আকাশের পানে ছুটে চলা: গ্যালিলিওর দূরবীন আবিষ্কারের গল্প
আকাশের পানে ছুটে চলা: গ্যালিলিওর দূরবীন আবিষ্কারের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৫৬৪ সালের এক শীতল ফেব্রুয়ারির সকাল। ইতালির পিসা শহরের এক ছোট্ট ঘরে জন্ম নিল এক শিশু—গ্যালিলিও গ্যালিলি। জানালার বাইরে তখন রোদ ঝলমল করছে, দূরে ঘণ্টার আওয়াজে ভরে উঠেছে চার্চের পথ। কেউ জানত না—এই ছোট্ট শিশুটি একদিন এমন এক সত্য আবিষ্কার করবে, যা বদলে দেবে গোটা পৃথিবীর ধারণা।
গ্যালিলিওর বাবা ভিনচেনজো গ্যালিলি ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ—সংগীতে যেমন নিয়ম থাকে, তেমনি তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানেরও নিজস্ব সুর আছে। ছোটবেলা থেকেই গ্যালিলিওর মধ্যে ছিল সেই সুরের ছোঁয়া—কোনো কিছু দেখলেই প্রশ্ন করত, “এমন কেন?”, “এটা হয় কীভাবে?”
একদিন সে দেখল বাজারে এক দোলানো বাতি দুলছে। একজন মানুষ সেটি দোলাচ্ছে প্রার্থনার সময়।গ্যালিলিওর চোখে তখন এক আশ্চর্য খেয়াল—“বাতিটা যতই দুলুক, মনে হচ্ছে সময়টা একই রকম লাগছে!” এই ছোট্ট পর্যবেক্ষণ থেকেই তার মনে জন্ম নেয় সময়ের ছন্দ নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তা।পরে সেই চিন্তাই হয়ে উঠবে দোলকের নিয়ম আবিষ্কারের বীজ।
বয়স বাড়তে লাগল, আর বাড়তে লাগল প্রশ্নের ঝড়।চার্চ বলত—পৃথিবী স্থির, সূর্য ঘুরছে।
কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্যালিলিও ভাবত, “যদি সত্যি পৃথিবীই ঘুরে, তাহলে সূর্য তো স্থিরই দেখাবে!”এই প্রশ্নগুলো ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু তার মন মানত না নিয়ম।
পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়ল চিকিৎসাশাস্ত্রে,
কিন্তু শিগগিরই বুঝল—তার মন পড়ে আছে সংখ্যা, গতি, আলো ও আকাশে।চিকিৎসাবিদ্যার বই রেখে সে মন দিল গণিত ও পদার্থবিদ্যায়।
তার শিক্ষকরা তাকে বলত, “তুমি খুব বেশি প্রশ্ন করো।”কিন্তু সেই প্রশ্ন করাই তাকে করে তুলল অন্যরকম।গ্যালিলিও তখন ছাত্র হলেও,তার চোখে ছিল এক আলাদা দৃষ্টি—যে দৃষ্টি শুধু দেখে না, বুঝতেও চায়।রাতের আকাশে তাকিয়ে সে ভাবত,“এই তারারা কি সবাই সমান দূরে?নাকি কেউ কাছে, কেউ দূরে?”এমন চিন্তা তৎকালীন যুগে প্রায় পাগলামি ছিল।
তবু গ্যালিলিওর মন থামেনি।
তার জন্য আকাশ মানে ছিল না কেবল প্রার্থনার স্থান,বরং এক অজানা জগৎ, যেখানে প্রতিটি তারা একটি প্রশ্ন, আর প্রতিটি প্রশ্ন এক সম্ভাবনার আলো।
রাত তখন গভীর। আকাশ ভরা নক্ষত্রে।
ইতালির পাদুয়া শহরের এক ছোট্ট ঘরে বসে আছেন গ্যালিলিও গ্যালিলি।চোখে ক্লান্তি, টেবিলে ছড়ানো কাগজ, কলম, আর কাচের টুকরো।বাইরে হালকা বাতাসে জানালার পর্দা দুলছে,আর তার ভেতরে এক মানুষ ভাবছে—“মানুষ চোখে যতটা দেখে, তার বাইরেও কি কিছু আছে?”
গ্যালিলিও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।ছাত্রদের পদার্থবিদ্যা শেখান, সংখ্যার হিসাব শেখান,কিন্তু তার নিজের মনে চলছে অন্যরকম যুদ্ধ— সত্যের সন্ধান।
একদিন তিনি শুনলেন এক আশ্চর্য খবর—
নেদারল্যান্ডের এক ব্যবসায়ী এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছে যা দিয়ে দূরের জিনিসও কাছে দেখা যায়!
গ্যালিলিওর মনে যেন আগুন জ্বলে উঠল।
“দূরের জিনিস কাছে দেখা যায়? তাহলে আমি যদি আকাশের দিকে তাকাই, চাঁদ, তারা—সব কি আরও স্পষ্ট দেখা যাবে?”
রাত গভীর। পাদুয়া শহরের এক ছোট ঘরে বাতাসে হালকা শীতের স্পর্শ।গ্যালিলিও গ্যালিলি বসে আছেন টেবিলের পাশে, চারপাশে ছড়ানো কাগজ, কলম, কাঠ ও কাচের টুকরো।
নেদারল্যান্ডের এক খবর শুনেছিলেন,
একটি ছোট যন্ত্র যা দূরের বস্তুকে কাছে দেখায়।
তার কৌতূহল এক মুহূর্তেও শান্ত হলো না।
চোখে জ্বলছে আগুন, হৃদয়ে ছড়িয়ে গেছে উত্তেজনার জোয়ার।“আকাশের রহস্য কি সত্যিই আমি দেখব?”—মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড়।
রাত গভীর। পাদুয়ার এক ছোট ঘরে বাতাসে হালকা শীত।গ্যালিলিও বসে আছেন টেবিলের পাশে, চারপাশে ছড়ানো কাগজ, কলম, কাঠ ও কাচের টুকরো।
প্রথম দিনেই শুরু হলো পরীক্ষা।
কাচ কাটা, পালিশ করা, কাঠের বেধ ঠিক করা—সবই নতুন চ্যালেঞ্জ।প্রথমবার লেন্সে তাকালেন—চিত্র ঝাপসা, অস্বচ্ছ।চাঁদ যেন কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে আছে। বৃহস্পতির চারপাশে কোন চিহ্ন দেখা গেল না।ক্লান্তি, হতাশা, আঙুলের ক্ষত—সব কিছু অনুভব করলেন।
গ্যালিলিও হতাশ হলেন? না।
তিনি জানতেন—প্রতিটি ব্যর্থতা নতুন শিক্ষা দেয়।
লেন্সের ক্ষুদ্রতম বাঁক, কাঠের ত্রুটি, আলো ও চোখের মিল—সবই পরীক্ষা করতে হবে।
পরের দিন নতুন লেন্স, নতুন কাঠ, আরও নিখুঁত পালিশ।বারবার পরীক্ষা। রাতের অন্ধকার, সূর্যের আলো—সবই প্রয়োগ।তার হাত কেটে যায়, চোখ ক্লান্ত হয়, কিন্তু মন থামেনি।প্রত্যেক ব্যর্থতা তাকে শিখিয়েছে—কোথায় ভুল, কোথায় পরিবর্তন দরকার।
এক মাস, দুই মাস…ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের ফলে শেষে তিনি বানালেন এক দূরবীন—যেটি আকাশকে স্পষ্টভাবে দেখাতে সক্ষম।“এ হলো আমার নতুন চোখ। এখন আমি সত্যকে স্পর্শ করতে পারব।”
এভাবে, প্রথম ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই তিনি শিখলেন—
সাফল্য সহজে আসে না, কিন্তু অধ্যবসায় ও কৌতূহল থাকলেই জয় সম্ভব।প্রথম দিনেই তিনি লেন্সের সাথে খেলতে শুরু করলেন। কাচ কেটে, পালিশ করে, কাঠের বেধ ঠিক করতে লাগলেন।
কিন্তু গ্যালিলিও থামলেন না। তিনি জানতেন— প্রত্যেক ব্যর্থতা একটি শিক্ষা। দিনের আলো, রাতের অন্ধকার, বারবার পরীক্ষা—এভাবেই তিনি চরম অধ্যবসায় দেখালেন।
এক রাতে, যখন সব শহর নিস্তব্ধ, তিনি নিজের তৈরি দূরবীন হাতে নিয়ে তাকালেন আকাশের দিকে।চাঁদ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল—পাহাড়, গহ্বর, ছায়া, সবই স্পষ্ট।
এমনকি বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরতে দেখা গেল চারটি ছোট উপগ্রহ।গ্যালিলিও বুঝলেন, পৃথিবী পৃথিবী নয়—সূর্য কেন্দ্র, পৃথিবী তার চারপাশে ঘুরছে।তার চোখে পৃথিবী এবং আকাশ এক নতুন বাস্তবতায় ভেসে উঠল।“এ সত্য, এ আলোর পথ। আমি যা দেখছি, তা সত্য।
গ্যালিলিও নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন।প্রতিটি রাত, প্রতিটি লেন্সের কোণ—সবই তিনি নোটে লিপিবদ্ধ করলেন।চাঁদ, গ্রহ, তারা—সবই। এভাবে তৈরি হলো বিশদ ও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, যা পরবর্তীতে পুরো ইউরোপকে বিস্মিত করল।তার নোটগুলো শুধু তথ্য নয়, ছিলেন প্রমাণের নিখুঁত ধারা।
গ্যালিলিও নিজের সব পর্যবেক্ষণ লিখলেন বইতে—“Sidereus Nuncius”।বইটি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপজুড়ে।যে সত্য দেখেছেন, তা প্রকাশ করার সাহস দেখালেন,যদিও জানতেন চার্চের প্রতিক্রিয়া কঠোর হবে।
ধর্মগুরুরা চিৎকার করল, মানুষ বিভ্রান্ত হল।
কিন্তু গ্যালিলিও থামলেন না।তিনি জানতেন—সত্যকে চুপ করানো যায় না।
যে ছোট লেন্স দিয়ে তিনি চাঁদ ও গ্রহ দেখেছিলেন,
আজ তার উত্তরসূরীরা বৃহৎ টেলিস্কোপে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করছেন।গ্যালিলিও প্রমাণ করলেন—“সত্য ধৈর্য, অধ্যবসায় ও কৌতূহলের দ্বারা অর্জিত হয়।যে মানুষ সাহসী, তার জন্য কোনো রহস্য অসম্ভব নয়।”
১৬১০ সালের শীতের এক গভীর রাত।
ইতালির আকাশে নক্ষত্রেরা জ্বলছে,
আর জানালার পাশে বসে আছেন এক নিঃশব্দ মানুষ—গ্যালিলিও গ্যালিলি।চোখে তাঁর নিজের তৈরি দূরবীন,হৃদয়ে কৌতূহল আর প্রত্যাশার আলো।
রাতের নীরবতা ভেদ করে যেন পুরো আকাশ কথা বলছে তাঁর সঙ্গে। তিনি তাকালেন চাঁদের দিকে। যে চাঁদকে এতদিন মানুষ ভেবেছিল মসৃণ, নিখুঁত, পবিত্র, সেই চাঁদে গ্যালিলিও দেখলেন পাহাড়, গহ্বর, ছায়া আর আলোর খেলা।“এ কেমন!”—তিনি ফিসফিস করে বললেন, “চাঁদ তো আমাদের মতোই অসম্পূর্ণ!”
তাঁর চোখের সামনে চাঁদ হয়ে উঠল এক জীবন্ত গ্রহ,
যেন মানুষের পৃথিবীর প্রতিবিম্ব।এই আবিষ্কার কেবল বিজ্ঞান নয়,মানুষের অহংকারকেও কাঁপিয়ে দিল—কারণ এতদিন মানুষ ভাবত, আকাশের জগৎ নিখুঁত,পৃথিবীই কেবল অসম্পূর্ণ।
কিন্তু গ্যালিলিওর কৌতূহল এখানেই থামেনি।
তিনি তাকালেন আরও দূরে—বৃহস্পতির দিকে।
লেন্সে ভেসে উঠল এক উজ্জ্বল বিন্দু,
তার পাশে কয়েকটি ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু।
প্রথমে ভাবলেন—ওগুলো হয়তো সাধারণ তারা।
কিন্তু টানা কয়েক রাত পর্যবেক্ষণ করে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন— ওগুলো অবস্থান বদলাচ্ছে,
বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরছে!
তিনি বুঝলেন, এ তো নতুন আবিষ্কার!
পৃথিবীর বাইরে আরেকটি গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরছে চারটি উপগ্রহ।তিনি লিখে রাখলেন তাদের নাম—আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো।
আজও তারা পরিচিত “গ্যালিলিওর উপগ্রহ” নামে।
এই দৃশ্য যেন এক মহাবিস্ময়ের বার্তা—
যদি বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে উপগ্রহ ঘুরতে পারে,
তাহলে সব কিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না!
গ্যালিলিওর মনে তখন একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—“সূর্যই কেন্দ্র, পৃথিবী নয়!”এই সত্য তখনকার পৃথিবীর বিশ্বাসকে কাঁপিয়ে দিল।মানুষ যাকে ঈশ্বরের বিধান মনে করত, গ্যালিলিও প্রমাণ করলেন, তা কেবল মানুষের ভুল ধারণা।
তিনি তাঁর আবিষ্কারগুলো লিখে ফেললেন এক বইয়ে,নাম রাখলেন "Sidereus Nuncius" — “তারাময় বার্তা”।বইটি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপজুড়ে,
আর মানুষ প্রথমবার বুঝল—আকাশ শুধু রহস্য নয়, গবেষণার ক্ষেত্রও হতে পারে।
রাত তখন নিস্তব্ধ। গ্যালিলিওর জানালার বাইরে বাতাসে কাঁপছে গাছের ডালপালা।তাঁর ঘরে ছড়ানো কাগজ, নোট, আর দূরবীনটি—যার লেন্সে তিনি দেখেছেন মহাবিশ্বের আসল চেহারা।
কিন্তু বাইরের পৃথিবী তখন আলোয় নয়, অন্ধকারে ঢেকে গেছে—অন্ধ বিশ্বাস, ভয়, আর ধর্মীয় কর্তৃত্বের অন্ধকারে।
গ্যালিলিওর “তারাময় বার্তা” বই ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপজুড়ে।বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, তরুণ ছাত্র—সবাই অবাক হয়ে পড়ল। কেউ বলল, “এ মানুষ তো স্বর্গের দরজা খুলে দিয়েছে!” আবার কেউ ফিসফিস করে বলল,“এ মানুষ বিপদ ডেকে এনেছে নিজের ঘরে...”কারণ তখন চার্চের মতবাদ ছিল একটাই—“পৃথিবী স্থির, সূর্য ঘুরছে।” আর গ্যালিলিওর দূরবীন দেখাচ্ছে—উল্টোটা!
একদিন খবর এল— চার্চ গ্যালিলিওর বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। রোম থেকে পাঠানো হলো নোটিশ—“তোমাকে বিচারকের সামনে হাজির হতে হবে।”
বৃদ্ধ গ্যালিলিও হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালেন রোমের আদালতে।আদালতের ঘরে ছিলেন বিশাল পোশাকে আবৃত বিচারক ও ধর্মগুরু। তাঁদের চোখে রাগ, গলায় হুঁশিয়ারি।“তুমি কি বলছো পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে?”
গ্যালিলিও মাথা নিচু করলেন। তিনি জানেন—এই সত্য বলা মানে মৃত্যু। তবু বললেন শান্ত গলায়,“আমি যা দেখেছি, তা-ই বলছি। দূরবীন মিথ্যা বলে না।”
ধর্মগুরুরা চিৎকার করে উঠল, “এ ঈশ্বরের বাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নাও, নয়তো শাস্তি পাবে!”
সেই রাতে গ্যালিলিওর মন ভারী হয়ে গেল।
একদিকে ছিল তাঁর দেখা সত্য,অন্যদিকে—জীবনের নিরাপত্তা। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে তিনি স্বীকার করলেন, “হ্যাঁ, আমি ভুল বলেছি।”
কিন্তু আদালত থেকে বেরিয়ে এসে নীরবে ফিসফিস করে বললেন সেই অমর বাক্য—“E pur si muove.” “তবুও, পৃথিবী ঘুরছে।”
চার্চ তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখল টাসকানির এক বাড়িতে। দূরবীন তখন টেবিলে পড়ে আছে, ধুলো জমছে লেন্সে,তবুও তাঁর চোখের দৃষ্টি নিভে যায়নি।
বৃদ্ধ বয়সে তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন,
তবু রাতে জানালার দিকে তাকিয়ে বলতেন,“আকাশের সত্য আমি দেখেছি।
কেউ যদি তা না মানে, তবু সত্য রয়ে যায় সত্যই।”
টাসকানির নিঃস্তব্ধ এক কোণে, পুরনো এক বাড়ির জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢোকে ধীরে ধীরে।সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ— চোখ প্রায় নিভে গেছে, কিন্তু মন এখনো জ্বলে।
তিনি গ্যালিলিও গ্যালিলি। মানুষ যাকে একসময় "ধর্মদ্রোহী" বলেছিল, আজ সেই মানুষই আকাশের সত্য উন্মোচনের প্রতীক।
বৃদ্ধ গ্যালিলিও হাতে তুলে নেন তাঁর পুরোনো দূরবীনটা। লেন্সে জমে থাকা ধুলো তিনি হাতের তালু দিয়ে মুছতে মুছতে ফিসফিস করেন,“আমি অন্ধ হয়েছি, কিন্তু আমার চোখে এখনো তারা জ্বলে।”তিনি জানেন—তাঁর দেখানো পথ একদিন বদলে দেবে পৃথিবীকে। তাঁর ছাত্র, তাঁর বই, তাঁর ভাবনা—সব ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে।
বছর কেটে যায়… ১৬৪২ সালে, ৮ জানুয়ারি,
তাঁর নিঃশব্দ নিঃশ্বাস থেমে যায় টাসকানির আকাশের নিচে।কিন্তু সেই আকাশে তখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর দেখা সেই চাঁদ, যার গহ্বরগুলো তিনি প্রথম মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন দূরবীনে।
সময় বয়ে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী।
গ্যালিলিওর নাম একদিন শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হতে থাকে“আধুনিক বিজ্ঞানের জনক” হিসেবে।
নিউটন তাঁর সূত্র লিখতে বসে বলেছিলেন,“আমি যদি দূরদর্শী হতে পারি,তা কেবল গ্যালিলিওর কাঁধে দাঁড়িয়েই।”
তাঁর দূরবীনের ক্ষুদ্র লেন্স থেকে জন্ম নেয় আধুনিক টেলিস্কোপ,মানুষ তাকিয়ে দেখে চাঁদের বাইরে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, শেষমেশ নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
চার্চও একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারে।
১৯৯২ সালে— গ্যালিলিওর মৃত্যুর ৩৫০ বছর পর—
পোপ জন পল দ্বিতীয় ঘোষণা করেন,“গ্যালিলিও ছিলেন সত্যের অনুসন্ধানী,তাঁর প্রতি আমাদের অন্যায় হয়েছিল।”
যে মানুষ একসময় কারারুদ্ধ ছিলেন,
তাঁর নাম তখন আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে—
গ্যালিলিও স্যাটেলাইট, গ্যালিলিও স্পেস প্রোব, গ্যালিলিও অবজারভেটরি…মহাবিশ্ব আজ যেন তাঁর নামেই প্রতিধ্বনিত হয়।
একজন মানুষ, এক ছোট্ট দূরবীন, আর এক সীমাহীন কৌতূহল— এই তিনে বদলে গেল পৃথিবীর চিন্তা।
গ্যালিলিও প্রমাণ করলেন,“আকাশ শুধু উপাসনার নয়, বোঝারও বিষয়।”তাঁর চোখে দেখা সেই দূর নক্ষত্রেরা আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্যকে হয়তো থামানো যায়,
কিন্তু সত্যের আলো কখনো নিভে না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা সেই তরুণ অধ্যাপক
একদিন পুরো পৃথিবীর দৃষ্টি পাল্টে দিলেন।
তাঁর চোখে মহাবিশ্বের দরজা খুলে গেল,
আর মানুষ শিখল—জিজ্ঞাসাই জ্ঞানের প্রথম আলো।
গ্যালিলিও তাই আজও ইতিহাসের আকাশে জ্বলে থাকা এক নক্ষত্র,যিনি প্রমাণ করেছিলেন —“যে মানুষ আকাশের পানে ছুটে চলে, সে-ই খুঁজে পায় সত্যের আলো।”