বাতাসে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর: রেডিও আবিষ্কারের গল্প
বাতাসে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর: রেডিও আবিষ্কারের গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল, ইতালির এক শান্ত শহর বোলোনিয়ায় জন্ম নেয় এক কৌতূহলী শিশু— গুলিয়েলমো মারকনি। তার বাবা ছিলেন জমিদার, আর মা ছিলেন এক শিক্ষিত আইরিশ মহিলা, যিনি ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে বিজ্ঞান আর সংগীতের প্রতি অনুরাগী করে তোলেন।
মারকনি ছিল আলাদা ধরণের শিশু। যখন অন্য বাচ্চারা খেলাধুলা করত, সে তখন জানালার পাশে বসে ভাবত—“কেন বিদ্যুৎ শুধু তার দিয়ে যায়, বাতাসে কেন নয়?” তার কৌতূহল যেন থামতেই চাইত না।ছোট গুলিয়েলমো খেলাধুলার চেয়ে বেশি ভালোবাসত ইলেকট্রিক তার, ব্যাটারি, আর ঘণ্টার আওয়াজ নিয়ে খেলা করতে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মারকনি খুব বেশি এগোয়নি। সে কোনো নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের বই, পরীক্ষাগার, আর নিজের তৈরি যন্ত্রপাতিই ছিল তার আসল শিক্ষক।
সে পড়ত জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ও হাইনরিখ হার্টজের লেখা বই—যেখানে বলা হয়েছিল যে, “বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
এই কথাটিই যেন তার জীবনের দিক নির্ধারণ করে দেয়।সে বুঝল—যদি এই তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে হয়তো একদিন মানুষ তার ছাড়াই কথা পাঠাতে পারবে!
রাতে ছাদের ওপর তারার দিকে তাকিয়ে সে ভাবত, “যদি আমি কোনোভাবে আমার কণ্ঠস্বরকে বাতাসে ভাসাতে পারতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তেও মানুষ শুনতে পেত।”এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় এক তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রম— বেতার যোগাযোগের স্বপ্নযাত্রা।
একদিন, বয়স তখন প্রায় ১০। গুলিয়েলমো দেখল, বিদ্যুতের সংযোগে ঘণ্টা বাজছে, কিন্তু তার ছাড়লেই থেমে যাচ্ছে।সে চুপচাপ বলে উঠল—“যদি এই ঘণ্টা আমি দূর থেকে বাজাতে পারতাম?”
বাবা হেসে বললেন, “তাহলে তো তুমি জাদুকর হয়ে যাবে!” আর সেই হাসিটাই যেন মারকনির মনের গভীরে এক স্বপ্নের বীজ বপন করল।
১৮৮০-এর দশকে গুলিয়েলমো যখন কিশোর, তখন ইউরোপে অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন বিদ্যুৎ ও তরঙ্গ নিয়ে।জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৬৫ সালে প্রমাণ করেছিলেন যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে,আর হাইনরিখ হার্টজ ১৮৮৮ সালে প্রথম সেই তরঙ্গ সৃষ্টি করে দেখালেন যে, সত্যিই তা সম্ভব।
মারকনি সেই খবর শুনে বিমুগ্ধ হয়ে গেল। সে ভাবল—“যদি এই তরঙ্গ সত্যিই বাতাসে যেতে পারে, তাহলে কি আমি একটা সংকেত পাঠাতে পারি কোনো তার ছাড়াই?”এই ভাবনাই তাকে রাত জেগে কাজ করতে বাধ্য করল।
১৮৯১ সালে, বয়স তখন ১৭। সে ভর্তি হয় ইতালির লিভর্নোর একটি টেকনিক্যাল স্কুলে।ক্লাসের পড়া তার কাছে যত না গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের তৈরি ছোট্ট পরীক্ষাগার।রাতের পর রাত সে ব্যাটারি, তার, কয়েল আর ধাতব প্লেট নিয়ে পরীক্ষা করত।
একদিন তার মা দেখে ফেললেন ছেলেকে রাত জেগে কাজ করতে। মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,“তুমি ঘুমাও না কেন, গুলিয়েলমো?”সে মাথা তুলে বলল,“মা, আমি চাই আমার কণ্ঠ যেন একদিন বাতাসে উড়ে অন্যের কাছে পৌঁছে যায়।”মা চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে—যেন বুঝে ফেললেন, এই ছেলেটি একদিন ইতিহাস বদলে দেবে।
১৮৯৪ সাল। ইতালির বোলোনিয়া শহর তখনো শান্ত, প্রাচীন সৌন্দর্যে ঘেরা। কিন্তু সেই শহরের এক পুরনো বাড়ির ছাদের ঘরে রাতের পর রাত জ্বলছে একটি বাতি— বসছে এক তরুণ, নাম তার গুলিয়েলমো মারকনি।
চারদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু কাগজের পাতায় ছাপা সূত্র, টেবিলের উপর তারে জড়ানো ব্যাটারি, আর মাঝে মাঝে স্ফুলিঙ্গের ঝলকানি।
তার চোখে ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই—শুধু এক অদ্ভুত তৃষ্ণা।বাতাসের নিঃশব্দ ফাঁকে সে যেন শুনতে পায় নিজের মনের ডাক—“শব্দ কি সত্যিই বাতাসে ভেসে যেতে পারে?”
মারকনির মনে এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই দুটি নাম—জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ও হাইনরিখ হার্টজ।ম্যাক্সওয়েল তত্ত্ব দিয়েছিলেন, আর হার্টজ প্রমাণ করেছিলেন যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বাতাসে চলতে পারে।কিন্তু সেই তরঙ্গে কথা বা সংকেত পাঠানো—এখনও কেউ পারেনি।তরুণ মারকনি সিদ্ধান্ত নিল— “আমি পারব।”
সে নিজের বাড়ির অ্যাটিক ঘরটিকে বানাল ছোট্ট এক পরীক্ষাগারে। মা চুপচাপ দেখে যান ছেলেকে—রাতভর কাজ করছে, চোখে তীব্র আগ্রহ। একদিন মা জিজ্ঞেস করলেন,“গুলিয়েলমো, তুমি এত রাত জেগে কি খুঁজছো?”সে হাসল হালকা করে, “আমি খুঁজছি এমন এক পথ, যেখানে কথা যাবে তার ছাড়াই... বাতাসের বুক বেয়ে।”
মা কিছু না বলে কাছে এসে তার মাথায় হাত রাখলেন।তাঁর চোখে ভেসে উঠল গর্ব আর মায়া—যেন তিনি বুঝে ফেলেছেন, ছেলেটির স্বপ্ন একদিন পৃথিবী বদলে দেবে।
দিন যায়, রাত আসে।মারকনির টেবিলের উপর জমে যায় ব্যর্থ যন্ত্রের টুকরো, কিন্তু তার মনে জমে না হতাশা।প্রতিটি ব্যর্থতা যেন তাকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
১৮৯৪ সালের শেষের দিকে, এক রাতে সে যখন যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা করছে, হঠাৎ দূরে ছোট্ট একটি ঘণ্টা বাজল।মারকনির চোখে ঝলমল করে উঠল বিজয়ের আলো।সে বুঝল—বাতাস তার বার্তা বহন করেছে!যদিও সেটা তখনো খুব ক্ষীণ সংকেত,
তবুও সেটাই ছিল মানব ইতিহাসে বেতার যোগাযোগের প্রথম আলোছায়া।
সেই ছাদের ঘরেই জন্ম নিল এক স্বপ্নের বীজ,
যা একদিন ফুটে উঠবে মানব সভ্যতার সবচেয়ে জাদুকরী ফুলে— রেডিওর আবিষ্কার।
১৮৯৫ সাল।ইতালির আকাশে বসন্তের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়ের ঢালে নরম ঘাসের গন্ধ, পাখির ডাকে মুখরিত সকাল।আর সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেই, বোলোনিয়ার উপকণ্ঠে এক পুরনো বাড়ির বাগানে, এক তরুণ ব্যস্ত তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায়।তার নাম গুলিয়েলমো মারকনি। বয়স মাত্র একুশ, মুখে কিশোরের সরলতা, চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
ইতালির বোলোনিয়া শহরের প্রান্তে, এক পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত মারকনি পরিবারের পুরনো বাড়ি।
বাড়ির পেছনে বিশাল এক বাগান—সবুজ ঘাসে মোড়া, মাঝে মাঝে পাখির কিচিরমিচির, আর দূরে ঝলমল করছে নীল আকাশ।
সেই বাগানেই, ১৮৯৫ সালের এক ঠান্ডা সকালের দিকে, এক তরুণ ছেলেটি মাথা নিচু করে কিছু নিয়ে কাজ করছে।তার চোখে কৌতূহল, মুখে অদ্ভুত মনোযোগ। সে আর কেউ নয়—গুলিয়েলমো মারকনি।
তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে তার, ব্যাটারি, ধাতব পাত, কয়েল, আর কাগজে লেখা অজস্র নোট।
মাঝেমাঝে বাতাসে হালকা স্ফুলিঙ্গের গন্ধ ভেসে আসে।
হঠাৎ ঘরে ঢুকল তার মা, অ্যানি জেমিসন।
“গুলিয়েলমো, তুমি এখনো এই যন্ত্র নিয়ে বসে আছো? সকালের খাবার খাওনি!”ছেলেটি মাথা না তুলে শান্ত গলায় বলল,“মা, আজ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আজ যদি আমার হিসাব ঠিক হয়, তাহলে আমি ঘণ্টা বাজাতে পারব... তার ছাড়াই।”
মা হেসে বললেন,“তুমি যদি পারো, তবে এটা হবে জাদু।”মারকনি চোখ তুলে হালকা হাসল,“না মা, এটা জাদু নয়—এটা বিজ্ঞান।”
কয়েক ঘণ্টা পর, বাগানে সাজানো হলো পরীক্ষার মঞ্চ।মারকনি যন্ত্রটা বসাল একদিকে, আর তার ভাই আলফনসো গেল বাগানের অপর প্রান্তে—দূরত্ব প্রায় একশো গজ।আলফনসোর হাতে ছোট্ট ঘণ্টা আর রিসিভার।
মারকনি চিৎকার করে বলল,“দেখো, যদি ঘণ্টা বাজে, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসো!”দূর থেকে ভাই হাত নাড়ল সম্মতির ইঙ্গিতে।চারদিক নিস্তব্ধ—শুধু পাখির ডাক, আর হালকা বাতাসে পাতার সোঁ সোঁ শব্দ।
মারকনির হৃদয় তখন ধকধক করছে।কাঁপা হাতে সে যন্ত্রের সুইচে আঙুল রাখল।এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল।তারপর—ক্লিক!একটি স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে দূর পাহাড়ের ওপার থেকে শোনা গেল ঘণ্টার শব্দ—
টিং... টিং... টিং!
মারকনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তার চোখে অবিশ্বাস, মুখে বিস্ময়।দূর থেকে ভাই আলফনসো দৌড়ে আসছে—চোখে উচ্ছ্বাস, মুখে হাসি।“গুলিয়েলমো! বেজেছে! ঘণ্টা সত্যিই বেজেছে!”
মারকনি এক মুহূর্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিল গভীরভাবে।তার চোখে যেন জ্বলজ্বল করছে ভবিষ্যতের আলো।“বাতাসে সংকেত পৌঁছেছে... আমি পেরেছি!”তার মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ছেলের মুখের উচ্ছ্বাস দেখলেন,আর চোখের কোনে নীরবে ঝরে পড়ল আনন্দাশ্রু।
সেই দিনে কেউ জানত না,বোলোনিয়ার সেই ছোট্ট বাগানে ইতিহাসের পাতা উল্টে গেছে।মানুষ প্রথমবার শিখেছে বাতাসের বুক বেয়ে বার্তা পাঠানো,আর পৃথিবী ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে রেডিওর জন্মের দিকে।
১৮৯৬ সাল।ইতালির বসন্তকাল তখন শেষের দিকে। গুলিয়েলমো মারকনি নিজের বাড়ির ছাদে বসে চুপচাপ দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাগানের ঘণ্টা বাজানোর সেই পরীক্ষার পর তার মন ভরে গেছে আনন্দে, কিন্তু তবু একধরনের অশান্তি রয়ে গেছে মনে।“আমি দেখিয়েছি এটা সম্ভব, কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে?”
তার এই চিন্তাই যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
ইতালির কয়েকজন বিজ্ঞানীকে সে দেখিয়েছিল নিজের যন্ত্র, কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না।
কারও কারও মুখে বিদ্রুপ—“এই ছেলেটা স্বপ্ন দেখে বাতাসে কথা বলার! পাগল বোধহয়।”মারকনি কষ্ট পেয়েছিল, কিন্তু ভেঙে পড়েনি।সে জানত, সত্যিকারের আবিষ্কারককে প্রথমে সবাই হাসে, পরে সবাই তার নাম মনে রাখে।
১৮৯৬ সালের শুরুর এক সকালে, মা অ্যানি জেমিসন ছেলের ঘরে এলেন।“গুলিয়েলমো, আমি ভেবেছি, আমাদের ইংল্যান্ডে যাওয়া উচিত,” তিনি বললেন শান্ত কণ্ঠে। “তোমার নানার দেশ, সেখানে বিজ্ঞানকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়। হয়তো তারা তোমার কথা শুনবে।”
মারকনি এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।
তার চোখে যেন ঝিলমিল করে উঠল নতুন আশার আলো।
সেই বছরের এপ্রিল মাসে, মা-ছেলে রওনা দিল ইংল্যান্ডের পথে। এক হাতে ছিল যন্ত্রের বাক্স, অন্য হাতে মায়ের আশীর্বাদ।জাহাজ যখন সমুদ্রের ঢেউ কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল, মারকনি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল—“আমি যাচ্ছি এমন এক দেশে, যেখানে হয়তো আমার স্বপ্ন সত্যি হবে।”
লন্ডনে পৌঁছে, কিছুদিনের মধ্যেই সে যোগাযোগ করল ব্রিটিশ পোস্ট অফিসের ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম প্রিস-এর সঙ্গে।প্রিস প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, যখন দেখলেন এক তরুণ তারের ব্যবহার ছাড়াই ঘণ্টা বাজাতে পারছে!
১৮৯৬ সালের মে মাসে, মারকনি লন্ডনের ওয়েস্টব্রুক টাওয়ারে তার যন্ত্র প্রদর্শন করলেন।
ইঞ্জিনিয়ারদের ভিড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
মারকনি যন্ত্রে বোতাম টিপলেন— টিং... টিং... টিং! ঘণ্টা বেজে উঠল।
সবাই স্তব্ধ।তারপর একে একে মুখে বিস্ময়ের হাসি।
কেউ ফিসফিস করে বলল,“এটা তো ভবিষ্যৎ! এই ছেলেটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে!”সেই দিন থেকেই মারকনির নাম ছড়িয়ে পড়ল লন্ডনের বৈজ্ঞানিক মহলে।
১৮৯৬ সালের ২ জুন, গুলিয়েলমো মারকনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দিলেন নিজের আবিষ্কারের পেটেন্ট আবেদন।কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি পেলেন বিশ্বের প্রথম বেতার টেলিগ্রাফের পেটেন্ট।
এই পেটেন্টই ছিল রেডিওর ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
সেদিন রাতে, মোমবাতির আলোয় নিজের নোটবুকে লিখল মারকনি—“আজ আমার স্বপ্ন স্বীকৃতি পেল। কিন্তু আমি জানি, এটাই শুরু—শেষ নয়।”
ইতালির যে তরুণকে একসময় পাগল ভাবা হয়েছিল,সেই ছেলেটিই আজ লন্ডনে বিজ্ঞানীদের চোখে হয়ে উঠল এক বিস্ময়।তার তৈরি যন্ত্র এখন আর শুধু ঘণ্টা বাজাচ্ছে না—এটা একদিন মানুষকে দেশ, ভাষা, সাগর আর সীমান্তের ওপারে যুক্ত করবে।
বোলোনিয়ার সেই বাগানের তরুণের স্বপ্ন এখন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দুনিয়ায়।আর ইতিহাস নিঃশব্দে লিখে রাখছে—১৮৯৬ সালে প্রথমবার, মানব কণ্ঠস্বরের বাতাসে উড়াল শুরু হলো।
এরপর ১৮৯৭ সালে, মারকনি তৈরি করল "Marconi Wireless Telegraph Company", নিজের নামে কোম্পানি।এবার তার লক্ষ্য আরও বড়—সমুদ্রের ওপারে সংকেত পাঠানো।সে জানত, একদিন বাতাসই হয়ে উঠবে বিশ্বের যোগাযোগের সেতু।
তার চোখে ছিল সেই পুরনো স্বপ্ন—“যেদিন মানুষ তার ছাড়াই কথা বলবে, সেদিন পৃথিবী হবে এক পরিবার।”সেই স্বপ্নের শুরু হয়েছিল ছোট্ট এক ঘণ্টার শব্দে,কিন্তু প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে গিয়েছিল গোটা মানবসভ্যতার আকাশে।
লন্ডনে সাফল্যের পর গুলিয়েলমো মারকনির মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—“যদি বাতাসে সংকেত কয়েক কিলোমিটার যেতে পারে, তবে কি সেটা সমুদ্র পেরিয়েও পৌঁছাতে পারবে?”
এটা ছিল এক অকল্পনীয় ভাবনা। সে সময় বিজ্ঞানীরা বলতেন, পৃথিবীর বক্রতার কারণে রেডিও তরঙ্গ অনেক দূর যেতে পারে না।কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেছিলেন—“মারকনি এবার সমুদ্রের ওপারে ভূত পাঠাতে চাইবে!”কিন্তু ইতিহাসে যারা বদলে দেয় পৃথিবীকে, তারা তো এমন কথায় থেমে যায় না।
১৯০০ সালে মারকনি তার ল্যাবরেটরিতে দিন-রাত কাজ করছিলেন। প্রতিদিন নতুন যন্ত্র, নতুন পরীক্ষা—কখনও বাতাসে ঝড়, কখনও ব্যর্থতা।তবুও একরাশ আশায় বলতেন,“বাতাসের কোনো সীমা নেই, তাই মানুষের কথারও সীমা নেই।”
তিনি তৈরি করলেন আরও শক্তিশালী ট্রান্সমিটার, বিশাল অ্যান্টেনা, আর এমন এক রিসিভার যা দুর্বল সংকেতও ধরতে পারে।
তারপর বেছে নিলেন দুটি জায়গা:ইংল্যান্ডের কর্নওয়াল প্রদেশের পোলধু,আর কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড প্রদেশের সেন্ট জনস।
দুটি স্থানের মাঝখানে ছিল প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার সমুদ্র!সবাই বলল, “অসম্ভব।”আর মারকনি মনে মনে বলল, “দেখবে, বাতাসই হবে আমার দূত।”
১২ ডিসেম্বর ১৯০১।সেই সকালটা ঠান্ডায় কাঁপছিল।নিউফাউন্ডল্যান্ডের পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে মারকনি আকাশের দিকে তাকালেন।
বাতাসে ছিল তুষারের গন্ধ।
দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউ গর্জে উঠছে।
তার হাতে একটি মরস রিসিভার, পাশে সহকারী জর্জ কেম্প।তারা দু’জন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে—ইংল্যান্ডের পোলধু থেকে সিগন্যাল আসবে।
একসময় কানে এল ক্ষীণ, কাঁপা কাঁপা এক শব্দ—
“ডিট… ডিট… ডিট…” তিনটি ছোট ডট, মানে ‘S’ সংকেত!
মারকনি চিৎকার করে উঠলেন—“পেয়ে গেছি! আমরা পেরেছি!”তুষারাচ্ছন্ন সেই পাহাড়ে দুজন মানুষ লাফিয়ে উঠল আনন্দে। মানুষের ইতিহাসে প্রথমবার, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে বেতার সংকেত পৌঁছাল।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই পৃথিবী স্তব্ধ।
বিজ্ঞানীরা অবাক—কীভাবে তরঙ্গ পৃথিবীর বক্রতা পেরিয়ে গেল?কেউ কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
কিন্তু মারকনি জানতেন, এটাই নতুন যুগের শুরু।
তিনি বলেছিলেন সাংবাদিকদের,“আজ মানুষ ও সমুদ্রের মধ্যে থাকা নীরবতা ভেঙে গেল।”
এর পরপরই ১৯০২ সালে তিনি আটলান্টিক পাড়ে নিয়মিত বেতার যোগাযোগ শুরু করলেন।
জাহাজে থাকা নাবিকরা এখন খবর পাঠাতে পারত,
সমুদ্রের দুর্ঘটনার খবর পৌঁছাতে পারত তীরের মানুষদের কাছে।মানব সভ্যতা তখন নতুন আলোয় উজ্জ্বল—বাতাসে জন্ম নিল রেডিওর যুগ।
সেই মুহূর্তে হয়তো মারকনি মনে মনে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের বোলোনিয়ার বাগানে,
যেখানে একদিন তিনি ঘণ্টা বাজিয়ে শুরু করেছিলেন এই যাত্রা।আজ সেই ঘণ্টার শব্দ পৌঁছে গেছে সমুদ্রের ওপারে!
বছর কয়েক পর, ১৯০৯ সালে,
গুলিয়েলমো মারকনি পেলেন নোবেল পুরস্কার—
“বেতার যোগাযোগে অবদানের জন্য।”আর পৃথিবী চিরদিন মনে রাখল সেই তরুণকে,যে প্রমাণ করেছিল—“বাতাসে শুধু গন্ধ নয়, স্বপ্নও ভেসে যেতে পারে।”
১৯১০ সালের দিকে, গুলিয়েলমো মারকনির আবিষ্কার মানুষকে এক নতুন যুগে নিয়ে আসে।
আরও শক্তিশালী ট্রান্সমিটার, বিশাল অ্যান্টেনা এবং দূর-দূরান্তের রিসিভার—সবকিছু প্রস্তুত। রেডিও এখন আর শুধু পরীক্ষা বা খেলা নয়, এটা মানুষকে সংবাদ, বিনোদন এবং সংযোগের নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিচ্ছিল।
প্রথমদিকে ইউরোপের শহরে মানুষ রেডিও ক্রয় করল। ব্রিটেনে ঘরবাড়ির জানালায় এখন ঝুলছে ছোট্ট বেতার যন্ত্র। মানুষ শুনছে সংবাদ—দূর দেশে কী ঘটছে, খবর পেয়ে তারা আর অবহেলিত বোধ করছে না।
১৮৯৫–১৯১০ সালের ছোট্ট বাগানের ঘণ্টা থেকে শুরু হয়ে,রেডিওর কণ্ঠ এখন পৌঁছেছে প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রামে।
১৯২০ সালের দিকে আমেরিকায় প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হলো।মানুষ ঘরে বসে শুনতে লাগল গান, নাটক, কাহিনী।বাচ্চারা শুনছে গল্প, বৃদ্ধরা শুনছে খবর,সবাই মুগ্ধ—কণ্ঠ যে বাতাসে ভেসে যেতে পারে!
এমনকি বিশ্বকাপ ফুটবল, অলিম্পিক খেলার খবরও মানুষ রেডিওর মাধ্যমে পেতে লাগল।
রেডিও হয়ে উঠল সকল বয়সের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯২৭–১৯৩০ সালের মধ্যে রেডিও পৌঁছালো দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার কিছু দেশ।
১৯৩১ সালে, মারকনির কোম্পানি প্রথমবার সাগরপথে চলা জাহাজে রেডিও বসাল।
নাবিকরা এখন দুর্ঘটনার সময় সংকেত পাঠাতে পারত,আর পরিবারদের কাছে খবর পৌঁছত ছুটে ছুটে।রেডিও মানুষের জীবনকে বদলে দিল—
মানব সভ্যতার মধ্যে ঘটল এক নতুন একতার অনুভূতি।
১৯০৯ সালে মারকনি পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার,
এবং ১৯৩৭ সালের দিকে তার কোম্পানি পুরো বিশ্বজুড়ে রেডিও সম্প্রচারের প্রভাব বিস্তৃত করেছিল।
তিনি বলেছিলেন—“আমার ছোট্ট বাগানের ঘণ্টা থেকে শুরু হওয়া যাত্রা আজ পৃথিবীকে একত্র করেছে। মানুষ আর দূরে নেই, মানুষ একে অপরের কাছাকাছি।”
১৮৭৪ সালে বোলোনিয়ায় জন্ম নেওয়া এক কৌতূহলী শিশু, ছাদের ঘরে পরীক্ষার যন্ত্র হাতে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল,আজ সেই স্বপ্ন মানুষকে যুক্ত করেছে সারা পৃথিবী জুড়ে কণ্ঠের মাধ্যমে।
রেডিও কেবল প্রযুক্তি নয়— এটি মানুষের আশা, সংযোগ, আবেগের প্রতীক।বাতাসে ভেসে আসা সেই কণ্ঠস্বর আজও আমাদের গল্প শোনায়, জীবনকে করে তোলে আরও কাছে, আরও উজ্জ্বল।
এক তরুণের কৌতূহল, সাহস আর অধ্যবসায় আজ আমাদের পৃথিবীকে করেছে একত্র।
রেডিও শুধু প্রযুক্তি নয়—এ এক আবেগ, এক কণ্ঠের সেতুবন্ধন।
যে স্বপ্ন একসময় মনে হয়েছিল পাগলামি, তা-ই একদিন বদলে দিল যোগাযোগের ইতিহাস।
বাতাসে ভেসে আসা সেই প্রথম কণ্ঠস্বর আজও পৃথিবীর প্রতিটি কোণে গেয়ে চলে মানুষের গল্প, আশা আর জীবন।