অসম্ভবকে সম্ভব করা এক যোদ্ধা: আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর জীবন কাহিনি
অসম্ভবকে সম্ভব করা এক যোদ্ধা: আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর জীবন কাহিনি
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬ সালের জুলাই মাসের ২০ তারিখে, এক ঝলমলে গ্রীষ্মের রাতে, গ্রীসের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ম্যাসিডোনিয়া রাজ্যের পেল্লা নগরীতে জন্ম নিলেন এক শিশুপুত্র— যিনি একদিন বিশ্ব মানচিত্র বদলে দেবেন। তাঁর নাম রাখা হলো আলেকজান্ডার। পিতা ছিলেন সেই সময়ের শক্তিশালী রাজা ফিলিপ দ্বিতীয়, আর মাতা ছিলেন রহস্যময় সৌন্দর্যের অধিকারিণী, ধর্মপ্রাণ ও দৃঢ়চেতা রানি অলিম্পিয়াস।
কথিত আছে, তাঁর জন্মের রাতটি ছিল এক অলৌকিক রাত। সেই রাতে দেবী আর্টেমিসের মন্দিরে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠেছিল, দূরে আকাশে উল্কাপাত হয়েছিল, আর ম্যাসিডোনিয়ার আকাশে অদ্ভুত আলো দেখা গিয়েছিল। পুরোহিতেরা বলেছিলেন—“আজ এমন এক সন্তানের জন্ম হয়েছে, যে একদিন পৃথিবী জয় করবে।”
শৈশব থেকেই আলেকজান্ডার ছিলেন অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা। প্রাসাদের সোনালি দেয়াল, পাহাড়বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সৈনিকদের কুচকাওয়াজের শব্দে তাঁর বেড়ে ওঠা। কিন্তু রাজকীয় বিলাসিতা কখনোই তাকে অলস করে তুলতে পারেনি। বরং তার চোখে ছিল এক অদম্য কৌতূহল—পৃথিবীকে জানার, মানুষকে বোঝার, আর নিজের সীমা ছাপিয়ে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা।
তার মা অলিম্পিয়াস প্রায়ই তাকে বলতেন— “তুমি শুধু একজন রাজপুত্র নও, তুমি দেবতার সন্তান। তোমার রক্তে আছে জিউসের বীরত্ব।”
এই কথাগুলো ছোট্ট আলেকজান্ডারের মনে এক বিশেষ বিশ্বাস তৈরি করেছিল—সে অন্যদের চেয়ে আলাদা, এবং তার জীবনের উদ্দেশ্য বড় কিছু করা।
ছোট থেকেই সে ছিল নির্ভীক। মাত্র ১২ বছর বয়সে তার জীবনের এক বিখ্যাত ঘটনা ঘটে। রাজা ফিলিপ এক বন্য ঘোড়া কিনেছিলেন— বুসেফেলাস। কিন্তু ঘোড়াটি এতই হিংস্র ছিল যে কোনো সৈন্যই তাকে বশ করতে পারছিল না। সবাই যখন ব্যর্থ, তখন ছোট্ট আলেকজান্ডার এগিয়ে এসে বলল, “আমাকে চেষ্টা করতে দাও।” রাজা প্রথমে হাসলেন, কিন্তু ছেলের চোখে এমন আত্মবিশ্বাস দেখলেন যে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
আলেকজান্ডার লক্ষ্য করল— ঘোড়াটি নিজের ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে। সে ঘোড়ার মাথা সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিল, কোমলভাবে তার গলা ছুঁয়ে শান্ত করল, তারপর ধীরে ধীরে তার পিঠে চড়ে বসল। মুহূর্তেই সবাই হতবাক— ঘোড়াটি স্থির! আলেকজান্ডার তাকে পুরো রাজপথে দৌড় করিয়ে আনল, বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে।
রাজা ফিলিপ তখন আবেগে ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন— “বেটা, ম্যাসিডোনিয়া তোমার জন্য ছোট। একদিন তুমি পুরো পৃথিবী জয় করবে!” এই ঘটনাটিই যেন ছিল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
শিশুকালেই আলেকজান্ডার নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্র গড়ে তোলে— একদিকে সে দার্শনিকের মতো চিন্তা করে, অন্যদিকে সৈনিকের মতো কাজ করে। বন্ধুদের মধ্যে নেতৃত্ব, সাহস ও সহানুভূতি— সবকিছুতেই সে ছিল অসাধারণ।
সে যখন পাহাড়ে ঘোড়া নিয়ে চড়ত, বাতাসে চুল উড়ত, আর চোখে থাকত দূরের দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকা স্বপ্ন—যে স্বপ্ন তাকে একদিন নিয়ে যাবে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, জয় করবে তিন মহাদেশ—ইউরোপ, এশিয়া, ও আফ্রিকা।
শিশু আলেকজান্ডার যখন একটু বড় হলো— প্রায় ১৩ বছর বয়সে— তখন রাজা ফিলিপ বুঝলেন, এই ছেলেটি সাধারণ কোনো রাজপুত্র নয়। তার মধ্যে আছে এক অদম্য কৌতূহল, এক অস্থির বুদ্ধি, আর নেতৃত্বের সহজাত ক্ষমতা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ছেলেকে এমন একজন শিক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে, যিনি কেবল বইয়ের জ্ঞানই নয়, জীবনবোধও শেখাতে পারবেন।
তখনই রাজা ফিলিপ ডেকে আনলেন প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে মহান দার্শনিকদের একজন— অ্যারিস্টটল। তিনি ছিলেন প্লেটোর শিষ্য, আর যুক্তি, দর্শন ও বিজ্ঞানে তাঁর মতো পণ্ডিত খুব কমই ছিল। রাজা তাঁর কাছে অনুরোধ করলেন— “আমার পুত্রকে এমনভাবে শিক্ষা দিন, যেন সে শুধু রাজা না হয়, একজন মহাজ্ঞানী মানুষ হয়।”
অ্যারিস্টটল এই আহ্বান গ্রহণ করলেন, এবং পেল্লা শহরের কাছে এক নিরিবিলি জায়গায়—মিয়েজা গ্রামে —একটি বিদ্যালয় গড়ে তুললেন। সেখানে শুরু হলো রাজপুত্র আলেকজান্ডারের শিক্ষা।
প্রতিদিন সকালে, বাগানের ছায়াতলে বা পাহাড়ের ঢালে বসে অ্যারিস্টটল তাঁকে শেখাতেন যুক্তি, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা, ইতিহাস, ভূগোল, এবং নৈতিকতা। কিন্তু শুধু বই পড়ানো নয়—অ্যারিস্টটল চাইতেন তাঁর ছাত্রটি পৃথিবীকে দেখুক, প্রশ্ন করুক, ভাবুক।
তিনি আলেকজান্ডারকে বলতেন,“একজন রাজা তখনই মহান হয়, যখন সে জ্ঞানের আলোয় শাসন করে, তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে নয়।”
আলেকজান্ডার গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি পাঠ শুনত। কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস ও দর্শন। তিনি প্রায়ই হোমারের ইলিয়াড পড়ে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। বীর আকিলিসকে তিনি নিজের আদর্শ হিসেবে মানতেন, আর বিশ্বাস করতেন—যেমন আকিলিসের গৌরব যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, তেমনি তিনিও এমন কিছু করবেন যা পৃথিবী ভুলতে পারবে না। সেই বইটি আলেকজান্ডার সারাজীবন নিজের সঙ্গে রাখতেন। হোমারের বীর আকিলিস ছিল তার আদর্শ।
অ্যারিস্টটল শুধু জ্ঞান দেননি, বরং আলেকজান্ডারের মধ্যে চিন্তার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। তিনি শেখালেন প্রকৃতি ও মানবতার সম্পর্ক, শৃঙ্খলার গুরুত্ব, এবং ন্যায়ের শক্তি।তিনি বলতেন,“যে নিজের মন জয় করতে পারে, সে-ই সত্যিকারের বিজেতা।”
এই শিক্ষাগুলো আলেকজান্ডারের চরিত্রে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীতে যখন সে বিশাল সাম্রাজ্য জয় করল, তখনো অনেক সিদ্ধান্তে অ্যারিস্টটলের শিক্ষার ছায়া দেখা যায়।
তবে তাদের সম্পর্ক সবসময় শিক্ষক-শিষ্যের সীমানায় সীমাবদ্ধ ছিল না—তারা ছিলেন চিন্তা ও আদর্শের দুই যোদ্ধা। একদিকে অ্যারিস্টটল শেখাতেন জ্ঞানের গুরুত্ব, অন্যদিকে আলেকজান্ডার প্রস্তুত হচ্ছিল জ্ঞান ও শক্তি—দুটিরই বাস্তব প্রয়োগের জন্য।
আলেকজান্ডার পরবর্তীতে বলেছিলেন,“আমি জীবনের জন্য আমার পিতার কাছে ঋণী, কিন্তু ভালোভাবে বাঁচার পথ শেখানোর জন্য ঋণী আমার শিক্ষক অ্যারিস্টটলের কাছে।”
এভাবেই মিয়েজার নিরিবিলি বাগানে গড়ে উঠেছিল এক এমন সম্পর্ক— যা শুধু শিক্ষক ও ছাত্রের নয়, বরং দার্শনিক ও ভবিষ্যৎ সম্রাটের।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ সাল। গ্রীষ্মের এক দুপুরে ম্যাসিডোনিয়ার রাজপ্রাসাদে বাজছিল আনন্দের ঢোল। রাজা ফিলিপ দ্বিতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক মহাবিয়ের—তিনি নতুন করে বিবাহ করতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, কিন্তু শক্তি ও গৌরবে তখনো তিনি ছিলেন অপরাজেয়। সমগ্র গ্রীস তাঁর নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছে, আর তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন— পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের।
কিন্তু সেই উৎসবমুখর প্রাসাদে হঠাৎ নেমে এল এক কালো ছায়া। রাজা ফিলিপ যখন মন্দিরে প্রবেশ করছিলেন, তখন হঠাৎ তাঁরই এক দেহরক্ষী পাউসানিয়াস ছুরি নিয়ে তাঁর বুকে আঘাত করল। রাজা পড়ে গেলেন মাটিতে—রক্তে ভেসে গেল রাজদরবার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ম্যাসিডোনিয়ার মহারাজা নিহত হলেন।
দরবারে শোক ও ভয়ের ছায়া নেমে এলো। কে হবে পরবর্তী রাজা? রাজকন্যা, অভিজাত, সেনাপতি— সবার চোখ তখন এক তরুণের দিকে। বয়স মাত্র ২০ বছর—কিন্তু চোখে আছে আগুন, মনে আছে দৃঢ়তা। সে হলো আলেকজান্ডার।
রানি অলিম্পিয়াস কাঁদছিলেন, কিন্তু ছেলের চোখে জল ছিল না। সে নীরবে পিতার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে শপথ করল— “তুমি যে স্বপ্ন দেখেছিলে, বাবা, আমি তা শেষ করব। আমি তোমার অসমাপ্ত যাত্রা পূর্ণ করব।”
রাজা ফিলিপের মৃত্যুর কয়েকদিন পরই তরুণ আলেকজান্ডার ম্যাসিডোনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। সময়টা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ সালের শেষের দিক। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি হয়ে গেলেন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজা।
কিন্তু রাজত্ব পাওয়া যতটা সহজ, টিকিয়ে রাখা ততটা নয়। রাজা ফিলিপের মৃত্যুর পরপরই রাজ্যের চারপাশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। থ্রেস, থিবস, এথেন্স—সব জায়গায় শাসকরা মনে করল, এই তরুণ রাজা দুর্বল; এখনই বিদ্রোহের সময়।
আলেকজান্ডার বুঝলেন, প্রথমেই তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি কেবল রাজার ছেলে নন—নিজেই এক রাজা, এক যোদ্ধা।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সাল। আলেকজান্ডার তখন মাত্র ২২ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য পারস্যের দিকে অভিযান শুরু করলেন।
তাঁর সামরিক কৌশল, সাহস এবং দৃঢ় মনোবল তাকে এত তাড়াতাড়ি ইতিহাসের এক অমর নাম বানাতে চলেছিল।
আলেকজান্ডার প্রথম পদক্ষেপ রাখলেন এশিয়ার মাটিতে, যেখানে নবনির্মিত সীমানা, নদী এবং পাহাড় ছিল প্রতিকূলতার প্রতীক।তাঁর সৈন্যরা দারুণ অনুপ্রাণিত— প্রতিটি ধাপে তারা রাজা আলেকজান্ডারের সাহস দেখে নতুন শক্তি পেল।
একদিন রাতে তাঁরা একটি নদীর তীরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সৈন্যরা বলল,“মহারাজ, আমরা এত দূরে, বিপদের মাঝে। আপনি কি ভয় পান না?”
আলেকজান্ডারের উত্তর ছিল দৃঢ় ও অদম্য:“যদি আমি ভয় পাই, আমরা ইতিহাসের অংশ হতে পারব না। ভয়কে জয় করলেই মানুষ স্মরণীয় হয়ে ওঠে।”
প্রথম অভিযানে আলেকজান্ডারের পথে প্রতিরোধ করল পারস্যের সৈন্যদল।তাঁর কৌশল ছিল অনন্য— দ্রুত গতি, ফ্যালানক্স পদ্ধতি, এবং চমকপ্রদ আক্রমণ। প্রথম যুদ্ধেই তিনি দেখালেন— ছোট বাহিনীও কৌশলগত চিন্তায় বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারে।
সেনারা তাকিয়ে দেখল, রাজা নিজে অগ্রসারে, ঝুঁকি নিয়ে আক্রমণ করছে।এক সৈন্য কেঁপে উঠল, কিন্তু আলেকজান্ডার হাসলেন এবং বললেন,“আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সাহসের সঙ্গে থাক, ভয় পেও না।”
এই প্রথম জয়ের পর আলেকজান্ডারের আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁল। তিনি বুঝলেন—এশিয়ার প্রতিটি অংশই জয় করা সম্ভব, যদি কৌশল ও সাহস থাকে।
এই অভিযানে তিনি শুধু যুদ্ধ করলেন না, স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেন। তিনি দেখলেন, প্রতিটি রাজ্য, নদী, মন্দির ও মানুষের জীবনই এক নতুন জ্ঞান এবং কৌশলের শিক্ষার উৎস।মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন, বিশ্বাস করলেন— দেবতার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো জয় স্থায়ী হয় না।
প্রথম অভিযান আলেকজান্ডারের জন্য শুধুই সামরিক জয় নয়, বরং ভবিষ্যতের পরিকল্পনার সূচনা। তিনি জানতেন—এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করতে হলে শুধু শক্তি নয়, কৌশল, শিক্ষা, এবং মানুষের মন জয় করতে হবে।
তিনি সৈন্যদের বললেন,“এই প্রথম জয় আমাদের শেখালো—যদি সাহস থাকে, মানুষ সীমা অতিক্রম করতে পারে। ইতিহাস কেবল বীরের জন্য নয়, স্বপ্নদ্রষ্টার জন্যও লেখা হয়।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৩ সালের গ্রীষ্ম, আলেকজান্ডারের অভিযান পারস্যের দিকে এগিয়ে চলছিল।
তিনি পূর্বের রাজ্যগুলো জয় করেছিলেন, সৈন্যরা অনুপ্রাণিত, এবং পারস্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র দখলের পথে।কিন্তু হঠাৎ একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শহর থিবস বিদ্রোহ করল— গ্রীসের প্রাচীন শহর, যেখানে স্বাধীনতার অনুভূতি শক্তিশালী ছিল।
থিবসের মানুষ আলেকজান্ডারের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতা হাতানোর চেষ্টা করল।তারা জানত, আলেকজান্ডারের প্রতি সৈন্যরা এখনও আনুগত্যপূর্ণ, কিন্তু স্থানীয় নেতারা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছিল।
থিবসের গলি ও প্রাসাদ জুড়ে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল।শহরের ঘর-বাড়ি ও রাজপ্রাসাদে উত্তেজনা, অশান্তি, এবং আতঙ্ক।
আলেকজান্ডার খবর পেয়ে শহরে আসলেন।
তিনি দেখলেন— বিদ্রোহীরা শুধু শহর দখল করেনি, বরং সেনাদেরও প্ররোচিত করছে।এখন এক কঠিন সিদ্ধান্তের সময়— নরম হবেন নাকি কঠোরভাবে শাস্তি দেবেন?তিনি ভাবলেন,“যদি আমি নম্র হই, বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে।যদি কঠোর হই, শহর ভেঙে যাবে, কিন্তু অন্যরা শিখবে— আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।”
আলেকজান্ডার সিদ্ধান্ত নিলেন কঠোরভাবে শাস্তি দেওয়া। তিনি সৈন্যদের সঙ্গে শহরে ঢুকলেন।সৈন্যরা দেখল— রাজা নিজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, পেছনে কেউ নেই।তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেন, শহরের প্রাচীর ধরে ঘোরাঘুরি, গলি-গলিতে আক্রমণ।
সৈন্যরা শোনালেন,“মহারাজ, শহর পুরোপুরি ধ্বংস হবে।”আলেকজান্ডার শান্ত কণ্ঠে বললেন,“শক্তি ছাড়া শান্তি আসে না। যারা বিদ্রোহ করে, তাদের শিক্ষা দিতে হবে।”শেষ পর্যন্ত থিবস পুরোপুরি ধ্বংস হলো।
যুদ্ধ শেষে তিনি শহরের নেতৃত্বের সঙ্গে কঠোর আলোচনা করলেন,যেন অন্য শহর কখনো বিদ্রোহ করার সাহস না পায়।
থিবস বিদ্রোহের কঠিন সিদ্ধান্ত আলেকজান্ডারের জন্য শুধুই রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি ছিল এক শিক্ষা—যুদ্ধ জেতার পাশাপাশি নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা। তিনি সৈন্যদের বললেন,“যে শক্তির সম্মান জানে না, সে কখনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না। সাহস এবং দায়িত্বই সত্যিকারের নেতা গড়ে তোলে।”
থিবস ধ্বংসের পর, অন্য শহরগুলোকে সতর্ক করা হলো। আলেকজান্ডার তখন বুঝলেন— যুদ্ধের শক্তি শুধু বাহুতে নয়, মনের দৃঢ়তা, কৌশল এবং সঠিক সময়ের সিদ্ধান্তে।এটি তাঁর জীবনের প্রথম বড় রাজনৈতিক ও সামরিক পাঠ হয়ে রয়ে গেল,
যা পরবর্তীতে এশিয়া জয়ের জন্য মূল ভিত্তি গড়ে দিল।
এইসব বিদ্রোহ দমন করে তিনি এক বছর পর ম্যাসিডোনিয়ায় ফিরে এলেন। তখন তাঁর বয়স ২২। চারদিকে এখন প্রশংসা, ভয়, আর শ্রদ্ধা। তিনি ঘোষণা দিলেন— “এবার আমাদের লক্ষ্য, গ্রীসের প্রতিশোধ। পারস্যকে হারাতে হবে।”
তাঁর পিতা ফিলিপ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন—পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেই স্বপ্ন পূরণের পথে পা রাখলেন আলেকজান্ডার। তিনি সৈন্যদের জড়ো করলেন—প্রায় ৪০,০০০ পদাতিক ও ৫,০০০ অশ্বারোহী।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালের বসন্তে, এপ্রিল মাসে, এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে, তিনি গ্রীস ও এশিয়ার মাঝের হেলেসপন্ট (বর্তমান দার্দানেলস প্রণালী) পাড়ি দিলেন। তলোয়ার বের করে তিনি সমুদ্রের ঢেউয়ে ছুঁড়ে মারলেন এবং বললেন— “জিউস সাক্ষী থাকুক, আজ থেকে আমি এশিয়ায় প্রবেশ করছি— জয় করার জন্য, ধ্বংস নয়; শাসন করার জন্য, কিন্তু অন্যায় নয়।”
সেই ছিল তাঁর প্রথম বিশ্বজয়ের যাত্রা। সামনে অপেক্ষা করছিল পারস্য সাম্রাজ্যের বিশাল সৈন্যবাহিনী, অজানা ভূমি, আর অগণিত বিপদ। কিন্তু আলেকজান্ডারের চোখে ছিল শুধু এক লক্ষ্য—
“পুরো পৃথিবী জয় করতে হবে।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালের এপ্রিল মাস। বসন্তের নরম হাওয়া বইছে গ্রীসের আকাশে। কিন্তু ম্যাসিডোনিয়ার তরুণ সম্রাট আলেকজান্ডার তখন প্রস্তুত হচ্ছেন এক মহাযাত্রার জন্য—যে যাত্রা কেবল যুদ্ধের নয়, ইতিহাস গড়ার। বয়স তাঁর মাত্র ২২ বছর, কিন্তু মন তাঁর দৃঢ়, চোখে আছে পৃথিবী জয় করার জ্বালা।
তিনি সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ আমরা গ্রীসের সম্মান ফেরত নিতে যাচ্ছি। শত বছর আগে পারস্য আমাদের দাস বানাতে চেয়েছিল, আজ আমরা তাদের সামনে দাঁড়াব মুক্ত জাতি হিসেবে!”
প্রায় ৪০,০০০ পদাতিক সৈন্য ও ৫,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে আলেকজান্ডার ম্যাসিডোনিয়া থেকে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁরা হেলেসপন্ট (বর্তমান তুরস্কের দার্দানেলস প্রণালী) পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেন এশিয়া মাইনরে— পারস্য সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে।
নদী পার হওয়ার সময় তিনি এক প্রতীকী কাজ করলেন— তলোয়ার বের করে সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে নিক্ষেপ করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, “হে সমুদ্রদেবতা, তুমি সাক্ষী থাকো— এশিয়া জয় করতে এসেছি, ধ্বংস করতে নয়; সভ্যতা আনতে, সম্মান ফিরিয়ে দিতে।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালে, আলেকজান্ডার গ্রীসকে শান্ত করে সামরিক শক্তি গড়ে তোলেন।তার লক্ষ্য স্পষ্ট—পারস্য সাম্রাজ্য জয় করা, যা তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল শক্তি।এশিয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ, হালকার্ণাসাস, লিডিয়া আর ফিনিশিয়ার উপকূল অতিক্রম করল।
সেনারা তাঁকে অবাক চোখে দেখল—এক তরুণ রাজা, যিনি রাতে শিবিরে ঘুমান, সকালে শত্রুর শিবিরে হাজির।একবার এক সেনা বলল, “মহারাজ, আপনি কি কখনও ভয়ে কমবেন না?” আলেকজান্ডারের উত্তর ছিল, “যদি আমি ভয় পাই, তাহলে ইতিহাস আমাকে ভুলে যাবে। আর আমি কখনও ভুলতে চাই না।”
এশিয়ার পথে প্রথমেই আলেকজান্ডার দেখলেন নানা ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য। সাগর, নদী, মরুভূমি, পাহাড়—সবই যেন তাঁর কৌশল, সাহস ও ধৈর্য পরীক্ষা করছে। পারস্য সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিভিন্ন উপজাতি ও রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করলেন।
তাঁর প্রতি ছিল এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা, কারণ তারা দেখল—ছোট রাজা, কিন্তু মনে অদম্য আগুন।
এশিয়ায় প্রবেশ করার পর আলেকজান্ডার প্রতিটি স্থানে দেবতাদের পূজা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধই সব নয়—দেবতার আশীর্বাদও গুরুত্বপূর্ণ। মিশরে পৌঁছালে তিনি নীল নদীর তীরে দেবতা আমুন-রার মন্দিরে যান। প্রাচীন পুরোহিতরা তাঁকে দেখে বলল,“তুমি দেবতার সন্তান। তোমার রক্তে সূর্যের আলো।”
এটি তাঁর আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করল।
তিনি বলেন, “যে সাহসিকতা দেবতার আশীর্বাদ পায়, সেই সাহসিকতা কখনো হারায় না।”
মিশরে পৌঁছে আলেকজান্ডার প্রতিষ্ঠা করলেন আলেকজান্দ্রিয়া— জ্ঞান, বাণিজ্য ও সভ্যতার কেন্দ্র। শহরটি শুধু বিজয়ের প্রতীক নয়, বরং মানুষের সম্ভাবনা, শৈল্পিক কল্পনা ও শিক্ষা কেন্দ্র।তিনি সৈন্য ও নাগরিকদের বলতেন,“আমাদের জয় শুধু যুদ্ধ নয়, আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐক্য।”
এশিয়ায় প্রথম পদক্ষেপ কেবল জয়ের যাত্রা নয়,
বরং এটি একটি স্বপ্নের সূচনা— দুনিয়ার বিভিন্ন মানুষ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির একত্রিকরণ।
আলেকজান্ডারের চোখে সবই সম্ভাবনা:পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্য জয় করা,মিশরের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে পরিচয়,এবং ভারত ও এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রবেশ।
তিনি ভাবতেন,“যে স্বপ্ন দেখতে পারে, সে সীমা পেরোতে পারে।ইতিহাস শুধুমাত্র বিজয়ীদের জন্য নয়—স্বপ্ন দেখার সাহসী মানুষের জন্য।”
এদিকে পারস্য সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল— “গ্রীসের তরুণ রাজা সৈন্য নিয়ে এশিয়ায় প্রবেশ করেছে!” পারস্যের রাজা দারিয়ুস তৃতীয় তখন রাজধানী পার্সেপোলিসে ছিলেন। তিনি ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলার দায়িত্ব দিলেন তাঁর প্রাদেশিক গভর্নরদের।
এশিয়া মাইনারের সাতজন সাত্রাপ (গভর্নর) মিলিত হয়ে এক সেনাবাহিনী গঠন করল—প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য। তাদের সঙ্গে ছিল ১০,০০০ অশ্বারোহী, এবং তারা অবস্থান নিল গ্রানিকাস নদীর তীরে, বর্তমান তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমে। তাদের উদ্দেশ্য—নদী পার হওয়ার আগেই আলেকজান্ডারের সৈন্যদলকে ধ্বংস করে দেওয়া।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালের মে মাসের শেষের দিকে, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে, আলেকজান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনী পৌঁছাল গ্রানিকাস নদীর পাড়ে। নদীর অপর পারে দাঁড়িয়ে আছে পারস্য বাহিনী।
অনেক সেনাপতি পরামর্শ দিলেন—“আজ নদী পাড়ি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।” কিন্তু আলেকজান্ডারের চোখে ছিল এক অন্য আগুন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,“আমরা এখানে জয়ের জন্য এসেছি, ঘুমানোর জন্য নয়। যদি মৃত্যুও আসে, আমি চাই তা আসুক সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে।”
তিনি ঘোড়ায় চড়ে নদীতে নেমে গেলেন—পানি তখন বুকসমান। তাঁর পিছু নিলেন হাজার হাজার সৈন্য। এ দৃশ্য দেখে পারস্য বাহিনী মুহূর্তেই আক্রমণ শুরু করল। তলোয়ারের ঝলকানি আর ঘোড়ার চিৎকারে নদী রক্তে লাল হয়ে উঠল।
আলেকজান্ডার নিজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সামনের সারিতে। পারস্য বাহিনীর অশ্বারোহীরা তাঁকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। একজন পারস্য সেনাপতি, স্পিথ্রিদাতেস, তাঁর মাথায় আঘাত করল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত সেনাপতি ক্লেইটাস দ্য ব্ল্যাক তাঁর প্রাণ বাঁচান— স্পিথ্রিদাতেসের মাথা কেটে ফেলেন।
যুদ্ধ ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠল। পারস্য বাহিনী সংখ্যায় বেশি হলেও, ম্যাসিডোনিয়ান সেনারা ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ ও দ্রুতগামী। নদীর ধারা, কাদা আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে তারা পারস্য বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলল।
অবশেষে সূর্য ডুবল রক্তমাখা আকাশে। পারস্য বাহিনী পিছু হটল, এবং আলেকজান্ডার বিজয় ঘোষণা করলেন। গ্রানিকাস নদীর যুদ্ধ শেষ হলো— এ ছিল তাঁর প্রথম বড় যুদ্ধ এবং তাঁর প্রথম জয়।
যুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর সেনাদের বললেন,“যারা সাহস দেখিয়েছে, তারা আমার ভাই; যারা প্রাণ দিয়েছে, তারা অমর।” তিনি নিহত সৈন্যদের সম্মান দিয়ে সমাধিস্থ করেন, আহতদের নিজে গিয়ে দেখতে যান, তাদের কাঁধে হাত রাখেন। শত্রুদেরও নির্দোষ নাগরিকদের হত্যা করতে নিষেধ করেন। এতে স্থানীয় মানুষরা বিস্মিত হয়—তাদের চোখে আলেকজান্ডার কেবল এক বিজেতা নয়, এক ন্যায়পরায়ণ নেতা।
গ্রানিকাসের বিজয়ের পর অনেক গ্রীক নগর-রাষ্ট্র পারস্যের কবল থেকে মুক্ত হয়—সারডিস, ইফিসাস, মাইলেটাস, একে একে তাঁর পতাকার নিচে আসে।
এই প্রথম জয়েই পৃথিবী বুঝে গেল— এ তরুণ রাজা সাধারণ কেউ নন। ইতিহাসে এমন খুব কম মানুষ আছে, যারা প্রথম যুদ্ধেই এমন কৌশল, সাহস আর নেতৃত্ব দেখিয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালের মে মাসে গ্রানিকাস নদীর তীরে জয় লাভের পর, মাত্র ২২ বছর বয়সী সম্রাট আলেকজান্ডার এখন হয়ে উঠেছেন এক ভয়ংকর শক্তি। তাঁর বিজয় যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিম এশিয়ায়। পারস্য সাম্রাজ্যের শহরগুলো একে একে পতন হচ্ছে—সারডিস, ইফিসাস, মাইলেটাস, হালিকারনাসাস—সব জায়গায় তাঁর পতাকা উড়ছে।
তবে এইসব জয়ের পরও তাঁর চোখে ছিল এক স্বপ্ন—পারস্যের রাজা দারিয়ুস তৃতীয়কে পরাস্ত করা।দারিয়ুস এখন নিজের রাজধানী পার্সেপোলিস থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর কাছে বার্তা এলো—“একজন তরুণ গ্রীক রাজা, আলেকজান্ডার, তোমার অর্ধেক বয়সেরও কম; কিন্তু সে তোমার অর্ধেক সাম্রাজ্য দখল করে ফেলেছে।”
এই খবর দারিয়ুসের অহংকারে আগুন ধরিয়ে দিল। তিনি ঘোষণা করলেন—“এবার আমি নিজেই যুদ্ধে নামব, এবং তাকে চিরতরে ধ্বংস করব।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালের শেষ থেকে ৩৩৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, আলেকজান্ডার পশ্চিম এশিয়ার উপকূল ধরে এগিয়ে চললেন। প্রতিটি শহরে তিনি একই নীতি অনুসরণ করলেন—যদি শহর আত্মসমর্পণ করে, তবে শান্তি; যদি প্রতিরোধ করে, তবে যুদ্ধ।
এক শহরে দেখা যায়, পারস্যের নিযুক্ত গভর্নররা পালিয়ে গেছে। সাধারণ মানুষরা আলেকজান্ডারের সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে— “আমরা পারস্যের অত্যাচারে ক্লান্ত, আমাদের মুক্তি দিন।”
আলেকজান্ডার তাদের শান্ত করলেন, করমুক্ত ঘোষণা দিলেন, এবং বললেন— “আমি বিজেতা হিসেবে নই, মুক্তিদাতা হিসেবে এসেছি।”এভাবেই তিনি শুধু তলোয়ারে নয়, মানুষের হৃদয়েও জয় করতে থাকলেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৩ সালের নভেম্বর মাস। বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণের ইস্যাস উপত্যকা। দারিয়ুস বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন—প্রায় ৬ লাখ সৈন্য, যার মধ্যে আছে রাজকীয় রথ, হাতি, অশ্বারোহী, আর অসংখ্য পদাতিক বাহিনী।
অন্যদিকে আলেকজান্ডারের বাহিনী মাত্র ৪০ হাজার সৈন্য। কিন্তু তাঁর কৌশল, গতি ও নেতৃত্ব ছিল সেই বিশাল বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী।
যুদ্ধ শুরু হলো ইস্যাস নদীর তীরে। পারস্য বাহিনী সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায় তারা চারদিক ঘিরে ফেলল। দারিয়ুস নিজে তাঁর রথে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
কিন্তু আলেকজান্ডার হঠাৎ এক দিক দিয়ে ঝড়ের মতো আক্রমণ করলেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গেলেন সরাসরি পারস্য রাজা দারিয়ুসের দিকে!
রাজা ভীত হয়ে পড়লেন, তাঁর সৈন্যরা বিশৃঙ্খল হয়ে গেল। আলেকজান্ডারের বর্শার এক ঝলক পারস্য রাজরথের চাকা ছুঁয়ে গেল, আর সেই আতঙ্কে দারিয়ুস রথ ছেড়ে পালালেন।
যুদ্ধের শেষে পারস্য বাহিনী সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। গ্রীক বাহিনী বিজয়ী হলো। আলেকজান্ডার দখল করলেন রাজকীয় তাঁবু, অসংখ্য ধনসম্পদ, এবং সবচেয়ে অবাক করা জিনিস—দারিয়ুসের স্ত্রী, মা, ও দুই কন্যা বন্দি অবস্থায়।
কিন্তু আলেকজান্ডার তাদের কোনো ক্ষতি করেননি। তিনি তাঁদের রাজকীয় মর্যাদা দিয়ে বললেন, “আমি রাজাকে পরাজিত করেছি, তাঁর পরিবারকে নয়।”এই মহানুভবতা শুনে দারিয়ুস তাঁকে চিঠি পাঠালেন— “তুমি আমার মতো শত্রুও নও, তুমি রাজাদের মধ্যে এক রাজা।”
ইস্যাসের যুদ্ধের পর আলেকজান্ডার দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন—লক্ষ্য ছিল ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের সমস্ত বন্দর দখল করা, যাতে পারস্যের নৌবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
ফিনিশিয়ার অনেক শহর আত্মসমর্পণ করল, কিন্তু এক শহর দাঁড়িয়ে গেল দৃঢ়ভাবে—টাইর। টাইর ছিল এক সমুদ্রদ্বীপে গড়া দুর্গনগরী, চারপাশে গভীর সমুদ্র, উঁচু প্রাচীর, আর অসাধারণ নৌবাহিনী। তারা ঘোষণা দিল— “কেউ টাইর জয় করতে পারবে না। এমনকি দেবতারাও নয়।”
আলেকজান্ডার শুনে শান্তভাবে বললেন,“তাহলে আমি দেবতা হবো না, কিন্তু ইতিহাস হবো।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হলো টাইর অবরোধ যুদ্ধ। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন—স্থল থেকে সাগরের মাঝে পাথর ফেলে একটি রাস্তা তৈরি করতে, যেন সৈন্যরা দ্বীপে পৌঁছাতে পারে। মাসের পর মাস কেটে গেল। টাইরের নাবিকরা নৌকা থেকে তীর ছুড়তে লাগল, কিন্তু আলেকজান্ডার থামলেন না।
ছয় মাস পর, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালের জুলাই মাসে, তাঁর সেনারা টাইরের দেয়ালে আঘাত হানে। প্রবল যুদ্ধের পর দুর্গ পতন ঘটে। সাত মাসের অবরোধ শেষে টাইর জয় হয়।
আলেকজান্ডার সেই শহর পুনর্গঠন করেন, বন্দিদের মধ্যে যারা নিরীহ ছিল তাদের মুক্তি দেন। তাঁর এই যুদ্ধসাফল্য দেখার পর মিশর, জেরুজালেম, সিরিয়া পর্যন্ত মানুষ তাঁর নাম উচ্চারণ করতে থাকে শ্রদ্ধায়।
টাইর জয় শেষে আলেকজান্ডার দক্ষিণমুখে যাত্রা করলেন—গন্তব্য মিশর। পারস্য শাসকরা মিশর ছেড়ে পালিয়ে গেল, এবং মিশরের জনগণ তাঁকে বরণ করল মুক্তিদাতা হিসেবে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালের শেষ দিকে, আলেকজান্ডার মিশরে প্রবেশ করলেন।
সেখানকার পুরোহিতেরা তাঁকে ঘোষণা দিলেন— “তুমি শুধু রাজা নও, তুমি সূর্যদেব রা-এর সন্তান।”
এই কথায় যেন সত্যি হয়ে গেল তাঁর মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী— “তুমি দেবতার সন্তান, তোমার নিয়তি পৃথিবী জয় করা।”মিশরে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া নামের এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন—যা পরবর্তীতে হবে জ্ঞান ও সভ্যতার এক কেন্দ্র।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালের শেষ প্রান্তে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে, আলেকজান্ডার তখন গ্রীস থেকে মিশর পর্যন্ত সব জয় করে ফেলেছেন।দারিয়ুস তৃতীয় এখন পারস্যের অন্তর্দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন, নতুন বাহিনী গঠনের জন্য।আর আলেকজান্ডার প্রস্তুত হচ্ছেন—বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপোলিস দখল করার জন্য।
তাঁর চোখে তখন একটাই লক্ষ্য—“যতক্ষণ পৃথিবী আছে, ততক্ষণ জয়ের যাত্রা থামবে না।”
এভাবেই এশিয়ার হৃদয়ে শুরু হলো সেই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা, যা ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে—
“আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট”-এর বিজয়পথ হিসেবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সাল। পারস্য জয় করে আলেকজান্ডার তখন ইতিহাসের সর্বশক্তিমান সম্রাট। গ্রীস থেকে মিশর, পারস্য থেকে আফগানিস্তান—সব জায়গায় তাঁর পতাকা উড়ছে। কিন্তু তবু তাঁর চোখে শান্তি নেই।
তিনি বললেন,“যতক্ষণ দিগন্তে নতুন সূর্য ওঠে, আমার পথ শেষ নয়।”
এবার তাঁর দৃষ্টি পড়ল এক রহস্যময় ভূখণ্ডের দিকে—ভারত।তাঁর কাছে এটি ছিল “পৃথিবীর প্রান্ত”, যেখানে সূর্য ওঠে, নদীগুলো সোনা বয়ে আনে, আর রাজারা দেবতার মতো শক্তিশালী।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালের শীতকাল। আলেকজান্ডারের বাহিনী আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড় পাড়ি দিচ্ছে।
তুষারপাত, খাদ্য সংকট, হিমশীতল বাতাস—সব কিছুর মাঝেও তাঁরা এগিয়ে চলেছে। অনেক সৈন্য পথেই মারা গেল, কিন্তু আলেকজান্ডার কখনো পিছু হটেননি।
তিনি পাহাড়ি উপজাতিদের সঙ্গে লড়লেন— অরাকোসিয়া, বাক্ট্রিয়া, সোগডিয়ানা, একে একে সবাই তাঁর শাসনের অধীনে এল। এই সময়ে তিনি প্রেমে পড়লেন এক পারস্য রাজকন্যার—রক্সানা।
তাঁকে বিয়ে করে তিনি বললেন, “গ্রীস আর এশিয়া আজ থেকে এক পরিবার।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালের বসন্তে আলেকজান্ডার পৌঁছালেন ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে—আজকের পাকিস্তানের তক্ষশিলা এলাকায়।সেখানকার রাজা অম্ভি (ট্যাক্সিলাস) তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং মিত্রতা প্রস্তাব করলেন।অম্ভি বললেন,“আমার শত্রু রাজা পোরাসের বিরুদ্ধে যদি তুমি আমাকে সাহায্য করো, আমি তোমার বন্ধু হব।”
আলেকজান্ডার রাজি হলেন। কিন্তু তাঁর মনে ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্য— ভারতকে জয় করে ইতিহাসের শেষ অধ্যায় রচনা করা।
হাইড্যাস্পিস নদী (বর্তমান ঝিলম নদী) র ওপারে ছিলেন রাজা পোরাস, এক মহাবীর যোদ্ধা।
তাঁর কাছে ছিল ৩০,০০০ সৈন্য এবং ২০০ যুদ্ধহাতি।
আলেকজান্ডারের সেনারা এর আগে কখনো এমন ভয়ঙ্কর জন্তুর মুখোমুখি হয়নি।
রাতে প্রবল বর্ষার মধ্যে, নদীর স্রোত উপেক্ষা করে আলেকজান্ডার তাঁর সেনাদের নিয়ে গোপনে পার হলেন। সকালে পোরাস বুঝতে পারলেন— শত্রু ঠিক তাঁর সামনে! তখন শুরু হলো ইতিহাসের এক মহাযুদ্ধ।
হাতিরা গর্জন করে সৈন্যদের পিষে ফেলছিল, তীর বৃষ্টি হচ্ছিল আকাশ থেকে, কিন্তু আলেকজান্ডার ছিলেন অবিচল। তিনি দ্রুত কৌশল বদলে ফেললেন—ঘোড়সওয়ার বাহিনী দিয়ে হাতির পেছনে আক্রমণ চালালেন, যাতে তারা পিছু হটে নিজেদেরই সৈন্যদের পদদলিত করে।
দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে অবশেষে পোরাস আহত অবস্থায় বন্দি হলেন।আলেকজান্ডার তাঁকে নিজের তাঁবুতে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন— “তুমি কেমন আচরণ চাও আমার কাছ থেকে?” পোরাস উত্তর দিলেন,“এক রাজা যেমন আচরণ করে আরেক রাজার সঙ্গে।”
আলেকজান্ডার মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সিংহাসনে ফিরিয়ে দিলেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যের এক অংশ উপহার দিলেন। তিনি বললেন,“তুমি জয় করনি আমার রাজ্য, জয় করেছ আমার হৃদয়।”
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালের বসন্ত, আলেকজান্ডার হাইড্যাস্পিসের মহাযুদ্ধে বিজয়ী। ভারতের বিস্তীর্ণ নদী ও পাহাড় জয়ের পর তাঁর চোখে জ্বলছিল নতুন অভিযান—গঙ্গা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে আরও শক্তিশালী রাজাদের সঙ্গে লড়াই করা। তাঁর সৈন্যরা—যারা গ্রীস, মিশর, পারস্য ও আফগানিস্তান পেরিয়ে হাজার মিল গিয়েছিল— তাদের মধ্যে ক্লান্তি এবং অভ্যস্ত জীবনের অভাব স্পষ্ট।
এক সকালে তাঁরা আলেকজান্ডারের কাছে এসেছিলেন, মুখে হতাশা, চোখে ভয়।“মহারাজ, আমরা সব দিয়েছি— আমাদের সহ্য করার ক্ষমতা শেষ। আমাদের ঘরে ফেরতে দিন।”
আলেকজান্ডার প্রথমে বোঝালেন, সাহসী ও ধৈর্যশীল হতে হবে। “আমরা ইতিহাসের শেষ অধ্যায় লিখতে যাচ্ছি, পদক্ষেপ থামালে বিশ্ব জানবে না আমাদের শক্তি কোথায়।”
কিন্তু সৈন্যদের মনোবল এতটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের কোনও শক্তি বা যুক্তি কাজ করল না।
তারা দৃঢ়ভাবে বলল,“আমাদের প্রাণ দিয়েও যদি অভিযানের শেষ না হয়, আমরা আর এগোতে পারব না।”
অবশেষে আলেকজান্ডার বুঝলেন— যে বিজয় তিনি চান, তা শুধুমাত্র সৈন্যদের জীবন বাঁচিয়ে সম্ভব।
তাঁর চোখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থাকলেও, মানুষিক দায়বোধ তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল।
ভারত থেকে ফেরার সময় আলেকজান্ডারের সেনারা পার হয়েছিল গেদ্রোসিয়ার মরুভূমি— যেখানে প্রচণ্ড গরমে হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল।
আলেকজান্ডার নিজেও বালুর ঝড় আর তীব্র তৃষ্ণায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। সবাইকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা যুদ্ধ জয় করেছি, মৃত্যুকেও জয় করব।”
এই অনুপ্রেরণায়ই ক্লান্ত সেনারা এগিয়ে গেল,
আর অবশেষে মেসোপটেমিয়ার উর্বর মাটিতে পা রাখল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালের বসন্তে, আলেকজান্ডার প্রবেশ করেন বাবিলনে— সেই সময়ের সবচেয়ে সুন্দর নগরী,যেখানে আকাশ ছোঁয়া মিনার, সুবিশাল উদ্যান,
আর ঝলমলে রাজপ্রাসাদ যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যের মতো।
শহরের মানুষ তাঁকে স্বাগত জানায় ফুল আর সোনার ধুলো ছড়িয়ে।তাঁর সম্মানে আয়োজিত হয় অভ্যর্থনা উৎসব, যেখানে সঙ্গীত, নৃত্য, আর বিজয়ের গান ধ্বনিত হচ্ছিল আকাশে।
আলেকজান্ডার তখন তরুণ, শক্তিতে ভরপুর,
চোখে নতুন পরিকল্পনার আগুন— আরব, আফ্রিকা, এমনকি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন।
বাবিলনে বসেই তিনি শুরু করেন নতুন অভিযানের প্রস্তুতি। সেনাদের সাজানো হচ্ছিল, নৌবহর তৈরি হচ্ছিল পারস্য উপসাগরে।তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীর প্রান্তে পৌঁছে সমুদ্রের শেষ দেখবেন।
একদিন রাজদরবারে তাঁর ঘনিষ্ঠ সেনাপতি হেফাইস্টিয়নের স্মৃতির কথা উঠল— যিনি কয়েক মাস আগেই অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আলেকজান্ডার গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গেলেন।
তাঁর সেই দুঃখ যেন হৃদয়ে এক অদৃশ্য আঘাত হয়ে রয়ে গেল।
বাবিলনে ফেরার পর থেকেই কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল।একটি পাখি তাঁর মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে ডাকতে লাগল, এক ভবিষ্যৎবক্তা এসে সতর্ক করে বলল, “মহারাজ, বাবিল আপনার জন্য অশুভ।”
কিন্তু আলেকজান্ডার হেসে বললেন,“রাজারা ভয় পেলে, সৈন্যরা আশা হারায়।”তিনি নিজের ভাগ্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রইলেন— যেন মৃত্যু তাঁর ছায়া হয়ে চারপাশে ঘুরলেও, তিনি এখনো অমরতার পথে হাঁটছেন।
বাবিলনের রাজপ্রাসাদে প্রতিদিনই জমত সভা, পরিকল্পনা, ভোজ। কিন্তু ইতিহাস জানে— সেই ছিল তাঁর জীবনের শেষ শান্ত সময়। বিজেতা রাজা ফিরে এসেছিলেন তাঁর রাজধানীতে, কিন্তু জানতেন না, এবার আর কোনো যাত্রা শুরু হবে না।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালের গ্রীষ্ম, বাবিলনের রাজপ্রাসাদ তখন আলেকজান্ডারের বিজয়ের গৌরবে ভরপুর।
প্রাসাদের প্রতিটি দেয়ালে সোনার অলংকার, চারদিকে সৈন্য, দূত, শিল্পী ও পণ্ডিতদের ভিড়।
কিন্তু সেই জাঁকজমকের মাঝেই এক অদৃশ্য ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসছিল — মৃত্যুর ছায়া।
এক সন্ধ্যায় আলেকজান্ডার রাজপ্রাসাদের বাগানে তাঁর সেনাপতিদের সঙ্গে ভোজে অংশ নিয়েছিলেন।
তাঁরা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছিলেন — আরব ও আফ্রিকা জয়ের।মদের পেয়ালা ঘুরছিল একের পর এক, হাসির শব্দে ভরে উঠেছিল প্রাসাদ।
হঠাৎ আলেকজান্ডার হালকা কাশি দিয়ে বললেন, “আজ শরীরটা একটু অদ্ভুত লাগছে।” সবাই ভেবেছিল ক্লান্তির জন্য। কিন্তু পরের দিন তাঁর জ্বর এলো, আর পরদিন তা আরও বেড়ে গেল।
জ্বর থামছিল না। প্রথমে চিকিৎসকেরা মনে করলেন, হয়তো সাধারণ জ্বর। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে তিনি হাঁটতে পারছিলেন না, কণ্ঠে দুর্বলতা এসে গেল। প্রাসাদজুড়ে নিস্তব্ধতা। সেনাপতিরা বাইরে উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিলেন, আর ভিতরে শুয়ে ছিলেন সেই মানুষ, যিনি পৃথিবীর অর্ধেক জয় করেছিলেন, অথচ এখন নিজের দেহকেও জয় করতে পারছেন না।
কিছু ইতিহাসবিদ বলেন, তাঁকে হয়তো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল; আবার কেউ বলেন, ম্যালেরিয়া বা টাইফয়েড জ্বরেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন।
যে কারণই হোক, মৃত্যু তখন নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল।
জ্বরের দশম দিনে, তিনি আর কথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর সেনাপতিরা একে একে তাঁকে দেখতে এলেন।দুর্বল হাতে আলেকজান্ডার তাঁদের দিকে তাকালেন, চোখে অদ্ভুত শান্তি, ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি।
এক সেনাপতি জিজ্ঞেস করলেন,“মহারাজ, আপনার পর এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী কে হবে?” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “যে সবচেয়ে যোগ্য।”এই একটি বাক্যই ছিল তাঁর শেষ রাজনৈতিক ঘোষণা — যা পরবর্তীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ ও বিভক্তির জন্ম দিয়েছিল।
মৃত্যুর আগের রাতে তিনি বলেছিলেন তিনটি শেষ ইচ্ছার কথা—
১️⃣ আমার কফিন বয়ে নিয়ে যাবে আমার চিকিৎসকেরা,
যাতে দুনিয়া বুঝে, মৃত্যু সামনে এলে চিকিৎসাও ব্যর্থ হয়।
২️⃣ আমার সব সোনা–রূপা ছড়িয়ে দিও রাজপথে,
যাতে মানুষ জানে, ধনসম্পদও কিছুই সঙ্গে নেওয়া যায় না।
৩️⃣ আমার দু’হাত কফিনের বাইরে থাকবে,
যাতে পৃথিবী দেখে, মহান বিজেতাও খালি হাতে বিদায় নেয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালের ১০ জুন, ভোরের আলো ফুটে উঠছে বাবিলনের আকাশে। বাতাসে নিস্তব্ধতা, পাখিরাও যেন চুপ।সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট,
মাত্র ৩২ বছর বয়সে।
তাঁর দেহ যখন প্রাসাদ থেকে বের করা হলো,
সেনারা নিঃশব্দে মাথা নত করল, আর কেউ কেউ কেঁদে উঠল শিশুদের মতো।একজন বৃদ্ধ সৈন্য বলল, “তিনি আমাদের শুধু যুদ্ধ শেখাননি, আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন।”
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়,সেনাপতিরা একে একে ভাগ করে নেয় তাঁর রাজ্য। কিন্তু ইতিহাসে তাঁর নাম কখনো হারিয়ে যায়নি।
তিনি রাজার থেকেও বড় কিছু হয়েছিলেন —
এক প্রেরণা, এক দৃঢ়তা, এক অসম্ভব স্বপ্নের প্রতীক। যিনি ছোট্ট এক রাজ্য থেকে শুরু করে বিশ্ব জয় করেছিলেন, আর যিনি প্রমাণ করে গেছেন —“মানুষের সীমা তার কল্পনার মধ্যেই থাকে, বাস্তবে নয়।”
আলেকজান্ডারের মৃত্যুতে তাঁর সৈন্যরা কেঁদে উঠল,
কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এমন এক মানুষও মরে যেতে পারে।তাঁর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ভেঙে যায়, সেনাপতিরা ভাগ করে নেয় সেই বিশাল ভূমি।
কিন্তু ইতিহাস কখনো তাঁকে ভোলেনি। কারণ তিনি শুধু যুদ্ধ জেতেননি— মানুষের সাহস, স্বপ্ন, ও সীমাহীন সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আজও যখন কেউ অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়, তখন তার অন্তরে বাজে এক নাম— “আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট” — যিনি দেখিয়েছিলেন, মানুষ চাইলেই সীমা পেরোতে পারে।