পৃথিবী নয়,সূর্যই কেন্দ্র : জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাসের সংগ্রামের কাহিনি
পৃথিবী নয়,সূর্যই কেন্দ্র : জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাসের সংগ্রামের কাহিনি
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৪৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, পোল্যান্ডের ছোট শহর টোরুন-এ জন্ম নিল এক শিশু, যাকে একদিন পুরো বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে হবে। তার নাম ছিল নিকোলাস কোপারনিকাস।
তার বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী, মা ছিলেন শিক্ষিত ও ধর্মপরায়ণা। ছোটবেলা থেকেই কোপারনিকাসের চারপাশে চলতে লাগল বিদ্যুৎপ্রদর্শনী—পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, বাজারের কোলাহল, নদীর তীরের সবুজ, আকাশের অসীম নীল।
কিন্তু তার চোখে সবচেয়ে বেশি আলো ফেলত রাতের আকাশ।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ছোট নিকোলাস ছাদের ওপর উঠে বসত। হাতের আঙুল দিয়ে তারা গুনত, চাঁদের বিভিন্ন রূপের কল্পনা করত। বন্ধুরা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকত, কিন্তু সে বসে থাকত নীরব— তার মনে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন জন্ম নিত, যা তাকে সারাজীবন ছুঁড়ে ধরে রাখত—“এই অসংখ্য তারা কী আমাদের চারপাশে ঘোরছে, না কি আমরা ঘুরছি তাদের চারপাশে?”
শৈশবেই সে দেখল, জ্ঞান কেবল পড়াশোনায় নয়—প্রকৃতির পর্যবেক্ষণেও লুকিয়ে থাকে।
নদীর বয়ে চলা, বাতাসের দোলা, সূর্যের ওঠা-আসা—সবই তাকে শেখাত ঘূর্ণন, কক্ষপথ এবং নিয়মের কাহিনি। এই কিশোর ছোটবেলা থেকেই মনে করত, “একদিন আমি এই আকাশের রহস্যকে মানুষের কাছে প্রকাশ করব।”
১৪৯১ সালের কথা, নিকোলাস কোপারনিকাস তখন মাত্র ১৮ বছর বয়সী কিশোর।
তার চোখে জিজ্ঞাসা আর কৌতূহলের অগ্নি জ্বলে উঠেছিল। টোরুনের ছোট শহর তাকে আর সীমিত রাখতে পারত না। তাই সে পাড়ি দিল ক্রাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে— পোল্যান্ডের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে গাণিতিক জ্ঞান, দর্শন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখানো হত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই কোপারনিকাস মনে করল, শিক্ষার জগৎ হলো এক নতুন আকাশের মতো। শ্রেণিকক্ষের প্রতিটি পাঠ, প্রতিটি আকারের নকশা, প্রতিটি জ্যামিতিক রेखা—সবই তাকে নতুন চিন্তার দিকে টেনে নিত। শ্রেণিকক্ষে বসে সে শুধু সূত্র শিখত না, বরং ভাবত—“এই সূত্রগুলো কি প্রকৃতির রহস্যের অর্ধেকও বুঝতে পারছে?”
পোল্যান্ডে কয়েক বছর কাটানোর পর, কোপারনিকাস আরও বড় জ্ঞানের খোঁজে চলে গেলেন ইতালিতে।
প্রথমে তিনি ভর্তি হলেন প্যাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ইতালির শহরগুলো তখন বৈজ্ঞানিক চিন্তায় জ্বলে উঠছিল—দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান ও আকাশের রহস্য একসাথে চলত।
বোলোনিয়ায় তিনি পরিচিত হলেন ডোমেনিকো মারিয়া নভারা (Domenico Maria Novara)-এর সঙ্গে, যিনি ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ।
নোভারা বললেন একদিন, “কোপারনিকাস, আমরা যা দেখি, তা কি সত্যিই বাস্তব? কখনো কি ভেবে দেখেছ, চোখের ভুল আমাদের প্রতারণা করতে পারে?”
এই এক বাক্য কোপারনিকাসের মনের ভিতরে আগুন লাগিয়ে দিল। সে বুঝতে পারল—যদি সূর্যকে কেন্দ্র ধরে মহাবিশ্ব দেখার চেষ্টা করা হয়,তাহলে গ্রহগুলোর গতি সহজে বোঝা যায়,আর পৃথিবীকে কেন্দ্র ধরে রাখলে অসংখ্য জটিলতা দেখা দেয়।
ইতালিতে থাকাকালীন কোপারনিকাস তার গবেষণা আরও গভীরভাবে চালালেন। রাতের আকাশে বসে তিনি গ্রহের অবস্থান, তারা ও চন্দ্রের চলাচল লক্ষ্য করতেন।প্রতিটি গ্রহের পথকে কাগজে চিত্রিত করতেন,সংখ্যার হিসাব মিলিয়ে চলাচলের নিয়ম খুঁজে বের করতেন।
তার নোটবুকগুলো ভরা থাকত সূর্য, চাঁদ, গ্রহ এবং তারাদের হিসাব দিয়ে। প্রতিদিনের রাতের একটুকরো নীরবতা তাকে শিখিয়েছিল— “বিচক্ষণ দৃষ্টিই সত্যকে প্রকাশ করে, ভয় নয়।”
এই সময়ে কোপারনিকাস বুঝলেন, তার আবিষ্কারগুলো সরাসরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
কারণ তখনকার চার্চ ও সমাজ এতটাই রক্ষণশীল,
যে কেউ যদি বলত “পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য নয়”, তাকে ধর্মবিরোধী হিসেবে দেখা হতো।তবু তার মনে বীজ বোনা হলো—একদিন মানুষ বুঝবে, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র।
এই সময়কালে কোপারনিকাস শুধু শিক্ষার্থী নন, বরং এক নিঃসঙ্গ অন্বেষক। যিনি রাতের আকাশের ছায়া ও আলো থেকে মহাবিশ্বের সত্য খুঁজছেন, যিনি দেখেছেন—বিজ্ঞান ও সত্যের জন্য সাহস থাকা আবশ্যক।
পোল্যান্ডে তার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর, নিকোলাস কোপারনিকাস দেশে ফিরে আসলেন।
দিনের পর দিন তিনি কাজ করতেন ধর্মীয় প্রশাসনে, কিন্তু রাত হলেই তার আসল যাত্রা শুরু হত— আকাশের দিকে তাকিয়ে, তার কাগজে গ্রহের গতি আঁকতে আঁকতে।
প্রতিটি রাতের নীরবতা তাকে নতুন ধারণা দিত।
সে লক্ষ্য করল—পৃথিবীকে কেন্দ্র ধরে সব গ্রহের চলাচল ব্যাখ্যা করা কঠিন, তবে যদি সূর্যকে কেন্দ্র ধরা হয়, সব হিসাব নিখুঁতভাবে মিলে আসে।
কোপারনিকাসের হাতে ছিল কেবল প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাগত পুস্তক ও তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ।
তবে তার পর্যবেক্ষণ ছিল নিখুঁত—গ্রহগুলোর প্রতিটি অবস্থান সে কাগজে চিত্রিত করত, চাঁদ ও সূর্যের গতির হিসাব করত, এবং গ্রহগুলোর কক্ষপথের নিয়ম খুঁজতে লাগল।
সে বুঝতে পারল—পৃথিবী ঘুরছে,সূর্য স্থির। এই চিন্তা বিপ্লবী—কারণ এটি পুরো ইউরোপের ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করছে।
দেশে ফিরে, নিকোলাস কোপারনিকাস দিনের আলোয় ছিলেন শান্ত, দায়িত্বশীল প্রশাসক।
প্রশাসনের কাজ—কথায় কথায় কর হিসাব, জমির নথি, রাজ্যের খামার—সব তিনি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতেন। কিন্তু রাত হলেই শুরু হত তার আসল যাত্রা।
প্রদীপের আলো ঝলমল করে ছোট্ট কক্ষে,
তার হাতের নোটবুক খুলে বসতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। গ্রহ, সূর্য, চাঁদ—সবকিছুর পথ তিনি কাগজে অঙ্কিত করতেন।প্রতিটি গ্রহের চলাচল, প্রতিটি তারার অবস্থান—সবই তার ঘন্টাঘর মতো নিখুঁতভাবে পরীক্ষা হতো।
কোপারনিকাস জানতেন, তার তত্ত্ব—পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য স্থির—সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মের বিপ্লব।
যদি কেউ জানতে পারে, তাকে ধর্মবিরোধী বলা হবে, বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। তাই তার গবেষণাকে রাখলেন গোপন,বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহকর্মীদের মাঝে শুধু ছোট ইঙ্গিত রাখতেন।
রাতের অন্ধকারে বসে তিনি লিখতেন, হিসাব করতেন, আবার মুছে ফেলতেন— প্রতিটি হিসাব, প্রতিটি নকশা, যেন তার নিজের হৃদয়ের গোপন কাব্য।
দিনের দায়িত্ব, রাতের গবেষণা—এই দুই জীবনকে মিলিয়ে চললেন কোপারনিকাস। কখনও কখনও তিনি ক্লান্ত, হতাশ।কিন্তু আকাশের অমলিন নিখুঁততা, গ্রহ ও তারাদের ছন্দ তাকে বলত— “সত্যের জন্য ধৈর্য ও অধ্যবসায় অপরিহার্য।”
সে জানতেন, একদিন তার আবিষ্কার প্রকাশ পাবে।
মানুষ বুঝবে—পৃথিবী নয়, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র।
এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র প্রতিশ্রুতি।
কোপারনিকাসের কক্ষ, যেখানে রাতের নীরবতা আর প্রদীপের আলো জ্বলজ্বল করত,সেটিই ছিল তার গোপন ল্যাবরেটরি, যেখানে প্রকৃতির অজানা নিয়ম, মহাকাশের গোপন রহস্য ধীরে ধীরে ফুটে উঠছিল।
প্রতি রাতই ছিল পরীক্ষার রাত। প্রতি গ্রহের অঙ্কন, প্রতিটি হিসাব ছিল এক চ্যালেঞ্জ, এক গোপন যুদ্ধ।আর তার অন্তরের গভীর আশাই তাকে চালিত করত— একদিন সত্য মানুষের চোখে প্রকাশ পাবে।
১৫৩০ সালের দিকে কোপারনিকাস লিখতে শুরু করলেন তাঁর মহান গ্রন্থ— “De Revolutionibus Orbium Coelestium”, যার অর্থ, “খগোলের কক্ষপথের বিপ্লব সম্পর্কে”।
গ্রন্থে তিনি ধীরে ধীরে দেখালেন— পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য স্থির।গ্রহগুলোর চলাচল সহজভাবে বোঝানো সম্ভব।এই ভাবনাই ছিল হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের মূল।
কিন্তু সে জানত, তাঁর ধারণা তৎকালীন সমাজে বিপ্লবী। তাই বইটি প্রকাশের আগে বহুবার সংশোধন করলেন, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন—সত্যের আলো ধীরে ধীরে সমাজে পৌঁছাবে।
এই সময়কালে কোপারনিকাস শিখলেন—বিজ্ঞান ও সত্যের জন্য ধৈর্য, নিঃশব্দ অধ্যবসায় এবং সাহস অপরিহার্য। রাতের আকাশের নীরবতা, গ্রহ ও তারার ছন্দ তাকে বোঝাল— মানুষকে সত্য উপলব্ধি করতে সময় লাগে, এবং সেই সময় আসলে অমর।
তবে নিশ্চিত ছিল এক কথা—একদিন মানুষ বুঝবে, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র,এবং এই ধারণাই হবে পরবর্তী সব জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীর ভিত্তি।
তখনকার ইউরোপে চার্চের কর্তৃত্ব ছিল সর্বোচ্চ।
চার্চের মতে, বাইবেল বলেছে—“পৃথিবীই কেন্দ্র।”
তাই কেউ যদি বলত “সূর্য কেন্দ্র”,তাকে ধর্মবিরোধী বলা হত।
কোপারনিকাস জানতেন,যদি তিনি এখন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেন,তাহলে তাঁকে হয়তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে,যেমন পরবর্তীতে গ্যালিলিওকে দেওয়া হয়েছিল।
তাই তিনি তাঁর গবেষণাকে গোপন রাখলেন।
বন্ধুদের বলতেন, “সত্যকে প্রকাশ করতে হবে, কিন্তু সঠিক সময়ে।”
বছরের পর বছর রাতের নীরবতায় বসে গবেষণা করার পর, কোপারনিকাসের হাতে জমে উঠল এক বিশাল কাজ— এক গ্রন্থ, যা পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার ইতিহাস বদলে দিতে পারত।
তার নাম রাখলেন—“De Revolutionibus Orbium Coelestium”,যার অর্থ: “খগোলের কক্ষপথের বিপ্লব”।
এই গ্রন্থে তিনি ধীরে ধীরে প্রমাণ করলেন—
পৃথিবী নয়, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র।গ্রহ, চাঁদ, এবং সূর্য—সবই স্থির নয়,সবাই সূর্যের চারপাশে ঘোরে।
কিন্তু কোপারনিকাস জানতেন, তার তত্ত্ব তখনকার সমাজে বিপ্লবী।ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের চোখে এটি ধর্মবিরোধী তত্ত্ব। যদি অবিলম্বে প্রকাশিত হত, তার জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারত।
তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে গ্রন্থটি সংশোধন করলেন,
সতর্কভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলেন।
প্রতিটি সংখ্যা, প্রতিটি চিত্র, প্রতিটি ব্যাখ্যা—সবই নিখুঁত হতে হবে।
১৫৪৩ সালের একটি দিন, বয়স প্রায় ৭০, কোপারনিকাস মৃত্যুশয্যায়।কথা আছে, সে প্রথম মুদ্রিত কপি হাতে পেয়েছিলেন,যেন দেখলেন—তার স্বপ্ন ও অধ্যবসায় বৃথা যায়নি।প্রথমবারের মতো সত্য ছড়িয়ে পড়ল মানুষের চোখে।
গ্রন্থটি ছিল শুধুই সংখ্যা ও গ্রাফের সংকলন নয়—
এটি ছিল এক সাহসী মানুষের লড়াই, ধৈর্য, এবং সত্যকে আলো দেখানোর গল্প।
কোপারনিকাসের এই বিপ্লবী তত্ত্ব পরবর্তী জ্যোতির্বিদদের পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়াল।
গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন—সবাই তার কাজের ওপর দাঁড়িয়ে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা গড়ে তুললেন।
তার এই গ্রন্থের প্রকাশ প্রমাণ করল— সত্যকে কেউ চুপ করাতে পারে না।এবং একদিন সব মানুষ সত্যের আলো বুঝবে।
কোপারনিকাসের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তাঁর তত্ত্ব আলো ছড়াতে শুরু করল।গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন—সবাই তাঁর কাজের উপর ভিত্তি করে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান গড়ে তুললেন।মানুষ বুঝতে পারল,পৃথিবী নয়—আমরা সূর্যের সন্তান, সূর্যের চারপাশে ঘুরি।
এভাবেই এক সাহসী মানুষের চিন্তা বদলে দিলো পুরো মানবসভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি।
তিনিই প্রথম মানুষ যিনি মিথ্যা বিশ্বাসের অন্ধকার ভেদ করে সত্যের সূর্যকে দেখিয়েছিলেন।
“যে সত্যে বিশ্বাস রাখে, সে একদিন সূর্যের মতো জ্বলে ওঠে।”— এই কথাটিই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল নিকোলাস কোপারনিকাসের জীবনে।