ধার করা কম্পিউটার থেকে বিলিয়নিয়ার: বিল গেটসের স্বপ্নযাত্রা
ধার করা কম্পিউটার থেকে বিলিয়নিয়ার: বিল গেটসের স্বপ্নযাত্রা
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেল শহরে জন্ম নেয় এক নরম স্বভাবের, কিন্তু অদ্ভুত কৌতূহলী এক ছেলে—উইলিয়াম হেনরি গেটস তৃতীয়, যাকে আমরা আজ চিনি বিল গেটস নামে।
তার বাবা, উইলিয়াম গেটস সিনিয়র, ছিলেন একজন আইনজীবী; মা, মেরি ম্যাক্সওয়েল গেটস, ছিলেন একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষক।
পরিবারটি ছিল শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত, যেখানে শৃঙ্খলা, বইপড়া ও শেখার আগ্রহকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হতো।
ছোটবেলা থেকেই বিলের চোখে ছিল প্রশ্ন—
"কেন?" "কীভাবে?" "এটা এমন হয় কেন?"
খেলনা খুলে তার ভেতরের যন্ত্রাংশ দেখাই ছিল তার প্রিয় কাজ।বন্ধুরা যখন বাইরে খেলাধুলা করত, বিল তখন বইয়ের পৃষ্ঠায় ডুবে থাকত।
সে গণিত, যুক্তি আর ধাঁধাঁর ভক্ত ছিল।
১৯৬৫ সালে, বয়স তখন মাত্র ১০।
একদিন তার মা দেখলেন, বিল অঙ্কের বইয়ের মার্জিনে নিজের তৈরি কোনো সংখ্যা পদ্ধতি লিখছে। জিজ্ঞেস করলে সে বলল—“আমি চেষ্টা করছি সংখ্যা দিয়ে চিন্তা করতে, শব্দ দিয়ে নয়।” এই উত্তর শুনে মা অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু বুঝেছিলেন—এই ছেলেটার চিন্তা সাধারণ নয়।
১৯৬৮ সালে, বয়স মাত্র ১৩। বিল ভর্তি হয় Lakeside School-এ—একটি অভিজাত প্রাইভেট স্কুল, যেখানে একদিন এক নতুন প্রযুক্তি এসে হাজির হলো: একটি টেলিটাইপ কম্পিউটার টার্মিনাল, যেটি তখন পুরো স্কুলের একমাত্র মেশিন!
সেদিন থেকেই শুরু হয় সেই ইতিহাস— ছোট্ট বিল গেটস আর তার বন্ধু পল অ্যালেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগল সেই মেশিনের সামনে। কেউ জানত না, সেই “ধার করা” কম্পিউটারই একদিন হয়ে উঠবে বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্যের সূচনা বিন্দু।
১৯৬৮ সাল। লেকসাইড স্কুলের এক সাধারণ সকালে হঠাৎই ইতিহাসের সূচনা ঘটে।স্কুল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় এক কোম্পানির সহায়তায় একটি নতুন যন্ত্র নিয়ে আসে— একটি টেলিটাইপ কম্পিউটার টার্মিনাল, যা তখন অত্যন্ত বিরল ও দামী প্রযুক্তি।
ছোট্ট বিল গেটস (বয়স ১৩) আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পল অ্যালেন প্রথমবার যখন মেশিনটির সামনে দাঁড়ায়, তারা যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করে। স্ক্রিনে ঝলমল করছে কয়েকটি অক্ষর, আর কী-বোর্ডে চাপ দিলেই সাড়া দিচ্ছে পুরো সিস্টেম। বিলের চোখে তখন এক অপূর্ব আলো—“এই মেশিন দিয়ে পৃথিবী বদলে দেওয়া যাবে!”
প্রতিদিন স্কুল শেষে তারা চুপিচুপি সেই কম্পিউটারের ঘরে ঢুকে যেত। কখনও রাতভর থেকে যেত, কখনও নতুন প্রোগ্রাম লিখে দেখত। তাদের কাছে এটা খেলার চেয়ে বেশি, যেন ছিল ভবিষ্যতের একটা দরজা।
কিন্তু এই বাড়তি ব্যবহার একসময় ধরা পড়ে যায়। ১৯৭০ সালে, স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়—
তারা নাকি অনুমতির চেয়ে বেশি সময় ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করেছে! শাস্তি হিসেবে তাদের কম্পিউটার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েক মাসের জন্য।
তখনও গেটস থেমে থাকেনি। সে ও পল অ্যালেন মিলে স্থানীয় এক কোম্পানির কাছে যায়— Computer Center Corporation (CCC)। ওই কোম্পানির সার্ভারে তারা প্রোগ্রামিং কাজ করে, আর বিনিময়ে ফ্রি কম্পিউটার সময় ধার দেয়।
এইভাবেই “ধার করা কম্পিউটার” তাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হয়ে ওঠে। তারা শিখে ফেলে কীভাবে কোড লেখা যায়, কীভাবে সফটওয়্যার কাজ করে, আর সবচেয়ে বড় শিক্ষা—“যা নেই, তা ধার করে শেখা যায়—যদি আগ্রহ থাকে।”
১৯৭২ সাল নাগাদ, বিল গেটস ও পল অ্যালেন মিলে ছোটখাটো সফটওয়্যার প্রোগ্রাম লিখে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি শুরু করে দেয়।
বয়স তখন মাত্র ১৭ ও ১৯।কেউ তখনো বুঝতে পারেনি— এই দুই কিশোরের “ধার করা কম্পিউটার শেখা” একদিন তৈরি করবে Microsoft, আর বদলে দেবে পুরো পৃথিবীর প্রযুক্তি ইতিহাস।
১৯৭৩ সাল। বিল গেটস তখন সদ্য স্কুল পেরিয়ে পা রাখছেন বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতে — হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটি যেন একজন সফল আইনজীবী হয়, কিন্তু বিলের মাথায় তখন একটাই ভাবনা — কম্পিউটার, সফটওয়্যার, আর ভবিষ্যৎ।
হার্ভার্ডে পড়লেও গেটসের সময় বেশিরভাগ যেত কম্পিউটার ল্যাবে। বন্ধুরা মজা করে বলত,“বিল, তুমি পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছ, না কম্পিউটার দখল করতে?”
১৯৭৪ সালের এক শীতের রাতে, বন্ধুরা যখন ঘুমাচ্ছিল, গেটস আর তার পুরনো বন্ধু পল অ্যালেন এক সংবাদপত্রে খবর পড়ে চমকে যায় — “Altair 8800” নামে নতুন এক মাইক্রোকম্পিউটার তৈরি হয়েছে, যা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তৈরি।এই খবর তাদের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারা জানত — যদি এই কম্পিউটারের জন্য সফটওয়্যার বানানো যায়, তাহলে এক নতুন যুগ শুরু হবে।
তারা বসে পড়ে প্রোগ্রাম লেখায়। কম্পিউটার না থাকায়, কাগজে পেন্সিল দিয়ে কোড লিখে পরীক্ষা করত! তারা যে সফটওয়্যার বানাচ্ছিল, তার নাম রাখল Altair BASIC।
১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, পল অ্যালেন সফটওয়্যারটি নিয়ে আলবুকার্কে যায়, যেখানে Altair কোম্পানির অফিস। সেখানে প্রোগ্রামটি চালু করে দেখায়, আর সবাই অবাক হয়ে যায় — প্রোগ্রামটি নিখুঁতভাবে কাজ করছে!
সেদিনের সেই সফল প্রদর্শনী বদলে দেয় তাদের জীবন। বিল গেটস তখনই হার্ভার্ড থেকে পড়াশোনা স্থগিত রাখার সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়।
সে বলল, “যদি এখন না ঝুঁকি নিই, তাহলে সারাজীবন ভাবব—‘হয়তো তখন পারতাম।’”
১৯৭৫ সালের এপ্রিলে, তারা দু’জন মিলে প্রতিষ্ঠা করে এক ছোট্ট কোম্পানি— Microsoft (‘Microcomputer’ + ‘Software’ শব্দ দুটি মিলে)।
তাদের প্রথম অফিস ছিল নিউ মেক্সিকোর এক ভাড়া করা ঘরে। ঘরে ছিল দুটি চেয়ার, একটি টেবিল, আর অদম্য বিশ্বাস যে—তারা পৃথিবী বদলে দিতে পারবে।সেই সাহসী সিদ্ধান্তই একদিন বিল গেটসকে বানাবে পৃথিবীর সবচেয়ে তরুণ বিলিয়নিয়ার,আর Microsoft হবে প্রযুক্তির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
১৯৭৫ সালের এপ্রিল, বিল গেটস ও পল অ্যালেন মিলে শুরু করলেন Microsoft।
প্রথম অফিস ছিল নিউ মেক্সিকোর এক ছোট্ট ভাড়া করা ঘরে—একটি টেবিল, দুটো চেয়ার এবং অসীম স্বপ্ন।
Altair 8800 কম্পিউটারের জন্য Altair BASIC সফটওয়্যার বিক্রি।এটি ছিল তাদের প্রথম বড় সাফল্য। ছোট দল, সীমিত অর্থ, কিন্তু অদম্য উদ্যম।
১৯৭৭–১৯৮০ সালের দিকে Microsoft ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। তারা বিভিন্ন কোম্পানির জন্য সফটওয়্যার বানাতে লাগল। বিল প্রতিদিন রাতভর কাজ করতেন, কলেজের ক্লাস মিস করতেন, শুধু একটাই লক্ষ্য—বাজারে আধিপত্য স্থাপন।
১৯৮১ সালে IBM-এর জন্য তৈরি হলো MS-DOS, যা ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ব্যবহার পরিবর্তনের এক বড় হাতিয়ার। বিলের দূরদৃষ্টি ছিল স্পষ্ট—“প্রত্যেক কম্পিউটারে আমাদের সফটওয়্যার থাকা উচিত।”
১৯৮৫ সালে Microsoft বাজারে নিয়ে আসে Windows 1.0, যা গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেসের যুগের সূচনা। কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য এক বিপ্লব। বছরের শেষে, কোম্পানির আকার বড় হয়ে গেছে।বিল গেটস জানতেন—সফলতা একদিনে আসে না। তাই তিনি নিজেকে ও তার দলকে কঠোর পরিশ্রমে আবদ্ধ রাখলেন।
এখন তারা কেবল সফটওয়্যার বিক্রি করছিল না, কম্পিউটার ব্যবহারের ধরনই বদলাচ্ছিল। এই দশকেই বিল গেটস প্রমাণ করলেন—ধার করা কম্পিউটার আর ছোট্ট ঘরও যথেষ্ট, যদি স্বপ্ন ও পরিশ্রম থাকে।
১৯৮৯ সালের দিকে Microsoft মুক্তি দেয় Windows 3.0, যা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত ব্যবহার দুটোতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।একই সময়ে, Microsoft Office Suite বাজারে আসে—যা ডকুমেন্ট, স্প্রেডশিট এবং প্রেজেন্টেশনের জন্য নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে।
১৯৯৫ সালে বিল গেটস বয়স ৩৯ বছর, আর তার সম্পদ পৌঁছে যায় প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে।
সেদিন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়— “Microsoft-এর প্রোগ্রামগুলো এখন বিশ্বের প্রতিটি বড় কম্পিউটারে।”বিল নিজে বলেছেন— “আমি ধনী হওয়ার জন্য কাজ করি নি। আমি পৃথিবীর জন্য কিছু তৈরি করতে চেয়েছি।”
এই দশকেই বিল গেটস প্রমাণ করলেন—ধার করা কম্পিউটার থেকে শুরু করে একজন সাধারণ কিশোর হতে পারি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।
২০০০ সাল। বিল গেটস ঘোষণা করলেন যে তিনি ধীরে ধীরে Microsoft-এর দৈনন্দিন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে আসবেন।তার লক্ষ্য এখন বিশ্বকে ভালোভাবে পরিবর্তন করা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচন।
তিনি এবং স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস প্রতিষ্ঠা করলেন Bill & Melinda Gates Foundation।এই ফাউন্ডেশন বছরের পর বছর সারা বিশ্বে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ, রোগ প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে।
ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মহাদেশে পোলিও, হাঁচি, ম্যালেরিয়ার মতো রোগের প্রতিষেধক বিতরণে সহায়তা করে। শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার, সফটওয়্যার ও স্কুল প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।
বিল গেটস তার সম্পদের একটি বিশাল অংশ দান করেছেন। তিনি বলেন— “আমি ধনী হওয়ার জন্য কাজ করি নি। আমি যা অর্জন করেছি তা সমাজের জন্য ফিরিয়ে দিতে চাই।”
এই দশকে, বিল গেটস প্রমাণ করলেন— বিলিয়ন ডলার অর্জন শুধু শেষ নয়, বরং সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করাই প্রকৃত সাফল্য।
একটি ধার করা কম্পিউটার, দুই বন্ধুর কৌতূহল, অসীম পরিশ্রম— সব মিলিয়ে তৈরি করল বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী প্রযুক্তি সাম্রাজ্য, যা শুধুমাত্র ধনী নয়, বরং মানবকল্যাণের জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠল।