পেনিসিলিন: ভুলে যাওয়া গবেষণাপাত্রে জন্ম নিল জীবনরক্ষার ঔষধ
পেনিসিলিন: ভুলে যাওয়া গবেষণাপাত্রে জন্ম নিল জীবনরক্ষার ঔষধ
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
বছরটা ছিল ১৯২৮। ইংল্যান্ডের লন্ডনের আকাশে শরতের হালকা মেঘ, হাওয়ায় ঠাণ্ডার ছোঁয়া। শহরের পশ্চিমে অবস্থিত সেন্ট মেরিস হসপিটাল—যেখানে প্রতিদিনই ব্যস্ততা আর গন্ধে মিশে থাকে চিকিৎসা আর বিজ্ঞান।সেখানেই এক কোণে ছোট্ট এক গবেষণাগারে দিনরাত কাজ করতেন একজন নিরলস বিজ্ঞানী—স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং।সেন্ট মেরিস হাসপাতালের গবেষণাগারে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন এক নিঃস্বার্থ বিজ্ঞানী—স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি পেশায় ছিলেন ব্যাকটেরিওলজিস্ট, মানে যিনি ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করেন।অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং সেন্ট মেরিস হসপিটাল মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক ও গবেষক ছিলেন।
তিনি শুধু চিকিৎসক নন, তিনি ছিলেন গবেষকও। অসুস্থ মানুষদের ব্যথা তাঁর মনে গভীর রেখা ফেলেছিল। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন এক ওষুধ আবিষ্কার করা, যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করবে।সেই সময় ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যেমন নিউমোনিয়া, সিফিলিস, টনসিলাইটিস, এবং সেপসিস হাজারো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছিল। চিকিৎসা ছিল সীমিত, মৃত্যুই ছিল প্রায় অনিবার্য পরিণতি।
ফ্লেমিং প্রতিদিনের মতোই তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলেন। তিনি তখন Staphylococcus নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তাঁর ল্যাবরেটরির টেবিলে সারি সারি পেট্রি ডিশ, প্রতিটিতে চাষ করা হয়েছে Staphylococcus নামের ব্যাকটেরিয়া।তিনি পরীক্ষা করছিলেন—কোন পরিবেশে এই ব্যাকটেরিয়া সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে।তাদের বৃদ্ধি ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়।
তবে টানা কয়েক সপ্তাহের নির্ঘুম কাজ শেষে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ছুটি আসন্ন—কিন্তু ফ্লেমিং তখনও ব্যস্ত পরীক্ষায়। তাই কয়েকদিনের জন্য বিশ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ছুটি নেবার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি তাড়াহুড়ো করে ল্যাব গুছাচ্ছিলেন। কিছু পেট্রি ডিশে তখনও কাজ চলছিল।তাই তিনি গবেষণার মাঝে কিছু পেট্রি ডিশ টেবিলেই ফেলে রেখেই ছুটিতে চলে গেলেন। ব্যস্ততার কারণে ডিশগুলো পরিস্কার করার কথা ভুলে গেলেন। পরিস্কার না করে তিনি ছুটি তে চলে গেলেন।
দুই সপ্তাহ পর ছুটি শেষে ফ্লেমিং ফিরে এলেন গবেষণাগারে। টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা পুরনো পেট্রি ডিশগুলো দেখে প্রথমে একটু বিরক্তই হলেন—ধুলো জমেছে, কিছুতে ছাঁচ জন্মেছে। তিনি সেগুলো ফেলে দেওয়ার জন্য হাতে নিলেন একটি ডিশ।
কিন্তু ঠিক তখনই চোখে পড়ল অদ্ভুত এক দৃশ্য।
ছাঁচের আশেপাশে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে, আর অন্য অংশে তারা এখনও জীবিত!
কৌতূহলবশত একটি ডিশ হাতে নিয়ে তিনি তাকালেন মাইক্রোস্কোপের নিচে। আর সেখানেই ঘটল অলৌকিক আবিষ্কার।ডিশের ভেতরে জন্ম নিয়েছিল সবুজাভ এক ছাঁচ (mold), আর আশ্চর্যের বিষয় হলো—যেখানে ছাঁচটি ছিল, তার চারপাশের সব ব্যাকটেরিয়া মরে গেছে!
দেখলেন, সেই সবুজাভ ছাঁচ ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধা দিচ্ছে। তিনি বুঝলেন, ছাঁচ থেকে কোনো এক বিশেষ পদার্থ বের হচ্ছে যা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলছে।
ফ্লেমিং প্রথমে ভাবলেন, হয়তো এটা কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু পুনরায় পরীক্ষা করে তিনি বুঝলেন—এটা কোনো সাধারণ ছাঁচ নয়, এটি এমন কিছু নিঃসরণ করছে যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করছে।
তখনই শুরু হলো তাঁর নিরন্তর অনুসন্ধান। তিনি ছাঁচটির নাম রাখলেন Penicillium notatum, আর সেই আশ্চর্য পদার্থটির নাম দিলেন পেনিসিলিন (Penicillin)।
তখনও হয়তো ফ্লেমিং নিজেও বুঝতে পারেননি যে তাঁর এই “ভুলে ফেলা ডিশ” মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো লিপিবদ্ধ করলেন, গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন—কিন্তু তখনকার অনেক বিজ্ঞানী বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি।
বছর কেটে গেল। পরে দুই বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি (Howard Florey) ও আর্নেস্ট চেইন (Ernst Chain) ফ্লেমিংয়ের কাজকে অনুসরণ করে পেনিসিলিনকে ব্যবহারযোগ্য ওষুধে রূপান্তরিত করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন লাখো সৈনিক আহত হচ্ছিল, তখন পেনিসিলিন তাদের জন্য হয়ে উঠল জীবনরক্ষাকারী আশীর্বাদ।
যে ওষুধ একসময় ভুলে যাওয়া পরীক্ষাগারে জন্মেছিল, সেটাই পরবর্তীতে কোটি কোটি প্রাণ বাঁচালো।
পেনিসিলিনের গল্প আমাদের শেখায়—
জীবনে কোনো কিছুই আসলে “অর্থহীন” নয়। কখনও কখনও একটিমাত্র ভুল, এক মুহূর্তের অবহেলা, কিংবা এক ভুলে ফেলা কাজই ইতিহাসের ধারা বদলে দিতে পারে।
ফ্লেমিংয়ের মতো বিজ্ঞানীরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে সাফল্য সবসময় সচেতন প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং কৌতূহল, পর্যবেক্ষণ, ও অধ্যবসায় মিলেই এনে দেয় প্রকৃত আবিষ্কার।
১৯৪৫ সালে স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং, হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নেস্ট চেইন—এই তিন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁদের অসামান্য অবদানের জন্য।
ভুলে যাওয়া পেট্রি ডিশের সেই ছাঁচ শুধু এক বিজ্ঞানীর সৌভাগ্য নয়, এটি মানবজাতির জন্য ছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত এক আশীর্বাদ।আজও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ পেনিসিলিনের কল্যাণে বেঁচে আছে।
ফ্লেমিংয়ের সেই গল্প আমাদের শেখায়— অবহেলিত মুহূর্তের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সৃষ্টির সম্ভাবনা।
আর যখন মন জাগে অনুসন্ধানে, তখন ভুলও হয়ে ওঠে বিজয়ের সোপান।