ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধের শেষ কোথায়?

25 Jul 2025 03:38:35 PM

 


ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধের শেষ কোথায়?

 মোঃ জয়নাল আবেদীন


     ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত কেবল একটি ভূখণ্ডের লড়াই নয়; এটি ইতিহাস, স্মৃতি, পরিচয়, নিরাপত্তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় অনুভূতি এবং ভূ-রাজনীতির জটিল মিশেল। একের পর এক যুদ্ধ, অন্তর্বর্তী শান্তি-চুক্তি, নতুন করে সহিংসতার বিস্তার—সব মিলিয়ে প্রশ্নটি আজও দাঁড়িয়ে আছে: এই যুদ্ধের শেষ কোথায়?


এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখি—কেউ নিরাপত্তা চায়, কেউ স্বাধীনতা; কেউ ইতিহাসের বিচার, কেউ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

 

২) ঐতিহাসিক পটভূমি: বীজের বপন থেকে বনসৃজন

২.১ অটোমান আমল থেকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (১৯শ–২০শ শতক)


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অঞ্চলটি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা ইহুদিদের “জাতীয় গৃহ” প্রতিষ্ঠার ধারণাকে আন্তর্জাতিক সমর্থন দেয়—যা পরবর্তী উত্তেজনার প্রধান এক উৎস হয়ে ওঠে।

 

একই ভূখণ্ডে আরব-ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর স্ব-অধিকার ও ভূমির প্রশ্নটি ক্রমেই তীব্র হয়।

 

২.২ জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (১৯৪৭) ও ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ


১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি বিভাজন পরিকল্পনা প্রস্তাব করে—ইহুদি ও আরব—দুই রাষ্ট্র, জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে।

 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পরপরই প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয় এবং লাখো ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন—যাকে ফিলিস্তিনিরা নাকবা (বিপর্যয়) বলে অভিহিত করেন।

 

২.৩ ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ


ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম, গোলান মালভূমি, সিনাই উপত্যকা দখল করে।

এখান থেকেই ইসরায়েলি বসতি স্থাপন (settlements) ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি নতুন মাত্রা পায়।

 

২.৪ প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (১৯৮৭–৯৩; ২০০০–০৫)


ইন্তিফাদা অর্থ জনঅভ্যুত্থান। ইসরায়েলি দখল, অবরোধ, চলাচলে বাধা, ভূমি দখল ও বসতি স্থাপন নীতির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের গণ-প্রতিরোধ।

 

দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় আত্মঘাতী বোমা হামলা, সামরিক আগ্রাসন, প্রাচীর নির্মাণসহ (Separation Barrier) সংঘাত ভয়াবহ রূপ নেয়।

 

 

৩) শান্তি প্রক্রিয়া: যে সেতু বারবার ভেঙে পড়ে

৩.১ ওসলো চুক্তি (১৯৯৩–৯৫)


পারস্পরিক স্বীকৃতি—ইসরায়েল ও পিএলও (Palestine Liberation Organization) একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (PA) গঠিত হয়; পশ্চিম তীর ও গাজা আংশিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রশাসনের আওতায় আসে।

কিন্তু মূল প্রশ্নগুলো—চূড়ান্ত সীমানা, জেরুজালেম, শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের অধিকার (Right of Return), বসতি স্থাপন, নিরাপত্তা কাঠামো—অমীমাংসিত থেকে যায়।

 

৩.২ ক্যাম্প ডেভিড, টাবা, রোডম্যাপ, আরব পিস ইনিশিয়েটিভ


২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনায় আপাত-সমাধানের কাছাকাছি যাওয়া হলেও চুক্তি হয়নি।

আরব পিস ইনিশিয়েটিভ (২০০২)—ইসরায়েল ১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তে ফিরে গেলে আরব রাষ্ট্রসমূহ স্বীকৃতি দেবে—এ প্রস্তাবও বাস্তবায়িত হয়নি।

রোডম্যাপ ফর পিস (২০০৩)—ধাপে ধাপে দুই রাষ্ট্র সমাধানের নকশা—বাস্তবতায় আটকে গেছে।

 

 

৪) আজকের বাস্তবতায় অমীমাংসিত মূল প্রশ্নগুলো

৪.১ জেরুজালেমের মর্যাদা


উভয় পক্ষই জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে দাবি করে।

ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক সব দিকেই এটি সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু।

 

৪.২ সীমানা (Borders)


১৯৬৭-পূর্ব সীমান্ত (Green Line) কি হবে দুই রাষ্ট্রের সীমানা?

বসতি স্থাপনকারীদের ভবিষ্যত কী? ভূমি-বিনিময় (land swap) হবে নাকি প্রত্যাহার?

 

৪.৩ শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার (Right of Return)


১৯৪৮ ও ১৯৬৭-তে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যত কী?

ইসরায়েল জনসংখ্যাগত (demographic) কারণে এই অধিকারকে হুমকি মনে করে; ফিলিস্তিনিরা এটিকে ন্যায্য অধিকার বলে মানে।

 

৪.৪ নিরাপত্তা বনাম স্বাধীনতা


ইসরায়েলের যুক্তি—রকেট হামলা, সন্ত্রাসবাদ, সীমান্ত সুরক্ষা।

ফিলিস্তিনির যুক্তি—দখল, চেকপয়েন্ট, অবরোধ, সামরিক অভিযান, ঘেরাটোপের জীবন।

 

৪.৫ বসতি (Settlements)


আন্তর্জাতিক আইনে অধিকাংশ বসতি অবৈধ বলে বিবেচিত হলেও ইসরায়েল বহু বসতিকে “বৈধীকৃত” করেছে বা ফ্যাক্টস অন দ্য গ্রাউন্ড তৈরি করেছে—যা দুই রাষ্ট্র সমাধানের ভূগোলকে ক্রমেই জটিল করে তুলেছে।

 

৪.৬ গাজা অবরোধ ও মানবিক সংকট


গাজা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডগুলোর একটি; সেখানে অবরোধ, যুদ্ধ, অবর্ণনীয় মানবিক সংকট, ধ্বংসস্তূপ, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা—সব মিলিয়ে মানুষের জীবন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে হাঁটছে।

গাজার শাসন কাঠামো (হামাস) ও পশ্চিম তীরের প্রশাসন (ফাতাহ) – এই আভ্যন্তরীণ বিভাজনও ফিলিস্তিনি জাতীয় রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।

 

 

৫) আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ ও বিশ্ব-রাজনীতি: ন্যায়ের পথ এবং বাস্তবের দেয়াল


জাতিসংঘের প্রস্তাব ২৪২ ও ৩৩৮—‘ভূমির বিনিময়ে শান্তি’ (Land for Peace)—ইসরায়েলকে দখলকৃত অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানায়।

প্রস্তাব ১৯৪—শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন বা ক্ষতিপূরণ।

 

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)—পশ্চিম তীরের প্রাচীর/বেষ্টনীকে (Separation Wall) আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী বলে মত দিয়েছে (advisory opinion)।

 

তবে এসব আইনি/নৈতিক কাঠামো বাস্তব রাজনীতির মুখে বারবার থেমে যায়—বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায়, আঞ্চলিক রাজনীতির পরিবর্তনে, এবং শক্তির রাজনীতিতে।

 

 

৬) “শেষ কোথায়?”—সম্ভাব্য চারটি ‘এন্ডগেম’ বা পরিণতির পথনকশা

৬.১ দুই-রাষ্ট্র সমাধান (Two-State Solution)

ধারণা: ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুইটি আলাদা, টেকসই, নিরাপদ রাষ্ট্র।
সমস্যা: বসতি স্থাপনের বিস্তার, জেরুজালেম প্রশ্ন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন, আস্থা সংকট, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ চাপ।

 

৬.২ এক-রাষ্ট্র সমাধান (One-State Solution)

ধারণা: একটি যৌথ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সকলের সমান অধিকার থাকবে।
সমস্যা: ইসরায়েলি পক্ষ জনসংখ্যাগত বাস্তবতায় “ইহুদি রাষ্ট্র” পরিচয় হারানোর ভয় দেখে; ফিলিস্তিনিরা আশঙ্কা করে সমতার বাস্তব অনুপস্থিতি, দমনপীড়নের ধারাবাহিকতা।

 

৬.৩ কনফেডারেশন/ফেডারেশন মডেল

ধারণা: দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু নিরাপত্তা, পানি, অবকাঠামো, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি ইত্যাদিতে যৌথ প্রশাসন/ব্যবস্থা।
সমস্যা: উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধা, নিরাপত্তার ভারসাম্য।

 

৬.৪ দীর্ঘমেয়াদি ‘স্ট্যাটাস ক্বো’ (Status Quo) বা ক্রমবর্ধমান সংঘাত

ধারণা: কোনো সমাধান নয়, বরং ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ-অবরোধ-প্রতিরোধ-যুদ্ধের চক্র, মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতি।


সমস্যা: মানবিক সংকটের স্থায়িত্ব; আন্তর্জাতিক আইনের বারবার লঙ্ঘন; চরমপন্থার বিকাশ; আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা।

 

৭) কী করলে সমাপ্তির দিকে যাওয়া সম্ভব?

৭.১ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ফ্রেমওয়ার্কে (Parameters) ফিরে যাওয়া


১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তকে ভিত্তি করে সীমান্ত নির্ধারণ

ভূমি-বিনিময় (land swaps) এবং জেরুজালেমে দুই পক্ষের বৈধ উপস্থিতির স্বীকৃতি

শরণার্থীদের জন্য বহুমাত্রিক সমাধান—আংশিক প্রত্যাবর্তন, ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন

 

৭.২ মানবিক ও আস্থা-নির্মাণমূলক পদক্ষেপ


অবরোধ শিথিল/উত্তোলন, চলাচল ও অর্থনীতিতে স্বাধীনতা

বন্দি বিনিময়, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক মিশন

ঘৃণাবাদী ভাষণ ও উসকানিমূলক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে দুই পক্ষেই শিক্ষা ও মিডিয়া সংস্কার

 

৭.৩ আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কার


ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণ ঐক্য (হামাস–ফাতাহ সমঝোতা)

ইসরায়েলি রাজনীতিতে সমতা, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি প্রতিশ্রুতি পুনরুজ্জীবন

 

৭.৪ নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা ও গ্যারান্টি ব্যবস্থা


বৃহৎ শক্তির যৌথ মধ্যস্থতা (US–EU–Arab Quartet–UN)

বাস্তবায়নের গ্যারান্টি: সীমান্ত নিরাপত্তা, পর্যবেক্ষণ মিশন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন তহবিল

 

৭.৫ ট্রানজিশনাল জাস্টিস ও সত্য কমিশন


যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দখল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জীবনের জন্য ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ, স্বীকৃতির প্রক্রিয়া

ট্রমা-ইনফর্মড পিসবিল্ডিং—উভয় সমাজের দুঃখ-স্মৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে আগানো

 

 

৮) মানবতা বনাম ভূ-রাজনীতি: দ্বন্দ্বের গহিনে মানুষ

এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ভাঙা-গড়ার শিকার সাধারণ মানুষ—শিশু, নারী, বৃদ্ধ, শরণার্থী। তাদের চোখে শেষ নেই; আছে আশ্রয়হীনতা, বোমার শব্দ, ক্ষুধা, ধ্বংসস্তূপ, প্রিয়জনের লাশ, অন্ধকার ভবিষ্যৎ। প্রশ্নটি তাই কেবল ভূ-রাজনৈতিক নয়; মানবিক ও নৈতিকও বটে।

 

৯) উপসংহার: শেষ কোথায়?

 

শেষ সেখানে,যেখানে নিরাপত্তা শব্দটি কেবল এক পক্ষের মুখে উচ্চারিত হবে না;

যেখানে স্বাধীনতা দাবিটিও আরেক পক্ষের গলায় আটকে থাকবে না;

যেখানে জেরুজালেম এক অনন্ত বিরোধ নয়, বরং সহাবস্থানের প্রতীক হবে;

যেখানে শরণার্থীরা কেবল পরিসংখ্যান নয়, মর্যাদাসহিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে;

যেখানে আইন, ন্যায় ও মানবতা—এই তিনটি শব্দ কূটনীতির কাগজে নয়, মানুষের জীবনে বাস্তবতা হবে।

 

প্রশ্নটি কঠিন, উত্তরটি জটিল; তবে সত্য এই—যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটের শেষ নেই। এর শেষ লুকিয়ে আছে ন্যায়ভিত্তিক শান্তিতে, পারস্পরিক স্বীকৃতিতে, সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বে, আন্তর্জাতিক নৈতিক চাপ ও নিরপেক্ষ মধ্যস্থতায়, এবং সবচেয়ে বেশি—উভয় পক্ষের মানুষের অন্তরের মানবিক স্বীকৃতিতে।