ছোট দোকান থেকে বিশ্ববাজার: ইনগভার কামপ্রাদের সাফল্যের গল্প
ছোট দোকান থেকে বিশ্ববাজার: ইনগভার কামপ্রাদের সাফল্যের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
সুইডেনের দক্ষিণে ঘন সবুজ বন আর ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা এক শান্ত গ্রাম — এলমহার্ট। শীতের সকালে বরফে ঢাকা মাঠে শিশির পড়ার শব্দে ভরে যায় চারদিক। গ্রামের মানুষজন মাটির ঘরে থাকে, কেউ কৃষিকাজে ব্যস্ত, কেউ আবার পশুপালনে।
এই সাধারণ, শান্ত গ্রামেরই এক ছোট ঘরে, ১৯২৬ সালের ৩০ মার্চ, জন্ম নেয় এক শিশু — যে একদিন বদলে দেবে পৃথিবীর আসবাবের ইতিহাস।তার নাম — ইনগভার কামপ্রাদ।
ছোট্ট ইনগভার জন্ম নেন এক কৃষক পরিবারে।
বাবা ছিলেন পরিশ্রমী ও নীরব স্বভাবের মানুষ, সারাদিন জমিতে কাজ করতেন। মা ছিলেন মায়াবতী ও বাস্তববাদী — তিনিই ছেলের জীবনের প্রথম শিক্ষক।তারা ধনী ছিলেন না, কিন্তু ঘরে ছিল ভালোবাসা, নিয়ম, আর পরিশ্রমের শিক্ষা।
শীতের রাতে মা তাকে কোলে নিয়ে গল্প বলতেন —
কীভাবে মানুষ পরিশ্রম দিয়ে ভাগ্য গড়ে।ইনগভার গভীর মনোযোগে শুনত, আর চোখের কোণে স্বপ্নের আলো ফুটত। সে ভাবত — “আমিও একদিন কিছু আলাদা করব, যা মানুষের কাজে লাগবে।”
গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। বাতাসে যখন বরফের গন্ধ মেশে, তখন ইনগভার ছোট্ট একটি প্রদীপ জ্বেলে পড়ত, কখনো অঙ্কের খাতা খুলে, কখনো আবার গ্রামের লোকদের আচরণ লক্ষ্য করত। সে খুব কৌতূহলী ছিল — সব কিছু জানতে চাইত, সব কিছু বুঝতে চাইত।
একদিন, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে, ইনগভার শহরে থাকা চাচার কাছ থেকে একটা ছোট বাক্স ভর্তি ম্যাচবক্স নিয়ে আসে।তার চোখে তখন জ্বলজ্বল করছে উত্তেজনা। সে বুঝেছিল — গ্রামের মানুষকে এই ছোট জিনিসটিও কিনতে যেতে হয় অনেক দূর!
তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় — সে নিজেই বিক্রি করবে।
সাইকেল ছিল না, তাই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলত, “এই ম্যাচবক্সটা নিন, দামের চেয়ে একটু কমে দিচ্ছি।”
মানুষ অবাক হয়ে তাকাত, একটা ছোট বালক, এত বিনয়ের সঙ্গে ব্যবসা করছে! কেউ কেউ হাসত, কেউবা প্রশংসা করত, কিন্তু ইনগভার নির্ভয়ে চলত নিজের পথে।
প্রথম দিনে সে সামান্য কিছু টাকা রোজগার করল।
রাতে ঘরে ফিরে টেবিলে কয়েনগুলো রাখল, চোখে ঝিলমিল আনন্দ।মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— “তুমি এসব কীভাবে করলে?” ইনগভার হেসে বলল, — “আমি শুধু ভেবেছি, মানুষ যদি দরকারি জিনিস সহজে পায়, তারা খুশি হবে।”
সেই দিনই শুরু হলো তার ব্যবসায়িক জীবনের প্রথম পাঠ — “মানুষের প্রয়োজন বোঝাই আসল ব্যবসা।”এরপর সে আরও নতুন জিনিস বিক্রি করতে শুরু করল — কলম, পোস্টকার্ড, মাছ ধরার হুক, এমনকি সজ্জার ছোট পাথরও! বাবা মাঝে মাঝে বলতেন, “এই বয়সে অন্যরা খেলছে, আর আমার ছেলে ব্যবসা করছে!” কিন্তু মনে মনে তিনি গর্ববোধ করতেন।
ইনগভার নিজের পকেটে ছোট নোটবুক রাখত।
কে কী কিনেছে, কাকে কী দিতে হবে — সব লিখে রাখত। সে শিখে গিয়েছিল সময়ের মূল্য, হিসাবের গুরুত্ব আর গ্রাহকের প্রতি শ্রদ্ধা।
সময়টা ১৯৩৫ সাল। সুইডেনের এলমহার্ট গ্রামের ঠান্ডা হাওয়ায় এখনো তুষার পড়ে, কিন্তু ছোট্ট ইনগভার কামপ্রাদের চোখে জ্বলছে উষ্ণ এক আলো— এক অদম্য স্বপ্নের আলো।
তখন তার বয়স প্রায় দশের কোঠায়। বয়সে ছোট, কিন্তু চিন্তায় অনেক বড়। সে বুঝে গেছে— শুধু স্কুলে ভালো করা নয়, জীবনে কিছু “করতে” হয়,
কিছু এমন কাজ, যা মানুষের উপকারে আসে।
ইনগভার দেখত, গ্রামের মানুষদের ছোট ছোট দরকার মেটাতে প্রায়ই অনেক দূরের শহরে যেতে হয়। একটি কলম, একটি টেবিল ঘড়ি, এমনকি একটি পেন্সিল শার্পনার কিনতেও কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়।
সে ভাবত—“যদি আমি এই জিনিসগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি? তাহলে তারা সময় বাঁচাবে, আর আমি সামান্য লাভ পাব।”এই চিন্তাই তার ব্যবসার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করে।
একদিন সকালে, সে বাবার পুরনো সাইকেলটিতে একটু তেল মাখল, হাত দিয়ে ধুলা ঝাড়ল, আর নিজেই বানিয়ে ফেলল তার “বাণিজ্যযান।”তখন তার ঝুড়িতে ভর্তি ছিল নানান জিনিস— কলম, ঘড়ি, ম্যাচবক্স, মাছ ধরার কাঁটা, ছোট আয়না, পোস্টকার্ড।
সে সাইকেলে চড়ে গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরত। বনের পথ পেরিয়ে, নদীর ধারে, কখনো বরফে পা পিছলে যেত, তবু থামত না। যে বাড়ির সামনে ধোঁয়া উঠত, সে জানত— সেখানে মানুষ আছে, হয়তো কিছু প্রয়োজনও আছে।
বাড়ির দরজায় গিয়ে সে মৃদু স্বরে বলত, “চাচা, নতুন কলম এসেছে, শহর থেকে। খুব সুন্দর লিখে। চাইবেন?”
লোকজন অবাক হতো,এই ছোট ছেলে শহর থেকে মাল এনে বিক্রি করছে! কিন্তু তার হাসি, ভদ্রতা আর নির্ভরযোগ্যতার কারণে ধীরে ধীরে সবাই তার নিয়মিত ক্রেতা হয়ে উঠল।
সে প্রতিদিন হিসাব রাখত— কোথায় কত বিক্রি হলো, কোন জিনিসের চাহিদা বেশি। অঙ্কে ভালো ছিল বলেই, হিসাবের খাতা সবসময় নিখুঁত রাখত। ইনগভার কখনো প্রতারণা করত না।যদি কোনো জিনিসে দাগ থাকত, সে গ্রাহককে আগে বলত।
সে জানত— বিশ্বাসই ব্যবসার মূলধন।
একদিন এক বৃদ্ধ কৃষক তার কাছ থেকে ঘড়ি কিনেছিলেন। পরের সপ্তাহে ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যায়।
বৃদ্ধ রাগে ফিরে আসেন ইনগভারের কাছে।
ইনগভার কোনো অজুহাত না দিয়ে নিজের পকেট থেকে টাকা ফেরত দেন। তারপর বলেন, “আমি চাই না আপনি আমার জিনিসে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমি চাই, আপনি আমার থেকে কিনে খুশি হন।”বৃদ্ধ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “তুমি একদিন বড় ব্যবসায়ী হবে, ছেলে।”
সেই দিন ইনগভার বুঝে ফেলেন—লাভ নয়, মানুষের আস্থা অর্জনই সবচেয়ে বড় সফলতা।
সময় যায়, বয়স বাড়ে, স্বপ্নও বড় হয়।১৯৪০-এর দশকের শুরুতে ইনগভার বুঝলেন— শুধু ছোট জিনিস বিক্রি করে সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না। মানুষের জীবনে আরেকটি বড় প্রয়োজন আছে— ঘরের আসবাব।
তিনি লক্ষ্য করলেন, গ্রামের মানুষ নিজের ঘর সুন্দর রাখতে চায়,কিন্তু দাম বেশি বলে নতুন আসবাব কিনতে পারে না।এই চিন্তা তাকে ভাবিয়ে তোলে।
সে বলল নিজেকে,“যদি এমনভাবে আসবাব বানানো যায়, যা সুন্দর, টেকসই, কিন্তু দামেও সস্তা—
তাহলে সবাই তা কিনতে পারবে।”
এই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে তার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে।তিনি কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন, ডিজাইন শেখেন, মানুষের রুচি বোঝেন।
বছরটা ছিল ১৯৪৩।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন,
চারদিকে অনিশ্চয়তা, ভয় আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন।তবুও সুইডেনের এক ছোট গ্রামে,
এক তরুণের মনে ফুটে উঠেছিল আশার আলোকরেখা।তার নাম ইনগভার কামপ্রাদ, বয়স মাত্র ১৭ বছর।
সেই বছরই, বাবার দেওয়া পরীক্ষার পুরস্কার—
এক মুঠো টাকার মতো সামান্য উপহার— তার জীবনের গতিপথ চিরতরে বদলে দেয়।অন্য ছেলেরা হয়তো সেই টাকা দিয়ে নতুন জামা বা খেলনা কিনত,কিন্তু ইনগভার করলেন অন্য কিছু—
তিনি সেই টাকা দিয়ে নিজের ব্যবসাকে “আনুষ্ঠানিক রূপ” দিলেন।সেই সামান্য অর্থ দিয়েই তিনি গড়ে তোলেন তার প্রথম কোম্পানি— IKEA।
ইনগভার সেই টাকাগুলো হাতে নিয়ে গভীরভাবে ভাবলেন।তিনি জানতেন, এটি হয়তো কোনো কিশোরের জন্য ছোট একটি সুযোগ,
কিন্তু একজন স্বপ্নবাজের কাছে এটি ছিল “একটি দরজা”—যেখান থেকে শুরু হতে পারে এক নতুন পৃথিবী।
সেই টাকাতেই তিনি তৈরি করলেন নিজের প্রথম কোম্পানি। কোনো অফিস নেই, নেই কর্মচারী—
তার অফিস ছিল নিজের ঘরের ছোট্ট টেবিল,
আর কর্মচারী ছিল সে নিজেই।কিন্তু তার ছিল এক জিনিস, যা বড় বড় কোম্পানির কাছেও তখন বিরল— দৃষ্টি।
তিনি তার নতুন কোম্পানির নাম রাখলেন— IKEA।
এই নামের প্রতিটি অক্ষর ছিল তার জীবনের গল্পের প্রতীক:
-
I – Ingvar (তার নিজের নাম)
-
K – Kamprad (তার পরিবারের নাম)
-
E – Elmtaryd (যে খামারে তিনি বড় হয়েছেন)
-
A – Agunnaryd (যে গ্রামের তিনি সন্তান)
এই নাম যেন বলছিল— “আমি কোথা থেকে এসেছি, তা কখনো ভুলব না।”
প্রথমে IKEA বিক্রি করত ছোটখাটো পণ্য— কলম, ওয়ালেট, ঘড়ি, ফটো ফ্রেম, খেলনা, এমনকি পোস্টকার্ড। ইনগভার এসব জিনিস ডাকযোগে পাঠাতেন গ্রাহকদের কাছে। এটাই ছিল তার প্রথম "মেল-অর্ডার ব্যবসা"।
তিনি প্রতিটি অর্ডারের সঙ্গে একটি ছোট চিঠি পাঠাতেন— নিজ হাতে লেখা ধন্যবাদ বার্তা।
এতে লেখা থাকত: “আপনার সন্তুষ্টিই আমার সাফল্য।”মানুষ এই ব্যক্তিগত যোগাযোগে মুগ্ধ হত।
তারা বুঝত— এই ছেলেটি শুধু বিক্রি করতে চায় না,
চায় সম্পর্ক গড়তে।
১৯৪৭ সালে, এক শীতের সকালে ইনগভার শহরের এক দোকানে গেলেন। তিনি দেখলেন, দোকানগুলোতে আসবাবপত্র খুব দামি, মাঝারি আয়ের মানুষ সেগুলো কিনতে পারে না। তবুও সবাই চায় নিজের ঘর সুন্দর সাজাতে।
ফিরে এসে তিনি ভাবলেন, “যদি আমি এমন আসবাব বিক্রি করতে পারি যা টেকসই, সুন্দর, কিন্তু সাশ্রয়ী—তাহলে সাধারণ মানুষও পাবে তাদের পছন্দের ঘর।” এই ভাবনা থেকেই শুরু হলো নতুন যুগ—IKEA Furniture-এর জন্ম।
ইনগভার স্থানীয় কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তারা একসাথে কাজ শুরু করলেন
কম দামে ভালো মানের চেয়ার, টেবিল, ও আলমারি বানাতে। কিন্তু সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়—
এই আসবাবপত্র পাঠানো যেত না সহজে। বড় সাইজের জন্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেশি পড়ত।
একদিন, এক মজার ঘটনা ঘটে। একজন কর্মচারী পরিবহনের আগে একটি টেবিলের পা খুলে রাখে,
যাতে জায়গা বাঁচে। ইনগভার সেটি দেখে অবাক হয়ে যান। তার মাথায় যেন বজ্রপাতের মতো আইডিয়া আসে— “যদি সব আসবাবই এমনভাবে বানানো যায়, যা খুলে প্যাক করা যায়, আর ক্রেতা নিজে জোড়া দিতে পারে?” এটাই ছিল Flat-Pack Furniture ধারণার জন্ম! এই চিন্তা বদলে দেয় আসবাব শিল্পের ইতিহাস। IKEA হয়ে ওঠে এক “বিপ্লবের” নাম।
১৯৫৮ সালে, সুইডেনের ছোট শহর Almhult-এ
ইনগভার খুললেন প্রথম IKEA শোরুম।
মানুষ ভিড় করে দেখতে এল সেই নতুন ধরণের আসবাব— যা সহজে বহনযোগ্য, নিজের হাতে জোড়া দেওয়া যায়, আর তবু দেখতে আধুনিক ও আকর্ষণীয়।দর্শকরা বিস্ময়ে বলত, “এমন জিনিস আগে কখনো দেখিনি!”সেই দিন থেকে IKEA নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সুইডেনের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপজুড়ে।
যে ছেলে একসময় সাইকেলে চড়ে ম্যাচবক্স বিক্রি করত, সে আজ নিজ হাতে গড়ে তুলেছে এক নতুন ব্যবসার ধারা।
একদিন মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, — “তুমি এত কষ্ট করছো, ক্লান্ত হও না?” ইনগভার মৃদু হেসে বলল,— “মা, আমি ক্লান্ত হই না। মানুষ যখন আমার বানানো আসবাবের পাশে বসে হাসে, তখন মনে হয়, আমি কিছু করে দেখাতে পেরেছি।”
সুইডেনের ছোট শহর Almhult, ১৯৫০-এর সকাল।
শীতের হাওয়া বইছে, কিন্তু ইনগভার কামপ্রাদের চোখে জ্বলছে অদম্য উদ্যম। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার ছোট্ট কারখানার সামনে, যেখানে শ্রমিকরা কাঠ কাটছে, পেইন্টিং করছে,আর আকাশে সূর্যের সোনালি আলো পড়ছে সব আসবাবের ওপরে।
ইনগভার জানতেন—মানুষ চায় সুন্দর আসবাব,
কিন্তু দাম বেশি।এই সমস্যার সমাধান ছাড়া তার স্বপ্ন কখনো পূর্ণ হবে না।
একদিন তিনি বসে ভাবলেন— “মানুষ যদি নিজের ঘরে সহজে বসাতে পারে এমন আসবাব পায়,
তাহলে দাম কম হবে, পরিবহন সহজ হবে, আর সবাই খুশি হবে।”
সে স্থানীয় কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। কাঠের মান, প্যাকেজিং, শক্তি—সব কিছু পরীক্ষা করলেন বারবার।প্রথমবারের মতো তিনি বুঝলেন—সরলতা এবং কার্যকারিতা মিলেই সত্যিকারের বিজয়।
এক শীতের সকালে, একজন শ্রমিক টেবিলের পা খুলে রাখে পরিবহনের জন্য। ইনগভার সেটি দেখল এবং চমকে উঠে বলল—“এইটিই! মানুষ যদি নিজেই জোড়া দিতে পারে, আমরা পরিবহন ব্যয় কমাতে পারি। আর দামও কম হবে।”এভাবেই জন্ম নিল Flat-Pack Furniture— একটি ধারণা যা কেবল আসবাব বদলালো না, বরং পুরো ব্যবসার মডেলকেও পরিবর্তন করল।
১৯৫৮ সালে, তিনি খোলেন প্রথম IKEA শোরুম।
গ্রাহকরা প্রথমে অবাক— “এই আসবাব কি সত্যিই সাশ্রয়ী এবং সুন্দর?”ইনগভার নিজে সেখানে দাঁড়িয়ে গ্রাহকদের দেখাতেন কীভাবে টেবিল জোড়া দেওয়া যায়, চেয়ার সেট করা যায়।তার সহজ ভাষা, উদার মনোভাব ও আন্তরিকতা মানুষকে বিমোহিত করল।“আমি চাই, কেউ যেন ভাবেও না— আসবাব শুধু মালামাল। আসবাব মানে আনন্দ, আর ঘর মানে জীবন।”
IKEA-এর নতুন ধারার আসবাব ক্রমে সুইডেনের সীমা পেরিয়ে ইউরোপজুড়ে পৌঁছাতে শুরু করল।
ফ্ল্যাট-প্যাক, কম দাম, কার্যকরী ডিজাইন—
এই তিনটির সমন্বয় মানুষকে নতুন অভিজ্ঞতা দিতে লাগল।
ইনগভার জানতেন—এটাই কেবল শুরু।
সে আরও ভাবছিল—কীভাবে এই ধারণা অন্য দেশে পৌঁছানো যায়, কীভাবে সবাইকে একই সুযোগ দেওয়া যায়।
১৯৬০-এর দশক। ইনগভার কামপ্রাদ তখন পঞ্চাশের কোঠায়। সুইডেনের ছোট গ্রাম এলমহার্ট থেকে তার পদচারণা এখন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তার চোখে আগের মতোই উজ্জ্বল স্বপ্নের আলোকরেখা, কিন্তু এবার স্বপ্নটি ছোট নয়—
এটি বিশ্বব্যাপী IKEA সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন।
প্রথম লক্ষ্য ছিল নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং জার্মানি।
ইনগভার জানতেন— “প্রত্যেক মানুষের ঘর সুন্দর হওয়া উচিত, সাশ্রয়ী দামে।” তাই তিনি নতুন শোরুম খুললেন, দেখালেন ফ্ল্যাট-প্যাক আসবাব।
মানুষ অবাক— “এ কি সম্ভব? এই দাম, এই মান?”
ইনগভার দাঁড়িয়ে বলতেন, “এটাই আমাদের লক্ষ্য—সবার জন্য মানসম্মত আসবাব।”যতই মানুষ ক্রয় করত, তার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠত।
তিনি ভাবতেন—“যদি আমি তাদের প্রয়োজন বুঝতে পারি, আমি শুধু ব্যবসা করি না, তাদের জীবন বদলাই।”
ইনগভার শুধু বিক্রি করতেন না, চিন্তা করতেন— কীভাবে সবকিছু আরও সাশ্রয়ী করা যায়, কীভাবে ডিজাইন আরও কার্যকরী হবে, কীভাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে আসবাব তৈরি করা যায়। তাঁর উদ্ভাবনগুলো ছিল ছোট ছোট, কিন্তু বিপ্লবী।
প্যাকিংয়ের পদ্ধতি, সাশ্রয়ী পরিবহন, নিজে জোড়া দেওয়া— সবকিছু মিলিয়ে IKEA হয়ে উঠল নতুন ব্যবসার মডেল।
১৯৭০-এর দশকে ইনগভার সাহস দেখালেন— “আমি ইউরোপে সফল, কেন না আমেরিকাতেও দেখাব?” ইনগভার পৌঁছালেন বোস্টন। প্রথম শোরুম খুলে দেখালেন— মানুষের রেসপন্স ছিল চমকপ্রদ।আমেরিকানরা ভাবতে পারছিল না, একজন সুইডিশ ব্যবসায়ী এমন সাশ্রয়ী, সুন্দর এবং কার্যকরী আসবাব তৈরি করতে পারবে।
ইনগভার হাসিমুখে দেখতেন, শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই নিজের হাতে আসবাব জোড়া দিচ্ছে, সবার মুখে হাসি, চোখে আনন্দ। এই দৃশ্য ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
১৯৮০-এর দশকে IKEA হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসবাব ব্র্যান্ড। ইনগভার তখনও সক্রিয়।
নিজে শোরুমে ঘুরে বেড়াতেন, কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতেন, নতুন ধারণা নিয়ে আলোচনা করতেন। ফলে IKEA কেবল ব্যবসা নয়, একটি মানবকেন্দ্রিক দর্শন হয়ে উঠল—“সবার ঘরে সুন্দর ও কার্যকর আসবাব।”২০০০ সালের মধ্যে IKEA-এর স্টোর ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া—সবখানে।
ইনগভার কামপ্রাদ তখনও সক্রিয়।তিনি অফিসে ঘুরে বেড়াতেন, কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতেন, নতুন ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করতেন।
২০০৪ সালে ফোবর্স ম্যাগাজিন তাকে ঘোষণা করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে।
২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি, ৯১ বছর বয়সে ইনগভার কামপ্রাদ মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত— IKEA, যার ৬০টিরও বেশি দেশে ৪০০+ শাখা, লক্ষাধিক কর্মী, আর কোটি গ্রাহক।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি—“The most dangerous poison is the feeling of achievement. The antidote is to think what can be done better tomorrow.” (“সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষ হলো ‘আমি সফল’ এই ভাবনা। এর প্রতিষেধক হলো—‘আগামীকাল কী আরও ভালো করা যায়’ তা ভাবা।”)