দরিদ্রের সন্তান থেকে ব্যবসায় সম্রাট: লি কা-শিংয়ের সাফল্যের গল্প
ন থেকে ব্যবসায় সম্রাট: লি কা-শিংয়ের সাফল্যের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৯২৮ সালের ১৩ জুন, চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াংডং প্রদেশের এক ছোট্ট শহর চাওঝু। সকালের নরম আলোয় পাহাড়ের ঢালে তখনও কুয়াশা ভাসছে। ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এমন এক সাদামাটা গ্রামীণ পরিবেশেই জন্ম নেয় এক শিশু—লি কা-শিং।
তার বাবা ছিলেন গ্রামের এক সাধারণ স্কুলশিক্ষক, যিনি সততা ও জ্ঞানের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। পরিবারে টানাপোড়েন থাকলেও লির বাবা-মা স্বপ্ন দেখতেন—“আমাদের ছেলেটি বড় হয়ে শিক্ষিত হবে, ভালো মানুষ হবে।” তাদের ঘর ছিল ছোট্ট একটি মাটির বাড়ি, তবে ভরপুর ছিল ভালোবাসায়।
ছোট্ট লি ছিল কৌতূহলী, চিন্তাশীল আর ভীষণ পরিশ্রমী। স্কুলের পুরনো বেঞ্চে বসে সে মনোযোগ দিয়ে শুনত শিক্ষকের প্রতিটি কথা। বই পড়ার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রবল। নিজের কপি না থাকলে বন্ধুর বই ধার নিয়ে রাতে কেরোসিন বাতির নিচে পড়ত। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত জ্বলজ্বলে আলো—যে আলোয় লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
কিন্তু পৃথিবী সব সময় কোমল হয় না। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে চীনে দারিদ্র্য আর রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমে বেড়ে চলেছিল। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছিল, অনেক পরিবার একবেলা খেয়ে বাঁচত। লির পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
তার বাবা অল্প বেতনে বিদ্যালয়ে পড়াতেন, তাতে সংসারের খরচ চলত না। অনেক সময় মা নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাবার দিতেন।
তবুও লি কখনও অভিযোগ করত না। সে জানত—কঠিন সময়ই মানুষকে শক্ত করে তোলে।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সে দেখল, কয়েকজন ধনী বাচ্চা নতুন খেলনা নিয়ে খেলছে। নিজের হাতে কিছু না থাকলেও সে মনে মনে বলল, “একদিন আমি এমন কিছু বানাবো, যা মানুষ ভালোবাসবে, যা আমার পরিবারকে সুখ দেবে।” সেদিনই হয়তো জন্ম নিয়েছিল তার উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম বীজ।
১৯৩৭ সাল। চীনের আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ। জাপান-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দেশের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। লির ছোট্ট শহর চাওঝু থেকেও যুদ্ধের গন্ধ আসতে শুরু করল। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, দোকানপাট বন্ধ, মানুষের মুখে ভয়।
লি তখন মাত্র ৯ বছরের।
তার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন—এভাবে আর থাকা যাবে না। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। তাই একরাতেই তারা সব ছেড়ে, মাত্র কয়েকটা কাপড় আর পুরনো কিছু জিনিস নিয়ে হংকং-এর পথে রওনা দিলেন।
যাত্রাটা সহজ ছিল না। পথে ছিল ক্ষুধা, ভয়, আর অনিশ্চয়তা। ছোট্ট লি কখনও কেঁদে ফেলত, কখনও মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলত, “মা, আমরা পারব!”
অবশেষে কয়েকদিনের কষ্টকর যাত্রার পর তারা পৌঁছায় হংকংয়ে—তখনকার এক ব্যস্ত বন্দরনগরীতে। কিন্তু নতুন শহর মানেই নতুন সংগ্রাম। পরিচিত কেউ নেই, থাকার জায়গা নেই, কাজের সুযোগ নেই।
সেই সময় লি বুঝল—জীবন যেন এক গভীর সমুদ্র, যেখানে টিকে থাকতে হলে সাঁতার জানতে হয়।
তার বাবা ছোট একটি স্কুলে চাকরি পেলেন, কিন্তু বেতন ছিল নগণ্য। তবুও তারা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে লাগলেন।
প্রতিদিন সকালে বাবা স্কুলে যেতেন, আর মা বাজারে কিছু ছোটখাটো কাজ করতেন।লি স্কুলে যেত, ফেরার পর মাকে সাহায্য করত। রাতে ছোট্ট ঘরে বসে সে নিজের হাতে বানানো পুরনো কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ত—পড়ত ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক—আর স্বপ্ন দেখত, একদিন সে বড় কিছু করবে।
কিন্তু নিয়তি যেন আবারও তাকে পরীক্ষা নিতে চাইল।১৯৪১ সাল, লির বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। তার প্রিয় বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। হাসপাতালে নেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না। এক সন্ধ্যায়, লি মায়ের কোলের পাশে বসে দেখল—তার বাবা ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছেন।
সেই রাতের নীরবতা যেন পুরো পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। লি কাঁদছিল, কিন্তু তার চোখে শুধু জল নয়—ছিল এক কঠিন অঙ্গীকারের আগুন। সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিল, “আমি আর কাউকে আমার মতো কষ্ট পেতে দেব না। আমি একদিন এমন কিছু করব, যাতে মানুষ সুখে বাঁচতে পারে।”
সেই শৈশবের ক্ষুধা, অনাহার, ভয় আর হারানোর বেদনা—এই সবই তাকে তৈরি করেছিল এক অদম্য মানুষে। সে বুঝেছিল, জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হলো কষ্ট।আর সেখান থেকেই শুরু হয় এক দরিদ্র ছেলের অসাধারণ জীবনের যাত্রা—যে একদিন হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী, এক কিংবদন্তি নাম—লি কা-শিং।
১৯৪১ সালের শীতের এক সন্ধ্যা। হংকংয়ের রাস্তায় তখন ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। দূরে কোথাও সাইরেন বেজে উঠছে—যুদ্ধের অ্যালার্ম। আর ছোট্ট এক ঘরের ভেতর, এক কিশোর ছেলে চুপচাপ বসে আছে টিমটিমে বাতির নিচে। তার মুখে বিষণ্ণতা, চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে লি কা-শিং। বয়স মাত্র ১৩ বছর, কিন্তু জীবনের বোঝা যেন অনেকটাই আগেভাগে এসে পড়েছে তার কাঁধে।
কয়েক মাস আগেই হারিয়েছে বাবাকে—যিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বাবার মৃত্যু যেন লির শৈশবটাকেই কেড়ে নিয়েছে। এখন তাকে স্কুল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। কারণ, পরিবারের জন্য উপার্জন না করলে তাদের আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
মা প্রতিদিন ঘরের পুরনো কাপড় সেলাই করে কিছু টাকা রোজগার করেন, কিন্তু তা দিয়ে খাবার জোটানোই কঠিন। তাই লি সিদ্ধান্ত নেয়—সে কাজ করবে।
কয়েকদিন ধরে চাকরি খুঁজে অবশেষে এক প্লাস্টিকের বোতল কারখানায় কাজ পায় সে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারখানার ভেতর গরম, ধোঁয়া আর প্লাস্টিকের গন্ধে ভরা বাতাসে কাজ করতে হয়। হাতে থাকে শুধু একটা ছুরি আর কাঁচি—প্লাস্টিক কেটে আকার দিতে হয়।
তার বয়সী অন্য ছেলেরা তখন স্কুলে যেত, মাঠে খেলত। আর লি ঘাম ঝরিয়ে কাজ করত মেশিনের পাশে। প্রতিদিনের মজুরি ছিল অল্প—কিন্তু সে খুশি ছিল, কারণ এই টাকাতেই তার পরিবারের খাবার জোটে।
কাজের ফাঁকে সে মাঝে মাঝে মালিকের কাজে সাহায্য করত, হিসাব লিখে দিত, বা নতুন পণ্য বানানোর ধারণা দিত। একদিন মালিক অবাক হয়ে বললেন, “তুমি এখনো বাচ্চা, কিন্তু তোমার চিন্তাভাবনা একজন ব্যবসায়ীর মতো!”
লি মৃদু হেসে বলল, “আমি একদিন নিজের কারখানা করব, স্যার।”মালিক হাসলেন, কিন্তু লি জানত—সে স্বপ্ন বলছে, আর স্বপ্নকে সে বাস্তব করবেই।
দিনে কাজ করত সে, আর রাতে পড়াশোনা।
ঘরে ফেরার পর, ক্লান্ত শরীর নিয়ে সে পুরনো টেবিলের পাশে বসত।একটা জীর্ণ বই খুলে মোমবাতির আলোয় পড়ত ইংরেজি শব্দ, ব্যবসার মৌলিক ধারণা আর গণিতের অঙ্ক।
তার মা বলতেন, “লি, ক্লান্ত লাগছে না?”
সে হাসত, “না মা, এখন না পড়লে ভবিষ্যতে কীভাবে আলোর মুখ দেখব?” এই পরিশ্রম আর আত্মনিবেদনই ধীরে ধীরে তৈরি করছিল এক ভবিষ্যতের মহীরুহকে।
একবার কারখানায় একটা বড় অর্ডারের কাজ চলছিল। হঠাৎ মালিকের চোখে পড়ে—লি নিখুঁতভাবে পণ্য বানাচ্ছে, অথচ অন্যরা তাড়াহুড়ো করছে। মালিক জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এত যত্ন করে কাজ করছ কেন? সময় তো বেশি লাগছে।”
লি শান্তভাবে বলল,“মানুষ পণ্য কেনে, কিন্তু আসলে তারা বিশ্বাস কেনে। যদি বিশ্বাস হারাই, সব হারাব।” এই এক বাক্যে যেন ফুটে উঠল তার জীবনের দর্শন—বিশ্বাসই ব্যবসার ভিত্তি।
১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। হংকং ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগল, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন তখনও অস্থির। লি তখন প্রায় ১৭ বছর বয়সী।
ততদিনে সে কারখানার দক্ষ শ্রমিক থেকে একপ্রকার পরিচালক পর্যায়ের সহকারী হয়ে উঠেছে।
সে বুঝেছিল, টিকে থাকতে হলে শুধু শ্রম নয়—বুদ্ধি, সততা, আর দূরদৃষ্টি প্রয়োজন। এই সময় থেকেই সে প্লাস্টিক শিল্প নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে। লক্ষ্য করল—প্লাস্টিক দিয়ে খেলনা, ফুল, ও গৃহস্থালির জিনিস তৈরি করলে ভবিষ্যতে বাজার বাড়বে।
যুদ্ধোত্তর হংকংয়ে সস্তা কিন্তু সুন্দর পণ্যের চাহিদা বাড়ছিল। লি ঠিক করল—একদিন সে এই সুযোগ কাজে লাগাবে।
১৯৪৭ সালে, লির বয়স ১৯ বছর। একদিন কারখানায় কাজ করার সময় সে হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—এই হাতগুলো শুধু অন্যের জন্য কাজ করবে, নাকি নিজের জন্যও কিছু তৈরি করবে?তার মনে বাজতে লাগল এক প্রশ্ন—“আমি কি সারাজীবন অন্যের কারখানায় থাকব, নাকি নিজের কিছু শুরু করব?”
সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সে মাকে বলল, “মা, আমি নিজে ব্যবসা শুরু করব।”মা একটু ভয় পেলেন।
“আমাদের তো টাকা নেই, পুঁজি নেই, আর তুমি একা…”।লি মৃদু হাসল, “পুঁজি না থাকলেও সাহস তো আছে। সেটাই আমার আসল সম্পদ।”
১৯৫০ সালের এক ভোরবেলা। হংকং শহরের রাস্তায় তখনও কুয়াশা ঘন। পাখিরা ডাকে, আর দূরের সমুদ্রের বাতাসে ভেসে আসে বন্দরের লবণাক্ত গন্ধ।মাত্র ২২ বছর বয়সী এক তরুণ সেই ভোরে হাঁটছিল একটি পুরনো নোটবুক হাতে নিয়ে। তার মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। সে আর কেউ নয়—লি কা-শিং।
গত কয়েক বছর ধরে সে একের পর এক কারখানায় কাজ করেছে—কখনও শ্রমিক, কখনও তত্ত্বাবধায়ক, কখনও হিসাবরক্ষক। সব জায়গায় একটাই জিনিস সে শিখেছে—কাজের মূল্য, সময়ের দাম, আর মানুষের বিশ্বাস।
সেই বিশ্বাস আর অভিজ্ঞতা নিয়েই সে এবার নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিল— “আমি এখন নিজের কারখানা শুরু করব।”
তখন তার হাতে ছিল খুব সামান্য টাকা—
মোটে ৭,০০০ হংকং ডলার (যার অর্ধেকই ধার করা)। এই টাকায় বড় কিছু শুরু করা অসম্ভব মনে হচ্ছিল সবার কাছে। বন্ধুরা বলত,“লি, এত কম টাকায় ব্যবসা? এটা তো পাগলামি!”
কিন্তু লি হাসত। তার বিশ্বাস ছিল, টাকা নয়—আইডিয়াই আসল পুঁজি। সে তখন লক্ষ্য করছিল, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক শিল্পের উত্থান হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ সস্তা, টেকসই আর সুন্দর পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। লি ভাবল—প্লাস্টিক দিয়েই শুরু করবে সে তার ভবিষ্যত গড়ার যাত্রা।
১৯৫০ সালের মাঝামাঝি, হংকংয়ের এক ভাড়া করা ছোট্ট ঘরে জন্ম নেয় একটি নতুন নাম— Cheung Kong Industries (চ্যুং কং ইন্ডাস্ট্রিজ)। “Cheung Kong” মানে “দীর্ঘ নদী” — যেভাবে নদী থেমে থাকে না, প্রবাহিত হয় শত বাধা পেরিয়ে, তেমনই লি চেয়েছিলেন তার ব্যবসাও চলুক অবিরাম।
প্রথম দিকে কারখানায় ছিল মাত্র কয়েকজন কর্মচারী, পুরনো কিছু মেশিন, আর একগাদা আশা।
লি নিজেই ডিজাইন করতেন, কাঁচামাল কিনতেন, কখনও প্যাকেট বানাতেন, কখনও বিক্রি করতে যেতেন দোকানে দোকানে।
তার তৈরি প্লাস্টিক ফুল ছিল সুন্দর, টেকসই আর দেখতে বাস্তবের মতো। প্রথম কয়েক মাসে লাভ না হলেও সে হাল ছাড়েনি। একদিন এক বিদেশি ব্যবসায়ী তার দোকানে এসে পণ্য দেখে অবাক হয়ে বলল, “তোমার এই ফুলগুলো তো ইউরোপে বিক্রি হবে!”
সেই এক অর্ডার বদলে দিল তার ভাগ্য। কয়েক মাসের মধ্যেই Cheung Kong-এর পণ্য রপ্তানি শুরু হলো বিদেশে।
লি কখনও অফিসে দেরি করে আসেনি, বরং সবার আগে এসে দরজায় তালা খুলত। রাতের বেলায় কর্মচারীরা চলে গেলে সে একা বসে হিসাব মিলাত, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করত। সে প্রায়ই বলত,“যদি তুমি তোমার কাজকে ভালোবাসো, তবে সেটাই তোমার প্রার্থনা হয়ে যায়।”
তার সৎ ব্যবসা ও মানসম্মত পণ্য দেখে গ্রাহকেরা তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করল। যারা প্রথমে সন্দেহ করেছিল, তারাই এখন তার অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করত।
১৯৫৩ সালের মধ্যে তার কারখানা ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে বড় ভবনে চলে যায়। তখন সে হংকংয়ের অন্যতম সেরা প্লাস্টিক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
কর্মচারীদের সঙ্গে লি কখনও বসের মতো আচরণ করতেন না। একদিন এক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে কাজে না আসায় সে নিজেই তার বাড়িতে ওষুধ নিয়ে গিয়েছিল। সবাই অবাক হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “আমি জানি কষ্ট কী। আমি একসময় তোমাদের মতোই শ্রমিক ছিলাম।”এই মানবিক আচরণেই কর্মচারীরা তাকে শুধু নেতা নয়, পরিবারের একজন অভিভাবক হিসেবে দেখতে শুরু করে।
১৯৫৫ সালের মধ্যে Cheung Kong-এর ব্যবসা হংকং ছাড়িয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপে পৌঁছে যায়।লি তখনও বলতেন, “এটা শুরু মাত্র। আমার স্বপ্ন এর চেয়ে অনেক বড়।” সেই সময়ই তার মনের মধ্যে জন্ম নেয় আরেক নতুন চিন্তা— “জমি, ঘরবাড়ি—এগুলোও তো মানুষের জীবনের চাহিদা। আমি শুধু ফুল বিক্রি করে থেমে থাকব না, মানুষের ভবিষ্যত গড়ব।”
এই চিন্তাই তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় নতুন এক পথে— যেখানে প্লাস্টিকের ফুলের ব্যবসায়ী হয়ে উঠবে রিয়েল এস্টেটের রাজা, আর পরে বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।
লি কা-শিংয়ের জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায়— সফল হতে বড় পুঁজি নয়, বড় সাহস লাগে। পরিশ্রম, সততা, আর ধৈর্যই মানুষকে উপরে তুলে দেয়।
একজন তরুণ, যে একসময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাজ করত অন্যের কারখানায়, সেই তরুণ নিজের হাতে গড়ে তুলল এমন এক প্রতিষ্ঠান—যার নাম আজও সাফল্যের প্রতীক।
এভাবেই, ১৯৫০ সালেই লি কা-শিং নিজের পায়ের তলায় দাঁড়ানোর মাটি খুঁজে পেলেন, যে মাটি থেকে গড়ে উঠল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের ভিত্তি।
১৯৬০ সালের এক গরম দুপুর। হংকং তখন নতুনভাবে জেগে উঠছে যুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ থেকে। শহরের রাস্তায় ট্রাম চলছে, বন্দর ব্যস্ত, মানুষের চোখে আশার আলো। সেই ব্যস্ত শহরের এক প্রান্তে, বড় কাঁচের জানালাওয়ালা অফিসে বসে আছেন এক তরুণ উদ্যোক্তা—লি কা-শিং। চ্যুং কং ইন্ডাস্ট্রিজ এখন আর ছোট কারখানা নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক উদীয়মান কোম্পানি।
কিন্তু লি জানতেন, শুধু প্লাস্টিক শিল্পেই থেমে থাকলে চলবে না। পৃথিবী বদলাচ্ছে, আর সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে সাফল্যও থেমে যাবে।
তার চোখ ছিল ভবিষ্যতের দিকে।
১৯৬০ সালের শুরুর দিকে লি লক্ষ্য করলেন—হংকং শহর দ্রুত বেড়ে উঠছে, মানুষ শহরে ভিড় করছে, বাসস্থানের চাহিদা বাড়ছে।
সে বুঝলেন, “প্লাস্টিক পণ্য মানুষ চায় আজ, কিন্তু জমি ও ঘর—মানুষ চায় আজীবন।”
তখনই তার মাথায় আসে নতুন ধারণা—রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় নামা।তিনি ছোট ছোট জমি কিনতে শুরু করলেন, যা তখন খুব সস্তায় পাওয়া যেত।
বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এই খাতে বিনিয়োগ করতে ভয় পেতেন, কারণ তখন হংকংয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল।কিন্তু লি ছিলেন অন্য রকম মানুষ।
তিনি বলতেন, “ভয়ের সময়ই আসলে সুযোগের সময়। যখন সবাই পিছিয়ে যায়, তখন এগিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তা।”
১৯৬৭ সাল—হংকং অচল হয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক দাঙ্গায়। বেশিরভাগ ধনী ব্যবসায়ী তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু লি কা-শিং সেই সময়ই সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিলেন— তিনি বিক্রি নয়, বরং বেশি জমি কিনতে শুরু করলেন।
মানুষ ভাবল, সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু লি বললেন,“ঝড় কেটে গেলে আকাশই সবচেয়ে পরিষ্কার হয়।”তার কেনা সেই জমিগুলোর দাম পরবর্তী পাঁচ বছরে বেড়ে গেল কয়েকগুণ। যখন অন্যরা ভয় পেয়েছিল, তিনি দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ। সেই সাহসই তাকে বানাল এক দূরদর্শী ব্যবসায়ীর প্রতীক।
১৯৬৯ সালের মধ্যে লি কা-শিং শুধু প্লাস্টিক নয়, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, এমনকি ব্যাংকিং খাতেও বিনিয়োগ করতে শুরু করলেন। তিনি তার কোম্পানির নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন— “আমরা শুধু পণ্য নয়, মানুষ ও ভবিষ্যত তৈরি করব।”
তার তৈরি বিল্ডিংগুলো শুধু দালান ছিল না;
সেগুলো হয়ে উঠেছিল আধুনিক হংকংয়ের প্রতীক। তিনি কর্মচারীদের বলতেন, “আমাদের কাজের মান এমন হতে হবে, যেন মানুষ গর্ব করে বলে—এটা চ্যুং কং বানিয়েছে।” এমন মনোভাবেই তিনি গড়ে তুললেন এক বিশ্বাসযোগ্য ব্র্যান্ড, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
এই সময় লি কা-শিংয়ের সাফল্যের তিনটি মূলনীতি তৈরি হয়—পরিশ্রম: তিনি নিজেই প্রতিটি প্রকল্পের পরিকল্পনা পর্যালোচনা করতেন। সততা: ব্যবসার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা বজায় রাখতেন। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা: কর্মচারী ও গ্রাহক—দু’জনকেই তিনি পরিবারের অংশ মনে করতেন।
একবার এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ কী?”
তিনি হেসে বলেছিলেন, “মানুষের বিশ্বাস।”
১৯৭০ সালের শেষে লি কা-শিং হংকংয়ের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে স্বীকৃতি পান। তার কোম্পানি Cheung Kong তখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু তার মনের মধ্যে ছিল আরও বড় স্বপ্ন।
তিনি ভাবলেন— “আমি যদি শুধু হংকং নয়, পুরো পৃথিবীতে আমার ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে পারি?”
এই চিন্তাই তার পরবর্তী যাত্রার পথ তৈরি করল—
যেখানে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠবেন একজন বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ী নেতা, আর Cheung Kong পরিণত হবে এক বহুজাতিক সাম্রাজ্যে।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়টা লি কা-শিংয়ের জীবনের জন্য ছিল “পরীক্ষা ও প্রমাণের যুগ।”তিনি প্রমাণ করেছিলেন— “যে ঝুঁকি নেয়, সে-ই ইতিহাস গড়ে।”
এক দরিদ্র শ্রমিক থেকে প্লাস্টিক কারখানার মালিক,
আর এখন রিয়েল এস্টেটের রাজা— এই এক দশকেই তিনি তৈরি করলেন নিজের সাফল্যের সিঁড়ি।
আর এখান থেকেই শুরু হলো তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়— “বিশ্বব্যাপী ব্যবসা সাম্রাজ্য (১৯৮০–২০০০)”, যেখানে লি কা-শিং হয়ে উঠবেন এক কিংবদন্তি, যাকে মানুষ আজও বলে—“এশিয়ার ব্যবসায় সম্রাট।”
১৯৮০ সালের দিকে তার কোম্পানি “Cheung Kong” পরিণত হয় একটি বহুজাতিক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে। তিনি টেলিকম, বন্দর, বিদ্যুৎ, ব্যাংক, এমনকি জাহাজ শিল্পেও বিনিয়োগ করতে শুরু করেন।তার অন্যতম বড় কোম্পানি Hutchison Whampoa হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত।
১৯৮৯ সালের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন হংকংয়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ২০০০ সালের মধ্যে, লি কা-শিংয়ের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে ৫০টিরও বেশি দেশে, ২,৫০,০০০ কর্মচারী নিয়ে। তার সাফল্যের পেছনে ছিল একটাই দর্শন: “পরিশ্রম করো, শেখো, আর কখনও হাল ছাড়ো না।”
ধনকুবের হলেও লি কা-শিং ছিলেন নম্র ও মানবপ্রেমী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Li Ka-Shing Foundation, যার মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার দান করেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণায়।
তিনি বলেছিলেন, “আমার প্রকৃত সাফল্য টাকার পরিমাণে নয়—আমি কতজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পেরেছি, সেটাই আসল।”
২০২০ সালের মধ্যে তার বয়স ৯২ বছর, কিন্তু তিনি তখনও ছিলেন পরামর্শদাতা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার নাম শুধু হংকং নয়, পুরো এশিয়ায় “সাফল্যের প্রতীক” হিসেবে পরিচিত।
লি কা-শিং প্রমাণ করেছেন—দারিদ্র্য কখনও বাধা নয়, যদি মনোবল অটল থাকে। একজন দরিদ্র শিক্ষকের সন্তান থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশ্বের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য। তার জীবন শেখায়— “পরিস্থিতি তোমাকে থামিয়ে দিতে পারে না, যদি তুমি নিজেই বিশ্বাস কর যে তুমি পারবে।”