সময়কে বেঁধে রাখার গল্প: ঘড়ি আবিষ্কারের কাহিনি

16 Oct 2025 07:56:44 PM

সময়কে বেঁধে রাখার গল্প: ঘড়ি আবিষ্কারের কাহিনি 

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

অনেক, অনেক দিন আগে—যখন পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ছিল না, ক্যালেন্ডারও ঠিকমতো ছিল না—মানুষ সময় বুঝত সূর্যের ছায়া দেখে। সকালে সূর্য উঠলে দিন শুরু, আর ছায়া লম্বা হলে বুঝত সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এইভাবে সময় বোঝা ছিল খুবই অনির্ভরযোগ্য। মেঘলা দিনে ছায়া হারিয়ে যেত, আর রাতে তো সূর্যই থাকত না!

তখন থেকেই মানুষ ভাবতে শুরু করল—“সময়কে কি ধরা যায়? বাঁধা যায় কোনো যন্ত্রে?”

 খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগের দিককালে এক তপ্ত দুপুরে। গরম বাতাসে কাঁপছে মরুভূমি। আকাশ জ্বলছে আগুনের মতো সূর্যের আলোয়। এই মাটিতেই, হাজার হাজার বছর আগে, প্রাচীন মিসরে বাস করতেন এক জ্ঞানী পুরোহিত—ইমহোটেপ। তিনি ছিলেন ফারাওয়ের উপদেষ্টা, চিকিৎসক, আর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাবিদ। প্রতিদিন সকালে তিনি সূর্যের প্রথম আলো দেখতে উঠতেন, আর ভাবতেন—“সূর্য তো প্রতিদিনই উঠে, কিন্তু আমি জানি না কখন সকাল হয়, কখন দুপুর, কখন রাত নামে! সময়কে মাপা যায় না কেন?”

তখন মানুষ সময় বোঝে কেবল প্রকৃতির ইঙ্গিতে—পাখির ডাক মানে সকাল, সূর্য মাথার উপরে মানে দুপুর, আর অন্ধকার নামলেই রাত। কিন্তু কৃষকরা ফসলের সময় নির্ধারণ করতে চাইত, মন্দিরে পুরোহিতরা চেয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনা করতে, আর রাজারা চেয়েছিলেন কাজের হিসাব রাখতে।
সবাই একই প্রশ্নে ভুগছিল—“সময়কে ধরা যায় না?”

একদিন দুপুরবেলায় ইমহোটেপ দেখলেন, তাঁর হাতে ধরা লাঠির ছায়া ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। সকালে ছায়া লম্বা হয়ে পূর্বদিকে পড়ে, আর দুপুরে ছোট হয়ে আসে তাঁর পায়ের কাছে। বিকেলে আবার ছায়া বাড়ে, তবে এবার পশ্চিমে।হঠাৎ তাঁর মনে জেগে উঠল এক চিন্তা—“এই ছায়ার পরিবর্তনই তো সূর্যের পথের সঙ্গে সময়ের বদলকে জানাচ্ছে!”

তিনি একটি পাথরের দণ্ড—যাকে বলা হয় গনোমন (Gnomon)—মাটিতে উঁচু করে দাঁড় করালেন। তারপর চারপাশে চিহ্ন কেটে রাখলেন, ছায়া যেদিকে পড়ে তা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন— দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ছায়া ঠিক নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পড়ে।

এভাবেই তিনি তৈরি করলেন পৃথিবীর প্রথম সূর্যঘড়ি (Sundial)।

সেদিন থেকেই মানুষ প্রথমবারের মতো “সময়কে দেখা” শিখল।সূর্য উঠলে ঘড়ির ছায়া লম্বা হতো, আর সূর্য যত ওপরে উঠত, ছায়া তত ছোট হয়ে আসত। দুপুরে যখন ছায়া দণ্ডের নিচে মিলিয়ে যেত, তখন সবাই জানত—এখন দিনের ঠিক মাঝবেলা।

প্রাচীন মিসরীয় সমাজে এই আবিষ্কার ছিল এক বিপ্লব।রাজদরবারে, মন্দিরে, এমনকি সাধারণ কৃষকের মাঠেও সূর্যঘড়ি বসানো হতো।
ফারাওয়ের প্রাসাদে সকালে ছায়া দেখা মানেই কাজ শুরু, আর সন্ধ্যায় ছায়া লম্বা হলে কাজ শেষ।

সূর্যঘড়ির ছায়া যেন মানুষকে বলত,
“সময় থেমে নেই, আমি চলছি, তোমরাও চল।”

ইমহোটেপের এই ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল প্রাচীন বিশ্বের নানা প্রান্তে।ব্যাবিলন, গ্রীস, চীন, ও রোম—সব জায়গায় সূর্যঘড়ি বানানো শুরু হলো। রোমানরা তো এমনকি রাস্তায় দাঁড়ানো সূর্যঘড়ি বসাত, যাতে পথচারীরাও সময় জানতে পারে।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত রোমান দার্শনিক ভিত্রুভিয়াস সূর্যঘড়ির বিভিন্ন ধরন নিয়েও লিখেছিলেন।আর চীনে তৈরি হলো গোলাকার ও আধবৃত্তাকার সূর্যঘড়ি—যেখানে ছায়া চলাচলের দিকেই সময় লেখা থাকত।

তবে সূর্যঘড়িরও ছিল দুর্বলতা।রাত হলে সূর্য অদৃশ্য, তাই ছায়াও নেই।মেঘলা দিনে ছায়া অস্পষ্ট হয়ে যেত, ফলে সময় নির্ধারণ করা যেত না। তবুও, তখনকার মানুষদের কাছে সূর্যঘড়ি ছিল সময়ের দেবতা—যে প্রথমবার সময়ের অদৃশ্য স্রোতকে চোখে দেখার সুযোগ দিয়েছিল।

ইমহোটেপ হয়তো ভাবতেও পারেননি, তাঁর ছায়া দেখার সেই সরল ধারণা একদিন বদলে দেবে পৃথিবীর সব জীবনযাত্রা।মানুষ বুঝে গেল—সময় হলো এমন এক শক্তি, যাকে দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায় নিয়মে।

এই সূর্যঘড়িই মানবজাতিকে নিয়ে গেল পরবর্তী ধাপে— যেখানে সময়কে মাপার জন্য পানি, বালি, এমনকি যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া শুরু হলো।

আর সেই ছায়া, যা একদিন মরুভূমিতে দণ্ডের নিচে নাচত,সেই ছায়াই আজও টিকটিক করে বাজে আমাদের কব্জির ঘড়িতে— সময়কে বেঁধে রাখার প্রথম আলো হিসেবে।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ – খ্রিষ্টাব্দ ১৩০০ সময়কালে ঘড়ির উন্নতি ঘটে। সূর্যঘড়ির আবিষ্কারের পর মানুষ সময় মাপতে শিখেছিল, কিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা ছিল—
রাতে যখন সূর্য থাকে না, তখন সময় কে বলে দেয়?
মেঘে ঢেকে গেলে ছায়া হারিয়ে যায়, তখন কীভাবে জানা যায়, প্রার্থনার সময় কখন?

এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হলো সময় ধরার দ্বিতীয় অধ্যায়—যেখানে সূর্যের আলো নয়, জল আর বালিই সময়ের ভাষা হয়ে উঠল।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ বছর আগে, প্রাচীন মিসরে, এক পুরোহিতের দায়িত্ব ছিল রাতে নির্দিষ্ট সময়ে মন্দিরে প্রার্থনার ঘণ্টা বাজানো।কিন্তু সূর্য না থাকলে তিনি সময় বুঝবেন কীভাবে?

তখন তিনি ভাবলেন— “সূর্য চলে গেছে, কিন্তু পানি তো ধীরে ধীরে পড়ে!যদি আমি পানির প্রবাহ গুনতে পারি, তাহলে সময়ও গুনতে পারব।”

এই ভাবনা থেকেই তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম পানির ঘড়ি—যাকে বলা হয় “ক্লেপসিড্রা (Clepsydra)”।

এই ঘড়িটি ছিল আশ্চর্য সরল, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত।
একটি পাত্রে ছোট ছিদ্র করা হতো।ধীরে ধীরে পানি ঝরতে থাকত অন্য একটি পাত্রে।পাত্রের ভেতরে চিহ্ন আঁকা থাকত—পানি যত নিচে নামত, সময়ও তত এগোত।

মন্দিরের পুরোহিতরা এই ঘড়ি ব্যবহার করতেন রাতে প্রার্থনার সময় মাপতে। রাজদরবারে এটি ব্যবহৃত হতো আদালতের সময় গোনার জন্য— যেখানে একজন বক্তাকে বলা হতো, “তোমার কথা বলার সময় যতক্ষণ এই পানি পড়বে।”

এভাবেই সময়কে ফোঁটায় ফোঁটায় বেঁধে রাখা শুরু হলো।

পানির ঘড়ির ধারণা ছড়িয়ে পড়ল গ্রীস, ব্যাবিলন ও ভারতের দিকে।গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এমনকি নিজের পাঠদানের সময় মাপতে পানির ঘড়ি ব্যবহার করতেন।অন্যদিকে রোমান সৈন্যরা যুদ্ধের সময় পালা বদলের হিসাব রাখত এই পানির ঘড়ি দেখে।

সমুদ্রযাত্রায়ও এটি ছিল অমূল্য।রাতে জাহাজের ক্যাপ্টেন সময় মাপতেন পানির ফোঁটায় ফোঁটায়—
কারণ সমুদ্রের ঢেউ থামলেও, পানির ঘড়ি থামত না।

এরপর মানুষ সময়কে ধরল আরেক প্রাকৃতিক উপাদানে—বালি।কেউ জানে না ঠিক কখন, তবে ধারণা করা হয় খ্রিষ্টাব্দ ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে বালুঘড়ির প্রচলন শুরু হয়।

দুটি কাচের গম্বুজ, মাঝখানে সরু পথ।উপরে থাকা বালি ধীরে ধীরে নিচে পড়ে—যতক্ষণ পড়ে, ততক্ষণ সময় চলে।এই ঘড়ির নাম হলো “Hourglass” বা বালুঘড়ি।

বালুঘড়ি ছিল আরও সহজ ও বহনযোগ্য।জাহাজে, রাজদরবারে, এমনকি সাধুদের ধ্যানকক্ষে এটি ব্যবহৃত হতো। যখন উপরের কাচের বালি ফুরিয়ে যেত, নিচের কাচটি উল্টে আবার শুরু করা হতো সময়ের নতুন যাত্রা।

মধ্যযুগে বালুঘড়ি হয়ে উঠেছিল সময়ের প্রতীক।
সমুদ্রযাত্রায় এটি ছিল অপরিহার্য—নাবিকরা জানত, “যতক্ষণ বালি পড়ছে, ততক্ষণ পাহারার সময়।”
বিচারালয়ে, কারিগরের কর্মশালায়, এমনকি পণ্ডিতদের ডেস্কেও বালুঘড়ি ছিল—একটি ছোট, টিকটিক না করা কিন্তু অদৃশ্যভাবে চলমান সময়ের যন্ত্র।

অনেকে এটিকে জীবনের প্রতীকও ভাবতেন।
কারণ বালির মতোই সময়ও ক্রমে ফুরিয়ে যায়, আর ফিরে আসে না।

খ্রিষ্টাব্দ ১২৮০ – ১৬৫৬ সময়কালে যখন সময় প্রথম লোহার দাঁতে বন্দি হলো

সূর্যের ছায়া, পানির ফোঁটা আর বালির দানায় সময়কে মেপে মানুষ অনেক দূর এগিয়েছিল।
তবুও এক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল —“কেন সময়কে শুধু প্রকৃতির ভরসায় রাখতে হবে? আমি কি এমন এক যন্ত্র বানাতে পারি, যা নিজের মতো করে সময় জানাবে?”

এই প্রশ্নই মানুষকে নিয়ে গেল এক নতুন যুগে—যন্ত্রঘড়ির যুগে।

১২৮০ খ্রিস্টাব্দ, ইতালির ছোট শহর মিলান। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি তখনও সূর্যের ছায়ার ওপর নির্ভর করে বাজানো হয়। কিন্তু পুরোহিতদের মাঝে উঠল বিরক্তি—মেঘলা দিনে কখনো ঘণ্টা আগেভাগে বাজে, কখনো দেরিতে।তখন এক লোহার মিস্ত্রি, নাম তার জিওভান্নি ডে ডন্ডি (Giovanni de Dondi), ভাবলেন— “যদি আমি এমন এক যন্ত্র বানাতে পারি, যা নিজেই সময় ধরে রাখবে?”

তিনি লোহা, কাঠ আর দাঁতযুক্ত চাকা (gear) ব্যবহার করে বানালেন এক অদ্ভুত যন্ত্র।ভেতরে ছিল ভারি দোলক, আর উপরে বড় ঘণ্টা। নির্দিষ্ট সময় পরপর ঘণ্টা বাজত, আর সেই শব্দ শুনে শহরের মানুষ জানত—সময় কেটে যাচ্ছে।

এভাবেই প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ির জন্ম হয় আনুমানিক ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে।

১৩০০ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এই বিশাল যান্ত্রিক ঘড়ি।ইংল্যান্ডের সালিসবুরি ক্যাথেড্রাল (Salisbury Cathedral)-এ ১৩৮৬ সালে বসানো হয় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন কার্যকর যন্ত্রঘড়ি।এই ঘড়িটি দিনে কয়েকবার ঘণ্টা বাজাত, কোনো সূর্য বা বালির প্রয়োজন ছাড়াই।

তখনকার মানুষদের কাছে এটি ছিল জাদুর মতো।
গোটা শহর সময় শুনে নিত ঘণ্টার আওয়াজে—
একটি যন্ত্র মানুষের জন্য সময়কে “শোনা যায় এমন” করে তুলেছিল।

 ১৫০০–১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ— সময় এখন মানুষের হাতে বন্দি হলো।বাতাসে তখন রেনেসাঁ যুগের সুর—ইউরোপের রাজপ্রাসাদে নতুন চিন্তা, শিল্প আর বিজ্ঞান নিয়ে উৎসব চলছে। গির্জার টাওয়ারে ঘণ্টা বাজে যান্ত্রিক ঘড়িতে, কিন্তু তাতে সময় জানার জন্য মানুষকে উপরে তাকাতে হয়।রাজা-রাজড়ারা, বণিক আর পণ্ডিতরা ভাবতে লাগলেন—“সময়কে যদি নিজের ঘরে, এমনকি নিজের সঙ্গে নিয়ে চলা যেত!”

এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় ছোট ঘড়ির যুগ— যেখানে সময় নামতে থাকে টাওয়ারের উচ্চতা থেকে মানুষের হাতে।

১৫১০ খ্রিস্টাব্দ, নুরেমবার্গ শহর, জার্মানির এক প্রাচীন কারিগরপাড়া। সেখানে বাস করতেন এক প্রতিভাবান তালাচাবি মিস্ত্রি—পিটার হেনলাইন (Peter Henlein)।তিনি ছিলেন একাধারে ধাতুশিল্পী ও উদ্ভাবক।

একদিন তাঁর মাথায় এলো এক অসম্ভব চিন্তা—
“ঘড়িকে এত বড় হতে হবে কেন? যদি আমি এর ভেতরে স্প্রিং লাগাই, তবে ভারি দোলকের দরকার পড়বে না!”

বছরের পর বছর চেষ্টা, ধাতুর টুকরো, গিয়ার, আর স্প্রিং-এর নকশা নিয়ে দিনরাত কাজ করলেন তিনি।
অবশেষে ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তৈরি করলেন ইতিহাসের প্রথম পোর্টেবল স্প্রিং-ঘড়ি (Portable Spring Clock)—যা ছোট, গোলাকার, আর কোমরে ঝোলানো যেত।

লোকেরা একে ডাকল “Nuremberg Egg”, কারণ এটি ছিল ডিমের মতো গোল ও মসৃণ।

পিটার হেনলাইনের ছোট ঘড়িটি ছিল এক অনন্য সৃষ্টি।ভেতরে ছিল একটি স্প্রিং, যা ধীরে ধীরে খুলে গিয়ে গিয়ার ঘুরাত।এভাবেই সময় চলত, ঘণ্টা বাজত।

তখনকার মানুষের কাছে এটি ছিল জাদুর মতো।
রাজপুত্ররা কোমরে ঝুলিয়ে রাখতেন, বণিকরা বুকে ঝুলিয়ে রাখতেন, আর যাত্রীরা গর্বভরে বলতেন—
“সময় এখন আমার সঙ্গে চলে।”

যে সময় একদিন গির্জার ঘণ্টায় বাজত, আজ তা ঝুলছে এক মানুষের কোমরে— এ যেন সময়ের স্বাধীনতা!

১৫৪০- ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ এর দিকে শীঘ্রই পিটার হেনলাইনের উদ্ভাবন ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র ইউরোপে।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন—প্রত্যেক দেশের রাজা তাঁদের প্রাসাদে এই নতুন ছোট ঘড়ি রাখার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন।

১৫৪০ সালের দিকে ইউরোপে দেখা গেল পকেটঘড়ি (Pocket Watch)—যা রাজা, অভিজাত আর ধনী ব্যবসায়ীদের স্ট্যাটাসের প্রতীক হয়ে উঠল।

পকেটঘড়িগুলো তৈরি করা হতো রুপা বা সোনায়, খোদাই করা থাকত ফুল, পাখি বা রাজচিহ্নের নকশা।তবে একটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল—এগুলো তখনও মিনিট দেখাতে পারত না, কেবল ঘণ্টা পর্যন্তই সময় জানাত। তবুও এই ছোট ঘড়ি যেন মানুষের জীবনে নিয়ে এল এক অদ্ভুত পরিবর্তন।

এখন মানুষ সময়কে “দেখা” নয়, “বয়ে বেড়ানো” শুরু করল।

১৫৫০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আরও উন্নত স্প্রিং-ঘড়ি তৈরি হলো।কারিগররা গিয়ারকে আরও নিখুঁত করলেন, কাঠের পরিবর্তে লোহা ও পিতল ব্যবহার শুরু হলো।অনেক ঘড়িতেই তখন “আলার্ম” যুক্ত করা হতো, যাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা বাজে।

এই সময়ই প্রথমবারের মতো “ঘড়ির নির্মাতা” নামে একটি নতুন পেশার জন্ম হলো। জার্মানির নুরেমবার্গ, ইংল্যান্ডের লন্ডন, আর ফ্রান্সের প্যারিসে তৈরি হতে লাগল ছোট, নান্দনিক ঘড়ি— যেগুলোর প্রতিটি ছিল যেন একেকটি শিল্পকর্ম।

রেনেসাঁ যুগের মানুষ তখন শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে নতুন আলো খুঁজছে। এবং সময়ের এই ছোট যন্ত্র তাদের জীবনের তাল বদলে দিচ্ছে।যারা আগে দিনের কাজ ঠিক করত সূর্যের ছায়া দেখে, তারা এখন ঘড়ির কাঁটা দেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কখন শুরু করবে, কখন শেষ করবে।

১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ, নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস (Christiaan Huygens) সেই স্বপ্ন পূরণ করলেন। তিনি তৈরি করলেন পৃথিবীর প্রথম দোলকঘড়ি (Pendulum Clock)।এর দোলকের নিয়মিত দোলন সময় মাপার নিখুঁত ছন্দ তৈরি করল।এই ঘড়ি দিনে মাত্র এক সেকেন্ড ভুল করত—যা সে যুগে ছিল অবিশ্বাস্য নির্ভুলতা!

দোলকঘড়ির জন্মের বছর ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ—এই বছরই মানবজাতি বুঝল, সময়কে শুধু দেখা বা শোনা নয়, এখন নিখুঁতভাবে মাপাও যায়।

১৫১০ সালে জার্মান উদ্ভাবক পিটার হেনলাইন (Peter Henlein) তৈরি করলেন প্রথম বহনযোগ্য ঘড়ি।এটি ছোট, পকেটে রাখার মতো, আর স্প্রিং দিয়ে চালিত।এই ঘড়িটিই মানুষকে সময়ের সাথে “চলতে শেখায়”—যেখানেই যাওয়া হোক, সময় সঙ্গে থাকে।

এরপর এল দোলকঘড়ি (Pendulum Clock)। ১৬৫৬ সালে ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস (Christiaan Huygens) তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল দোলকঘড়ি, যা দিনে মাত্র এক সেকেন্ড ভুল করত—অতুলনীয় সাফল্য!

১৮শ শতকে ব্রিটিশ উদ্ভাবক জন হ্যারিসন (John Harrison) তৈরি করলেন সমুদ্রযাত্রার ঘড়ি বা মেরিন ক্রোনোমিটার, যা জাহাজে সময় ঠিক রাখত।
এর ফলে নাবিকরা নির্ভুলভাবে দিক নির্ণয় করতে পারত, এবং সমুদ্রযুগের বিপ্লব ঘটে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের হাতে দেখা গেল নতুন এক যন্ত্র—কব্জিঘড়ি (Wristwatch)। যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সময় দেখার সুবিধায় এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল।এরপর এলো কোয়ার্টজ ঘড়ি (Quartz Clock)—১৯৬৯ সালে জাপানের সাইকো কোম্পানি বানায়, যা সময় মাপায় বিপ্লব ঘটায়।

আজ সময় শুধু ঘড়িতে নয়, মোবাইল, কম্পিউটার, এমনকি ফ্রিজেও আছে!কোয়ার্টজের জায়গা নিয়েছে অ্যাটমিক ঘড়ি (Atomic Clock)—যা বছরে এক সেকেন্ডও ভুল করে না।

হাজার বছরের পরিশ্রমে মানুষ শিখেছে সময়কে মাপা, বাঁধা, আর মানা। যে সময় একদিন সূর্যের ছায়ায় মাপা হতো, আজ তা মিলিসেকেন্ডে মাপা যায় পরমাণুর স্পন্দনে।

আর আমরা?আজও সেই সময়ের দাস—ঘড়ির টিকটিক শব্দে আমাদের দিন শুরু হয়, আর একই শব্দেই রাত নামে।সময়কে বেঁধে রাখার গল্প, আসলে মানুষ নিজেকেই বেঁধে ফেলার গল্প।