সত্যের অনুসন্ধানী: সক্রেটিসের জীবনকাহিনী

17 Oct 2025 08:13:11 PM

সত্যের অনুসন্ধানী: সক্রেটিসের জীবনকাহিনী

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

 

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ সালের বসন্ত, এথেন্সের এক ছোট্ট শান্ত শহরে জন্ম নিল এক শিশু—সক্রেটিস।
শহরের সরু গলি, পাথরের প্রাচীর আর সূর্যের আলোতে ঝলমল করা বাড়িগুলোতে নতুন জীবন এসেছে। শিশুটি সাধারণ নয়; তাঁর চোখে জিজ্ঞাসার আগুন, হৃদয়ে সত্যের প্রতি আগ্রহ—যা আগামীর এক মহান দার্শিকের প্রতিভার প্রথম সংকেত।

সক্রেটিসের বাবা সোফ্রনিস্কাস ছিলেন ভাঙা-মেরামতির কাজের মানুষ।তার হাতের মেহনত আর ধৈর্যশীলতা শিশুর মনেও এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছিল। মা ফেনারেস, একজন midwife, সদা সদয়, শিশুর প্রতি যত্নশীল।তাঁরা দেখতেন, সক্রেটিস কেবল খেলাধুলায় ব্যস্ত নয়,বরং চারপাশের প্রতিটি ঘটনাকে প্রশ্নের চোখে দেখতে শুরু করেছে।

 

শৈশব থেকেই সক্রেটিসকে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে দেখা যায়।“কেন মানুষ কখনও সত্য বলে, কখনও মিথ্যা?”“ন্যায় কি শুধুই মানুষের মনোভাব, নাকি প্রকৃতির নিয়ম?”“মানুষ কি সত্য জানতে চায়, নাকি স্বার্থে অন্ধ থাকে?”

প্রতিটি প্রশ্নের মধ্যেই তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন— জীবনের গোপন সত্য কী। শহরের মানুষ প্রথমে বিস্মিত হতেন, তারপর হাসতেন।কিন্তু শিশুটির মন যে থেমে থাকে না, তা তারা বুঝতে পারতেন না।

সক্রেটিস প্রথমে স্থানীয় বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন।
তেখান থেকে তিনি শিক্ষালাভ করলেন গণিত, সাহিত্য, যুক্তি এবং নৈতিকতার প্রাথমিক পাঠ।
কিন্তু তাঁর মনের জন্য এই শিক্ষা যথেষ্ট ছিল না।
সক্রেটিসের আগ্রহ ছিল—জ্ঞান কেবল গ্রহণ না করে, নিজের চিন্তায় সত্যকে খুঁজে বের করা।

শিশুর বন্ধু ও সহপাঠীরা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকলেও, সক্রেটিস প্রায়শই বসে থাকতেন, প্রশ্ন করতেন, ভাবতেন, আর কখনও কখনও নিজের কাছে উত্তর খুঁজতেন।

এই শৈশবের দিনগুলি সক্রেটিসের জীবনের ভিত্তি স্থাপন করল।এখানেই জন্ম নিল তাঁর প্রশ্নকৌশল, কৌতূহল এবং সত্যের প্রতি অদম্য আগ্রহ।যে শিশু ছোটবেলা থেকেই নিজের চারপাশকে প্রশ্নের আলোতে দেখতে শিখল,সে একদিন হবে এমন এক মানুষ, যাকে পৃথিবী সক্রেটিস—সত্যের অনুসন্ধানী নামে চেনে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ সালে, সক্রেটিস বড় হচ্ছিল।
শিশুকাল শেষ হয়ে এলো, কিন্তু তাঁর কৌতূহল ও প্রশ্নের আগুন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল।
এথেন্সের স্কুলে শিক্ষালাভ শুরু করলেন। গণিত, সাহিত্য, যুক্তি, নৈতিকতা—সবকিছুই শেখার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু সক্রেটিস বুঝতে পারছিলেন—শুধু বই পড়ে বা শিক্ষক শোনে সত্য জানার উপায় নেই।
তিনি চাইছিলেন, নিজের চিন্তাভাবনা, প্রশ্ন এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সত্যকে খুঁজে বের করতে।
তাই পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি দিনের বেলা শহরের গলিপথ ও বাজারে ঘুরে মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন।

 

যুবক সক্রেটিস ঘন ঘন নিজেকে প্রশ্ন করতেন— “মানুষ সত্যকে কতটা স্বীকার করে?”“ন্যায় কেবল আইন মানা, নাকি অন্তরের সততা?” “সাহস কি শুধুই যুদ্ধের জন্য, নাকি নৈতিক সিদ্ধান্তের জন্যও প্রয়োজন?”

প্রতিটি প্রশ্ন তাঁর মনের মধ্যে দর্শনের বীজ রোপণ করেছিল। বন্ধুরা প্রাথমিকভাবে হেসে উড়িয়ে দিত, কিন্তু সক্রেটিসের অন্তর্দৃষ্টি ধীরে ধীরে তাদের মনেও আলোকপ্রভা ফেলতে লাগল।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রেটিস বিভিন্ন পণ্ডিত ও শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে লাগলেন।তিনি শিখলেন কৌশলগত চিন্তাভাবনা, যুক্তি বিশ্লেষণ এবং নৈতিকতার মূলনীতি।কিন্তু প্রতিটি শিক্ষকের কাছে তিনি কেবল একজন শ্রোতা ছিলেন না; তিনি প্রশ্ন করতেন, চ্যালেঞ্জ করতেন, কখনও কখনও বিতর্কও করতেন।

একদিন একজন শিক্ষক বললেন,“সক্রেটিস, তুমি কেবল শিখছ না, তুমি নিজেই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছ।” এটাই সক্রেটিসের প্রথম বড় উপলব্ধি—প্রশ্ন করাই জ্ঞানের মূল পথ।

যখন সক্রেটিস ছোট্ট শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষার থেকে বড় হলেন, তখন তিনি বুঝলেন—জ্ঞান কেবল শিখে শেষ হয় না, তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হয়।শহরের সরু গলি, বাজারের উন্মুক্ত স্থান, প্রাসাদের চত্বর—সবই তাঁর জন্য শিক্ষার ক্লাসরুম।
তিনি শুধু মানুষের কথায় বিশ্বাস করতেন না; তিনি প্রত্যেক আচরণ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি কর্ম পর্যবেক্ষণ করতেন।

প্রতিদিন তিনি নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগাতেন—“আমি কি সত্যের পথে চলছি?” “আমার সিদ্ধান্ত নৈতিক কি?”“মানুষ কি নিজের অন্তরের সত্য জানে, নাকি ভোগ ও স্বার্থের পিছনে হারিয়ে গেছে?”

এই প্রশ্নগুলি তাঁকে সাধারণ জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। সক্রেটিস বুঝলেন—সত্যের খোঁজ মানে কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, নিজের মন ও সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা।

সক্রেটিস জানতেন, নিজেকে সত্যের পথে রাখার জন্য ধৈর্য ও সাহস দরকার। কখনও কখনও মানুষ তাঁকে অবহেলা করত, বিরক্ত হতো, কিংবা ব্যঙ্গ করত।কিন্তু সক্রেটিস কখনো হাল ছাড়েননি। তিনি মনে মনে বলতেন,“যে পথ সত্য ও ন্যায়ের দিকে, সে সহজ হয় না। কিন্তু সেই পথটাই আমাকে চিরকাল স্মরণীয় করবে।”

প্রতিটি দিনের ছোট ছোট ঘটনা সক্রেটিসকে নতুন শিক্ষা দিত— এক শিশুর খেলা, একজন বৃদ্ধের উপদেশ, একজন ব্যবসায়ীর আচরণ—সবকিছুই জ্ঞান ও নৈতিকতার পাঠ। তিনি শিখলেন, সত্য কখনো কেবল বইয়ে থাকে না; এটি মানুষের মন, কাজ ও সমাজে বিরাজমান।

এই সময়ই সক্রেটিসের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতার বীজ জন্ম নিল। তিনি জানতেন, ভবিষ্যতে তাঁকে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে—রাজনীতি, সমাজ ও মানুষকে প্রশ্নের আলো দেখাতে হবে।তাঁর লক্ষ্য স্পষ্ট— মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখানো এবং সত্য অনুসন্ধানে পরিচালিত করা।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালের গ্রীষ্ম, সক্রেটিস এখন এক যুবক।তাঁর মনের আগুন আরও জ্বলছে—প্রশ্ন, অনুসন্ধান এবং সত্যের সন্ধান।শহরের সরু গলিপথ, বাজারের চত্বর, প্রাসাদের বারান্দা—সবই তাঁর শিক্ষালয়।এখানেই সক্রেটিস মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন, তাদের চিন্তা, ভয়, সুখ ও দুঃখকে বোঝার চেষ্টা করলেন।

সক্রেটিস প্রায়শই মানুষের কাছে যেতেন এবং সরল কিন্তু গভীর প্রশ্ন করতেন— “আপনি ন্যায় কি জানেন?” “সাহস কেবল যুদ্ধের জন্য কি, নাকি নৈতিকতার জন্যও প্রয়োজন?” “জ্ঞান কি শক্তির উৎস, নাকি আত্মমর্যাদার আলো?”

শুরুতে মানুষ হাসত, কিছু কিছু বিতর্ক করত।
কিন্তু ধীরে ধীরে সক্রেটিসের প্রশ্নের শক্তি তাদের মনকে চ্যালেঞ্জ করতে লাগল। মানুষ ভাবতে শুরু করল—নিজেদের চিন্তা, সিদ্ধান্ত এবং আচরণের গভীরতা বুঝতে।

সক্রেটিসের দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে বেশ কয়েকজন যুবক তাঁর চারপাশে সমবেত হল।প্লেটো, জেনোফন, এবং অন্যান্য শিক্ষার্থী সক্রেটিসের কাছে আসলেন সত্য, ন্যায় এবং জ্ঞানের পাঠ শেখার জন্য। তাঁরা শিখলেন যে জ্ঞান কেবল গ্রহণের বিষয় নয়, প্রশ্ন ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিজে আবিষ্কারের প্রক্রিয়া।

একদিন প্লেটো বললেন, “স্যার, আপনি শুধু শিখাচ্ছেন না, আমাদের চিন্তাভাবনাকেও উজ্জীবিত করছেন।”এটাই সক্রেটিসের দর্শনের মূল—মানুষকে নিজের চিন্তায় স্বাধীন করা।

তাঁর মুক্তচিন্তাভাবনা কিছু ক্ষমতাধারীর অস্বস্তি তৈরি করল।কেউ তাঁকে বিপজ্জনক মনে করল, কেউ ভেবেছিল তিনি জনগণকে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছেন, যা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করবে।তবুও সক্রেটিস নিজের পথ ছাড়লেন না। তিনি মনে মনে বলতেন,“সত্যের অনুসন্ধান কখনও সহজ নয়, কিন্তু এটি মানুষের মনকে আলোকিত করে।”

এথেন্সে এই বছরগুলো সক্রেটিসকে শুধু শিক্ষাদান নয়, নিজের নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি শক্ত করার সময়ও দিল। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ঘটনা তাঁকে শিখিয়েছে—সত্য শুধুই বইয়ের মধ্যে নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে খুঁজে পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪২০ সালের বসন্ত, সক্রেটিস এখন পূর্ণবয়স্ক। তার জীবন কেবল দর্শন এবং শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ধীরে ধীরে রাজনীতি ও সমাজের সঙ্গে সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
সক্রেটিসের মুক্তচিন্তাভাবনা এবং সত্য অনুসন্ধানের পথ কিছু ক্ষমতাধারীর জন্য বিপজ্জনক মনে হতে শুরু করল।


তিনি জনগণকে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছিলেন, যা তাদের ভাবনাকে স্বাধীন করে তুলছিল।কিছু রাজনীতিবিদ এই স্বাধীন চিন্তাকে হুমকি হিসেবে দেখল।

সক্রেটিস কখনো শক্তিশালী ক্ষমতার কাছে টানাহেঁচড়া করেননি।কিন্তু তাঁর মুক্তচিন্তাভাবনা এবং শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি কিছু রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী নাগরিকের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল।
তাদের মনে হয়েছিল, সক্রেটিস জনগণকে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছেন, যা পুরনো সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করবে।

সক্রেটিসকে প্রায়শই সতর্ক করা হত,“তুমি খুব বেশি কথা বলছ, সৈন্য ও নাগরিকদের ভুল পথে পরিচালিত করছ।”কিন্তু তিনি নিজের নৈতিকতা এবং দার্শনিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।
তিনি বলতেন,“সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলা কখনও সহজ হয় না। কিন্তু এই পথই মানুষকে মুক্ত করে।”

রাজনীতি ও ক্ষমতার চাপ সত্ত্বেও, সক্রেটিস শহরের মানুষের মনকে আলোকিত করতে থাকলেন।
তিনি দেখালেন, সত্যের অনুসন্ধান শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবন নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেরও শিক্ষণীয় দিক।প্রতিটি বিতর্ক, প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি পর্যবেক্ষণ সমাজকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ দিত।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪২০ সালের শীত, সক্রেটিসের নাম এখন এথেন্সের শহরজুড়ে পরিচিত।তিনি কেবল দার্শনিক হিসেবে নয়, সামাজিক চেতনার শিক্ষক হিসেবেও খ্যাত।তাঁর ছাত্ররা—প্লেটো, জেনোফন এবং অন্যান্য যুবক—শহরের মানুষকে সত্য, ন্যায় ও নৈতিকতার পাঠ শেখাচ্ছিল।

একদিন সক্রেটিস এবং তাঁর ছাত্ররা এল থিবস শহরে, যেখানে সামাজিক চেতনার এক ছোট সংকট ঘটেছিল।শহরের মানুষ নিজের স্বার্থের কাছে এতটাই আবদ্ধ যে, ন্যায় ও সততার মানে ভুলে গেছে।
সক্রেটিস দেখলেন—মানুষ নিজের জীবনের সিদ্ধান্তে সততার পরিবর্তে স্বার্থকে বেশি মূল্য দিচ্ছে।

সক্রেটিস স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বসে আলোচনা শুরু করলেন।তিনি প্রশ্ন করতেন— “ন্যায় মানে কি কেবল আইন মানা, নাকি অন্তরের সততার প্রকাশ?”
“মানুষ সত্যকে কতটা স্বীকার করে?”  “সাহস মানে কি শুধু যুদ্ধের জন্য, নাকি নৈতিক সিদ্ধান্তের জন্যও?”

প্রথমে মানুষ অবাক ও কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে সক্রেটিসের প্রশ্ন তাদের মনকে আলোকিত করতে লাগল।এটি শুধু জ্ঞানের পাঠ নয়; এটি ছিল চিন্তাভাবনার স্বাধীনতার শিক্ষা।

সক্রেটিসের ছাত্ররা স্থানীয় যুবকদের কাছে তার শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিল।মানুষ শিখল কিভাবে নিজেকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে নৈতিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী হওয়া যায়।থিবসের মানুষ বুঝতে শুরু করল—একজন সত্য অনুসন্ধানীর প্রভাব কেবল তার ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পুরো সমাজকেই পরিবর্তন করতে পারে।

সক্রেটিস দেখালেন, সত্য ও ন্যায়ের শিক্ষা সামাজিক রূপান্তরের জন্য অপরিহার্য।একটি শহর, একটি সমাজ যখন প্রশ্ন করতে শিখবে, তখন তা শুধু আইন বা শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না, বরং মানুষের মন ও অন্তরের নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হবে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালের বসন্ত, এথেন্সের আকাশ নিস্তব্ধ, কিন্তু শহরের বাতাসে উত্তেজনা। সক্রেটিস— এথেন্সের সবচেয়ে চিন্তাশীল ও প্রভাবশালী দার্শিক— এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি।কিছু ক্ষমতাধারী নাগরিক তাঁকে অভিযোগ করেছিলেন— “যুব সমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করা এবং দেবতাদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করা।”

সক্রেটিস শান্ত, দৃঢ় মন নিয়ে আদালতে উপস্থিত হলেন।তাঁর চোখে কোনো ভয় বা অনাস্থা নেই, শুধুই সত্যের প্রতি অটল বিশ্বাস।সক্রেটিস জানতেন— এটা তাঁর শেষ দিন হতে পারে, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা কখনো মারা যাবে না।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালের বসন্ত, এথেন্সের আদালত জড়ো মানুষে ভরা।সক্রেটিস, যিনি জীবনভর সত্য ও ন্যায়ের অনুসন্ধান করেছেন, এবার নিজের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছেন।কিছু নাগরিক অভিযোগ এনেছেন— “সক্রেটিস যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করছে এবং দেবতাদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে।”

সক্রেটিস শান্তভাবে দাঁড়ালেন। তার চোখে ভয় নেই, কেবল দার্শনিক দৃঢ়তা।তিনি বললেন— “আমি কখনো কাউকে নিজের পথে হেঁচড়ে আনি নি।
আমি শুধুমাত্র প্রশ্ন করেছি, চিন্তা করতে শেখিয়েছি।
সত্য খুঁজতে যারা চায়, তারা নিজেই তার পথ খুঁজে পাবে।”

সক্রেটিস আদালতকে বোঝালেন, মানুষকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে চিন্তাভাবনায় স্বাধীনতা দেওয়াই প্রকৃত শিক্ষা। তিনি বললেন— “মানুষকে শেখানো হয় না কেবল তথ্য দিয়ে, বরং তার নিজের বুদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে সত্য আবিষ্কার করার ক্ষমতা জাগিয়ে দেওয়া হয়।”

তাঁর শব্দগুলো সরল, কিন্তু গভীর। প্রতিটি বাক্য যেন আদালতের দেওয়াল ছাড়িয়ে মানুষদের অন্তরে পৌঁছায়। কিছু মানুষ মুগ্ধ হয়, কিন্তু বেশিরভাগ তখনও ভয়ে ও অজ্ঞতায় বাধ্য।

সক্রেটিস জানতেন— এই মুহূর্তে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি হতে পারে।কিন্তু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও নৈতিক অটলতা ত্যাগ করেননি। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য, সত্যের অনুসন্ধানীর জন্য দৃঢ়তার উদাহরণ হয়ে থাকলেন।“যে মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকে, তার জীবন অমর হয়ে যায়।”

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালের বসন্ত, আদালতের দেয়াল যেন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সক্রেটিস, এথেন্সের মহান দার্শিক, শান্ত মন নিয়ে বসেছেন। তার চারপাশে শিক্ষার্থী, বন্ধু এবং নাগরিকরা—সবাই নীরব, কেউ সাহস করে কথা বলতে পারছে না। আজ তার সামনে মৃত্যুর এক চরম মুহূর্ত। 

এক কর্মকর্তা শান্ত হাতে বিষের পাত্রটি এগিয়ে দিল।
হেমলকের তিক্ত গন্ধ বাতাসে মিলেমিশে ধীরে ধীরে সক্রেটিসের নাক পর্যন্ত পৌঁছালো।পাত্রটি হাতে ধরে সক্রেটিস একবার গভীর নিঃশ্বাস নিলেন। তার চোখে ভয় নেই, শুধু অবিচল শান্তি এবং জ্ঞানের প্রতি অটল বিশ্বাস।

সক্রেটিস তার শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেন, মুখে শান্তি এবং দৃঢ়তা।“ভয় করো না। মৃত্যু কেবল শরীরের সমাপ্তি। কিন্তু সত্য অনুসন্ধান, জ্ঞান অর্জন এবং নৈতিকতা কখনো মারা যায় না। আমাদের চিন্তা, আমাদের মন, আমাদের মূল্যবোধ— এগুলোই চিরন্তন।”

পাশে দাঁড়ানো যুবকরা—প্লেটো, জেনোফন এবং অন্যান্য শিক্ষার্থী—নীরব। কেউ চোখে জল, কেউ বিস্ময়, কেউ ভয় নিয়ে তাকিয়ে।  কিন্তু সক্রেটিসের মুখমন্ডল তাদের হৃদয়ে অদম্য প্রেরণা জ্বালাল।

শ্রোতরা হতবাক। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ল, কেউ চুপচাপ। কিন্তু সক্রেটিসের কণ্ঠে শক্তি এবং দৃঢ়তা—এটি সবাইকে শিখিয়ে দিল সত্যের প্রতি অটল থাকার সাহস।

সক্রেটিস ধীরে ধীরে বিষ পান করলেন। প্রথমে হালকা অসুবিধা, তারপর শরীরের ভার হ্রাস পাওয়া।
তার দেহ মাটির দিকে ঝুঁলল, কিন্তু চেতনায় তিনি শান্ত। তার চোখের দিকে শেষবার তার শিক্ষার্থীরা তাকাল। এই মুহূর্তে তারা বুঝল—সক্রেটিস মারা গেলেও তার দর্শন, শিক্ষা এবং সত্যের অনুসন্ধান চিরজীবী। শহরের মানুষ এবং তাঁর ছাত্ররা বুঝল—একজন সত্য অনুসন্ধানীর মৃত্যু তার চিন্তা ও প্রেরণাকে শেষ করতে পারে না।

হেমলক বিষের ধীরে ধীরে প্রভাবের মধ্যে সক্রেটিসের মুখে শান্তি, দৃঢ়তা এবং অদম্য শিক্ষা ফুটে উঠল।
সেই মুহূর্তে তিনি প্রমাণ করলেন—সত্যের পথে থাকা, প্রশ্ন করা এবং নৈতিক জীবনযাপনই চিরন্তন শক্তি। “মৃত্যু শরীরের শেষ, কিন্তু জ্ঞান ও সত্য কখনো মারা যায় না।”

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালের পর, সক্রেটিসের শরীর মাটি হতে ঝুঁলেছে, কিন্তু তাঁর চিন্তা, দর্শন এবং শিক্ষা চিরজীবী হয়ে ওঠেছে। প্লেটো, জেনোফন এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা এখন তাঁর দর্শনকে সংরক্ষণ করতে শুরু করল।
 

প্লেটো তাঁর গুরু সক্রেটিসের কথা রচনা করলেন।
“সক্রেটিস শুধু একজন দার্শিক নয়, তিনি মানুষের চিন্তাধারার মুক্তির প্রতীক,” প্লেটো লিখলেন।
জেনোফন তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে সক্রেটিসের নৈতিক শিক্ষা এবং সমাজচেতনার গল্পগুলো লিখলেন।
এই গ্রন্থগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে দেখাল—কিভাবে প্রশ্ন করা, সত্য খোঁজা এবং ন্যায়ের পথে থাকা জীবনের মূল লক্ষ্য।

সক্রেটিসের দর্শন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। এথেন্সের নাগরিক, যুবক এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়ল। প্রশ্নকৌশল (Socratic Method) মানুষকে শেখালো—শুধু গ্রহণ না করে, নিজেই চিন্তাভাবনা করে সত্য খুঁজে পেতে হয়।

সক্রেটিস প্রমাণ করলেন—একজন মানুষের জীবন যদি সত্য ও ন্যায়ের পথে গড়ে তোলা হয়, তাহলে তার প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, পুরো সমাজকেই আলোকিত করে।

সক্রেটিসের মৃত্যুর পরেও তাঁর শিক্ষার আলো ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।  প্লেটো এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীর লেখাগুলো বিশ্বকে দেখালো—জ্ঞান, ন্যায় এবং নৈতিকতা চিরকাল মানুষের মনকে উজ্জীবিত করতে পারে।

সক্রেটিসের জীবন শুধু একটি ইতিহাস নয়, এটি এক অনন্ত শিক্ষার উৎস।তার অনুসন্ধান, প্রশ্নকৌশল এবং নৈতিকতা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দেয়। “একজন সত্য অনুসন্ধানী মারা যেতে পারে, কিন্তু তার চিন্তাধারা, শিক্ষা এবং নৈতিক প্রভাব চিরন্তন।”

সক্রেটিসের জীবন শুধু একটি দার্শনিকের জীবনকাহিনী নয়। এটি সত্যের অনুসন্ধানী যাত্রা, ন্যায়ের জন্য লড়াই, মানুষের মনকে স্বাধীন করার গল্প। প্রশ্ন করা, ভাবা এবং জ্ঞান অর্জন—এগুলোই তাঁর জীবনের অমর উত্তরাধিকার।