এক কাচের বাক্সে পৃথিবীকে দেখা: টেলিভিশন আবিষ্কারের কাহিনি
এক কাচের বাক্সে পৃথিবীকে দেখা: টেলিভিশন আবিষ্কারের কাহিনি
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৮৮ সালের এক ঝিরঝিরে শীতের সকাল।
স্কটল্যান্ডের হেলেনসবুর্গ শহরটা তখন কুয়াশায় ঢাকা। সেখানে এক পুরোনো গির্জার পাশে ছোট্ট একটি বাড়ি— সেই বাড়িতেই জন্ম নিল এক ছেলে,নাম রাখা হলো জন লোগি বেয়ার্ড।
বাবা ছিলেন গির্জার ধর্মযাজক—গম্ভীর, নিয়মকানুনে কঠোর মানুষ। মা ছিলেন শান্ত, হাসিখুশি, তাঁর চোখে ছেলের জন্য হাজার স্বপ্ন।
কিন্তু ছোট জন ছিল অন্যরকম। বাবা বলতেন,“জন, বই পড়ো, প্রার্থনা করো।” আর জন বসে থাকত ঘড়ির কাঁটা খুলে দেখছে—
“ভেতরে এই ছোট ছোট চাকা ঘুরে সময় দেখায় কীভাবে?”
জনের হাতে যদি পুরোনো কোনো তার বা ভাঙা ল্যাম্প পড়ত,সে সেটাকে খেলনা বানাতো না, পরীক্ষা করত। বাড়ির সবাই হাসত— “এই ছেলেটা পাগল হবে একদিন!”
একবার মা দেখলেন, জন টিনের বাক্সে কাচের টুকরো আর বাল্ব জুড়ে কিছু বানাচ্ছে।তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“জন, তুমি কী বানাচ্ছো?”জন গম্ভীর মুখে বলল, “মা, আমি এমন এক যন্ত্র বানাবো, যাতে দূরে থাকা মানুষকে চোখে দেখা যাবে!”মা মৃদু হেসে বললেন,“তুই স্বপ্ন দেখ, জন… হয়তো একদিন সত্যি হবে।”
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল।বুকে কাশি, ঠান্ডা, ক্লান্তি—এইসব তাঁকে বারবার বিছানায় ফেলে রাখত।তবুও তাঁর চোখে জ্বলত আগুন।তিনি বলতেন নিজের বন্ধুদের,“মানুষ যদি তার কণ্ঠস্বর তারে পাঠাতে পারে (টেলিফোনে),তাহলে চোখে দেখা জিনিসও পাঠানো যাবে!”
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে তিনি নানা পরীক্ষা করলেন। কিন্তু একদিন অধ্যাপক বললেন,“বেয়ার্ড, তোমার ধারণা খুবই কল্পনাপ্রবণ।” এটা শুনে জন কষ্ট পেলেও থামলেন না। তাঁর চোখে তখনও সেই স্বপ্ন—
দূরের দৃশ্য কাছে এনে দেওয়া, মানুষকে এক কাচের বাক্সে দেখা।
এক রাতে, জন জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।তখন শহরের সব বাতি নিভে গেছে। তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখলেন— “অন্ধকার যত গভীর হয়, আলো খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছা তত বেড়ে যায়।”
সেই রাতেই তিনি স্থির করলেন— নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন সেই আলোর খোঁজে, যে আলো মানুষকে দূর থেকে একে অপরকে দেখাবে।
জন তখনও জানতেন না, তাঁর এই ছোট শহরের ঘরটাই একদিন হবে পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশনের জন্মভূমি। যে যন্ত্রে মানুষ কেবল শুনবে না— দেখতেও পারবে।
সেদিন তাঁর মা ছেলের ঘরে এসে দেখলেন,
মোমবাতির আলোয় ছেলেটি ঘড়ির গিয়ার আর পুরোনো বাল্ব নিয়ে কাজ করছে। তিনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। মৃদু হেসে বললেন,“জন, তোর চোখে আমি আলোর ঝলক দেখছি।”জন তাকিয়ে বলল,“মা, আমি একদিন পুরো পৃথিবীকে আলো দেখাবো।”
এইভাবেই শুরু হয় সেই যাত্রা, যার শেষ হয় এক কাচের পর্দায় পৃথিবীকে দেখা দিয়ে।অন্ধকার শহরের সেই ছেলেটিই একদিন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল কোটি মানুষের ঘরে।
স্কটল্যান্ডের মেঘলা বিকেল। বৃষ্টির ফোঁটা জানালার কাঁচে ছোট ছোট দাগ টেনে নামছে।বাইরে শিশুরা খেলছে কাদায়,আর ভেতরে ঘরের এক কোণে বসে আছেন তরুণ জন লোগি বেয়ার্ড— একগাদা তার, পুরোনো ঘড়ির চাকা আর একটুখানি বাল্ব নিয়ে টুকটাক কিছু করছেন।
তাঁর চোখে ক্লান্তি নেই, আছে কৌতূহলের আগুন।
তিনি নিজেই বিড়বিড় করে বললেন,“মানুষের চোখ যা দেখে, তা কি বিদ্যুৎ দিয়ে পাঠানো যায়?”
বাক্যটা উচ্চারণ করার পর যেন ঘরের ভেতর এক ঝলক আলো ছুটে গেল—এটাই ছিল সেই মুহূর্ত,যখন জন্ম নিল এক অসম্ভব চিন্তা— টেলিভিশনের ধারণা।
সে সময় ১৯১০-এর দশক। মানুষ তখন টেলিফোনে কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়,আর রেডিও তখনও সবে জনপ্রিয় হচ্ছে। দূরের মানুষকে দেখা যাবে— এমন চিন্তা ছিল প্রায় কল্পবিজ্ঞানের মতো।
বন্ধুরা বলত,“বেয়ার্ড, তুমি পাগল! আলোকে কেমন করে তারে পাঠাবে?”তিনি মৃদু হেসে বলতেন,“যে শব্দ তারে যায়, আলো কেন যাবে না?”সেই উত্তর কেউ দিতে পারত না।কিন্তু তিনি থেমে যাননি। কারণ তাঁর কাছে “অসম্ভব” মানে ছিল— এখনও সম্ভব হয়নি।
বেয়ার্ড ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতেন।তিনি জানতে চাইলেন, মানুষের চোখ কেমন করে আলো বোঝে।তিনি লিখলেন তাঁর নোটবুকে:“চোখ এক ধরনের প্রাকৃতিক ক্যামেরা।
আমি চাই সেই চোখকে যন্ত্রের মধ্যে বসাতে।”
দিনের আলোতে তিনি পরীক্ষা করতেন কাচ, আয়না আর লেন্স নিয়ে।রাতে বাতির নিচে বসে কাগজে স্কেচ আঁকতেন— কীভাবে আলোকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে সিগন্যাল হিসেবে পাঠানো যায়।
এক রাতে তিনি নিজের ঘরে একা বসে ছিলেন।
বাইরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি জানালায় কড়া নাড়ছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবলেন—
“একদিন মানুষ ঘরে বসে অন্য শহরের মানুষকে দেখতে পাবে। তারা দূরে থেকেও একে অপরের মুখের হাসি দেখবে। আমি যদি সেটা করতে পারি, তাহলে মানুষকে আর দূরে বলা যাবে না।”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মুখে এক অদ্ভুত শান্ত হাসি ফুটে উঠল। তাঁর মধ্যে যেন এক শক্তি প্রবেশ করল— যা তাঁকে পরের দুই দশক ধরে নিদ্রাহীন রাত, দারিদ্র্য, বিদ্যুতের ঝলকানি আর উপহাসের মাঝেও চালিয়ে নিয়ে গেল সামনে, সামনে, আরও সামনে।
বেয়ার্ড নিজের ঘরে বানাতে শুরু করলেন এক অদ্ভুত যন্ত্র। পুরোনো ঘড়ির মোটর, সাইকেলের চেইন, আর কাঠের পাত দিয়ে তৈরি করলেন এক ঘূর্ণায়মান চাকতি। তাতে ছোট ছোট গর্ত—
প্রতিটি গর্ত দিয়ে আলো যাবে, আর সেই আলোই পাঠাবে ছবির প্রতিটি অংশ।
তিনি নাম দিলেন, “দৃষ্টি প্রেরণ যন্ত্র” (Vision Transmitter)।সবাই বলল, “এটা কাজ করবে না!”বেয়ার্ড বললেন, “তাহলে দেখে নিও, একদিন এই চাকতির মধ্য দিয়েই পৃথিবীকে দেখবে মানুষ।”
সেই দিনগুলোতে তাঁর পকেটে প্রায় টাকা থাকত না।খাবার জুটত সামান্য,তবুও তাঁর চোখে জ্বলত এক অদম্য বিশ্বাস।তিনি জানতেন—এই অসম্ভব চিন্তাই একদিন পৃথিবীর ঘরে আলো জ্বালাবে।যে আলোয় মানুষ শুধু শুনবে না, দেখবেও।
সাল ১৯২০।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। ইউরোপ তখন দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর হতাশায় ডুবে। এই সময়েই লন্ডনের এক পুরোনো বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করতেন এক মানুষ— জন লোগি বেয়ার্ড।
বিছানার পাশে একটা কাঠের বাক্স, তার ওপরে ছড়িয়ে আছে তার, লেন্স, পুরোনো বাল্ব আর মোটরের অংশ।ঘরের ভেতর ধুলো, গন্ধ, আর বৈদ্যুতিক স্পার্কের আওয়াজ। কিন্তু তাঁর চোখে তখনও স্বপ্নের আলো।
লন্ডনের আকাশে ঘন মেঘ। বেয়ার্ড জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন— চিনি ছাড়া, কারণ চিনি কেনারও টাকা ছিল না। তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখলেন—“মানুষ আজ কণ্ঠস্বর পাঠাতে পারে (টেলিফোনে)। আমি চাই তাদের মুখও পাঠাতে।”
এই কথাটা তাঁর নিজের কাছে এক প্রতিজ্ঞা হয়ে গেল। তিনি চাকরি পেলেও কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়ে দিতেন— কারণ অফিসে বসে তাঁর মন যেত ল্যাবে, যে ল্যাব আসলে তাঁর নিজের ঘর।
বেয়ার্ডের কোনো ধনী পৃষ্ঠপোষক ছিল না।
তাঁর “ল্যাব” বলতে এক ভাঙা টেবিল, কিছু স্ক্রু, আর মোমবাতির আলো। বাজার থেকে যন্ত্রাংশ কেনার টাকা না থাকলে, তিনি পুরোনো দোকান থেকে ভাঙা রেডিও, সাইকেলের মোটর, আর টিনের বাক্স সংগ্রহ করতেন।
একদিন দোকানের মালিক বলল,“এইসব ভাঙা জিনিস দিয়ে তুমি কী করবে?” বেয়ার্ড হেসে উত্তর দিলেন, “দুনিয়ার সবচেয়ে নতুন জিনিস বানাব।”দোকানদার হেসে মাথা নাড়ল—
“বেচারা পাগল!”
রাতে তাঁর ঘরে কোনো পর্যাপ্ত আলো ছিল না।
তাই তিনি পুরোনো ব্যাটারি আর কার্বন রড দিয়ে তৈরি করলেন নিজের আলো।হাত পুড়ে যেত, তারে শক লাগত, তবুও থামতেন না।তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করতেন,কীভাবে আলোকে সিগন্যাল হিসেবে পাঠানো যায়। দিনের পর দিন ব্যর্থতা।তবুও পরদিন সকালে আবার একই চেষ্টা।
এক রাতে তিনি হতাশ হয়ে নিজের ডায়েরিতে লিখলেন—“আজও পারলাম না।কিন্তু আমি জানি, আলোর গোপন কথা একদিন খুলবই।”
অভাব ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী।একদিন ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা বলল, “বেয়ার্ড, আপনি চলে যান। এই যন্ত্রপাতি নিয়ে থাকলে পুরো বাড়ি পুড়ে যাবে!” বেয়ার্ড চোখ নামিয়ে বললেন,“যন্ত্রগুলো আমার জীবনের অঙ্গ, সেগুলো ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।”
অবশেষে তিনি এক বন্ধুর গ্যারেজে গিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করলেন।সেখানে ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে, আলো-হীন পরিবেশ— তবুও তাঁর মনে যেন এক জ্বলন্ত সূর্য ছিল।
এক রাতে, কাজ করতে করতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। বেয়ার্ডের যন্ত্র থেমে গেল, আর তিনি নিজেও ক্লান্ত হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। চোখে জল চলে এলো।
তিনি ধীরে বললেন, “হয়তো আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমি জানি, একদিন কোনো না কোনো জন আমার এই স্বপ্নকে সত্যি করবে।”
কিন্তু ভাগ্য যেন তাঁকেই বেছে নিয়েছিল— তাঁর এই দৃঢ়তা, তাঁর এই একাগ্রতা।অবশেষে তাঁকেই পৌঁছে দেয় সেই মুহূর্তে যখন তাঁর যন্ত্রে প্রথমবার জীবন্ত মুখ দেখা যাবে।
সাল ১৯২৫। লন্ডনের এক ছোট্ট ঘর, নামমাত্র ল্যাবরেটরি।ভেতরে শীত আর স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ।
বাইরে ঘন কুয়াশায় ডুবে আছে শহর।
কিন্তু ঘরের ভেতরে বসে আছে এক মানুষ—
জন লোগি বেয়ার্ড, চোখে ক্লান্তি, মুখে আশার আলো।
টেবিলের ওপর ছড়ানো তার, বাল্ব, লেন্স আর কাঠের চাকতি।চাকতির গায়ে ছিদ্র করা—
যার নাম নিপকো ডিস্ক।এই চাকতি ঘুরবে, আর তার ছিদ্র দিয়ে যাবে আলো, যার সাহায্যে “চিত্র” পাঠানো সম্ভব—এটাই তাঁর স্বপ্ন।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেয়ার্ড চেষ্টা করছেন। কিন্তু যন্ত্র বারবার ব্যর্থ।একটু আলো আসে, আবার নিভে যায়।তিনি ক্লান্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে বললেন, “হয়তো এখনো সময় হয়নি।” তবুও থামলেন না। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, ভেতরে তাঁর মন জ্বলছে এক আশায়—আজ হয়তো কিছু ঘটবে।
রাত প্রায় ১টা। বেয়ার্ড তাঁর যন্ত্রগুলো আবার পরীক্ষা করলেন—লেন্স ঠিক করলেন, ডিস্কের গতি বাড়ালেন,আর এক কোণে বসানো আলোটা সামান্য ঘুরিয়ে দিলেন।
তিনি নিজের সহকারীকে বললেন,“ওই আলোটার সামনে তোমার হাত নড়াও।”সহকারী অবাক হয়ে তাকালেন, কিন্তু নির্দেশ মতো করলেন।
বেয়ার্ড চোখ রাখলেন পর্দায়—একটা পুরোনো কাচের বাক্স,যেখানে আশা ছিল অদৃশ্য কিছু দেখার।
হঠাৎ পর্দায় কিছু একটা কাঁপল! বেয়ার্ড চমকে উঠলেন— একটা অস্পষ্ট ছায়া, হাতের মতো কিছু!তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,“দেখো! এটা নড়ছে!”সহকারী হতবাক—তার নিজের হাত, আলোর মাধ্যমে, এখন দেখা যাচ্ছে অন্য প্রান্তে কাচের বাক্সের ভেতর!
ঘর নিস্তব্ধ, শুধু যন্ত্রের গুনগুন শব্দ, আর দুই জনের নিঃশ্বাসের শব্দ।এক মুহূর্ত যেন থেমে গেল পৃথিবী।
এই পরীক্ষাটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম সফল ভিডিও ট্রান্সমিশন।বেয়ার্ডের যন্ত্রের মাধ্যমে আলো ও ছায়া মিলে তৈরি হলোপ্রথম জীবন্ত ছবি—একজন মানুষের নড়াচড়া!
তিনি পরে বলেছিলেন,“ওই রাতটা আমি কোনোদিন ভুলব না। মনে হচ্ছিল, আমি অন্ধকারে আলো ধরেছি।”
সে রাতে বেয়ার্ডের চোখে ঘুম আসেনি।তিনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকালেন।
নিচে ঘুমিয়ে থাকা লন্ডনের মানুষেরা জানত না,
একজন দরিদ্র উদ্ভাবক এখনই বদলে ফেলেছে ভবিষ্যতের ইতিহাস।
সেই কুয়াশা ঢাকা রাতেই জন্ম নিল এক নতুন যুগ—যুগের নাম টেলিভিশন যুগ।বেয়ার্ড নিজের ডায়েরিতে লিখলেন—“আজ আলো আর মানুষের চোখের মধ্যে নতুন বন্ধন তৈরি হলো।”
২৬ জানুয়ারি ১৯২৬।স্থান — লন্ডনের ফ্রিথ স্ট্রিট, সোহো-এর ২২ নম্বর বাড়ি।একটি ছোট ঘর, ভেতরে পুরোনো মোটরের শব্দ, ধোঁয়া আর গরম বাতাস। সেই ঘরেই ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জন লোগি বেয়ার্ড,
চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে উচ্ছ্বাসের ছাপ।
বছরের পর বছর ধরে তিনি যে স্বপ্ন বুনেছেন,
আজ সেই স্বপ্নের পর্দা উঠতে যাচ্ছে।
বেয়ার্ড টেবিলের ওপর তাঁর তৈরি যন্ত্রগুলো সাজালেন—লেন্স, তার, ডিস্ক, আলো, আর একটি বিশেষ কাচের বাক্স।বাক্সটির ভেতরেই দেখা যাবে ইতিহাসের প্রথম জীবন্ত মুখ।
তিনি নিজের সহকারী উইলিয়াম টেন্টন-কে বললেন,“টেন্টন, আলোটা জ্বালাও। আজ আমাদের পরীক্ষা সফল না হলে আমি হাল ছেড়ে দেব।”টেন্টন মাথা নেড়ে বললেন,“স্যার, আমি বিশ্বাস করি—আজ হবে।”বেয়ার্ড নিঃশ্বাস নিলেন গভীরভাবে, আর সুইচ টিপলেন।
যন্ত্রের গুনগুন শব্দ ঘর ভরিয়ে দিল। চাকতি ঘুরছে দ্রুত, আলো কাঁপছে। বেয়ার্ডের চোখ কাচের বাক্সে স্থির।হঠাৎ— একটা অস্পষ্ট ছায়া ফুটে উঠল পর্দায়। মুহূর্তের মধ্যেই সেই ছায়া বদলে গেল এক মানুষের মুখে! চোখ, নাক, ঠোঁট—সব দেখা যাচ্ছে, যদিও কালো-সাদা আলোয় ঝাপসা।
বেয়ার্ড বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন— “দেখো! এটাই সে! জীবন্ত মুখ—এখন পর্দায়!”ঘরের ভেতর কেউ কথা বলল না। সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল পর্দার দিকে।একজন মানুষ, অন্য ঘর থেকে,এখন দেখা যাচ্ছে কাচের পর্দায়, তার মুখ নড়ছে, ঠোঁট কাঁপছে।
সেদিন উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক।তাঁরা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন।কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।
একজন সাংবাদিক পরে লিখেছিলেন—“মনে হচ্ছিল, আমি জাদু দেখছি।এক মানুষ, আলো আর তারের ভেতর দিয়ে অন্য জায়গায় উপস্থিত!”বেয়ার্ড নীরবে হাসলেন। তাঁর চোখে জল চলে এলো। বছরের পর বছর ক্ষুধা, ঠান্ডা, ব্যর্থতা— সব মিলিয়ে আজ যেন সার্থকতা পেল।
সে দিনটি—২৬ জানুয়ারি ১৯২৬— মানব ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। কারণ সেই দিনই প্রথমবার “চলমান চিত্র” পৌঁছাল মানুষের ঘরে।
বেয়ার্ড পরে বলেছিলেন,“আমি জানি, একদিন পৃথিবীর প্রতিটি ঘরে এই কাচের বাক্স থাকবে, আর মানুষ এর মধ্যেই পৃথিবীকে দেখবে।”
তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলো—আজ কোটি কোটি ঘরে টেলিভিশন আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। আর তার শুরু হয়েছিল সেই অদ্ভুত, বিস্ময়কর সকালে।
বেয়ার্ড জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।বাইরে শীতল সকাল, কুয়াশা ঢাকা লন্ডন।কিন্তু তাঁর চোখে তখন সূর্যের মতো আলো।তিনি নরম কণ্ঠে বললেন, “আজ পৃথিবী একটু বদলে গেল।”
সেই বছরের শেষে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটে তিনি সাংবাদিকদের সামনে এই যন্ত্র প্রদর্শন করলেন। সবার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
তারা দেখল— এক কাচের বাক্সে নড়ছে মানুষের মুখ! এটাই ছিল বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার।
১৯২৭ সাল। লন্ডনের শীতল সকাল। বেয়ার্ড তাঁর পুরোনো ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
চোখে সেই পুরোনো ক্লান্তি, কিন্তু মুখে নতুন আত্মবিশ্বাস। কারণ, এখন তিনি জানেন- তাঁর “টেলিভিশন” কেবল যন্ত্র নয়, এটা একটি যুগের সূচনা।
সে বছরই, ১৯২৭ সালে, বেয়ার্ড ইতিহাসের আরেক নতুন দিক খুললেন। তিনি লন্ডন থেকে গ্লাসগো, প্রায় ৪০০ মাইল দূরের শহরে
প্রথমবার টেলিভিশন সংকেত পাঠাতে সক্ষম হলেন!
কাচের বাক্সের ছোট্ট পর্দায় দেখা গেল একটি মানুষের মুখ—দূর শহর থেকে সরাসরি!এটা ছিল বিশ্বের প্রথম দূরবর্তী টেলিভিশন সম্প্রচার।সে সময় উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, “এ যেন সময় আর স্থান—দু’টোই ভেঙে দিল।”
বেয়ার্ড থামলেন না। তিনি তখন প্রায় নির্ঘুমভাবে কাজ করতেন।এক এক করে বানালেন অবিশ্বাস্য সব জিনিস—১৯২৮: রঙিন টেলিভিশনের প্রথম প্রোটোটাইপ! (তিনটি রঙ — লাল, সবুজ, নীল — ব্যবহার করে)। ১৯২৯: ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (BBC)- এর সাথে যৌথভাবে
বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার। ১৯৩০: প্রথমবার বিদেশে — ফ্রান্স, আমেরিকা ও জার্মানিতে তাঁর প্রযুক্তি প্রদর্শিত হলো।
বেয়ার্ডের নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে।
লোকেরা তাঁকে বলত,“The man who made light speak.” — যে মানুষ আলোকে কথা বলিয়েছে।
১৯৩০ সালেই টেলিভিশনে প্রথমবার সংবাদ পাঠ হলো।একটি ছোট ঘরে বসে একজন উপস্থাপক কথা বলছিলেন,আর লন্ডনের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু পরিবার সেই দৃশ্য দেখছিলেন!
বেয়ার্ড পরে বলেছিলেন,“এ এক নতুন জানালা—
যার মাধ্যমে মানুষ পুরো পৃথিবীকে দেখতে পারবে।”তিনি স্বপ্ন দেখতেন—একদিন স্কুলের ক্লাস, নাটক, এমনকি ক্রীড়া অনুষ্ঠানও সবই দেখা যাবে ঘরে বসে।
কিন্তু এই সাফল্যের মাঝেও ঝড় থামেনি।
বেয়ার্ডের প্রযুক্তি ছিল যান্ত্রিক (Mechanical TV)।অন্যদিকে, মার্কিন বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন ইলেকট্রনিক টেলিভিশনে, যা ছিল দ্রুত ও স্পষ্ট।
১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়েই
বেয়ার্ডের কোম্পানি BBC-এর চুক্তি হারিয়ে ফেলে। তবুও তিনি নিরাশ হননি। নিজের গবেষণাগারে বসে বলতেন,“আমার কাজ যদি শেষও হয়, টেলিভিশনের যাত্রা চলবে।”
১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপ উত্তপ্ত। বেয়ার্ড তখন অসুস্থ, বয়স বাড়ছে।
তবুও নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করছিলেন—
তিন-মাত্রিক (3D) টেলিভিশন ও রঙিন সম্প্রচারের ওপর।
বন্ধুরা বলত,“বেয়ার্ড, এখন বিশ্রাম নাও।”
তিনি হেসে বলতেন, “বিশ্রাম? টেলিভিশনের চোখ এখনো পুরো পৃথিবী দেখেনি।”
১৯৪৬ সালে,বেয়ার্ড শেষবার নিজের টেলিভিশন চালিয়ে দেখলেন BBC-এর সম্প্রচার।
তিনি নরম স্বরে বললেন, “এটাই আমার সন্তানের কথা বলা।”
১৯৩৬ সালে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল বেয়ার্ডের।
তবুও তিনি রঙিন টেলিভিশনের দিকেও কাজ করছিলেন।১৪ জুন ১৯৪৬। ৬ বছর যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর পরিশ্রমের পর,এই মহান উদ্ভাবক চিরনিদ্রায় যান।
কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর পরই, টেলিভিশন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে— যে যন্ত্রকে একসময় সবাই “অবাস্তব” বলেছিল, তা হয়ে উঠল মানবজাতির “দ্বিতীয় চোখ”।
জন লোগি বেয়ার্ডের জীবন এক শিক্ষা— যে মানুষ নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস করে, সে একা হলেও ইতিহাস বদলে দিতে পারে।
তিনি ছিলেন না কোনো ধনী বিজ্ঞানী, ছিল না রাজকীয় ল্যাব,ছিল শুধু এক অটল বিশ্বাস—“ একদিন মানুষ এক কাচের বাক্সে পৃথিবীকে দেখতে পারবে।”
আজ যখন আমরা টেলিভিশনের পর্দায় পৃথিবীর খবর দেখি, হয়তো কোথাও আকাশের ওপারে
বেয়ার্ড মৃদু হেসে বলেন, “আমি তো বলেছিলাম, এটা সম্ভব।”