রান্নাঘর থেকে কিংবদন্তি: জুলিয়া চাইল্ডের অনুপ্রেরণামূলক গল্প
রান্নাঘর থেকে কিংবদন্তি: জুলিয়া চাইল্ডের অনুপ্রেরণামূলক গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৯১২ সালের ১৫ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় জন্ম নেন জুলিয়া ম্যাকউইলিয়ামস, যাকে পরে বিশ্ব চিনবে জুলিয়া চাইল্ড নামে। এক ধনী পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তার শৈশব কেটেছিল আরামেই। কিন্তু খাবার রান্নার প্রতি তখনো কোনো ঝোঁক ছিল না তার। বরং তিনি ছিলেন ক্রীড়া-প্রেমী ও প্রাণবন্ত স্বভাবের।
১৯৩০ সালে তিনি ভর্তি হন Smith College-এ এবং ১৯৩৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ইতিহাসে। এরপর কিছুদিন কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেন। স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়ার, কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে যাচ্ছিল এক ভিন্ন পথে—রান্নার জগতে।
একটা ছোট্ট রান্নাঘর। টেবিলের উপর কয়েকটা হাঁড়ি, কিছু উপকরণ, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক লম্বা হাসিখুশি নারী। তার হাতে ধরা কাঠের চামচ, মুখে আনন্দের ছাপ—যেন প্রতিটি পদ তিনি ভালোবাসা দিয়ে রাঁধছেন। এই নারীই পরবর্তীতে আমেরিকার রন্ধনজগতকে পাল্টে দিয়েছিলেন।তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ভালোবাসা ও আগ্রহ থাকলে রান্নাঘর থেকেও জন্ম নিতে পারে এক কিংবদন্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে (১৯৩৯–১৯৪৫) জুলিয়া দেশের সেবায় এগিয়ে আসেন। ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন Office of Strategic Services (OSS)-এ — যা ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা (CIA) এর পূর্বসূরি। সেখানে তিনি একজন প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। যুদ্ধকালীন সময়ে সেখানেই তার পরিচয় হয় আমেরিকান কর্মকর্তা পল চাইল্ড-এর সঙ্গে। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে তাদের বিয়ে হয়।
প্যারিসের এক শীতল সকাল। জানালার বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসে কফির গন্ধ আর রুটি বেক করার মিষ্টি সুবাস। রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক লম্বা, হাসিখুশি নারী—হাতে কাঠের চামচ, চোখে আগ্রহের ঝিলিক। তিনি জুলিয়া চাইল্ড, তখনও বিশ্ব তাকে চেনে না, কিন্তু তার ভিতরে কিছু একটার জন্ম হচ্ছে—রন্ধনপ্রেমের এক গভীর আগুন।
১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সময়টা তখনও পুনর্গঠনের। জুলিয়া ও তার স্বামী পল চাইল্ড ফ্রান্সে কূটনৈতিক দায়িত্বে এসেছেন। একদিন পল তাকে নিয়ে যান একটি ছোট্ট ফরাসি রেস্তোরাঁয়—“La Couronne”।জুলিয়ার সামনে পরিবেশন করা হয় এক থালা গরম sole meunière—এক প্রকার মাছের পদ, ঘি ও লেবুর ঝাঁজে ভরপুর।
প্রথম কাঁটা দিয়েই যেন তার জীবনের দিক বদলে গেল।
তিনি পরবর্তীতে স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন—“It was the most exciting meal of my life.”
সেই খাবারই যেন তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, খাবার শুধু পেট ভরানোর নয়—এটি এক শিল্প, এক ভাষা, এক আনন্দের যাত্রা।পরদিন থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করলেন— “আমি কি নিজেও এমন রান্না শিখতে পারি?”
পল তার আগ্রহ বুঝে উৎসাহ দিলেন। তিনি ভর্তি হলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত Le Cordon Bleu কুকিং স্কুলে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই শিক্ষকরা বিস্মিত—
লম্বা দেহী এক আমেরিকান নারী, বয়সও প্রায় ৩৭, হাতে নোটবুক, চোখে উচ্ছ্বাস!
শুরুটা সহজ ছিল না। শিক্ষকরা ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন, আর জুলিয়ার ভাষাজ্ঞান ছিল খুবই সীমিত।কখনো সঠিকভাবে পেঁয়াজ কাটতে না পারায় হাসির পাত্র হয়েছেন, কখনো সসের ঘনত্ব ঠিক না হওয়ায় পুরো ডিশ নষ্ট করেছেন।তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন চুলার সামনে দাঁড়িয়ে, স্যুপে চামচ ডুবিয়ে, ভুল থেকে শিখে।
শিক্ষক একদিন বললেন, “Madame Julia, your hands may tremble, but your passion is steady.” (“ম্যাডাম জুলিয়া, আপনার হাত কাঁপে বটে, কিন্তু আপনার আগ্রহ অটল।”) এই বাক্যটাই হয়ে যায় তার জীবনের প্রেরণা।
১৯৫১ সালে জুলিয়া চাইল্ড ফ্রান্সের রান্নার কৌশল শিখে ফেলেছেন প্রায় নিখুঁতভাবে। রান্না শেখার পর তিনি বুঝতে পারলেন—ফরাসি রন্ধনশৈলী যতই চমৎকার হোক, সেটি আমেরিকানদের নাগালের বাইরে থেকে যায়।তাদের ভাষা, উপকরণ ও রান্নার অভ্যাস একেবারেই আলাদা।তখন তিনি ভাবলেন, “আমেরিকার মানুষদেরও এই ফরাসি রন্ধনশিল্প শেখানো উচিত—কিন্তু তাদের ভাষায়, তাদের রান্নাঘরের উপকরণে।”
তখনই তার দেখা হয় দুই ফরাসি নারীর সঙ্গে—সিমোন বেক (Simone Beck) এবং লুইসেট বারথল (Louisette Bertholle)।
তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন—
তারা এমন একটি বই লিখবেন, যা ফরাসি রন্ধনশিল্পকে সহজভাবে আমেরিকান গৃহিণীদের সামনে তুলে ধরবে।
।তিনজন মিলে নাম রাখলেন—
“L’Ecole des Trois Gourmandes” (তিন রসনাবিলাসীর স্কুল)।
বইয়ের কাজ শুরু হলো ১৯৫২ সালে। কিন্তু বই লেখা তো কোনো সহজ কাজ নয়!দিনের পর দিন তাঁরা রান্না করে নোট নিতেন, প্রতিটি উপকরণ মেপে লিখতেন।তাদের লক্ষ্য ছিল, ফরাসি রান্নাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য করা। কিন্তু কাজটা ছিল বিশাল! প্রতিটি রেসিপি তারা তৈরি করতেন, পরীক্ষা করতেন, তারপর বারবার পরিবর্তন করতেন।কখনো এক পদ ঠিক করতে হতো ১০ বার পর্যন্ত।বইটি রচনায় সময় লাগলো প্রায় দশ বছর!
১৯৬০ সালে অবশেষে বইটির পান্ডুলিপি নিয়ে তারা যোগাযোগ করেন বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা Houghton Mifflin-এর সঙ্গে।প্রকাশকরা পড়লেন, তারপর বললেন এক কথায়— “It’s too long, too detailed. American housewives will never buy this.”(“এ বইটা খুব দীর্ঘ, খুব জটিল। আমেরিকান গৃহিণীরা এমন বই কখনো কিনবে না।”)
জুলিয়ার মন ভেঙে গেল। বইটি ফিরিয়ে দিলো প্রকাশকরা।অনেকে বলেছিল— “তুমি একজন বিদেশি নারী, ফরাসি ভাষায় লেখা রেসিপি নিয়ে কে আগ্রহী হবে?”
কিন্তু জুলিয়া হাল ছাড়লেন না। তিনি বললেন—“If it’s too long, it means it’s detailed. And that’s what people need.” (“যদি এটা বড় হয়, তার মানে এটি বিস্তারিত—আর সেটাই মানুষ চায়।”)
তাদের বইয়ের পান্ডুলিপি একদিন Judith Jones নামের এক তরুণ সম্পাদক পড়ে ফেলেন। তিনি পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি বলেন— “This is not a cookbook; this is literature!” Judith Jones বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন Alfred A. Knopf প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
১৯৬১ সালের ১৩ অক্টোবর, বইটি প্রকাশিত হয় —
“Mastering the Art of French Cooking” নামে।
বইটির লেখক হিসেবে জুলিয়া চাইল্ড, সিমোন বেক ও লুইসেট বারথল—এই তিন নারীর নাম ছাপা হয় প্রচ্ছদে। বইটি যেন রান্নার জগতে এক বিস্ফোরণ ঘটাল।ফরাসি রান্না তখন আর রাজকীয় ব্যাপার নয়—ঘরে বসেই তা শেখা সম্ভব, এ বিশ্বাস জন্ম দিল জুলিয়া চাইল্ড।
প্রথম সপ্তাহেই বইটি হিট! নিউইয়র্ক টাইমস-এর সমালোচক লিখলেন—“This book will change the way Americans cook forever.” বইটি মুহূর্তেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়, এবং জুলিয়া চাইল্ড হয়ে ওঠেন “America’s Cooking Teacher.”
বইয়ের সাফল্যের দুই বছর পর, ১৯৬৩ সালে, বোস্টনের টিভি চ্যানেল WGBH তাকে একটি কুকিং শো করার প্রস্তাব দেয়।তারা চেয়েছিল, তিনি যেন একটি ছোট রান্নার ডেমোনস্ট্রেশন দেন। জুলিয়া সেখানে হাসিমুখে বললেন, “রান্না মানে কেবল খাবার নয়, এটা আনন্দের উৎসব।”
তার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা দর্শকদের মন জয় করে নেয়। এরপর শুরু হয় তার নিজের টেলিভিশন অনুষ্ঠান— “The French Chef”, যা ১৯৬৩ সালে PBS-এ প্রচার শুরু হয়। সেই অনুষ্ঠান চিরতরে বদলে দেয় আমেরিকান টেলিভিশনের ইতিহাস। তিনি হাসিমুখে বলেন, “If you can read, you can cook!”
তার সহজ ভাষা, রসিক ভঙ্গি ও আত্মবিশ্বাস মানুষকে শিখিয়েছিল—রান্না মানে ভয়ের নয়, আনন্দের বিষয়।
তিনি যখন টেলিভিশনে আসেন, তখন বেশিরভাগ নারী ছিলেন লাজুক ও সংযত; আর জুলিয়া ছিলেন ঠিক তার বিপরীত— চোখে চশমা, মুখে প্রশস্ত হাসি, মাঝে মাঝে হাঁড়ি থেকে খাবার ছিটে পড়লেও তিনি বলতেন, “Never apologize! Remember, you’re the boss in your kitchen!”
দর্শকরা ভালোবেসে ফেললেন এই হাস্যরসিক, প্রাণবন্ত নারীকে।১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠানটির জন্য তিনি Emmy Award পান। তার পর থেকেই আমেরিকার প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এক নতুন বার্তা—“Cooking can be fun, fearless, and full of joy.”
১৯৭০-এর দশকে জুলিয়া চাইল্ড হয়ে ওঠেন রন্ধনশিল্পের বিশ্বনেত্রী। তার প্রতিটি টিভি শো মানুষকে হাসাত, অনুপ্রাণিত করত, শেখাত আত্মবিশ্বাস। তিনি প্রমাণ করেছিলেন—রান্না কোনো ছোট বিষয় নয়; এটি এমন এক শিল্প যা মানুষকে একত্র করে, সুখ দেয়, আর জীবনের স্বাদ বাড়ায়।
জুলিয়া চাইল্ড জীবদ্দশায় একাধিক বই লিখেছেন এবং বহু টেলিভিশন সিরিজে অংশ নিয়েছেন।
১৯৮০-এর দশকে তিনি হয়ে ওঠেন “আমেরিকান কুকিং”-এর প্রতীক। ২০০০ সালে তিনি পান ফ্রান্সের Legion of Honour, আর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Presidential Medal of Freedom।
২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট, নিজের ৯২তম জন্মদিনের দুই দিন আগে, তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জুলিয়া চাইল্ড শুধু একজন রাঁধুনি ছিলেন না — তিনি ছিলেন এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।
যেখানে নারীরা রান্নাকে গৃহস্থালি কাজ হিসেবে দেখত, সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, রান্নাও হতে পারে শিল্প, বিজ্ঞান, এমনকি ব্যবসার এক বিশাল ক্ষেত্র। তার এক অমর উক্তি আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে— “Find something you’re passionate about and keep tremendously interested in it.” — Julia Child