে দিল তাঁর অন্তরকে।

১৯২৮ সাল। গনজার বয়স তখন ১৮।
একদিন তিনি মায়ের কাছে এসে বললেন,“মা, আমি সবকিছু ছেড়ে ঈশ্বরের পথে যাব। আমি মিশনারি হবো।”মায়ের চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। তিনি শুধু বললেন— “যাও মা, যদি ঈশ্বর তোমাকে ডাকেন, তবে তাঁর সেবাই তোমার পথ।”

সেপ্টেম্বর মাসে গনজা স্কোপিয়ে ছেড়ে পাড়ি দিলেন দূর আয়ারল্যান্ডের লরেটো কনভেন্টে, যেখানে তিনি নতুন জীবন শুরু করবেন এক সন্ন্যাসিনী হিসেবে।
রেলস্টেশনে মা তাঁর হাতে একটি ছোট ক্রুশ ও রুটি তুলে দিয়ে বললেন, “মনে রেখো, গনজা, তুমি যদি কখনো কষ্ট পাও, মানুষের দিকে তাকিও—তাঁদের চোখেই ঈশ্বর আছেন।”

ট্রেন যখন ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, গনজা জানালার পাশে বসে দেখছিলেন মায়ের মুখ।
অজানা ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু হলো এক তরুণীর, যিনি একদিন হয়ে উঠবেন বিশ্বের মানবতার প্রতীক—মাদার তেরেসা।

১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক ঠান্ডা সকাল।
অ্যাগনেস গনজা বোজাহিউ, মাত্র ১৮ বছরের এক তরুণী, নিজের শহর স্কোপিয়ে ছেড়ে পাড়ি দিলেন দূর আয়ারল্যান্ডের পথে। তাঁর চোখে জল, কিন্তু হৃদয়ে ছিল দৃঢ় এক বিশ্বাস—“ঈশ্বর আমাকে কোনো এক বিশেষ কাজের জন্য ডাকছেন।”

ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কুয়াশায় ঢাকা শহর, মায়ের মুখটা ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। হাতে ছিল ছোট্ট একটি ক্রুশ, যা মা দিয়েছিলেন—“কখনো ভয় পেও না, ঈশ্বর সবসময় তোমার সঙ্গে।”

লরেটো সিস্টার্স কনভেন্টে পৌঁছে গনজা পেলেন এক ভিন্ন জগৎ। নিঃশব্দ প্রার্থনা, নিয়মতান্ত্রিক জীবন, এবং একটানা শিক্ষা। সেখানে তিনি ইংরেজি শেখেন, কারণ তাঁকে পাঠানো হবে ভারতের মিশনে—সেই সময় ভারত ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে।

সন্ন্যাস জীবনের প্রথম দিনে তাঁকে দেওয়া হলো নতুন নাম— “সিস্টার তেরেসা”, সেন্ট তেরেসা অব লিসিউ-এর নাম অনুসারে, যিনি ছোট কাজের মাধ্যমে বড় ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
গনজা নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন— “আমি আজ থেকে ঈশ্বরের মানুষ হয়ে গেলাম। আমি চাই, আমার প্রতিটি হাসি মানুষের দুঃখ কমিয়ে দিক।”

১৯২৮ সালের শেষ ভাগ। ইউরোপে তখন শীতের কুয়াশা নেমে এসেছে। আয়ারল্যান্ডের লরেটো কনভেন্টের নীরব প্রার্থনাঘরে সিস্টার তেরেসা হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন, দু’হাত জোড় করে। তাঁর সামনে জ্বলছে একটি ছোট মোমবাতি—তার আলোয় চোখেমুখে দেখা যাচ্ছিল এক গভীর দৃঢ়তা।

তিনি জানতেন, আগামীকাল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় যাত্রা শুরু হবে—ঈশ্বরের সেবার পথে, ভারতের কলকাতার উদ্দেশ্যে।

পরদিন সকালে, ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের এক ঠান্ডা দিনে, তিনি উঠলেন সেই জাহাজে যা আয়ারল্যান্ড থেকে ছেড়ে যাবে বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে। জাহাজের নাম ছিল SS Victoria.  যাত্রার সময় কনভেন্টের অন্য সিস্টাররা তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিল। কেউ কান্না চেপে রেখেছিল, কেউ হাসছিল মৃদু করে।
সিস্টার তেরেসা তাদের বললেন—“আমার জন্য দোয়া করো। আমি জানি না, সামনে কী অপেক্ষা করছে, তবে ঈশ্বরই আমার দিশা।”

জাহাজের বাঁশি বাজল—গভীর এক শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল। সিস্টার তেরেসা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন, ইউরোপের পরিচিত উপকূল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে নীল জলে। তাঁর চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে প্রার্থনা— “হে ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দাও, যেন আমি তোমার ভালোবাসা নিয়ে পৌঁছাতে পারি কষ্টে থাকা মানুষদের মাঝে।”

সমুদ্রযাত্রা ছিল দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। আয়ারল্যান্ড থেকে জিব্রালটার, তারপর ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে মিশরের সুয়েজ খাল, তারপর ভারত মহাসাগর।  দিনের পর দিন শুধু পানি আর আকাশ। রাতে তিনি ডেকে বসে তারা দেখতেন, লিখতেন নিজের ডায়েরিতে— “এই তারার নিচেই কোথাও আছে আমার নতুন ঘর, আমার নতুন জীবন।”

জাহাজের ছোট্ট চ্যাপেলে তিনি প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন। অনেক সময় সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতেন, তাঁদের উৎসাহ দিতেন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে।  একদিন এক বৃদ্ধ যাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করল,“আপনি এমন দূর দেশে যাচ্ছেন কেন, সিস্টার?” তেরেসা শান্তভাবে উত্তর দিলেন—
“কারণ আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের ভালোবাসা পৌঁছাতে হবে প্রতিটি মানুষের কাছে—বিশেষ করে যারা সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে।”

প্রায় এক মাসের যাত্রার পর, ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে, ভোরের আলো ফুঁড়ে জাহাজ ভিড়ল ভারতের কলকাতার বন্দরে।

জাহাজ থেকে নামতেই তেরেসার চোখে ধরা দিল এক সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবী—  গরম বাতাস, রিকশার ঝনঝন শব্দ, গরুর গাড়ি, রাস্তার ধারে ভিক্ষুক, আর এক অদ্ভুত গন্ধে মিশে থাকা দুঃখ ও জীবনের লড়াই। এই অচেনা শহরটা যেন তাঁকে ডাকছিল, বলছিল— “এসো, এখানে তোমার কাজ শুরু হবে।”

তেরেসা গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন—“হে ঈশ্বর, আমি এসে গেছি। এখন তুমি আমাকে পথ দেখাও।”

সেদিন থেকেই শুরু হলো এক জীবনের দীর্ঘতম ও পবিত্রতম যাত্রা, যা তাঁকে বানাবে পৃথিবীর মানবতার মা—মাদার তেরেসা।

১৯২৯ সালের শীতল জানুয়ারির সকাল। কুয়াশা ভেদ করে সিস্টার তেরেসার গাড়ি ঢুকল কলকাতার এন্টালি এলাকার লরেটো কনভেন্ট স্কুলে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমবার দেখলেন স্কুলের উঠোন—গাছপালায় ঘেরা, শিশুরা ইউনিফর্ম পরে হাসছে, দৌড়াচ্ছে। তাঁর মুখে ফুটল এক মৃদু হাসি।“এই হাসিগুলোই আমার আশীর্বাদ,”
নিজের মনে বললেন তিনি।

কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে পাঠানো হলো শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত সেন্ট মেরি হাই স্কুলে, যেখানে তিনি শিক্ষকতা করবেন পূর্ণকালীনভাবে।এটি ছিল ধনী ইউরোপীয় এবং বাঙালি মেয়েদের একটি নামী স্কুল। এখানেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষকতা জীবন— এক নিরহঙ্কার, কিন্তু গভীর ভালোবাসায় ভরা সময়।

স্কুলে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনেই তিনি ক্লাসে প্রবেশ করলেন নিঃশব্দে।ছাত্রীরা একটু অবাক হয়ে তাকাল সেই বিদেশি সন্ন্যাসিনীর দিকে—সাদা পোশাক, গলায় ক্রুশ, চোখে গভীর মমতা। তিনি বোর্ডে লিখলেন বড় অক্ষরে:

“LOVE ONE ANOTHER.”
তারপর বললেন মৃদু স্বরে, “আজ থেকে আমরা শুধু বই নয়, ভালোবাসাও শিখব।”শিক্ষক হিসেবে সিস্টার তেরেসা ছিলেন কঠোর অথচ স্নেহময়।


তিনি ছাত্রীদের শুধু পাঠ্যপুস্তক শেখাতেন না— শিখাতেন কীভাবে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হয়, কষ্টে থাকা মানুষকে সাহায্য করতে হয়। একদিন তিনি স্কুলের মেয়েদের বললেন—“তোমরা যদি সত্যিই ঈশ্বরকে ভালোবাসো, তবে তোমাদের চারপাশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাও। সেখানেই ঈশ্বর থাকেন।”

তবে স্কুলের সুরক্ষিত দেয়ালের বাইরে ছিল এক সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী।কলকাতার রাস্তায় তিনি প্রতিদিন দেখতেন—শিশুরা খালি পায়ে ঘুরছে, কেউ খাবারের জন্য কাঁদছে, কেউ আবার অসুস্থ হয়ে ফুটপাথে পড়ে আছে।

একদিন ক্লাস শেষে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছিলেন, রাস্তার পাশে এক বাচ্চা মেয়েকে তার মা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে—মেয়েটি কাঁদছে, মায়ের চোখে ক্লান্তি।


সেই দৃশ্য দেখে সিস্টার তেরেসার বুক ভার হয়ে উঠল।তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখলেন—“আমি যে শহরে এসেছি, তার রাস্তায় ঈশ্বর কাঁদছেন—মানুষের রূপে।”তখন থেকেই তাঁর হৃদয়ে জন্ম নিতে লাগল এক নতুন বীজ—মানবসেবার আহ্বান।

বছর গড়াল। সেন্ট মেরি স্কুলের ছাত্রীরা তাঁকে ভালোবেসে ডাকত “মা তেরেসা”—যদিও তখনও কেউ জানত না, একদিন সত্যিই তিনি হয়ে উঠবেন “Mother Teresa”।ছাত্রীরা বলত,“সিস্টার তেরেসা শুধু আমাদের পড়ান না, আমাদের ভালোবাসেন।”

তাঁর ক্লাসে বইয়ের পাশাপাশি চলত জীবনের পাঠ।
একদিন এক ছাত্রী স্কুলে না আসায় তিনি নিজে গিয়ে তার বাড়ি খোঁজ নিলেন—দেখলেন, মেয়েটির মা অসুস্থ, ঘরে খাবার নেই।তেরেসা নিজের খাবার ভাগ করে দিলেন তাদের সঙ্গে।সেই দিন থেকে স্কুলের মেয়েরা শিখল—সত্যিকার শিক্ষা শুধু বইয়ের মধ্যে নয়, মানুষের মাঝে।


তবু সেই বিশৃঙ্খলার মাঝেও সেন্ট মেরি স্কুলে প্রতিদিন সকালবেলা ঘণ্টা বাজে, আর ক্লাসে দাঁড়িয়ে সিস্টার তেরেসা শান্ত কণ্ঠে বলেন—“প্রেম ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।”তিনি তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। শৃঙ্খলা, দায়িত্ব ও প্রার্থনায় ভরা এক নিয়মিত জীবন।


তবুও তাঁর হৃদয়ের গভীরে যেন কিছু একটা নড়াচড়া করছিল।প্রতিদিন জানালার বাইরে তাকালে তিনি দেখতেন—দারিদ্র্যের পাহাড়, অনাহারী শিশু, আর অসহায় বৃদ্ধদের মুখ। কখনো মনে হতো, তাঁর আসল কাজ হয়তো এই স্কুলের দেয়ালের ভেতরে নয়—বরং দেয়ালের ওপারে, জীবনের রাস্তায়।

১৯৪০ সালের দিকে তাঁর মধ্যে এক গভীর সংগ্রাম শুরু হয়।তিনি বুঝতে পারছিলেন, কনভেন্টের আরামদায়ক দেয়ালের ভেতর থেকে তিনি প্রকৃত দুঃখের মুখোমুখি হচ্ছেন না।তাঁর মন বলত— “ঈশ্বর তো ওই রাস্তাতেই আছেন, যেখানে কষ্ট আছে, ক্ষুধা আছে, মৃত্যু আছে।”

এই সময়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৪৩ সালের বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তাঁকে নাড়িয়ে দেয়।
কলকাতার রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মরছে, শিশুদের দেহ পড়ে আছে রেলস্টেশনে— এই দৃশ্য তেরেসার হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়।
তিনি অনুভব করেন, এখন তাঁর জীবনকে নতুন দিকে নিতে হবে।

১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস।
ভারতের স্বাধীনতার এক বছর আগে। দেশজুড়ে অস্থির সময়—রাজনীতি, বিভাজন, দাঙ্গা আর মানুষের চোখে ভয়।

১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর।দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে যাচ্ছিলেন সিস্টার তেরেসা—বার্ষিক রিট্রিটে অংশ নিতে।বিকেলের ট্রেন, জানালার বাইরে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা, মাঝে মাঝে ঝড়ের হাওয়া এসে লাগছে মুখে।


ট্রেনের ছন্দে তিনি প্রার্থনায় ডুবে ছিলেন। হঠাৎ যেন তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে এক অজানা কণ্ঠ শোনা গেল—“তেরেসা, তোমাকে স্কুলে নয়, দরিদ্রদের মাঝে পাঠিয়েছি।আমার সন্তানরা রাস্তায় কাঁদছে, তারা অসহায়, তারা একা। তুমি কি তাদের কাছে যাবে না?”

তিনি বিস্ময়ে চোখ খুললেন। চারপাশে কেউ নেই, শুধু ট্রেনের শব্দ আর বাতাসের গর্জন। তবু সেই কণ্ঠ তাঁর মনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।তিনি চুপচাপ মাথা নিচু করে বললেন,“হে ঈশ্বর, যদি এটা তোমার ইচ্ছা হয়, তবে আমি যাবো। আমাকে সাহস দাও।”

সেই মুহূর্তে তাঁর জীবন যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।
তিনি পরে বলেছিলেন—“সেই দিন আমি বুঝেছিলাম, এটি ছিল এক ডাকের ভেতর আরেক ডাক— ‘The Call Within The Call.’ঈশ্বর আমাকে বলেছিলেন, স্কুলের চাকরি ছাড়ো, রাস্তায় যাও, এবং সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের সেবা করো।”

ফিরে এসে তিনি কয়েকদিন নিঃশব্দে কাটালেন প্রার্থনায়, আত্মসমীক্ষায়।সহকর্মীরা লক্ষ্য করলেন, তিনি আগের মতো নন—চোখে আছে গভীর এক শান্তি, কিন্তু মুখে এক সিদ্ধান্তের ছাপ।প্রার্থনার সময় তিনি প্রায়ই কাঁদতেন। ডায়েরিতে লিখলেন—“আমি জানি, আমাকে কঠিন পথে হাঁটতে হবে, কিন্তু আমি একা নই। ঈশ্বর আমার সঙ্গে আছেন।”

তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না।
তিনি জানতেন, কনভেন্ট ছেড়ে গেলে তাঁকে একা লড়তে হবে— বসবাস, খাবার, নিরাপত্তা—কিছুই থাকবে না নিশ্চিত।তবু তাঁর অন্তরের সেই আহ্বান তাঁকে আর শান্তিতে থাকতে দিল না।

এক রাতে প্রার্থনা শেষে তিনি ক্রুশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—“প্রভু, আমি তোমার সন্তানদের কাছে যেতে চাই।আমার যা কিছু আছে, সব তোমাকে দিলাম।”

সেদিন থেকেই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন— নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য, কষ্টে থাকা মানুষদের সেবার জন্য।

 

সেন্ট মেরি স্কুলের শিক্ষকতা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম অধ্যায়— যেখানে তিনি ভালোবাসা শেখালেন, মানবতার পাঠ দিলেন, আর নিজেও শিখলেন সত্যিকারের সেবা মানে কী।

কিন্তু ঈশ্বরের সেই “নীরব ডাক” তাঁকে থামতে দিল না। তিনি জানতেন, তাঁর আসল মিশন স্কুলের দেয়ালের বাইরে— কলকাতার বস্তিতে, রাস্তায়, মানুষের চোখের জলে।এভাবেই শুরু হলো তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়— মানবতার পথে এক সন্ন্যাসিনীর যাত্রা।

কলকাতার তীব্র গরম, ধুলোবালি, কোলাহল— সব কিছুর মাঝেও সিস্টার তেরেসা ছিলেন শান্ত, হাসিমুখে পরিশ্রমী। ছাত্রীদের পড়াতেন ইংরেজি ও ভূগোল, কিন্তু তাঁর পাঠ শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না।
তিনি তাঁদের শিখাতেন করুণা, সহানুভূতি, ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। অনেক সময় তিনি বলতেন—“যদি তুমি কোনো কাজ ভালোবাসা দিয়ে করো, তবে সেটিই প্রার্থনা।”

ছাত্রীরা তাঁকে ভালোবাসত, কারণ তিনি কখনো রাগ করতেন না; বরং প্রতিটি ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখতেন।

কিন্তু ধীরে ধীরে তেরেসার মন অস্থির হতে থাকে।
তিনি দেখতেন, স্কুলের উঁচু প্রাচীরের ওপারে রয়েছে অন্য এক কলকাতা— যেখানে শিশুরা না খেয়ে থাকে, রাস্তায় মরে যায় অসহায় মানুষ, রোগীরা পড়ে থাকে ফুটপাথে চিকিৎসাহীন অবস্থায়।
স্কুলের পর তিনি অনেক সময় জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরে, যেন ওই দুঃখী মুখগুলো তাঁর অন্তরে কাঁপন তুলত।

একদিন তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন:“ঈশ্বর আমাকে সুখী করেছে, কিন্তু আমার সুখ অসম্পূর্ণ। যতক্ষণ না আমি এই কষ্টে ভরা মানুষগুলোর জন্য কিছু করি, ততক্ষণ শান্তি পাব না।”

”তারপর থেকেই শুরু হয় তাঁর গভীর প্রস্তুতি। তিনি রোমে ও কলকাতায় লিখিত অনুমতি চান— কনভেন্টের বাইরে গিয়ে কাজ করার জন্য।দুই বছরের প্রার্থনা ও ধৈর্যের পর অবশেষে ১৯৪৮ সালে তাঁর আবেদন অনুমোদিত হয়।

১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট। সেদিন তেরেসা লোরেটো কনভেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন— হাতে ছোট একটি ব্যাগ, গায়ে সাধারণ নীলপাড় সাদা শাড়ি, যা পরবর্তীতে “মিশনারিজ অব চ্যারিটি”-র পোশাক হিসেবে পরিচিত হয়।তিনি তখন একা, অথচ সাহসী। তাঁর গন্তব্য — কলকাতার বস্তি ও রেলস্টেশন।
সেই দিন থেকেই শুরু হয় এক অসাধারণ সেবাযাত্রা, যা পৃথিবীকে শেখায়— মানবতা মানেই ঈশ্বরের আরেক রূপ।

১৯৪৮ সালের আগস্ট মাস। কলকাতার গরম ও ধুলোয় ভরা দুপুর। লোরেটো কনভেন্টের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিস্টার তেরেসা— এখন আর তিনি সন্ন্যাসব্রতী শিক্ষিকা নন, বরং একা এক সেবিকা, একা এক যাত্রী, ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসরণে।
তাঁর পরনে সাধারণ নীলপাড় সাদা শাড়ি, গলায় ছোট্ট ক্রুশ, হাতে একটি ব্যাগে ছিল শুধু কয়েকটি কাপড়, একটি নোটবুক, এবং প্রার্থনার বই।
কনভেন্টের দরজা পেছনে বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়— মানবতার ময়দানে ঈশ্বরের সন্ধান।

তিনি বলেছিলেন—“আমি ঈশ্বরকে খুঁজব না গির্জার দেয়ালের ভেতরে, আমি তাঁকে খুঁজব রাস্তায়, গলিতে, অসহায়দের চোখে।”

তেরেসা প্রথমে আশ্রয় নিলেন কলকাতার মোটিজিল বস্তিতে, যেখানে কাদা, দুর্গন্ধ আর রোগই ছিল নিত্যসঙ্গী। তিনি শুরু করলেন দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা দেওয়া— মাটিতে বসে, কোনো ব্ল্যাকবোর্ড বা বই ছাড়াই।একদিন একটি শিশুকে তিনি আঙুল দিয়ে বালিতে ‘A’ অক্ষর শেখাচ্ছিলেন। কেউ পাশ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, — “সিস্টার, এইভাবে কি স্কুল হয়?”তিনি মৃদু হেসে বললেন, — “হয়, যদি ভালোবাসা থাকে।”

শুরুটা ছিল তেমনই ছোট— কিন্তু হৃদয়ে ছিল বিশাল এক স্বপ্ন: প্রত্যেক মানুষ যেন জানে, সে ভালোবাসার যোগ্য।

দারিদ্র্য শুধু ক্ষুধা নয়, সঙ্গে ছিল রোগ ও মৃত্যু।
তেরেসা বুঝলেন, শিক্ষা একা যথেষ্ট নয়, তাঁদের প্রয়োজন চিকিৎসা, যত্ন, সান্ত্বনা।তিনি নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিলেন পাটনা মেডিকেল মিশন থেকে, তারপর ফিরে এসে শুরু করলেন অসুস্থদের সেবা।


হাতে ওষুধের বাক্স, কাঁধে ব্যাগ, আর মুখে অনন্ত মমতার হাসি— এমনই ছিল তাঁর প্রতিদিনের চিত্র।
ফুটপাথে পড়ে থাকা মুমূর্ষু মানুষকে তিনি কোলে তুলে নিতেন, ধুয়ে-মুছে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।
তাঁর জন্য মানুষ বলত,“তিনি দেবী নন, কিন্তু তাঁর চোখে আমরা ঈশ্বর দেখি।”

প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একা, কিন্তু তাঁর নিঃস্বার্থ কাজ দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়।
১৯৪৯ সালের দিকে কয়েকজন তরুণী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন, যারা চেয়েছিল ভালোবাসার এই আন্দোলনের অংশ হতে।


তাঁরা একসঙ্গে বস্তির রাস্তায় বের হতেন, অসুস্থদের খুঁজতেন, ক্ষুধার্তদের খাওয়াতেন, নিঃস্ব শিশুদের আশ্রয় দিতেন। তেরেসা তাঁদের বলতেন—“আমরা বড় কাজ করছি না, আমরা ছোট কাজ করছি বিশাল ভালোবাসা দিয়ে।”

১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর, রোম থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যায়। তেরেসার ছোট উদ্যোগ তখন হয়ে ওঠে একটি সংগঠন— “মিশনারিজ অব চ্যারিটি” (Missionaries of Charity)। তাঁর কথায়,“আমাদের কাজ একটাই— সবচেয়ে গরিব, সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মানুষদের মাঝে ঈশ্বরকে দেখা।”

এই সংগঠনই পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয় মানবতার আলো, আর তেরেসা হয়ে ওঠেন “মাদার তেরেসা”— কোটি মানুষের ভালোবাসার মা।

১৯৬০-এর দশকে কলকাতার রাস্তায় যদি কেউ “মাদার” বলত, সবাই বুঝত— সে তেরেসার কথাই বলছে। নীলপাড় সাদা শাড়িতে মোড়া ক্ষীণকায় নারীটি তখন শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি হাসপাতালে এক পরিচিত মুখ। তিনি কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি নন, না কোনো ধনী দাতা—  তবু তাঁর উপস্থিতি যেন এক আশীর্বাদের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দুঃখী মানুষের মাঝে।

১৯৬২ সালে ভারত সরকার তাঁকে দিল “পদ্মশ্রী” পুরস্কার।সেদিন পুরস্কার নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন মৃদু কণ্ঠে—“আমি এটা নিজের জন্য নিচ্ছি না, নিচ্ছি সেই মানুষগুলোর জন্য, যাদের সমাজ ভুলে গেছে।”

তেরেসার সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত “নির্মল হৃদয়” (Nirmal Hriday) — যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ মানুষদের আশ্রয় দেওয়া হতো।


এই কাজ চলতে থাকে সত্তরের দশকেও আরও বিস্তৃতভাবে। যে মানুষদের রাস্তায় কেউ ছোঁয় না, তাঁদের কোলে তুলে নিতেন তিনি;যে রোগীদের সমাজ “অস্পৃশ্য” বলত, তাঁদের মুখে জল দিতেন তিনি নিজে। তিনি বলতেন—“আমরা মৃত্যু থেকে কাউকে বাঁচাতে পারি না, কিন্তু মরার আগে যেন তারা ভালোবাসা অনুভব করে, সেটাই আমাদের কাজ।”

তেরেসার সংগঠন তখন কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে—
ফিলিপাইন, জর্ডান, ভেনিজুয়েলা, ইতালি, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা—যেখানেই দরিদ্রতা, অসহায়তা বা ক্ষুধা, সেখানেই তাঁর সংগঠনের নীলপাড় শাড়ি দেখা যেত। তাঁর হাতে গড়া “Missionaries of Charity” হয়ে উঠেছিল মানবতার বৈশ্বিক প্রতীক।

যেখানেই তিনি যেতেন, মানুষ তাঁকে ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিত।রাজনীতিক, ধর্মীয় নেতা, সাধারণ মানুষ— সবাই বলত,“তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে একজন মা।”

১৯৭৯ সাল। নরওয়ের অসলো শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। বিশ্বের চোখ আজ সেই ক্ষুদ্রকায় নারীটির দিকে, যিনি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছেন অন্যদের জন্য।ঘোষণা এল— “নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে মাদার তেরেসাকে।”

পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন,“এই পুরস্কার কোনো ব্যক্তির নয়, এটি গরিবদের, যাদের প্রতি ভালোবাসা দেখানোই আমাদের শান্তির পথ।”

নোবেল অনুষ্ঠানে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
— “আমরা কীভাবে শান্তি আনতে পারি?”
তিনি হাসলেন এবং বললেন,“তোমার পরিবারে গিয়ে তোমার সন্তানদের ভালোবাসো। সেখান থেকেই শান্তি শুরু হয়।”

১৯৭৯ সালের পর তেরেসা শুধু একজন নারী নন, তিনি হয়ে ওঠেন মানবতার প্রতীক, এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। বিশ্ব তাঁকে ‘সেন্ট অব দ্য গাটার’— অর্থাৎ “নর্দমার সাধ্বী” নামে ডাকতে শুরু করে, কারণ তিনি সৌন্দর্য দেখেছিলেন ঠিক সেখানেই, যেখানে কেউ তাকাত না।

কলকাতার ভিড়ভাট্টা রাস্তায় যখনই তাঁর গম্ভীর অথচ মমতাভরা মুখ দেখা যেত, মানুষ যেন একটু থেমে যেত —কারণ তাঁকে দেখলে মনে হতো, ভালোবাসা এখনো পৃথিবীতে বেঁচে আছে।

১৯৮০-এর দশক। মাদার তেরেসার বয়স তখন ৭০-এর কোঠায়। কলকাতার রাস্তায় তিনি এখন এক পরিচিত প্রতীক।যে ক্ষীণকায় নারী একসময় কনভেন্টের দেয়াল থেকে বের হয়ে একা রাস্তায় নামেছিলেন, আজ তাঁর সংগঠন Missionaries of Charity বিস্তৃত।শহরের বস্তি, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র—সব জায়গায় তাঁর উপস্থিতি মানুষের হৃদয়ে আশার আলো জ্বালায়।

তবে বয়স বাড়লেও তাঁর কাজের উদ্যম কমেনি।
প্রতিদিন সকালে তিনি যাত্রা শুরু করতেন বস্তির দিকে, হাত ধরে অসহায় শিশুরা, কাঁধে ঝুলন্ত ব্যাগে খাবার, আর মুখে অশেষ ভালোবাসা।

১৯৮২ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান—ভারতরত্ন প্রদান করে।
বিশ্বের নেতারা তাঁকে দেখা করতে আসত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, পোপ, জাতিসংঘের কর্মকর্তা— সকলেই তাঁর কাছ থেকে শিখত মানবতার অর্থ।


তিনি সবসময় বলতেন—“আমি কোনো বিরাট কাজ করি না। আমি শুধু অল্প অল্প ভালোবাসা দিই। সেই অল্প ভালোবাসা মিলেই পৃথিবী বদলে যায়।”

১৯৮۵ সালে তাঁর সংগঠন পৃথিবীর ৭০টির বেশি দেশে পৌঁছে।যেখানে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, রোগী— সেখানেই তিনি উপস্থিত। প্রতি দিন নতুন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু চোখে অদম্য আশা।

১৯৯০-এর দশক। বয়স প্রায় ৮০। শারীরিক কষ্ট, চোখে জ্বলজ্বলান কমেছে, কিন্তু মন ছিল যেমনই—অদম্য। প্রতিদিন কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে, অসহায়দের পাশে, তিনি অনুভব করতেন— “যতক্ষণ আমার শক্তি আছে, ততক্ষণ আমি তাদের জন্য থাকব।”

১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।কালো ঘন কুয়াশা ভরা সকালে মাদার তেরেসা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
কলকাতার মানুষ, সমগ্র বিশ্ব শোকাহত।
কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা থেকে জন্ম নেওয়া আলো— মানবতার প্রেম, সেবা, সহানুভূতি— চিরন্তন হয়ে রইল।

মাদার তেরেসার জীবন প্রমাণ করল— একজন মানুষের ছোট্ট ভালোবাসাও পৃথিবী বদলে দিতে পারে। আজও বস্তি, হাসপাতাল, রেলস্টেশন— যেখানে তিনি একবার দাঁড়িয়েছেন, সেই জায়গাগুলোতে মানুষ তাঁর শিক্ষা মনে রাখে।

তিনি শুধু একজন নারী ছিলেন না; তিনি মানবতার প্রতীক, এক জীবন্ত প্রেরণা। তিনি শিখিয়েছেন— দারিদ্র্য, অসহায়তা বা মৃত্যু যতোই ভয়ঙ্কর হোক, ভালোবাসা সবসময় বিজয়ী হয়।

১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাদার তেরেসার দেহ পৃথিবীর মায়া থেকে বিদায় নিয়েছিল, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, মানবিক আদর্শ ও সেবা চিরকাল অব্যাহত।
Missionaries of Charity বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে—৭০টিরও বেশি দেশে তাদের কেন্দ্র, হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।যেখানে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ আছে, সেখানে আজও তাঁর কাজের ছাপ পাওয়া যায়।

বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ে জন্ম নিল এক নতুন ধারণা—মানবতার চিরন্তন শক্তি।শিশুদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ, অসুস্থদের সেবা, বস্তির মানুষের পাশে থাকা—সবই এখন প্রেরণার উৎস।

স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও মানবিক সংগঠনগুলোতে আজও মাদার তেরেসার জীবন পাঠানো হয়।
ছাত্ররা শেখে—সর্বপ্রথম ভালোবাসা, তারপর অন্য কিছু।তিনি প্রমাণ করেছেন, ভালোবাসা দিয়ে ছোট ছোট কাজ করা, পৃথিবী বদলে দিতে পারে।

একজন প্রফেসর বলেন—“তার জীবন দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু বড় পদক্ষেপ নয়, ছোট ছোট মানবিক কাজের মধ্য দিয়েও বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব।”

জাতিসংঘ, নোবেল কমিটি, বিশ্বব্যাংক—সব জায়গায় তিনি মানুষের চোখে আশা ও মানবতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন। রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে মানবিক নীতি গ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়।বিশ্বের নেতারা বলেন—“যেখানে মানুষের জন্য কাজ করা হয়, সেখানেই আসল নেতৃত্ব জন্মায়। মাদার তেরেসা সেই নেতৃত্বের এক জীবন্ত প্রতীক।”

মাদার তেরেসা প্রমাণ করেছেন—একজন মানুষের সত্যিকারের নৈতিকতা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা পুরো পৃথিবীকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায়— মানবতার জন্য সাহস, ভালোবাসা, এবং পরিশ্রমই আসল পুরস্কার।

এই গল্পের শেষ নয়—কারণ মানবতার প্রদীপ, মাদার তেরেসার সেবা, আজও প্রতিটি হৃদয়ে জ্বলছে।
মানুষদের জন্য তাঁর পথ দেখানো শিক্ষা, অনুপ্রেরণা, ও ভালোবাসা চিরকাল জীবন্ত থাকবে।