অজানাকে জানার তৃষ্ণা: আইনস্টাইনের বিজ্ঞানী হওয়ার গল্প
অজানাকে জানার তৃষ্ণা: আইনস্টাইনের বিজ্ঞানী হওয়ার গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ, জার্মানির উল্ম শহরে জন্ম নিল এক শান্ত, চুপচাপ শিশু— আলবার্ট আইনস্টাইন।ছোট্ট আলবার্টের চোখে সবকিছুই ছিল রহস্যময়।বাবা হেরমান আইনস্টাইন ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,মা পোলিনা শিল্পকলা ও সংগীতপ্রেমী।তাদের ভালোবাসা ও স্নেহ ছিল আলবার্টের প্রথম পাঠশালা, আর ঘর-বাড়ির চারপাশের পরিবেশ ছিল তার প্রাথমিক পরীক্ষা-পরীক্ষণক্ষেত্র।
একদিন বাবা তাকে একটি চৌম্বক কম্পাস উপহার দেন। ছোট্ট আলবার্ট কৌতূহলে চমকে তাকিয়ে থাকে।সুঁই সবসময় উত্তর দিকে ঘুরছে— যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে।
ছেলে আলবার্ট ভাবতে থাকে:“এই শক্তি কোথা থেকে আসে? কেন সব সময় ঠিক ওই দিকে নির্দেশ করে?কি কেউ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে না? না কি এটি প্রকৃতির কোনো নিয়ম?”
এই ছোট্ট প্রশ্নের সঙ্গে জন্ম নিল অজানাকে জানার তৃষ্ণা,যা একদিন তাকে বিশ্বের অন্যতম মহান বিজ্ঞানী করে তুলবে।
আলবার্ট খেলাধুলায় খুব আগ্রহী ছিল না।
প্রকৃতি, গণিত, তার চারপাশের জিনিসপত্র—
এই সব বিষয় তাকে আকৃষ্ট করত।সে প্রায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ভাবত:“আলো যদি একটি তরঙ্গ হয়, আমি যদি তার সঙ্গে দৌড়াই, কি দেখব?”
সকালে জানালার পাশে বসে সূর্যের আলো,
পাতার নড়াচড়া, নদীর জলপ্রবাহ—সবকিছুই ছিল তার “ল্যাবরেটরি”। প্রতিটি ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণই ছিল তার বৈজ্ঞানিক চিন্তার বীজ।
আলবার্টের ঘর ছিল তার নিজস্ব ল্যাব।খেলনা বা বস্তুগুলোকে ছোট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হিসেবে ব্যবহার করত। একবার সে দেখল, বেলুনে বাতাস ভরে ধরার পর কীভাবে তার আকার পরিবর্তন হয়। সে লিখল খাতায়—“বস্তু স্থির থাকলেও ভিতরে শক্তি থাকে, যা প্রভাব ফেলে।”ছোট্ট ছেলের কল্পনা ও পর্যবেক্ষণ মিলিত হয়ে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী হওয়ার ভিত্তি তৈরি করছিল।
১৮৯০ ছোট্ট আলবার্ট আইনস্টাইন তখন মাত্র ১১ বছর বয়সী। সে ভর্তি হলো উল্মের স্থানীয় স্কুলে।
শুরুটা সহজ ছিল না—শিক্ষকরা তাকে অলস ও ধীরগতির বলে মনে করতেন।
মুখস্থ করা বই বা নিয়মকানুন তার জন্য ছিল একধরনের বাধা।
কিন্তু আলবার্ট ভিন্ন—সে বুঝতে চেয়েছিল, শুধু মনে রাখা নয়।একদিন শিক্ষক গণিতে জটিল সূত্র বোঝানোর সময় বললেন,“এটা মুখস্থ করো, কারণ তুমি পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে চাও।”ছোট্ট আলবার্ট কেঁপে ওঠল না, বরং ভাবল:“কেন এই সূত্র কাজ করে? কীভাবে এটি পৃথিবীর নিয়মের সঙ্গে মিলছে?”
এভাবেই জন্ম নিল তার স্বাধীন চিন্তাধারা, যা তাকে পরবর্তীতে বৈপ্লবী তত্ত্বের পথে নিয়ে যাবে।
ছেলেটির কৌতূহল বাড়ছিল প্রতিনিয়ত।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যামিতি, অঙ্ক—সবকিছুই তাকে আকর্ষণ করত। সে প্রায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছোট্ট পরীক্ষা করত: নদীর পানি দিয়ে টানাপোড়েন পরীক্ষা। বাতাসের প্রবাহ ও আলো পর্যবেক্ষণ।ঘরে থাকা যন্ত্রপাতি নিজেই খুলে-জোড়া করা।
প্রতিটি ছোট পরীক্ষা তার কল্পনার ল্যাবরেটরি।
এতে জন্ম নিত নতুন ধারণা, নতুন প্রশ্ন।
একবার সে ভাবল—“যদি আলোর সঙ্গে দৌড়াই, তাহলে আলোর গতি আমার কাছে কেমন মনে হবে?”
এই ধরনের প্রশ্নই পরে তাকে স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি আবিষ্কারের পথে নিয়ে যায়।
১৮৯৩ ছোট্ট আলবার্ট তখন ১৪ বছর বয়সী।
যেখানে স্কুলের কঠোর নিয়ম, শিক্ষক ও বন্ধুরা তাকে প্রায়ই “অলস” বলে মনে করত, সেখানে তার চারপাশের পরিবারই হয়ে উঠল তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
আলবার্টের মা, পোলিনা আইনস্টাইন, ছিলেন শিল্পকলা ও সংগীতপ্রেমী। সে ছোটবেলা থেকেই পিয়ানোতে মনোনিবেশ করত। মায়ের সঙ্গে সঙ্গীত অনুশীলন তাকে শেখিয়েছে ধৈর্য, মনোযোগ,
এবং গভীরভাবে বিষয়গুলো অনুভব করার ক্ষমতা।
প্রতিটি সুর, প্রতিটি স্বর, প্রতিটি ছন্দ তাকে বুঝিয়ে দিত— “যদি তুমি মন দিয়ে চাও, তুমি কঠিন কিছুও আয়ত্ত করতে পারবে।”
এরপর এসেছে তার বাবা, হেরমান আইনস্টাইন, যিনি ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বাবার গল্পে ছিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রপাতির জাদু,আর প্রতিটি গল্পে লুকিয়ে ছিল প্রকৃতির নিয়মের রহস্য।
একদিন বাবা তাকে দেখালেন একটি ইলেকট্রিক সার্কিট।আলবার্ট বিস্ময়ে দেখল—কীভাবে বিদ্যুৎ নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত হয়ে আলো জ্বালায়।
ছেলেটি গভীরভাবে ভাবল:“যদি আমি প্রকৃতির নিয়মগুলো বুঝতে পারি, তাহলে আমি সবকিছু জানার পথে এগোতে পারব।”
আলবার্টের ঘর, তার পরিবার,সবকিছুই যেন তার নিজস্ব প্রথম বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরি। খেলনা, ঘরের জিনিসপত্র, নদী বা বাতাস— প্রতিটি ছিল তার পরীক্ষার উপকরণ।একবার সে একটি বেলুন নিয়ে পরীক্ষা করল, বাতাস ভরে ধরার পর বেলুনের আকার কীভাবে পরিবর্তন হয় তা লক্ষ্য করল।
সে লিখল খাতায়:“যদি বস্তু স্থির থাকে, তবুও এতে শক্তি লুকিয়ে থাকে, যা প্রভাব ফেলে।”
এভাবেই ছোট্ট ছেলে প্রকৃতির প্রতি তার কৌতূহলকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করত।
পরিবারের অনুপ্রেরণা তাকে শেখালো—প্রশ্ন করা, খুঁজে দেখা এবং নিজেরভাবে বোঝা বড় অর্জনের প্রথম ধাপ।
এই বয়সেই আলবার্ট শিখতে শুরু করল- পড়াশোনায় ব্যর্থতা মানে শেষ নয়। প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা একটি নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে। শিক্ষকরা বলত, সে কখনো বড় কিছু করতে পারবে না।কিন্তু আলবার্ট মনে বলত: “আমি অন্যরকম হব। আমার পথ হবে ভিন্ন। আমি সেই পথ অনুসরণ করব যা কেউ আগে দেখেনি।”
১৮৯৪ ছোট্ট আলবার্ট তখন ১৫ বছর বয়সী।
স্কুলের শিক্ষকরা বারবার বলত, সে অলস এবং নিয়ম মানার ক্ষমতা কম।বন্ধুরা খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকত,কিন্তু আলবার্টের মন ছিল অন্য কোথাও—প্রকৃতির রহস্য, অঙ্ক, আলো এবং গতি নিয়ে গভীর চিন্তায়।
একদিন শিক্ষক তাকে বললেন:“তুমি কখনো বড় কিছু করতে পারবে না। তুমি অন্যদের মতো হয়ে উঠতে পারবে না।”অনেক ছেলেই হয়তো হার মেনে যেত। কিন্তু আলবার্ট থেমে থাকল না।
তার চোখে জ্বলল এক অদম্য আগুন, মনে জন্ম নিল অচিন্ত্য শক্তির সংকল্প—“আমি বড় কিছু করতে চাই, কিন্তু আমার পথ হবে ভিন্ন।আমি সেই পথে চলব যা কেউ দেখেনি, যা কেউ ভাবেনি।”
প্রতিটি শব্দ যেন তার মনে নতুন প্রাণ ঢেলে দিল।
শব্দগুলো ছিল চ্যালেঞ্জ, কিন্তু তার মন ঠিক করল—
প্রতিবন্ধকতা তাকে থামাবে না, বরং শক্তিশালী করবে।
আলবার্ট বুঝতে শুরু করল—বড় স্বপ্নের জন্য বড় সংকল্প দরকার। তিনি শিখলেন, বাস্তবের কঠোরতা এবং অন্যের সন্দেহই যদি তাকে ভেঙে না দেয়,
তাহলেই কেবল নতুন ধারণা ও তত্ত্বের জন্ম সম্ভব।এই সংকল্প ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পথে, যেখানে কোনো বাধা তাকে থামাতে পারবে না।
১৮৯৫ ছোট্ট আলবার্ট তখন ১৬ বছর বয়সী।
স্কুল জীবনের প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষক ও সমাজের শঙ্কা—সবকিছু পেছনে ফেলে, সে নিজস্ব পথ খুঁজে চলার সিদ্ধান্ত নিল।এই বছরই সে প্রথম নিজস্ব বৈজ্ঞানিক খাতার নোট লিখল। খাতার পাতায় ছোট ছোট আক্ষরিক অক্ষর, কিন্তু প্রতিটি লাইন ছিল জ্ঞান ও কল্পনার সোনালী বীজ।সে পর্যবেক্ষণ করত, প্রশ্ন করত, এবং নিজের ভাবনা লিখে রাখত—“প্রকৃতির নিয়মগুলো বোঝা সম্ভব যদি তুমি মন দিয়ে দেখো, ভেবে বোঝো।”
তার মনে ছিল এক অদম্য আশা—যে কোনো বাধা তাকে থামাতে পারবে না।প্রতিদিন সকালে সে সূর্যের আলো, পাতার নড়াচড়া, নদীর জলপ্রবাহ দেখত,
আর মনে করত:“এই পৃথিবী আমাকে শেখাচ্ছে, শুধু আমাকে খুঁজতে হবে সঠিক উত্তর।”
ছোট্ট এই খাতা ছিল তার ভবিষ্যতের বৈপ্লবী তত্ত্বের প্রথম পদক্ষেপ।এখানে জন্ম নিল সেই দৃঢ় সংকল্প— “আমি জানব, আমি খুঁজব, আমি তৈরি করব নতুন ধারণা, নতুন বিশ্ব।”
এই বয়সে আলবার্ট বুঝতে পারল—সত্যিকারের জ্ঞান কোনো শিক্ষাপত্রে লেখা থাকে না,
এটি আসে পর্যবেক্ষণ, ধৈর্য ও নিজের চিন্তাশক্তির মাধ্যমে।ছোট্ট ছেলের এই আত্মবিশ্বাস ও তৃষ্ণা তাকে একদিন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত করবে।এভাবেই ১৮৯৫ সাল হয়ে উঠল তার নিজস্ব পথের সূচনা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল স্বপ্ন ও সাহসের মিশ্রণ।
১৮৯৬ সালের বসন্ত, আলবার্ট আইনস্টাইন তখন ১৭ বছর। রাতের অন্ধকারে আলবার্ট বসে ভাবল—“আমি কি যথেষ্ট ভালো নই?আমার স্বপ্ন কি শুধুই অপ্রাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে?”এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ তাকে ভেঙে দিতে পারত। কিন্তু তার মধ্যে জন্ম নিল অদম্য সংকল্প।সে নিজেকে বলল:“ব্যর্থতা শেষ নয়, বরং এটি শেখার সুযোগ।যারা বড় কিছু করে, তারা ব্যর্থতা থেকে শিখে উঠে।”
আলবার্ট বুঝল যে, শুধু পরীক্ষার ফল নয়— নিজের কৌতূহল ও পর্যবেক্ষণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে খাতায় লিখতে লাগল, নিজস্ব ছোট ছোট পরীক্ষার ফলাফল, ধারণা, এবং নতুন প্রশ্ন।একটি ব্যর্থতা তাকে ভেঙে দেয়নি, বরং শক্তি যোগ করেছে।
প্রতিটি ব্যর্থ পরীক্ষা তার মনে বার্তা দিল: “তুমি যদি নিজের পথে এগো, চিন্তা ও অনুসন্ধানের শক্তি কাজে লাগাও,তবে ব্যর্থতাও তোমার শিক্ষকের মতো হয়ে যাবে।”
১৮৯৭ সালের বসন্ত, আলবার্ট আইনস্টাইন তখন ১৮ বছর বয়সী।জার্মানির উল্ম শহরের ছোট্ট ঘর, স্কুলের কঠোর নিয়ম, সীমাবদ্ধ চিন্তা—সবকিছু পেছনে ফেলে, সে যাত্রা করল নতুন সম্ভাবনার দেশে—সুইজারল্যান্ডের জুরিখ।
নতুন শহর, নতুন ভাষা, নতুন মানুষ—সবকিছুই ছিল অচেনা। কিন্তু আলবার্ট ভীত না হয়ে ভাবল:“এখানে আমার কৌতূহল, আমার চিন্তাভাবনা স্বাধীন হবে।
আমি প্রকৃতিকে ভালোভাবে বুঝব, নতুন ধারণা আবিষ্কার করব।”
জুরিখ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তার দিন শুরু হল উৎসাহে ভরা।প্রত্যেকটি লেকচার ছিল তার জন্য নতুন দিশারী।
প্রফেসররা স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করতেন, আর ছাত্ররা নিজস্ব পরীক্ষায় ডুবে থাকত।
আলবার্টের চোখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জ্ঞানার্জনের নতুন চাহিদা।তিনি অধ্যয়ন করতেন রাতের অন্ধকারে, মাথার ওপর ঝুলে থাকা ল্যাম্পের আলোয় খাতায় নোট লিখতেন, প্রশ্ন করতেন:“কেন এই সূত্র কাজ করছে? শক্তি ও গতি কি সত্যিই এইভাবে সম্পর্কিত?”
১৯০০ সাল। আলবার্ট আইনস্টাইন তখন মাত্র ২১ বছর বয়সী। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত জুরিখ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি শেষ করেছেন।তার চোখে তখন একটাই স্বপ্ন — একজন গবেষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে বিজ্ঞানের গভীর রহস্য অনুধাবন করা।কিন্তু বাস্তবতা তার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
একটি নয়, দুইটি নয় — দশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন আবেদন।
জবাব এলো প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যান।
একটি চিঠিতে লেখা —“আপনার চিন্তাভাবনা অতিরিক্ত স্বাধীন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত নয়।” আরেকটি চিঠিতে লেখা —“আপনি নিয়ম মানেন না, এমন লোককে আমরা নিয়োগ দিতে পারি না।”
আইনস্টাইন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যে স্বাধীন চিন্তা তাকে আনন্দ দিত, সেটিই এখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর তার প্রিয় শিক্ষক হাইনরিখ ওয়েবার, যার কাছ থেকে সে সুপারিশপত্র আশা করেছিল, তিনি বললেন ঠান্ডাভাবে — “আলবার্ট খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু খুব একগুঁয়ে। আমি তাকে আর সমর্থন করতে পারব না।”
সে রাতে আইনস্টাইন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখছিল।চোখে একফোঁটা জল ঝলমল করছিল আলোয়।“এত বছর পরিশ্রমের ফল যদি কেবল প্রত্যাখ্যান হয়,তাহলে কি আমার জ্ঞান বৃথা গেল?”
১৯০১ সালে, আলবার্টের জীবন আর্থিকভাবে কঠিন হয়ে উঠল। সে টিউশনি করে, ছোট ছোট কাজ করে টিকে থাকত।তার প্রেমিকা মিলেভা ম্যারিচ-এর সাথে ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা আরও দূর হয়ে গেল।প্রেমিকা মিলেভা ম্যারিচ-এর কাছে চিঠি লিখে সে বলে, “আমরা হয়তো এখন কষ্টে আছি, কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না। আমি বিশ্বাস করি, একদিন আমার চিন্তাগুলো মানুষ বুঝবে।”
রাতের অন্ধকারে জানালার পাশে বসে সে ভাবত— “বিজ্ঞান আমার জীবন। কিন্তু যদি আমি গবেষণার সুযোগই না পাই,তবে এই জ্ঞান নিয়ে করবই বা কী?”
তবুও সে হাল ছাড়ল না।
বন্ধুদের কাছে সাহায্য চাইল, বিভিন্ন অফিসে আবেদন পাঠাল,এমনকি কিছুদিন টিউশনির কাজও করল।
একদিন তার পুরনো সহপাঠী মার্সেল গ্রসম্যান বলল—“আমার বাবা সুইস পেটেন্ট অফিসে কাজ করেন।আমি তোমার নামটা সুপারিশ করতে পারি।” তুমি একটা আবেদন দাও আমার হাতে। এটাই ছিল ভাগ্যঘটিত মোড়। আলবার্ট নিজের হাতে আবেদনপত্র লিখে পাঠালেন বার্ন শহরের ফেডারেল পেটেন্ট অফিসে।
১৯০২ সালের মার্চ মাস।বার্ন শহরের সকালের ঠান্ডা বাতাসে আইনস্টাইন পরেছে তার একমাত্র ভালো কোট। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা। অফিসে ঢুকতেই সাদা দেয়াল, কাঠের চেয়ার আর গম্ভীর মুখের কর্মকর্তারা।
একজন জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন এই কাজ চান?” আইনস্টাইন শান্ত গলায় বলল, “কারণ প্রতিটি যন্ত্র, প্রতিটি নকশা আমার কাছে একেকটা প্রশ্ন।আর আমি প্রশ্ন খুঁজতে ভালোবাসি।” ঘরে নীরবতা।কেউ হাসল না, কেউ কিছু বলল না।
তবে সেই নীরবতার ভেতরেই জন্ম নিল এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা।
কয়েক সপ্তাহ পর, এক চিঠি এল —“মি. আলবার্ট আইনস্টাইন, আপনাকে ফেডারেল পেটেন্ট অফিসে ‘Technical Expert, Class III’ “প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ তৃতীয় শ্রেণি” পদে নিয়োগ দেওয়া হলো।”
আইনস্টাইন চিঠিটা হাতে নিয়ে হাসল, একটা ছোট্ট হাসি — কিন্তু তাতে ছিল গভীর শান্তি।
প্রথমে চাকরিটি তাহার কাছে সাধারণ মনে হয়েছিল — অন্যদের আবিষ্কারের নকশা যাচাই করা, যান্ত্রিক নীতিগুলো পরীক্ষা করা, সব কিছুই ছিল কাগজপত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ।কিন্তু ধীরে ধীরে আলবার্ট বুঝলেন — এটাই তার নিজস্ব ল্যাবরেটরি।
এই অফিসে বসেই তিনি প্রতিদিন নতুন যন্ত্র,
নতুন প্রযুক্তি এবং ভৌত নীতির বিশ্লেষণ করতেন।
প্রতিদিনের একঘেয়ে কাজের মাঝেও
তার মস্তিষ্কে জন্ম নিচ্ছিল নতুন প্রশ্ন, নতুন তত্ত্বের বীজ — যেগুলো একদিন বদলে দেবে মানব সভ্যতার চিন্তাধারা।
১৯০২ সাল। সুইজারল্যান্ডের শান্ত শহর বার্ন। এখানেই অবশেষে আইনস্টাইন পেলেন তার প্রথম স্থায়ী চাকরি—Swiss Patent Office-এ একজন সহকারী পরীক্ষক হিসেবে। কাজটা ছিল প্রযুক্তিগত—মানুষের পাঠানো নতুন আবিষ্কারের নকশা ও আবেদনপত্র পরীক্ষা করা। বাইরে থেকে এটা নিছক একঘেয়ে অফিসের কাজ মনে হলেও, আইনস্টাইনের জীবনে এটা ছিল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
অফিসের কাজ শেষ হতো বিকেল পাঁচটায়, আর তার পরের সময়টুকুই ছিল আইনস্টাইনের আসল জীবন। দিনের বেলা তিনি অন্যদের উদ্ভাবন যাচাই করতেন, আর রাতে নিজের চিন্তার মহাবিশ্বে ভেসে যেতেন। ঘড়ি, আলোর গতি, সময়ের প্রসারণ, শক্তি—এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করতেন।
প্রতিদিন অফিসের ডেস্কে বসে তিনি শত শত যন্ত্রের নকশা দেখতেন—কেউ নতুন ইঞ্জিন তৈরি করছে, কেউ বিদ্যুৎ নিয়ে পরীক্ষা করছে। এইসব আবেদন দেখতে দেখতেই তাঁর মাথায় জন্ম নেয় অনেক প্রশ্ন: “সময় আসলে কীভাবে কাজ করে?”, “আলো কি সবসময় একই গতিতে চলে?”, “যদি একজন চলন্ত ট্রেনের ভিতর থেকে বজ্রপাত দেখে, তবে সে কি বাইরের মানুষের মতোই তা দেখবে?”
এমন অসংখ্য প্রশ্নে ভরা তাঁর দিনরাত। আর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন নিঃশব্দ এক বিপ্লবী।
রাতের নীরবতায় তিনি বসতেন ছোট্ট টেবিলের পাশে, হাতে কলম, সামনে খাতা। বাইরে তুষারপাত, আর ভিতরে তাঁর মাথায় জন্ম নিচ্ছে এমন সব তত্ত্ব, যা বদলে দেবে গোটা পদার্থবিদ্যার চেহারা। বার্নের সেই পেটেন্ট অফিসই হয়ে উঠল তাঁর “গোপন গবেষণাগার”—যেখানে কোনো ল্যাবরেটরি ছিল না, কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না, কিন্তু ছিল এক অদম্য চিন্তার জগৎ।
১৯০৩ সালে তিনি বিয়ে করলেন তাঁর সহপাঠী মিলেভা মেরিচকে, যিনি নিজেও এক সময় পদার্থবিদ্যার ছাত্রী ছিলেন। সংসার, চাকরি, আর সীমিত আয়—সব মিলে জীবন ছিল কঠিন, কিন্তু মনোবল ছিল অটুট।
১৯০৪ সালে, তাঁদের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়—হান্স আলবার্ট। সেই বছরই অফিসের পদোন্নতি পেলেন আইনস্টাইন, কিন্তু সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল অন্য কিছু—তিনি শেষ করে ফেললেন তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার প্রাথমিক খসড়া।
তারপর এলো ১৯০৫ সাল, যেটি বিজ্ঞান ইতিহাসে আজ পরিচিত “Annus Mirabilis” বা “অলৌকিক বছর” হিসেবে। কারণ, এই এক বছরেই বার্নের পেটেন্ট অফিসের এক অচেনা কর্মচারী লিখলেন চারটি বৈপ্লবিক গবেষণাপত্র, যা পরিবর্তন করল গোটা বিশ্ববিজ্ঞানের ধারা—
-
আলো-তরঙ্গের কোয়ান্টাম তত্ত্ব (Photoelectric Effect) – যা পরে নোবেল পুরস্কার এনে দেয় তাঁকে।
-
ব্রাউনীয় গতি (Brownian Motion) – যা প্রমাণ করে যে পরমাণু সত্যিই আছে।
-
বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Special Theory of Relativity) – যা সময়, স্থান ও গতির ধারণাকেই বদলে দেয়।
-
E = mc² – শক্তি ও ভরের সম্পর্কের সেই বিখ্যাত সমীকরণ, যা আজও মহাবিশ্ব বোঝার মূল চাবিকাঠি।
বার্নের সেই নিঃশব্দ অফিসরুমে বসে, দিনের পর দিন, কোনো ল্যাব ছাড়াই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন মানব ইতিহাসের এক মহান বৈজ্ঞানিক বিপ্লব।
এইভাবেই এক সাধারণ সরকারি কর্মচারী হয়ে উঠলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর এক কিংবদন্তি।
তাঁর গল্প শেখায়—মহান কাজ করার জন্য বড় জায়গা নয়, দরকার বড় মন আর অবিচল অধ্যবসায়।
১৯০৬ সাল। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহর।পেটেন্ট অফিসের ছোট্ট ঘরে বসে কাজ করছেন এক তরুণ, যাকে তখনও খুব কম মানুষ চেনে।কিন্তু সেই মানুষটির কলম থেকে ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে চারটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, যা বদলে দেবে মহাবিশ্বকে বোঝার ইতিহাস—তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
আইনস্টাইনের কাজ তখনও এক সাধারণ কর্মচারীর মতোই চলছিল,তবে তাঁর মন ছুটছিল আলোর গতিতে। তিনি পেটেন্ট অফিসে “Technical Expert Second Class” পদে পদোন্নতি পান। রাতে বাসায় ফিরে তিনি আবার ডুবে যান তাঁর প্রিয় চিন্তার জগতে—সময়, স্থান, ও শক্তির রহস্যে।
তাঁর স্ত্রী মিলেভা মেরিচ সংসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন,তাঁদের ছোট ছেলে হান্স আলবার্ট তখন হাঁটতে শিখছে।জীবন ছিল কষ্টে ভরা, কিন্তু মনের গভীরে আইনস্টাইন জানতেন— তিনি এক বিশাল কিছু আবিষ্কারের পথে আছেন।
এই বছরই তাঁর মাথায় আসে এক যুগান্তকারী ধারণা— “সমতুল্য নীতি” (Principle of Equivalence)।একজন যদি জানালা-বন্ধ ঘরে থাকে,সে বুঝতে পারবে না সে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে, নাকি মহাকাশে উড়ছে।এই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় ভবিষ্যতের “সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব”-এর বীজ।
তিনি বলেছিলেন—“That was the happiest thought of my life.” —এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের চিন্তা।
অবশেষে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর আইনস্টাইনের মেধার স্বীকৃতি আসে। বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে “Privatdozent” হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপর তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করেন, আর ধীরে ধীরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ জুড়ে।
তখন তিনি লেখেন:“পেটেন্ট অফিস আমাকে রুটি দিয়েছে, কিন্তু চিন্তা দিয়েছে মহাবিশ্ব।”
আইনস্টাইন প্রাগ শহরে চলে আসেন, যেখানে তিনি অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন।এই সময়েই তিনি বলেন—"আলো যদি মহাকর্ষীয় বল দ্বারা বাঁকতে পারে?" এই এক প্রশ্ন পরবর্তীতে প্রমাণ করে দেয় যে তাঁর তত্ত্ব কেবল ধারণা নয়, বরং বাস্তব সত্য।
জুরিখের শীতল শীতের সকাল। জানালার ওপারে হালকা তুষারপাত, আর টেবিলের উপর ছড়ানো কিছু কাগজ—তার মাঝখানে বসে আছেন এক অমনোযোগী মানুষ,যার চোখে জ্বলছে চিন্তার আগুন—অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
তিনি তখন জুরিখে ফিরে এসেছেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে।বছরের পর বছর কঠিন পরিশ্রমের পর তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ জুড়ে।কিন্তু জীবনের অন্য প্রান্তে, যেখানে থাকা উচিত ছিল শান্তি,
সেখানেই ধীরে ধীরে জমে উঠছে এক অজানা দূরত্ব।
তাঁর স্ত্রী মিলেভা মেরিচ,।যিনি একসময় তাঁর সহপাঠী, সহযাত্রী, সহচিন্তক ছিলেন, এখন সংসারের বোঝায় ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত।ছোট দুই ছেলেকে মানুষ করা, গৃহস্থালির যত কাজ, সব মিলিয়ে তিনি যেন নিজের পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।
আইনস্টাইন চেয়েছিলেন পৃথিবীকে বদলাতে,
কিন্তু বুঝতে পারেননি, এই চেষ্টা করতে গিয়েই
নিজের সংসারের পৃথিবীটাকে ধীরে ধীরে হারাচ্ছেন।
মিলেভা দূরে সরে যাচ্ছিলেন— একদিকে তাঁর স্বামীর খ্যাতি, অন্যদিকে তাঁর নিজের নিঃসঙ্গতা। তিনি বুঝতে পারছিলেন না,তাঁর সেই তরুণ বিজ্ঞানী স্বামী
এখন যেন এক নতুন পৃথিবীতে বাস করছেন— যেখানে কেবল চিন্তা, গবেষণা আর খ্যাতি।
১৯১৪ সালে, আইনস্টাইন বার্লিনে স্থানান্তরিত হন—
প্রুশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস তাঁকে আহ্বান জানায়। এটা ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু পরিবারকে নিয়ে গেলেন না। মিলেভা সন্তানদের নিয়ে জুরিখেই রইলেন।
তাঁর অনুপস্থিতিতে জন্ম নেয় নীরব এক শীতলতা।
চিঠিতে মিলেভা লিখতেন—“তুমি যেন দূরের এক তারা হয়ে গেছো,আলো ছড়াও ঠিকই, কিন্তু আমার জীবনে কোনো উষ্ণতা নেই।”
আইনস্টাইনও একদিন লিখলেন,“আমি আমার চিন্তার জগতে হারিয়ে গেছি, কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকেই জিজ্ঞেস করি— এই পথের শেষে কি সত্যিই সুখ আছে?”
ধীরে ধীরে তাঁদের সম্পর্ক এক সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলে রইল— যে সুতো আর বেশিদিন টিকল না।
বার্লিনের গবেষণাগারে আইনস্টাইন যখন
বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাস বদলানোর পথে হাঁটছেন,
ঠিক তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে শুরু হলো ভাঙনের সুর। দুটি আলাদা মহাবিশ্বে তাঁরা যেন দুই তারা—একজন আলো খুঁজছেন বিজ্ঞানে, আরেকজন খুঁজছেন ভালোবাসায়।
এভাবেই শেষ হলো তাঁদের একসঙ্গে পথচলার দিনগুলো—একসময়ের সেই মিলেভা, যিনি তাঁকে একদিন উৎসাহ দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী হতে,
এখন হয়ে উঠলেন তাঁর জীবনের নীরব প্রস্থান।
চার বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার পর, আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে ঘোষণা করেন তাঁর “General Theory of Relativity”— যা সময়, স্থান, ও মহাকর্ষকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে।তাঁর সমীকরণ বলল— “মহাকর্ষ কোনো বল নয়, বরং স্থান-কালের বক্রতা।”
এই আবিষ্কার মানবসভ্যতার চিন্তাকে এক নতুন যুগে নিয়ে যায়। তবুও, তখনও অনেকে তাঁর তত্ত্বকে “অতিরঞ্জিত কল্পনা” বলে উপহাস করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় (১৯১৪–১৯১৮)। পুরো ইউরোপ ধ্বংসের মুখে, কিন্তু আইনস্টাইন শান্তির পক্ষে দৃঢ় থাকেন। তিনি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সই করেন, বলেছিলেন—“মানবতার চেয়ে বড় কোনো জাতীয়তা নেই।”
তাঁর এই অবস্থান অনেক সহকর্মীকে বিরক্ত করেছিল,তবুও তিনি নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন।এই সময় তিনি দুর্বল শরীর ও একাকীত্বে ভুগলেও,তাঁর মাথা কাজ করছিল আগের চেয়েও তীক্ষ্ণভাবে।তিনি তখনও বিশ্বাস করতেন—“বিজ্ঞানই আলো দেখাবে পৃথিবীকে।”
১৯১৯ সালে, ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন আইনস্টাইনের তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করেন— সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায়,
সূর্যের মহাকর্ষ আলোকে সত্যিই বাঁকিয়ে দেয়!বিশ্ব বিস্মিত হয়ে গেল— একজন অচেনা জার্মান পদার্থবিদ হঠাৎ হয়ে উঠলেন বিশ্বের প্রতীক।
অবশেষে ১৯১৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ (divorce) হয়। তবে বিচ্ছেদের সময় আইনস্টাইন একটি শর্ত দেন— “যদি আমি কখনো নোবেল পুরস্কার পাই, তার অর্থ আমি তোমাকে দেব।” তিনি প্রতিশ্রুতি রাখেন। ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার জেতার পর পুরস্কারের অর্থ সত্যিই তিনি মিলেভার কাছে পাঠান।
১৯২০ সাল। ইউরোপ তখন যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে,
মানুষ খুঁজছে আশার আলো, আর ঠিক তখনই
এক জার্মান বিজ্ঞানীর নাম ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে—অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
তাঁর “আপেক্ষিকতা তত্ত্ব” প্রমাণিত হয়েছে,
আর তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ — E = mc² —
মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সঙ্গে।
বার্নের সেই নিঃশব্দ কর্মচারী এখন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী।
বার্লিনের রাজপথে তাঁর লেকচার হলে ঢল নামে।
ছাত্র, সাংবাদিক, রাজনীতিক—সবাই তাঁর কথা শুনতে আসে।যেখানে তিনি দাঁড়ান, সেখানেই যেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে।তবুও, এই খ্যাতির মাঝেও আইনস্টাইন থাকেন শান্ত, বিনয়ী।
তিনি বারবার বলতেন,“আমি কোনো বিশেষ মানুষ নই, আমি শুধু এক অনন্ত কৌতূহলী আত্মা।”কিন্তু পৃথিবী তাঁকে “নতুন নিউটন” বলে অভিহিত করছিল।
১৯২১ সালে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় বক্তৃতার জন্য। এটাই ছিল তাঁর প্রথম আমেরিকা সফর।তিনি শুধু বিজ্ঞান নয়, মানবতার বার্তা নিয়েও কথা বলেন।আর সেই বছরই, তাঁর বহু বছরের অবদান স্বীকৃতি পায়— আইনস্টাইন পান নোবেল পুরস্কার (Physics, 1921)
“Photoelectric Effect”-এর আবিষ্কারের জন্য।
অদ্ভুত ব্যাপার—তিনি যে আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বিখ্যাত,নোবেল পেয়েছিলেন সেটির জন্য নয়,
কারণ তখনও অনেক বিজ্ঞানী তা পুরোপুরি বুঝতে পারেননি!
নোবেল পাওয়ার পর আইনস্টাইন তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।প্রথম স্ত্রী মিলেভা মেরিচ-কে তিনি পুরো পুরস্কারের অর্থ দেন। এভাবেই তিনি নিজের কথার মূল্য রাখেন।
এরপর তিনি দীর্ঘ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন— জাপান, চীন, ভারত, প্যালেস্টাইন, স্পেন, ও ফ্রান্স ভ্রমণ করেন, যেখানে যেখানেই যান, তাঁকে মানুষ অভ্যর্থনা জানায় জ্ঞান ও শান্তির প্রতীক হিসেবে।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বলেছিলেন— “আমি বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানের কাজ মানুষকে বিনম্র করা,
অহঙ্কার নয়, আলো দেওয়ার জন্য।”
১৯২৪ সালের এই সময়েই তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
বোসের এক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দেখে আইনস্টাইন মুগ্ধ হন, নিজে সেটি অনুবাদ করে প্রকাশ করতে সাহায্য করেন।
এর ফলেই সৃষ্টি হয় বিখ্যাত বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব (Bose–Einstein Statistics),
যা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে ওঠে।তিনি তখন বলতেন—“জ্ঞান কেবল নিজের জন্য নয়, জ্ঞান ভাগ করলেই তার সত্যিকারের অর্থ জন্ম নেয়।”
১৯২৭ সালে তিনি ব্রাসেলসের সলভে কনফারেন্সে অংশ নেন, যেখানে এক অসাধারণ মেধার লড়াই শুরু হয়— আইনস্টাইন বনাম নীলস বোর (Niels Bohr)। কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তাঁদের তর্ক আজও বিখ্যাত।আইনস্টাইন বলেছিলেন, “ঈশ্বর পাশা খেলেন না।”বোর জবাব দিয়েছিলেন, “আইনস্টাইন, ঈশ্বরকে কী করতে হবে, তা তুমি শেখাতে পারো না।”
আইনস্টাইন তখন শুধু বিজ্ঞানী নন, তিনি হয়ে উঠেছেন মানবতার কণ্ঠস্বর। যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে তিনি বলতেন—“জাতীয়তা হলো মানুষের শিশুসুলভ রোগ, সত্যিকার ধর্ম হলো মানবতা।”
তিনি নিরস্ত্রবাদ ও শান্তির প্রচার শুরু করেন, দারিদ্র্য ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর নাম তখন বিশ্বজুড়ে হয়ে ওঠে আশা ও শান্তির প্রতীক।
যে জার্মানি তাঁকে শ্রদ্ধা করেছিল, সেই দেশেই উঠতে শুরু করে এক ভয়ঙ্কর ছায়া— আডলফ হিটলার ও নাৎসিবাদ। ইহুদি হওয়ায় আইনস্টাইন হয়ে ওঠেন টার্গেট।তাঁর ছবি পত্রিকায় ছাপা হয় "রাষ্ট্রদ্রোহী" লেখা স্লোগানের পাশে। বাড়িতে হুমকির চিঠি আসে, তাঁর গবেষণাগার নজরবন্দি হয়।
১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে,আইনস্টাইন জার্মানির নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন,আর চিরতরে পাড়ি জমান আমেরিকায়।যাত্রার আগে তিনি বলেন— “আমি আমার দেশ ছাড়ছি, কিন্তু আমার নীতিবোধ নয়।”
১৯৩৩ সাল। ইউরোপ তখন ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে,
নাৎসিবাদের কালো ছায়া জার্মানির আকাশ ঢেকে ফেলেছে। আর ঠিক সেই সময়, এক নৌকা ভেসে যাচ্ছে আটলান্টিক পেরিয়ে—তাতে বসে আছেন শান্ত চেহারার এক বিজ্ঞানী, হাতে ছোট্ট একটি বেহালা, পাশে কয়েকটি নোটবই।
তিনি আর কেউ নন — অ্যালবার্ট আইনস্টাইন,
যিনি নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
১৯৩৩ সাল।নিউইয়র্ক বন্দরে নোঙর ফেলল জাহাজটি। সমুদ্রের বাতাসে আইনস্টাইনের চুল উড়ছে, কিন্তু চোখে এক ধরনের গভীর দৃঢ়তা —
যেন বলছেন, “আমার মস্তিষ্ককে কেউ নির্বাসিত করতে পারবে না।”
অল্পদিন পর তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে (Princeton University) একটি স্থায়ী গবেষণার দায়িত্ব পান। সেই জায়গাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের শেষ আশ্রয়।
প্রিন্সটনের শান্ত পরিবেশে, তিনি নতুন করে ডুবে যান গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের রহস্যে। সেখানে তাঁকে ঘিরে থাকেন তরুণ গবেষকরা— তাঁরা তাঁকে শুধু শিক্ষক নয়, মানবতার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে দেখতেন।
১৯৩৪ সালে আইনস্টাইন তখন কাজ করছিলেন এক স্বপ্নের তত্ত্ব নিয়ে— "Unified Field Theory",
যার লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির সব শক্তিকে এক সূত্রে বাঁধা।কিন্তু তাঁর চারপাশের পৃথিবী তখন ভয়ংকরভাবে বদলে যাচ্ছে।
১৯৩৯ সালে তিনি জানতে পারেন— নাৎসি জার্মানির বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক বিভাজন (Nuclear Fission) আবিষ্কার করেছেন। এর মানে, মানবজাতি এক ভয়ানক অস্ত্র তৈরি করতে পারে—পারমাণবিক বোমা।
আইনস্টাইন তখন এক দুঃসহ সিদ্ধান্ত নেন।
শান্তিকামী হয়েও, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট-কে চিঠি লেখেন, যাতে তিনি সতর্ক করেন যে জার্মানি আগে বোমা তৈরি করতে পারে। এই চিঠিই পরবর্তীতে ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর সূচনা ঘটায়।
কিন্তু পরে আইনস্টাইন অনুতপ্ত হন।
তিনি বলেছিলেন—“যদি জানতাম মানুষ এই জ্ঞান দিয়ে ধ্বংস ডেকে আনবে, তবে আমি ঘড়ি মেরামতকারীর কাজ করতাম!”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, আইনস্টাইন তাঁর গবেষণার পাশাপাশি শান্তির আহ্বান জানাতে থাকেন।
যুদ্ধ শেষ হলে, যখন হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়, আইনস্টাইন ভেঙে পড়েন।তিনি বলেছিলেন—“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল— রুজভেল্টকে লেখা সেই চিঠি।”
এরপর থেকে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন
পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও মানবতার পক্ষে আন্দোলনে।
১৯৪৬ এর শেষের দিকে এই সময়ে আইনস্টাইন ক্রমে হয়ে ওঠেনএকজন বিজ্ঞানীর চেয়ে বড় কিছু—
একজন চিন্তাবিদ, মানবতাবাদী ও দার্শনিক।তিনি লিখতে থাকেন শান্তি, শিক্ষা ও সামাজিক ন্যায় নিয়ে প্রবন্ধ।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা তাঁর মতামত চাইতেন।
যখন ১৯৫২ সালে ইসরায়েল সরকার তাঁকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়।তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন।বলেছিলেন—“আমি বিজ্ঞান বুঝি, কিন্তু রাজনীতি নয়। নেতৃত্ব নয়, আমি চাই আলো ছড়াতে।”
১৯৫১ সাল হতে জীবনের শেষ দিকে আইনস্টাইন অনেকটাই একা হয়ে পড়েন।তাঁর গবেষণা তাঁকে শান্তি দিত,কিন্তু শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।
তবু প্রতিদিন সকালে তিনি প্রিন্সটনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন,হাতে পুরনো ফাইল আর চোখে সেই আগুন—জ্ঞানকে খোঁজার অদম্য ইচ্ছা।
১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে, ৭৬ বছর বয়সে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব দেন,কিন্তু আইনস্টাইন শান্তভাবে বলেন— “আমি যখন চাইনি জন্ম নিতে, তখন মৃত্যুকেও প্রতিরোধ করব কেন?”
১৮ এপ্রিল ১৯৫৫। মানবতার এক মহান আলোকবর্তিকা নিভে গেল চিরতরে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আলো আজও জ্বলে— প্রতিটি গবেষণাগারে, প্রতিটি ছাত্রের চোখে,প্রতিটি মানুষে যারা প্রশ্ন করতে ভয় পায় না।
আইনস্টাইন কেবল এক বিজ্ঞানীর নাম নয়— তিনি এক চিন্তার বিপ্লব। যিনি প্রমাণ করেছিলেন,
বুদ্ধি ও বিবেকের মেলবন্ধনেই জন্ম নেয় সত্যিকার মানবতা। “জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা হলো রহস্যকে অনুভব করা। যে বিস্ময় হারায়, সে জীবিত থাকলেও মৃত।” — অ্যালবার্ট আইনস্টাইন