দূরত্ব ভেঙে ভেসে আসা কন্ঠ: টেলিফোন আবিষ্কারের গল্প
দূরত্ব ভেঙে ভেসে আসা কন্ঠ: টেলিফোন আবিষ্কারের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৪৭ সালের ৩ মার্চ, কানাডার আলমা শহরে জন্ম নিল এক ছেলে—অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।
তার বাবা ছিলেন শ্রবণবিদ্যার বিশেষজ্ঞ, মা ছিলেন শিক্ষিত ও সঙ্গীতপ্রেমী। ছেলেটির ছোটবেলা থেকে চোখে ছিল কৌতূহল, মনের ভেতর ঘুরপাক খেলত এক প্রশ্ন— “মানুষ কি দূর থেকে সরাসরি কথা বলতে পারবে?”
বেল ছোটবেলা থেকেই শব্দের জাদু অনুভব করত।
তার মা তাকে শোনাত গান, তার বাবা তাকে শেখাত কণ্ঠের কম্পন। একদিন বেল তার বাবা এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বসে বলল,“আমি চাই কণ্ঠ শুধুই বাতাসে ভেসে যাক, কিন্তু কেউ তা ছুঁয়ে না।”
ছোটবেলার এই কৌতূহল তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল।শরীরের খেলা বা সাধারণ খেলাধুলার চেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞান ও পরীক্ষার দিকে।
১৮৬৫ সালে, বয়স তখন ১৮, বেল লন্ডনে চলে গেল পড়াশোনার জন্য। সে ভর্তি হলো এডিনবার্গের শ্রবণবিদ্যা স্কুলে।শ্রবণ, কণ্ঠ এবং শব্দের প্রকৃতি নিয়ে তার আগ্রহ দিনদিন বেড়ে চলছিল। তিনি শিখলেন—কীভাবে কণ্ঠের কম্পন একটি যন্ত্রের মাধ্যমে অন্য স্থানে পৌঁছানো যায়।
লন্ডনে থাকার সময় সে তার শিক্ষকের কাছ থেকে বৈদ্যুতিক সংকেতের জ্ঞানও নিল।ছেলের মনে জন্ম নিল এক নতুন স্বপ্ন—“কোনোদিন মানুষ তারের মাধ্যমে নয়, সরাসরি কণ্ঠের মাধ্যমে দূরে কথা বলবে।”
ছোট্ট ল্যাবরেটরি তৈরি করে সে পরীক্ষা করত, ব্যর্থ হত, আবার চেষ্টা করত।তার চোখে ছিল এক অদম্য দৃঢ়তা।শ্রবণ এবং কণ্ঠের এই রহস্যময় জগতে সে পুরো হৃদয় দিয়েছিল।
১৮৬৫ সালের শেষের দিকে, লন্ডনের এক ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে বসে ছিল এক তরুণ—অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্যাটারি, তার, কয়েল, এবং কাগজের খাতা—প্রতিটি পাতায় লেখা তার স্বপ্নের গল্প।
ছেলেটির চোখে উজ্জ্বল আশা, মুখে অদম্য দৃঢ়তা।
সে জানত—মানুষের কণ্ঠ শুধু শব্দ নয়, এটি অনুভূতি, অনুভূতি দিয়ে হৃদয় স্পর্শ করতে পারে।
প্রতিদিন রাতভর সে পরীক্ষা চালাচ্ছে। কখনও ব্যর্থ, কখনও অল্প সফল।প্রতিটি ব্যর্থতা যেন তাকে আরও দৃঢ় করে তুলছে, যেন বলছে,“চেষ্টা কর, একদিন তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে।”
একদিন মা তার ঘরে এসে চুপচাপ তাকালেন।“বেল, তুমি আবার রাতভর পরীক্ষা করছো? আর কিছু খেয়েছো?”
বেল এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল,“মা, আমি চাই একদিন দূরের মানুষ আমার কণ্ঠ শুনুক—তার ছোঁয়া ছাড়া, শুধু বাতাসে ভেসে।”
মা চুপচাপ বসে রইলেন, চোখে গর্বের অশ্রু।
তারা দু’জন জানতেন না, কিন্তু সেই ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিচ্ছিল একটি স্বপ্ন,যা একদিন পৃথিবীর দূরত্ব ভেঙে মানবকে একত্রিত করবে।
ছোট্ট সেই স্বপ্নের মাঝে ছিল আশা, ভরসা, এবং অজানা উত্তেজনা—একটি স্বপ্ন, যা টেলিফোনের আবিষ্কারের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছিল।
১৮৭৪ সালে, বয়স তখন মাত্র ২৭, বেল তার নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে পরীক্ষা করছিল। শীতল সকালে, লন্ডনের ছোট্ট ল্যাবরেটরির জানালা দিয়ে হালকা সূর্যরশ্মি প্রবেশ করছিল।
এক তরুণ বিজ্ঞানী—অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল— চুপচাপ বসে আছে তার যন্ত্রের সামনে।
তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট ব্যাটারি, কয়েল, তার, এবং খোলা খাতায় অজস্র নোট। প্রতিটি পদক্ষেপে লেখা তার চিন্তার গল্প—এক স্বপ্ন যা কেবল তার নিজের নয়, বরং পুরো মানবজাতির জন্য।
বেল জানে, আজকের পরীক্ষা সফল হলে তার স্বপ্নের পথ খুলে যাবে।সে গভীর শ্বাস নিল, হাত আলতো কাঁপছে, চোখ বন্ধ করে বলল:“দূরের কণ্ঠকে আমি শোনাবো, শুধু বাতাসের মাধ্যমে, কোনো তার ছাড়া।”
ল্যাবরেটরির অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সহকারী ওয়াটসন, হাতে ছোট রিসিভার।বেল বোতাম চাপল। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা।তারপর—ক্লিক!
ওয়াটসনের কানে এল ক্ষীণ, কাঁপা শব্দ—“ডিট… ডিট…” ওয়াটসন চোখ বড় করে তাকাল, অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল:“আমি শুনতে পাচ্ছি! আমি সত্যিই শুনতে পাচ্ছি!”
বেল যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল।
তার হৃদয় ধুকধুক করছে, চোখে উজ্জ্বলতা।“দূরত্ব আর বাধা নয়, শব্দ ভেসে যেতে পারে—সঠিক যন্ত্রের সাহায্যে।”
ল্যাবের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার মা।
চোখে গর্বের অশ্রু, মুখে অদ্ভুত এক হাসি।“বেল, তুমি ইতিহাস তৈরি করছো, জানো কি?”
ছোট্ট সেই ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিল মানব ইতিহাসের প্রথম টেলিফোন পরীক্ষা। একটি ক্ষীণ শব্দ, একটি ছোট্ট সাফল্য— যা একদিন পুরো পৃথিবীকে একত্রিত করবে, দূরত্ব ভেঙে কণ্ঠকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেবে।
১৮৭৬ সালের ৭ মার্চ, লন্ডনের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে এক উত্তেজিত তরুণ দাঁড়িয়ে ছিল তার যন্ত্রের সামনে—অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল।ছেলেটির চোখে উজ্জ্বলতা, মুখে এক অদম্য আত্মবিশ্বাস।প্রায় দুই বছরের পরিশ্রম, অসংখ্য ব্যর্থতা, অসংখ্য রাতজেগে পরীক্ষা—সবই আজ এক মুহূর্তে মিলিত হতে চলেছে।
ল্যাবের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সহকারী ওয়াটসন, রিসিভার হাতে।বেল গভীর শ্বাস নিল, বোতাম চাপল।প্রথমে কিছুই শোনা গেল না।তারপর—টিং… টিং… টিং!ওয়াটসনের কানে পৌঁছল শব্দ।
ওয়াটসন অবাক হয়ে চিৎকার করল:“আমি শুনতে পাচ্ছি! বেল! আমি সত্যিই শুনতে পাচ্ছি!”
বেল চোখ বড় করে তাকাল, মুখে হাসি, হৃদয় ধুকধুক করছে।তার প্রথম কথাটি পৌঁছল ওয়াটসনের কাছে—দূরত্ব ভেঙে।“মিস্টার ওয়াটসন! এখানে! আমি কথা বলছি!”
এই এক মুহূর্তই ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম টেলিফোন কল।ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিল সেই যন্ত্র,যা একদিন পৃথিবীর প্রতিটি কোণকে সংযুক্ত করবে।
বেল জানত, এটি কেবল শুরু।
আজ যে শব্দ পৌঁছেছে কয়েক মিটার দূরে, কাল তা পৌঁছাবে শহর, দেশ, আর মহাদেশের ওপারেও।
তার মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন, চোখে আনন্দের অশ্রু।“বেল, তুমি সত্যিই ইতিহাস রচনা করছো।”
এই ক্ষীণ শব্দ, এই প্রথম সফল পরীক্ষা— ব্লকবস্টার স্বপ্নের প্রথম ধাপ।দূরত্ব আর বাধা—সবই এখন কেবল সংখ্যা মাত্র। এবার মানুষ কণ্ঠের জাদু ছুঁতে পারবে, বাতাসের মাধ্যমে।
১৮৭৭ সালের বসন্তে, লন্ডনের ছোট্ট ল্যাবরেটরির সেই তরুণ বিজ্ঞানী—অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল—দূরের কণ্ঠকে কাছে আনতে সক্ষম হয়েছে।
তার প্রথম সফল পরীক্ষা, প্রথম কল, সবই ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে। কিন্তু বেল জানত, এটিই কেবল শুরু।
ল্যাবের জানালার বাইরে রোদ ঝলমল করছিল, বেল খাতা খুলে নিজের নোটে লিখছিল:“একটি শব্দ, একটি সংকেত, বাতাসে ভেসে—মানুষকে একত্রিত করবে।”
তার প্রতিটি পরীক্ষা আরও নিখুঁত হতে লাগল।
তিনি উন্নত মাইক্রোফোন, শক্তিশালী রিসিভার, দীর্ঘ তারের সংযোগ—সবই তৈরি করলেন।
তার লক্ষ্য স্পষ্ট: শহর, দেশ, মহাদেশ—সর্বত্র মানুষ একে অপরের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুক।
১৮৭৭–১৮৮০ সালের মধ্যে টেলিফোন ধীরে ধীরে শহরের মানুষের ঘরে পৌঁছতে লাগল।মহিলারা বাজার থেকে ফিরে বাসায় প্রথমবার টেলিফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলল।শিশুরা ঘরে বসে শুনল দূরের কণ্ঠ।বৃদ্ধরা অবাক—এখন তারা খবর পেতে আর দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে না।
একটি ছোট্ট যন্ত্র, যা ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিয়েছিল,
এবার মানুষকে একত্রিত করেছিল এক অদ্ভুত সেতুর মাধ্যমে।দূরের কণ্ঠ যেন সরাসরি হৃদয়ে পৌঁছাচ্ছে।
১৮৯০–১৯০০ সালের মধ্যে টেলিফোন পৌঁছল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ,তারপর আস্তে আস্তে আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার শহরগুলোতেও।
১৮৯৯ সালে প্রথমবার লন্ডন থেকে প্যারিস পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কল সম্পন্ন হলো।
নাবিকরা সমুদ্রের মাঝেই সংকেত পাঠাতে পারল,
সেনারা দূরের স্থানে খবর পেতে পারল।
বাতাসে ভেসে আসা কণ্ঠ মানুষের জীবনকে বদলে দিল—দূরত্ব আর বাধা আর কোনো অর্থ রাখে না।
ছোট্ট ল্যাবরেটরির সেই রাত,যেখানে বেল বলেছিল, “দূরের মানুষ আমার কণ্ঠ শুনুক—তার ছোঁয়া ছাড়া,”আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
টেলিফোন শুধু যন্ত্র নয়, এটি মানুষের আশা, আবেগ ও সংযোগের প্রতীক।
১৮৭৭ থেকে ১৯০০—মাত্র তেইশ বছরে, অ্যালেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল একটি পৃথিবীকে একত্রিত করার সেতু গড়লেন।শব্দ, সংকেত, কণ্ঠ—এখন আর দূরের নয়। মানুষ অনুভব করল, কণ্ঠের জাদু সত্যিই বাতাসে ভেসে যেতে পারে।