সংখ্যা যখন কথা বলতে শিখল: কম্পিউটার আবিষ্কারের গল্প
সংখ্যা যখন কথা বলতে শিখল: কম্পিউটার আবিষ্কারের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
হাজার হাজার বছর আগে, যখন মানুষ কলমে লিখত না, তখনও তাদের দরকার ছিল গণনার। মাঠে যত গরু, খেতে যত ধান, কিংবা ব্যবসায় যত পণ্য—সবকিছুর হিসাব রাখতে হতো।তখনই জন্ম নেয় এক আশ্চর্য বস্তু—অ্যাবাকাস।কাঠের ফ্রেমে দানা গোনা হতো এক হাতে, আর মুখে মুখে হিসাব চলত অন্য হাতে।
মানুষ বুঝল—সংখ্যা শুধু মুখে উচ্চারিত হয় না, এগুলোকে ছুঁয়ে, সাজিয়ে, বোঝাও যায়।
সেই অ্যাবাকাসই ছিল ভবিষ্যতের প্রথম সিঁড়ি— যেখানে সংখ্যা প্রথমবার “চলাফেরা” করতে শেখে।
সময় গড়াল। ১৭শ শতকের ইউরোপে বিজ্ঞানীরা ভাবতে লাগলেন— “মানুষের মতো যদি কোনো যন্ত্র হিসাব করতে পারত?”
১৬২৩ সালে উইলহেম শিকার্ড নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী বানালেন এক অদ্ভুত মেশিন—গণনাযন্ত্র।
তারপর এলো ব্লেইজ প্যাসকেল (ফ্রান্স) ও গটফ্রিড লাইবনিজ (জার্মানি)। তারা এমন যন্ত্র বানালেন, যা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে পারত! কিন্তু তখনও যন্ত্রের মন ছিল না—ওগুলো কেবল মানুষের নির্দেশেই কাজ করত।
২৬ ডিসেম্বর, ১৭৯১। লন্ডনের দক্ষিণে এক ধনী ব্যাংকারের ঘরে জন্ম নিল এক বালক—চার্লস ব্যাবেজ।শৈশব থেকেই সে ছিল কৌতূহলী, একরোখা আর প্রশ্নবাজ।
একদিন ক্লাসে শিক্ষক বোর্ডে গাণিতিক টেবিল লিখছিলেন। ব্যাবেজ চুপচাপ দেখে বলল, “স্যার, যদি মানুষ হিসাব লিখতে গিয়ে ভুল করে?”শিক্ষক হাসলেন, “তাহলে ভুল তো হবেই, চার্লস। মানুষ তো নিখুঁত নয়।”
কিন্তু ব্যাবেজের মনে কাঁটা বিঁধে গেল—
“যদি এমন কিছু বানানো যেত, যা ভুল করবে না!”এই এক চিন্তাই তার জীবনের বীজ হয়ে গেল।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ব্যাবেজ একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন—বিজ্ঞান বইয়ের গাণিতিক টেবিলগুলোতে অসংখ্য ভুল!
তিনি বললেন বন্ধুকে,“মানুষ যখন এই টেবিলগুলো হাতে বানায়, তখন ভুল হতেই পারে।আমি এমন এক যন্ত্র বানাব, যা নিজেই হিসাব করবে।”
সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল তাঁর প্রথম স্বপ্ন— Difference Engine।এটি এমন এক মেশিন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণিতের টেবিল তৈরি করতে পারবে।
১৮২২ সালে তিনি তার প্রথম মডেল প্রদর্শন করলেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। সরকার মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অর্থ দিল পুরো যন্ত্র তৈরি করতে। কিন্তু সেই সময়ের প্রযুক্তি তখনো এত উন্নত ছিল না। মেশিন বানাতে গিয়ে দেখা দিল নানা জটিলতা, আর সরকারের ধৈর্য শেষ হয়ে গেল।তবুও ব্যাবেজ থামলেন না।
১৮৩৩ সালে ব্যাবেজের মাথায় এলো এক নতুন ভাবনা— “যদি মেশিন শুধু হিসাব না করে, নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে?”
তিনি কাগজে আঁকলেন এক আশ্চর্য নকশা— Analytical Engine। এই মেশিনে ছিল চারটি মূল অংশ, যেগুলো আজকের কম্পিউটারের মূল ভিত্তি:
-
মেমরি (Store) – যেখানে তথ্য রাখা হবে।
-
প্রসেসর (Mill) – যেখানে হিসাব হবে।
-
ইনপুট (Reader) – যেখানে নির্দেশনা ঢুকবে।
-
আউটপুট (Printer) – যেখানে ফলাফল বের হবে।
অবিশ্বাস্যভাবে, এটি ছিল এক যান্ত্রিক কম্পিউটার—যা প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করত!
ব্যাবেজের স্বপ্ন বোঝার মতো লোক ছিল খুব কম।
কিন্তু এক তরুণী—এডা লাভলেস, কবি লর্ড বাইরনের মেয়ে— তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখলেন।
তিনি ব্যাবেজের মেশিনের কাজ বিশ্লেষণ করে লিখলেন প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
একদিন এডা বলেছিলেন,“আপনার যন্ত্র শুধু সংখ্যা গুনবে না, একদিন এটি গান বাজাবে, ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে।”
ব্যাবেজ হাসলেন, “তুমি কি ভাবো মেশিন ভাবতে পারবে?”এডা বলেছিলেন,“হ্যাঁ, যদি মানুষ তাকে চিন্তার ভাষা শেখায়।”তাদের এই কথোপকথনই ছিল আধুনিক প্রোগ্রামিংয়ের সূচনা।
ব্যাবেজের জীবদ্দশায় তাঁর মেশিন সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। তাকে “পাগল স্বপ্নবাজ” বলা হয়েছিল।
কিন্তু মৃত্যুর পর সময় তাঁকে ন্যায্য মর্যাদা দিয়েছে।
আজ বিশ্বের প্রতিটি কম্পিউটার তাঁর চিন্তার সন্তান।
তার আঁকা নকশার ভিত্তিতেই আধুনিক CPU, মেমরি, ইনপুট-আউটপুট সিস্টেম তৈরি হয়েছে।
চার্লস ব্যাবেজ একবার বলেছিলেন,“আমি হয়তো ব্যর্থ, কিন্তু আমার ব্যর্থতাই ভবিষ্যতের বীজ।”
আজ যখন তুমি কম্পিউটারের কীবোর্ডে টাইপ করো, স্ক্রিনে সংখ্যা কথা বলে, ছবি আঁকে, গান বাজায়—তখন মনে রেখো, সেই ভাষা শিখিয়েছিলেন এক মানুষ, যিনি একদিন বিশ্বাস করেছিলেন— “যন্ত্রও ভাবতে পারে।”
১৮১৫ সালের এক শীতের সকালে লন্ডনের আকাশে জন্ম নিল এক কন্যাশিশু—অ্যাডা অগাস্টা বাইরন।জন্ম নিল কম্পিউটারের প্রথম প্রোগ্রামার।
তার বাবা ছিলেন বিশ্বখ্যাত রোমান্টিক কবি লর্ড বাইরন, আর মা— লেডি অ্যানাবেলা, গণিতপ্রেমী এক নারী।
বাবা-মায়ের সম্পর্ক ছিল ঝড়ো, জন্মের এক মাসের মধ্যেই তারা আলাদা হয়ে যান। অ্যানাবেলা ঠিক করলেন,“আমার মেয়েকে কবিতার নয়, যুক্তির পথে বড় করব।”
তাই ছোট্ট এডাকে গান, নাচ নয়—গণিত আর বিজ্ঞান শেখানো হলো।কিন্তু রক্তে মিশে থাকা কবিতার ছোঁয়া তাকে কখনো ছাড়েনি।সে সংখ্যার ভেতরেও খুঁজে পেত ছন্দ,ফর্মুলার ভেতরে দেখত এক শিল্পের সৌন্দর্য।
১৮৩৩ সালে এক পার্টিতে এডার পরিচয় হয় এক অদ্ভুত মানুষ—চার্লস ব্যাবেজ। তিনি তখন তাঁর Analytical Engine নামের “চিন্তা করা যন্ত্র” নিয়ে উত্তেজিত।
ব্যাবেজ হাসিমুখে বললেন, “লেডি এডা, আমি এমন এক যন্ত্র বানাচ্ছি, যা মানুষ ছাড়া নিজেই হিসাব করবে।” এডার চোখ বড় হয়ে গেল। “আপনি কি বলছেন, একটি যন্ত্র ভাববে?”
ব্যাবেজ মাথা নেড়ে বললেন,“হ্যাঁ, সংখ্যার মাধ্যমে। কিন্তু পৃথিবী এখনো তা বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নয়।” এডা মুগ্ধ হয়ে গেলেন।তিনি বললেন,“সংখ্যাও তো ভাষা, স্যার। আপনি শুধু তাদের কথা বলতে শেখাচ্ছেন।”
সেই মুহূর্তেই জন্ম নিল এক অনন্য সম্পর্ক—
ব্যাবেজ, যিনি ছিলেন কম্পিউটারের জনক,
আর এডা, যিনি হবেন সংখ্যার কবি।
ব্যাবেজের যন্ত্রের কাজ বুঝে এডা তৈরি করলেন নির্দেশনার একটি দীর্ঘ নোট। তিনি ব্যাবেজের নকশাকে রূপ দিলেন ভাষায়— যেখানে ধাপে ধাপে বোঝানো ছিল, যন্ত্র কীভাবে গণনা করবে, কিভাবে ফলাফল দেবে।
এই লেখাগুলিই ইতিহাসে প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু শুধু প্রোগ্রাম নয়—
এডা এক দৃষ্টিশক্তি দিয়েছিলেন, যা তার সময়ের বহু দূরের। তিনি বলেছিলেন,“সংখ্যা কেবল গাণিতিক নয়। একদিন এগুলো দিয়ে মানুষ সঙ্গীত রচনা করবে, ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে।”
তখন অনেকে তাঁকে উপহাস করেছিল। কিন্তু আজ সেই ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি— কম্পিউটার আজ সত্যিই গান বাজায়, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে।
এডা লাভলেস মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, ১৮৫২ সালে মারা যান। কিন্তু তার রেখে যাওয়া চিন্তা আজও জীবন্ত। তাঁর নামেই পরে এক প্রোগ্রামিং ভাষার নাম রাখা হয়— ADA।
চার্লস ব্যাবেজ বলেছিলেন, “এডা বুঝতে পারত আমার মেশিনকে আমার চেয়েও ভালো।”
আজ যখন একজন প্রোগ্রামার কোড লিখে মেশিনকে নির্দেশ দেয়, সেই প্রতিটি লাইনে লুকিয়ে আছে এডার অনুপ্রেরণা— এক নারী, যিনি সংখ্যার ভেতর দেখেছিলেন কবিতার ছন্দ।
১৯৩৬ সাল। ইউরোপ জুড়ে ঘনিয়ে আসছে যুদ্ধের মেঘ। মানুষ তখন ভয় আর বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে।
ঠিক সেই সময়, ইংল্যান্ডের এক তরুণ গণিতবিদ,
অ্যালান টিউরিং, একা বসে লিখছিলেন এক প্রবন্ধ—যেখানে তিনি বলেছিলেন,“একটি যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব, যা মানুষের মতো যুক্তি করতে পারবে,
নির্দেশনা বুঝবে, আর নিজে নিজেই হিসাব করবে।”
তার সহপাঠীরা হাসল— “একটা যন্ত্র কি কখনো চিন্তা করতে পারে, টিউরিং?”কিন্তু টিউরিং চুপ করে রইলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—
তিনি দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। জার্মান সেনারা ব্যবহার করত এক ভয়ানক যন্ত্র—Enigma Machine, যা তাদের গোপন বার্তা এনকোড করে পাঠাত। প্রতিদিন সেই কোড বদলে যেত,
ফলে বার্তাগুলো ভাঙা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত।
ব্রিটিশ সরকার বিপাকে পড়ে টিউরিংকে ডাকে।
তাকে পাঠানো হয় গোপন স্থানে—Bletchley Park,
যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ বসে জার্মান কোড ভাঙার চেষ্টা করত।
একদিন টিউরিং মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন সহকর্মীদের,“আমরা মানুষ। প্রতিদিন হাজার কোড বিশ্লেষণ আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু যদি আমরা এমন এক যন্ত্র বানাতে পারি,যা মানুষের মতো যুক্তি করে, দ্রুত গণনা করতে পারে— তাহলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাবে।”
টিউরিং ও তার দল তৈরি করলেন এক বিস্ময়কর যন্ত্র—The Bombe।এটি বিশাল, শব্দে গর্জন করা মেশিন;ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে গিয়ার, ক্লিক ক্লিক শব্দে কাজ করছে অসংখ্য সুইচ।
রাতভর সেই মেশিন কাজ করত, হাজার হাজার সম্ভাব্য কোড পরীক্ষা করত, আর অবশেষে সকালে কোনো এক মুহূর্তে একটি লাল আলো জ্বলত—
যার মানে ছিল, “কোড ভেঙে গেছে!”
সেদিন টিউরিংয়ের চোখে জল এসে গেল।
তিনি জানতেন— এই মেশিন শুধু যুদ্ধের তথ্য নয়, ইতিহাসই বদলে দেবে।
এই মেশিনের সাহায্যে মিত্রবাহিনী জার্মানদের অনেক গোপন বার্তা আগে থেকেই জেনে যেত। ফলাফল?যুদ্ধের গতিপথ বদলে গেল। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা পেল। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা বলেছিলেন— “টিউরিংয়ের মেশিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অন্তত দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিল।”
কিন্তু টিউরিং কোনো গৌরব চাননি। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি শান্তভাবে লিখেছিলেন,“আমি শুধু একটিই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম— যন্ত্রও ভাবতে পারে।”
টিউরিংয়ের সেই মেশিনই ছিল আধুনিক কম্পিউটার ধারণার জন্মস্থান। তার ‘চিন্তা করা যন্ত্র’-এর তত্ত্ব থেকে জন্ম নেয় প্রোগ্রাম, কোড, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)–এর ধারণা।
১৯৪৫ সালের শেষে যুদ্ধ শেষ হলো, কিন্তু টিউরিংয়ের ল্যাবরেটরিতে তখনও ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে এক প্রশ্ন— “মানুষ কি একদিন যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলবে?” আজ যখন আমরা কম্পিউটারের সামনে বসে কথা বলি, লিখি, বা ভাবি— আমরা আসলে টিউরিংয়ের স্বপ্নেরই বাস্তব রূপ ছুঁয়ে আছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, পৃথিবী তখন ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নতুন এক যুদ্ধে নেমেছেন— গণনার গতি বাড়ানোর যুদ্ধ।
১৯৪৬ সালে জন্ম নেওয়া ENIAC নামের বিশাল মেশিন তখন মানুষের কল্পনার চূড়ান্ত সীমা। ৩০ টন ওজন, ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব, একটি ছোট ঘর নয়, পুরো হলঘর ভর্তি করে রেখেছে এই গণনার দানব!
তবু বিজ্ঞানীদের চোখে ঝিলিক— “এটিকে আরও ছোট, আরও দ্রুত করা সম্ভব।”
এক শীতের দিনে, ১৯৪৭ সালে, বেল ল্যাবরেটরি-র তিন বিজ্ঞানী— জন বারডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন, এবং উইলিয়াম শকলে— ছোট্ট এক ধাতব টুকরো নিয়ে কাজ করছিলেন। তাদের চোখে উত্তেজনা, হাতে কাঁপুনি। হঠাৎই তারা বুঝলেন— এই ছোট জিনিসটি বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।এটাই ছিল ট্রানজিস্টর। আর সেই মুহূর্তে পৃথিবী বদলে গেল।
ব্যাবেজের চাকা, টিউরিংয়ের মেশিন—সব মিলিয়ে এখন এক নতুন যুগের দরজা খুলে গেল। বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউবের জায়গা নিল এই ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর।মেশিনের গতি বেড়ে গেল, আকার ছোট হলো, খরচ কমল। যন্ত্র আর শুধু যুদ্ধের নয়— এখন সে মানুষের জীবনকে বদলাতে প্রস্তুত।
১৯৫৮ সালে টেক্সাসের এক ইঞ্জিনিয়ার, জ্যাক কিলবি, ভাবলেন— “যদি ট্রানজিস্টর, রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর—সব এক জায়গায় রাখা যেত!” তিনি তৈরি করলেন ইতিহাসের প্রথম ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট,
যা পরে পরিচিত হলো মাইক্রোচিপ নামে।
এই ছোট্ট চিপের ভেতর লুকিয়ে ছিল হাজার হাজার যন্ত্রাংশের কাজ। যে মেশিন একসময় ঘর ভরিয়ে রাখত, এখন তা মুঠোর মধ্যে এসে গেল। মানুষ বিস্মিত হলো— “এত ছোট জিনিসে এত বিশাল শক্তি?”
সময় তখন ১৯৭০ দশক।দুই তরুণ উদ্যোক্তা, স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াক, একটি গ্যারেজে বসে গড়ে তুলছিলেন অ্যাপল কম্পিউটার। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন— “একদিন প্রতিটি ঘরে একটি কম্পিউটার থাকবে।”
অন্যদিকে, বিল গেটস ও পল অ্যালেন লিখছিলেন সফটওয়্যার— যা মেশিনকে মানুষে রূপ দেবে,
তাকে বোঝার ভাষা শেখাবে। কম্পিউটার তখন শুধু বিজ্ঞানীর নয়, ছাত্র, শিক্ষক, অফিসকর্মী, গৃহিণী— সবার বন্ধু।
কম্পিউটারের ইতিহাস আসলে মানুষের স্বপ্ন দেখার গল্প। চার্লস ব্যাবেজ যখন বলেছিলেন, “মানুষের চিন্তা যন্ত্রের ভেতর বন্দি করা সম্ভব,” তখন অনেকে হাসতো। কিন্তু সেই হাসির ভেতর দিয়েই শুরু হয়েছিল এক বিপ্লবের পদচিহ্ন।
এডা লাভলেস দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ— যন্ত্র একদিন শুধু সংখ্যা নয়, সুর, ছবি, কবিতাও সৃষ্টি করবে।
তার সেই কল্পনা আজ বাস্তব। আমরা এখন এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে, যেখানে কম্পিউটার আমাদের শিক্ষক, সহচর, এমনকি বন্ধু হয়ে গেছে।
একসময় যে যন্ত্র চালাতে লাগত পুরো ভবন,
আজ তা লুকিয়ে আছে আমাদের পকেটে।
তবু তার ভেতর বাজে সেই পুরোনো সুর—
মানুষের কৌতূহল, অধ্যবসায় আর স্বপ্নের সুর।
কম্পিউটার কেবল একটি মেশিন নয়;
এটি মানুষের অসীম কল্পনাশক্তির প্রতীক।
যে মানুষকে শিখিয়েছে— অসম্ভব বলে কিছু নেই।
তুমি যদি একদিন থেমে যাও, তবুও মনে রেখো—
ব্যাবেজও একসময় ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে থেকেছে আজকের প্রতিটি ক্লিকের ভেতর।
এই গল্প তাই কেবল কম্পিউটারের জন্মকথা নয়,
এটা মানুষের সীমা ছাড়ানোর কাহিনি— যেখানে সংখ্যা কথা বলে, আর স্বপ্ন হয়ে ওঠে বাস্তব।