এক ক্লিকে বিশ্ব: ইন্টারনেট আবিস্কারের গল্প
এক ক্লিকে বিশ্ব: ইন্টারনেট আবিস্কারের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৯৩০-এর দশকে, কম্পিউটার ছিল বিশাল, জটিল যন্ত্র, যা শুধুমাত্র গাণিতিক হিসাব করতে পারত।
কিন্তু কয়েকজন উদ্ভাবক—যেমন জোসেফ লিকলাইডার—ভাবছিলেন, মানুষ কেন কম্পিউটারকে শুধু হিসাবের জন্য ব্যবহার করবে?
তাদের মনে ছিল বড় স্বপ্ন—একটি বিশ্ব যেখানে তথ্য দূরত্বকে হার মানিয়ে এক ক্লিকেই পৌঁছাবে।
ছোট ছোট ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা দিনরাত চেষ্টা করতেন। তারা ভাবতেন—কোড, সার্ভার, কম্পিউটার, এবং দূরবর্তী সংযোগ—সবকিছুকে একত্র করা সম্ভব কি?
প্রথম প্রথম ধারণাগুলো ছিল কল্পনার মতো। কিন্তু লিকলাইডার লিখেছিলেন: “আমি চাই মানুষ পৃথিবীর যেকোনো তথ্য এক ক্লিকে পেতে পারুক।”
শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকভাবে এই ধারণা অদ্ভুত মনে করত।কিন্তু এই ছোট্ট স্বপ্নই পরবর্তীতে ইন্টারনেটের জন্মের বীজ রোপণ করল।
বিজ্ঞানীরা ছোট ছোট পরীক্ষা করতেন, ব্যর্থ হতেন, আবার চেষ্টা করতেন।প্রত্যেকটি ব্যর্থতা তাদেরকে আরও উদ্ভাবক করে তুলত।এভাবেই কৌতূহল, ধৈর্য এবং স্বপ্নের মিলনে তৈরি হলো ইন্টারনেটের প্রথম বীজ,যা ভবিষ্যতের মানুষের জীবন, কাজ ও শিক্ষাকে সম্পূর্ণ বদলে দেবে।
১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ছোট ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবকরা উত্তেজনার মধ্যে বসে আছেন। DARPA নামের সংস্থা চালু করেছে ARPANET, যা ছিল ইন্টারনেটের পূর্বসূরী।চারটি বিশ্ববিদ্যালয়— UCLA, Stanford, UCSB, এবং University of Utah—একসাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রথম বার্তা পাঠানোর মুহূর্ত।কী-বোর্ডে টাইপ হলো—“LOGIN”।কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে, প্রথমবার শুধু “L—O—” পৌঁছল।
তবুও, উদ্ভাবকরা হতাশ হলেন না।
একজন বলল:“আমরা শুধু দুটি অক্ষর পেলাম, কিন্তু আমরা জানি—দূরত্বের মধ্যে সংযোগ সম্ভব।”
এই ছোট্ট পরীক্ষা দেখাল, কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারে,এবং এটি একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে তথ্য আর স্থান আর বাধা নয়।
পরবর্তী মাসগুলোতে, তারা বারবার পরীক্ষা চালালেন।ধীরে ধীরে ARPANET বৃদ্ধি পেল, আরও কম্পিউটার সংযুক্ত হলো, এবং তথ্য দূর থেকে দূরে পৌঁছানো সম্ভব হলো।
ছোট্ট “L—O—” এর সেই মুহূর্তই পরবর্তীতে হয়ে গেল ডিজিটাল যুগের প্রথম ঝলক,যেখানে মানুষ কেবল স্বপ্ন দেখলেই তথ্য এক ক্লিকে পেতে পারবে।
১৯৭০-এর দশকে, ARPANET বৃদ্ধি পেতে থাকল।
বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার, এবং প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত হল। তবে বড় সমস্যা ছিল—কম্পিউটারগুলো একে অপরকে বোঝে না। তাদের কথা বলার জন্য একটি সাধারণ ভাষা প্রয়োজন।
এখানেই এলেন ভিন্ট সার্ফ এবং রবার্ট কাঞ্চ, যারা তৈরি করলেন TCP/IP প্রোটোকল।এটি ছিল কম্পিউটারের জন্য একটি ভাষা, যা তাদের একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে সাহায্য করল।একদম ছোট ছোট ধাপ, কিন্তু এটাই ছিল দূরবর্তী সংযোগের মূল চাবিকাঠি।
এরপর ১৯৮০–৮০-এর দশকে, ARPANET আরও সম্প্রসারিত হলো।কম্পিউটার সংযোগের সংখ্যা বাড়ল, তথ্য ভাগাভাগির গতি বেড়ে গেল।এখন মানুষ বুঝতে পারল—একটি নতুন যুগ শুরু হচ্ছে।
১৯৯১ সালে, টিম বার্নার্স-লি বিশ্বব্যাপী ওয়েব (World Wide Web) চালু করলেন। এখন ঘরে বসে মানুষ এক ক্লিকে তথ্য পেতে পারল। ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে শুরু হওয়া গবেষণা এখন হয়ে গেল বিশ্বব্যাপী তথ্যের সেতু।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল, যে মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারত না— এক ক্লিকে দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বন্ধুর সঙ্গে সংযোগ সম্ভব।ছোট্ট কৌতূহল, সাহস এবং পরীক্ষা—সবই একত্রে তৈরি করল ডিজিটাল যুগের জাদু।
১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাপী ওয়েব চালু হওয়ার পর, ইন্টারনেট শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের জীবনকে আলোকিত করার শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হল।
প্রথমবারের মতো মানুষ ঘরে বসেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের তথ্য এক ক্লিকে পেতে পারল।
স্কুলের ছাত্ররা প্রাচীন বই না খুঁজে অনলাইন খুঁজে শিখতে পারল।ডাক্তাররা দূরবর্তী রোগীর চিকিৎসা করতে পারল,ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর বাজারে পণ্য পাঠাতে পারল।আর বন্ধুরা দূরের শহরে বসে চোখের সামনে হাসি বিনিময় করতে পারল।
ইন্টারনেট শুধু তথ্যের সেতু নয়; এটি মানুষের সম্পর্ক, শিক্ষা, উদ্ভাবন এবং স্বপ্নের জাল হয়ে উঠল।ফ্র্যাঙ্কলিন, এডিসন বা লিকলাইডারের মতো কৌতূহলী বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীকে আলোকিত করতেন।তাদেরই পথ অনুসরণ করে ইন্টারনেট মানুষকে সংযুক্ত করল এবং নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলল।
এক ক্লিক—এক মুহূর্ত—এখন মানুষ সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত।ছোট্ট কৌতূহল, উদ্ভাবনার সাহস এবং ধৈর্য—এসব মিলেই ডিজিটাল যুগের আলো জন্মালো।
আজও প্রতিটি নতুন উদ্ভাবক, প্রোগ্রামার এবং শিক্ষার্থী এই আলোকে আরও দূরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে।ইন্টারনেট হয়ে উঠল মানবতার, জ্ঞানের এবং স্বপ্নের সেতু, যা প্রতিটি ঘরে আলো ছড়ায়।