মানবতার আহবান: স্বামী বিবেকানন্দের আত্মপ্রেরণার গল্প
মানবতার আহবান: স্বামী বিবেকানন্দের আত্মপ্রেরণার গল্প
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি, কলকাতার এক বাঙালি পরিবারে জন্ম নিল এক অসাধারণ শিশু—বেলুর মঠের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ববিখ্যাত সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন সুপরিচিত আইনজীবী এবং মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণ, জ্ঞানী ও দৃঢ়চেতা নারী। ছোটবেলা থেকেই নরেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, অদম্য কৌতূহল এবং নেতৃত্বের গুণ।
শৈশবে নরেন ছিলেন একেবারেই চঞ্চল ও প্রাণবন্ত। কখনো বন্ধুদের নিয়ে খেলায় মাততেন, কখনো গাছের ডালে বসে ভাবনায় হারিয়ে যেতেন। মায়ের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন “সত্য বলো, কখনো ভয় পেও না”—এই নীতি, যা তাঁর সারাজীবনের আদর্শ হয়ে রইল।
বাল্যকাল থেকেই নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি ছোটবেলায় প্রশ্ন করতেন— “যদি ঈশ্বর থাকে, তবে তাঁকে দেখা যায় না কেন?” এই প্রশ্নে লুকিয়ে ছিল তাঁর ভবিষ্যতের দর্শনের বীজ। ধর্ম তাঁর কাছে ছিল অন্ধ বিশ্বাস নয়, বরং সরাসরি অনুভবের বিষয়।
বিদ্যালয় জীবনে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছাত্র। তিনি সহজেই যেকোনো বিষয় বুঝে ফেলতেন। সংগীত, ব্যায়াম, সাহিত্য, বিতর্ক—সব ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখা যেত। একদিকে যেমন তিনি ভগবদ্গীতা ও উপনিষদের পাঠ করতেন, তেমনি পাশ্চাত্য দর্শনের বইও আগ্রহভরে পড়তেন।
১৮৭৫ সালের দিকে, তিনি ব্রাহ্মসমাজের সভায় যাওয়া শুরু করেন। সমাজ সংস্কার, মানবসেবা ও সত্যের অনুসন্ধানের আদর্শ তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু তাঁর মনে তখনও এক অদম্য তৃষ্ণা—ঈশ্বরকে নিজের চোখে দেখা।
১৮৭৯ সালে, নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই তাঁর ভাবনার জগৎ আরও বিস্তৃত হয়। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার সংঘাত তাঁর মনকে প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে। সেই সময় তিনি জানতেন না, খুব শিগগিরই তাঁর জীবনে আসতে চলেছেন এক মহাপুরুষ—শ্রী রামকৃষ্ণ দেব, যাঁর সান্নিধ্যে তাঁর জীবন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হবে।
এইভাবেই এক কৌতূহলী, সত্যসন্ধানী, প্রাণবন্ত কিশোরের জীবনের প্রথম অধ্যায় শেষ হলো— যেখানে জন্ম নিচ্ছে ভবিষ্যতের “বিবেকানন্দ”— এক আলোর যাত্রী, যিনি শুধু নিজের নয়, সমগ্র মানবতার পথ আলোকিত করবেন।
১৮৮০ সাল। নরেন্দ্রনাথ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বয়স মাত্র সতেরো, কিন্তু তাঁর চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ তখনই আশ্চর্যরকম পরিণত। শিক্ষকরা তাঁকে বলতেন “জীবন্ত বিশ্বকোষ” — কারণ তিনি শুধু মুখস্থ করতেন না, সবকিছুর কারণ জানতে চাইতেন।
যে প্রশ্ন তাঁর অন্তরে ক্রমে আগুনের মতো জ্বলছিল, তা ছিল—“ঈশ্বর আছেন? থাকলে কোথায়? তাঁকে কি দেখা যায়?”
তিনি ধর্মগ্রন্থ পড়তেন, যুক্তি খুঁজতেন, তর্ক করতেন। কিন্তু কোনো উত্তর তাঁকে তৃপ্ত করত না। তিনি ধর্মের নামে কুসংস্কার ও ভণ্ডামি দেখলে বিদ্রোহ করতেন। একদিন এক শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি ঈশ্বরকে খুঁজছো, কিন্তু তুমি কি তাঁকে অনুভব করতে পারবে?” নরেন দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে আমি তাঁকে দেখতেই চাই। কেবল বিশ্বাসে নয়—প্রমাণে।”এই ছিল তাঁর মনের আগুন—সত্যকে চোখে দেখা, জীবনে অনুভব করা।
সেই সময়ই তিনি যোগ দিচ্ছিলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)। পাশ্চাত্য দর্শনের শিক্ষকরা তাঁর মনে নতুন আলো জ্বালালেন। ডেভিড হিউম, স্পেন্সার, ক্যান্ট—এইসব দার্শনিকদের বই তাঁর চিন্তার জগৎকে আলোড়িত করল। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি অনুভব করলেন, যত জ্ঞানই অর্জন করুন না কেন, তাঁর মনের গভীরে এক শূন্যতা রয়ে যাচ্ছে—এক অজানা অভাবের বেদনা।
এই সময়েই এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি প্রথম শুনলেন দক্ষিণেশ্বরের এক পাগল সাধুর নাম—শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। শুনলেন, সেই সাধু নাকি বলেন, “আমি ঈশ্বরকে দেখি, তোমাকেও দেখাতে পারি।”
নরেনের মনে যেন ঝড় বয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, “এমন লোক যদি সত্যিই থাকেন, তবে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে!”
১৮৮১ সালের একদিন, তিনি প্রথম গেলেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে। শীতল বাতাসে ভেসে আসছিল ঘণ্টাধ্বনি, ফুলের গন্ধে ভরে ছিল মন্দিরচত্বর। সেখানে এক সরল, উজ্জ্বল চোখের সাধু তাঁকে দেখে উচ্ছ্বাসে বললেন— “ওহে, তুমি কতদিনে এলে! আমি জানতাম তুমি আসবেই!”
নরেন বিস্মিত। এই মানুষটি তাঁকে চেনেন কীভাবে?
শ্রী রামকৃষ্ণ সস্নেহে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার চেতনার ভেতর আমি সেই ঈশ্বরকেই দেখি, যাঁকে তুমি খুঁজছো।”
সেই মুহূর্তে নরেন্দ্রনাথের ভেতরে কিছু বদলে গেল। যেন মনের জিজ্ঞাসার আগুনের সঙ্গে মিলল শান্তির এক স্নিগ্ধ আলোক।
কিন্তু এই ছিল শুরু—আত্ম-অন্বেষণের, দ্বন্দ্বের, ও সত্যের পথে যাত্রার শুরু।নরেন তখনও জানতেন না— এই সাধারণ গৃহস্থ সাধুই একদিন তাঁর জীবন, তাঁর চিন্তা, আর সমগ্র মানবজাতির পথ পরিবর্তন করে দেবেন।
১৮৮২ সাল—এক ইতিহাসের সূচনা।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে সেই প্রথম সাক্ষাৎ যেন নরেন্দ্রনাথের জীবনের বাঁকবদল। যাঁকে তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এক সাধারণ সাধু, সেই শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস ধীরে ধীরে তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন।
নরেন তখনও যুক্তিবাদী, তর্কপ্রবণ যুবক। তিনি রামকৃষ্ণের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করতেন— “আপনি কি সত্যিই ঈশ্বরকে দেখেছেন?” রামকৃষ্ণ মৃদু হেসে বলতেন, “যতটা স্পষ্ট তোমাকে দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্ট দেখি।”
এই সরল অথচ গভীর উত্তরে নরেন হতবাক হয়ে যেতেন।রামকৃষ্ণ তাঁর মধ্যে চিনতেন এক বিশাল আত্মার সম্ভাবনা। তিনি বলতেন, “নরেন, তোমার মধ্যে আছে অসীম শক্তি। একদিন তুমি সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে।”
রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে নরেনের মধ্যে শুরু হলো ভেতরের রূপান্তর।যে নরেন একসময় যুক্তির আগুনে ধর্মকে বিচার করত, সে এখন অনুভব করতে লাগল ভক্তির মাধুর্য। কিন্তু এই পরিবর্তন সহজ ছিল না—দ্বন্দ্ব চলত ভিতরে ভিতরে। একদিকে তাঁর পশ্চিমা শিক্ষার যুক্তিবাদী মন, অন্যদিকে গুরুর অকপট প্রেম আর ঈশ্বর-অভিজ্ঞতার গভীরতা।
রামকৃষ্ণ তাঁকে শেখালেন—“তুমি ঈশ্বরকে দূরে খুঁজো না, মানুষের মধ্যেই তাঁকে দেখো। দরিদ্র, অসহায়, অসুন্দর—সবাই তাঁর রূপ।”
এই শিক্ষা নরেনের হৃদয়ে গেঁথে গেল। পরবর্তীকালে এই শিক্ষাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠল—“জীবে প্রেমই শিবসেবা।”
১৮৮৫ সালে গুরু অসুস্থ হলেন। দক্ষিণেশ্বরের বদলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো শ্যামপুকুর, পরে কাশীপুরে। নরেন তখন দিনরাত গুরুর সেবা করতেন—ভুলে যেতেন নিজের ক্লান্তি, নিজের জীবন। একদিন রামকৃষ্ণ তাঁকে বললেন,“নরেন, তোমার মধ্যে নারায়ণ আছেন। এখন তুমি এই শক্তি মানবসেবায় বিলিয়ে দাও।”
১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট, শ্রী রামকৃষ্ণ মহাসমাধি লাভ করলেন।সেই দিনটি ছিল নরেনের জীবনের গভীরতম আঘাতের দিন—তাঁর গুরুর দেহ নেই, কিন্তু তাঁর বাণী, তাঁর আলো, তাঁর আদর্শ চিরজীবী হয়ে নরেনের অন্তরে জ্বলতে লাগল।
এই শোকের মাঝেই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন— “গুরুদেব, আমি আপনার কাজ শেষ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেব না। মানবতার সেবাই হবে আমার সাধনা।”
এইভাবেই নরেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যে জন্ম নিল নতুন সত্তা—স্বামী বিবেকানন্দ। গুরুর আলোয় তাঁর আত্মা জেগে উঠল, আর তিনি প্রস্তুত হলেন বিশ্বকে আলোকিত করার জন্য।
গুরু শ্রী রামকৃষ্ণের মহাসমাধির পর, ১৮৮৬ সালের আগস্ট মাসে নরেন্দ্রনাথের জীবন যেন এক বিশাল শুন্যতায় ভরে গেল। প্রিয় গুরুর অনুপস্থিতিতে মনে হলো, পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে। কিন্তু সেই আঁধারেই তিনি খুঁজে পেলেন নতুন আলোর দিশা — গুরুর রেখে যাওয়া আদর্শের পথ।
রামকৃষ্ণ জীবিত থাকতে বলেছিলেন,“নরেন, তোমরা সবাই একসঙ্গে থেকো, গৃহত্যাগ করো, মানবসেবায় জীবন দাও।”এই নির্দেশকে হৃদয়ে ধারণ করেই নরেন শুরু করলেন নতুন যাত্রা।
গুরুর মৃত্যুর পর নরেন ও তাঁর সহসঙ্গীরা কলকাতার বরানগরে একটি ভাঙা বাড়ি ভাড়া নিলেন। সেই ঘরেই প্রতিষ্ঠিত হলো প্রথম রামকৃষ্ণ সংঘ — ভবিষ্যতের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বীজ। দিনে তাঁরা ভিক্ষা করতেন, রাতে জপ, ধ্যান ও ধর্ম আলোচনা। দারিদ্র্য ছিল সঙ্গী, কিন্তু তাঁদের মনে ছিল অদম্য শান্তি ও শক্তি।
নরেন এখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন “স্বামী বিবেকানন্দ” — এক দীক্ষিত সন্ন্যাসী, যাঁর লক্ষ্য আর ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং মানবতার মুক্তি।
১৮৮৭ সালে তিনি ব্রহ্মচার্য প্রতিজ্ঞা নেন, এবং গুরুভাইদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করেন।তিনি তাঁদের শিখিয়েছিলেন — “আমরা গরিব নই। আমাদের মধ্যে আছে অসীম শক্তি। নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে জাগাও, আর সেই শক্তি দিয়ে সমাজকে জাগাও।”
তখন থেকেই তিনি সমাজ, দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর মমতায় ভরে উঠলেন। গুরুর শেখানো এক বাণী তাঁর মনে গেঁথে গেল —“জীবে প্রেম কর, এটাই ধর্ম।”
১৮৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন — এবার তিনি ভারত ভ্রমণে বের হবেন। একা, নিঃস্ব, কেবল গেরুয়া পোশাকে, পায়ে হেঁটে, ভিক্ষার আহারে।তিনি দেখতে চাইলেন — তাঁর দেশের মানুষ কেমন আছে, কীভাবে বেঁচে আছে, তাদের দুঃখ-দুর্দশা কত গভীর।
তিনি মঠের সঙ্গীদের বললেন,“আমি যেতে চাই ভারতের পথে পথে, মানুষের মধ্যে, জীবনের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজতে।”
এইভাবে শুরু হলো স্বামী বিবেকানন্দের তীর্থযাত্রা—
কখনো তিনি রাজপুত্রের অতিথি, কখনো পথের ফকির; কখনো রাজা, কখনো ভিক্ষুকের সহচর।
উত্তর ভারতের হিমালয়, দক্ষিণের মন্দির, পূর্বের সমুদ্রতট—সব জায়গায় তিনি দেখলেন এক গভীর সত্য— দেশের জনগণ দরিদ্র, শিক্ষাহীন, অথচ তাঁদের অন্তরে অগাধ শক্তি লুকিয়ে আছে।এই উপলব্ধিই তাঁর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের ভিত্তি হয়ে গেল— “মানুষই ঈশ্বর, তার সেবাই সর্বোচ্চ পূজা।”
১৮৯০ সালের শেষে তিনি বারানসী থেকে যাত্রা করলেন হিমালয়ের দিকে, নতুন অভিজ্ঞতা আর আত্মশক্তির সন্ধানে। তাঁর এই অভিযাত্রা একদিন তাঁকে পৌঁছে দেবে কন্যাকুমারী, মাদ্রাজ, আর শেষ পর্যন্ত আমেরিকা— যেখানে তিনি ভারতীয় আত্মার জ্যোতি ছড়িয়ে দেবেন বিশ্বমঞ্চে।
১৮৯০ সালের মাঝামাঝি সময়—স্বামী বিবেকানন্দ এখন এক নির্ভীক সন্ন্যাসী, একা পথিক। হাতে গেরুয়া বস্ত্র, কাঁধে জোলার ব্যাগ, পায়ে মাটির ধুলো, হৃদয়ে গুরুর বাণী—“জীবে প্রেমই শিবসেবা।”
তিনি বেরিয়ে পড়লেন ভারতের পথে—মানুষকে জানার, মানুষকে জাগানোর, আর নিজের অন্তরের শক্তিকে আবিষ্কার করার জন্য।
প্রথমে তিনি গেলেন হিমালয়ের গুহায়। সেখানকার তপস্বীরা তাঁকে গ্রহণ করলেন সহৃদয়ে। শীতল পাহাড়ি বাতাসে তিনি ধ্যান করতেন ঈশ্বরের নাম স্মরণে। কিন্তু শীঘ্রই তিনি বুঝলেন—“কেবল গুহায় বসে ঈশ্বর লাভ নয়, মানুষের মাঝে থেকেও তাঁকে পাওয়া যায়।”
এই উপলব্ধি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
তিনি ঘুরলেন নৈনিতাল, হরিদ্বার, ঋষিকেশ, গাজীপুর, বারাণসী, আলাহাবাদ, লখনউ, জয়পুর, রাজপুতানা—প্রতিটি জায়গায় তিনি দেখলেন দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অশিক্ষা।তিনি ব্যথিত মনে বলতেন,“আমার দেশ মায়ের মতো, কিন্তু তাঁর সন্তানরা অশিক্ষায়, অনাহারে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এ জাতি জাগবে কবে?”
এই যাত্রায় তিনি রাজা ও রাণীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, আবার পথের ভিখারির সঙ্গেও খাবার ভাগ করে খান। তাঁর মধ্যে ছিল একই সমবেদনা—
কারণ তাঁর কাছে প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের রূপ।
১৮৯১ সালে তিনি গিয়েছিলেন রাজপুতানার আলওয়ার, কোটা, জয়পুর, এবং পরে মধ্যপ্রদেশে।
রাজাদের সভায় তিনি বলতেন,“ধর্ম শুধু মন্দিরের ভেতর নয়; যদি দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষ তোমার দরজায় দাঁড়ায়, তাকে সেবা করো—সেই সেবাই ঈশ্বরের পূজা।”
এই কথাগুলো রাজা-মহারাজাদের মন কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অনেকে তখন তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি তো যেন জীবন্ত বেদান্তের প্রতীক!”
১৮৯২ সালে তিনি দক্ষিণ ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) তিনি প্রথম দেখলেন শিক্ষিত যুবসমাজ, যারা তাঁর চিন্তায় আলোড়িত হলো। তাঁরা তাঁকে উৎসাহ দিলেন বিদেশে গিয়ে ভারতের মহিমা প্রচার করতে।
১৮৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পৌঁছালেন ভারতের শেষ প্রান্ত—কন্যাকুমারী।সেখানে সমুদ্রের মাঝে এক বিশাল পাথরের ওপর বসে তিনি তিন দিন তিন রাত ধ্যানে মগ্ন রইলেন।তাঁর মনে উথলে উঠল এক দুঃখ ও এক প্রতিজ্ঞা— “এই দরিদ্র, অবহেলিত, অশিক্ষিত মানুষদের আমি জাগাবো। তাদের আত্মশক্তি জাগিয়ে তুলব। ভারতকে আবার বিশ্বগুরু করে তুলব।”
সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিশে গেল তাঁর অন্তরের শপথ। সেই মুহূর্তে জন্ম নিল বিশ্ব-বিবেকানন্দ—এক মহাপুরুষ, যিনি ভারতের আত্মাকে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে দাঁড়াবেন।
১৮৯৩ সালের শুরুতে তিনি ফিরে এলেন মাদ্রাজে। সেখানকার তরুণেরা তাঁকে অনুরোধ করল,“স্বামীজি, আপনি আমেরিকার ধর্মসভায় যান। তাদের দেখান ভারতের প্রকৃত আধ্যাত্মিক শক্তি।”তাঁরও মনে হলো—এটাই গুরুর ইচ্ছা, এটাই মানবতার সেবা।মাদ্রাজের ভক্তরা অর্থসংগ্রহ করে তাঁর যাত্রার ব্যবস্থা করলেন।
১৮৯৩ সালের মে মাসে, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বন্দর থেকে তিনি পাড়ি দিলেন সমুদ্রপথে—এক সন্ন্যাসী, একা, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে অটল। তাঁর গন্তব্য— আমেরিকা, তাঁর লক্ষ্য— বিশ্বকে ভারতীয় ভাবধারার আলোয় জাগানো।
১৮৯৩ সালের গ্রীষ্মকাল। এক তরুণ সন্ন্যাসী, গেরুয়া বস্ত্রে আবৃত, হাতে একটি ছোট লাঠি, চোখে দীপ্ত আত্মবিশ্বাস—আমেরিকার মাটিতে পা রাখলেন।
তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ—ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে World’s Parliament of Religions বা বিশ্বধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে যাত্রা করেছিলেন।
কিন্তু এই যাত্রাপথ এত সহজ ছিল না।
১৮৯৩ সালের মে মাসে, তিনি বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বন্দর থেকে যাত্রা করেন জাপানের নাগাসাকি হয়ে হংকং, কানাডা, তারপর পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। পথে একাধিকবার অসুস্থ হয়েছিলেন, অর্থও ফুরিয়ে গিয়েছিল প্রায়।তবুও তিনি মনে রাখতেন গুরুর বাণী—“যে সত্যের জন্য জন্মেছে, বিশ্ব তার পথ নিজেই তৈরি করে দেবে।”
শিকাগো পৌঁছে নতুন সমস্যা দেখা দিল—সভায় যোগ দিতে হলে আমন্ত্রণপত্র ও সুপারিশপত্র দরকার, আর তাঁর কাছে দুটোই নেই।দরিদ্র সন্ন্যাসী, একা বিদেশে—অপরিচিত ভাষা, অপরিচিত সংস্কৃতি।কেউ তাঁকে চিনত না, সাহায্যও করত না।তিনি প্রায় উপবাস অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন রাস্তায়, যতক্ষণ না মিসেস হেল নামে এক দয়ালু মহিলা তাঁকে আশ্রয় দিলেন।
মিসেস হেলের বাড়িতে থেকে তিনি আবার শক্তি ফিরে পেলেন। তাঁর কথা শুনে আমেরিকানরা মুগ্ধ—তাঁর ইংরেজি ছিল সাবলীল, কিন্তু তার চেয়েও গভীর ছিল তাঁর চিন্তা। শেষমেশ, সোয়েডেনবর্গ সোসাইটি থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র পাওয়া গেল।
এবং সেপ্টেম্বর মাসে, তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হলো—“Hindu Monk from India” হিসেবে।
শিকাগোর Art Institute-এর বিশাল হলঘরে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্বের নানা ধর্মের প্রতিনিধিরা—খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি, বৌদ্ধ, কনফুসিয়ান, শিন্তো—আর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারতের সন্ন্যাসী, স্বামী বিবেকানন্দ। সভা শুরু হলো। একে একে বক্তারা ধর্ম, জাতি, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন।শেষে যখন স্বামীজি উঠলেন, হলঘর নিস্তব্ধ।তিনি মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন—“Sisters and Brothers of America…”
এই ছয়টি শব্দ শুনেই হলঘর যেন বিদ্যুৎপ্রবাহে কেঁপে উঠল। সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগল। করতালি চলল প্রায় দুই মিনিটেরও বেশি সময়!
এই একটি সম্বোধনে তিনি জয় করে নিলেন সমগ্র আমেরিকার হৃদয়। তিনি বললেন—“আমি এক এমন ধর্মের প্রতিনিধি, যা শুধু সহিষ্ণুতাই শেখায় না, বরং সকল ধর্মকে সত্য বলে গ্রহণ করে।”
তিনি বললেন মানবতার ঐক্যের কথা, ধর্মের সার্বজনীন সত্যের কথা।তিনি ঘোষণা করলেন—“যতদিন মানুষ ক্ষুধার্ত, অশিক্ষিত, নির্যাতিত—ততদিন ধর্মের আসল উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না।”
তাঁর বক্তৃতা শেষে জনতা উঠে দাঁড়াল, উল্লাসে, চোখে জল নিয়ে। এক বিদেশি সংবাদপত্র লিখেছিল—“That unknown monk from India stole the hearts of America.”
এই বক্তৃতা শুধু আমেরিকাকেই নাড়া দেয়নি, জাগিয়ে দিয়েছিল নিদ্রিত ভারতকেও।
ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনের ছায়ায় ক্লান্ত। স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠ যেন বাতিঘরের আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল—“উঠো, জাগো, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত থেমো না।”
শিকাগোর সেই দিন থেকে তিনি শুধু একজন সন্ন্যাসী নন—তিনি হয়ে উঠলেন এক জাতির আত্মা, এক নবজাগরণের প্রতীক, এক বিশ্বগুরুর কণ্ঠস্বর।
১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে যে তরুণ সন্ন্যাসী বিদেশের মঞ্চে “ভাই-বোনেরা” বলে বিশ্বকে এক পরিবারের মতো দেখেছিলেন, তিনি প্রমাণ করে দিলেন—
সত্যিকারের ধর্ম হলো মানবপ্রেম, আর সত্যিকারের দেশপ্রেম হলো মানবসেবা।
শিকাগোর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর, বিশ্ব যেন নতুন করে চিনল ভারতের নাম।যে দেশকে অনেকেই তখন দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের অন্ধকারে ঢাকা ভাবত, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণীতে দেখালেন—ভারত হল আধ্যাত্মিকতার সূর্যোদয়ভূমি।১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত এই চার বছর ছিল তাঁর জীবন ও বিশ্ব ইতিহাসে এক উজ্জ্বল যুগ—বিবেকানন্দের আলোর যুগ।
শিকাগোর ধর্মসভা শেষে তিনি আমেরিকার নানা শহরে বক্তৃতা দিতে লাগলেন—ডেট্রয়েট, বস্টন, নিউ ইয়র্ক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
হাজারো মানুষ তাঁর কথা শুনতে আসত।
তাঁর গভীর কণ্ঠ, সহজ যুক্তি ও প্রেমভরা দৃষ্টি আমেরিকান শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করত।
তিনি বলতেন—“ধর্ম মানে কুসংস্কার নয়, ধর্ম মানে মানবপ্রেম।” “যে মানুষ ক্ষুধার্ত, তার কাছে ঈশ্বর রুটির রূপে আসেন।”
তাঁর বক্তৃতায় মানুষ বুঝতে শিখল—ভারতীয় দর্শন মানে কেবল ধ্যান বা যোগ নয়, বরং মনুষ্যত্বের বিজ্ঞান।
তাঁর ছাত্র ও অনুসারীরা তাঁকে ভালোবেসে বলত, “The Cyclonic Monk”—অর্থাৎ এক ঝড়ের মতো আগত সন্ন্যাসী, যিনি অল্প সময়ে মানুষের মন পাল্টে দিচ্ছেন।তিনি পশ্চিমাদের শেখালেন,“বাহ্যিক উন্নতি ভালো, কিন্তু আত্মার উন্নতি ছাড়া সভ্যতা টেকে না।”
আর একই সঙ্গে তিনি ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা নিজের শক্তি চিনতে শেখো। তোমরা যে জাতির সন্তান, সে জাতি যুগে যুগে বিশ্বকে জ্ঞান দিয়েছে।”এই দুই দিকের বার্তাই তাঁকে করল পূর্ব-পশ্চিমের সেতুবন্ধন।
১৮৯৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন Vedanta Society of New York—যার মাধ্যমে আমেরিকায় প্রথম সংগঠিতভাবে ভারতীয় দর্শনের প্রচার শুরু হয়।
তাঁর বক্তৃতা ও শিক্ষায় পশ্চিমা দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকরা প্রভাবিত হয়েছিলেন।বিশ্ব জানতে পারল—ভারতের সত্যিকারের সম্পদ তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও মানবতার আদর্শ।
তিনি বলতেন,“জ্ঞানই মুক্তি, কিন্তু সেই জ্ঞান যদি সেবায় না আসে, তবে তা অন্ধকার।”
বিদেশে সাফল্যের শীর্ষে থেকেও তাঁর হৃদয় সারাক্ষণ কাঁদত নিজের দেশের জন্য। চিঠিতে তিনি লিখতেন—“আমার দরিদ্র দেশবাসী যেন শিক্ষা পায়, শক্তি পায়—এটাই আমার প্রার্থনা।”তিনি ভক্তদের বলতেন,“যদি তোমরা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হও, তবে প্রথমে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখো।”তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা, প্রতিটি লেখাই ছিল দেশজাগরণের আহ্বান।
১৮৯৬ সালের শেষে তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করলেন—ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি।
সেখানে তিনি অসংখ্য শিষ্য তৈরি করলেন—মিস মার্গারেট নোবেল (পরবর্তীকালে সিস্টার নিবেদিতা) তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি অবশেষে ফিরে এলেন ভারতে।যেদিন তাঁর জাহাজ কলকাতার বন্দরে পৌঁছাল, হাজারো মানুষ সমুদ্রতীরে তাঁকে বরণ করতে এলো।সেই দিনটি যেন এক মহাজাগরণের দিন।তিনি বললেন—“আমি ভারতের যুবকদের বলছি—নিজের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে নাও, নিজের শক্তি চিনে নাও, জাগো!”সেই আহ্বানেই শুরু হলো ভারতের নতুন অধ্যায়—এক নবজাগরণের অধ্যায়।
১৮৯৩ থেকে ১৮৯৭—এই কয়েক বছরেই স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের আত্মাকে তুলে ধরলেন বিশ্বমঞ্চে। তিনি প্রমাণ করলেন,“ধর্ম মানে বিভেদ নয়, ঐক্য;শক্তি মানে যুদ্ধ নয়, প্রেম; আর মানুষ মানে ঈশ্বরের রূপ।”
এই চার বছরে তিনি কেবল বক্তা নন, হয়ে উঠেছিলেন এক আলোর দূত—যিনি পূর্ব ও পশ্চিমকে মিলিয়ে দিলেন মানবতার বন্ধনে।
১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাস। বিদেশভ্রমণ শেষে দীর্ঘদিন পর নরেন্দ্রনাথ, এখন স্বামী বিবেকানন্দ, ফিরে এলেন নিজের মাতৃভূমি—ভারতে। সমুদ্রপথে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) পৌঁছানোর পর হাজারো মানুষ তাঁকে দেখতে ভিড় করল। কেউ তাঁকে অবতার বলল, কেউ জাতির নায়ক। কিন্তু তিনি শান্ত মুখে শুধু বললেন—“আমি তোমাদেরই একজন। আমার জীবন, আমার চিন্তা—সব তোমাদেরই জন্য।”
বিদেশে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা কত সাহসী, কত আত্মবিশ্বাসী। অথচ নিজের দেশ ভারত তখন দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর কুসংস্কারের জালে জড়ানো। কুসংস্কার, জাতিভেদ, দারিদ্র্য—সব মিলিয়ে যেন এক গভীর অন্ধকার।
কলকাতায় ফিরে তিনি বললেন—“দেশের মাটি পবিত্র, এর প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের রূপ। যদি তোমরা মানুষকে ভালোবাসতে না শেখো, তবে মন্দিরে পূজা করে লাভ নেই।”তাঁর কণ্ঠে যেন বজ্রের মতো আহ্বান—“উঠ, জাগো, আর লক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত থেমো না!”
১৮৯৭ সালের ১লা মে, স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন। তিনি বলতেন,“ধর্ম মানে কেবল প্রার্থনা নয়—ধর্ম মানে মানুষের সেবা।”এই মিশনেই পরে শুরু হলো স্কুল, আশ্রম, হাসপাতাল—যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনো ভেদাভেদ ছিল না।
বিবেকানন্দের চোখে দেশের ভবিষ্যৎ ছিল যুবকের হাতে। তিনি বলেছিলেন—“আমার একশত নিষ্ঠাবান, নির্ভীক যুবক দাও, আমি ভারতকে বদলে দেব।”তাঁর কথা শুনে অনেক তরুণ ভেতর থেকে কেঁপে উঠেছিল, যেন ঘুম ভাঙল এক নতুন শক্তির।
দেশের গ্রামে গ্রামে, শহরের পথে পথে তিনি ঘুরে বেড়ালেন— কখনো বক্তৃতা দিলেন, কখনো দরিদ্রের কুটিরে বসে তাদের খোঁজ নিলেন।
তিনি বুঝেছিলেন—জাতি জাগে যখন মানুষ নিজের শক্তিকে চেনে।
১৮৯৯ সালে বেলুড়ে তিনি স্থাপন করলেন বেলুড় মঠ, যেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের মূল কেন্দ্র গড়ে ওঠে। সেখানে তিনি বলতেন—“সন্ন্যাসী মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, মানে মানুষের সেবা।”
দেশ তখনও স্বাধীন নয়, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে জেগে উঠেছিল এক স্বাধীনতার দীপ্তি— “ভারত একদিন জেগে উঠবে, কারণ এটি ধর্মের ভূমি, মানবতার ভূমি!”
১৯০১ সালে তাঁর দেহ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়লেও মন ছিল আগের মতোই অগ্নিসম। তিনি বলতেন, “আমার মৃত্যুর পরও আমি কাজ করব—প্রত্যেক তরুণের হৃদয়ে।”
১৯০২ সাল। বেলুড় মঠ তখন শান্ত, সবুজে ঘেরা এক আধ্যাত্মিক আশ্রম। গঙ্গার জলে ভাসছে সূর্যের সোনালি আলো। মঠের এক কক্ষে বসে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ—চোখে গভীর প্রশান্তি, মুখে মৃদু হাসি। শরীর তাঁর দুর্বল, কিন্তু মন জাগ্রত, দৃঢ়, অটল।
তিনি জানতেন—জীবনের যাত্রা শেষের দিকে, কিন্তু তাঁর কাজ এখনো থামেনি। শিষ্যদের বলেছিলেন— “আমি দীর্ঘজীবন চাই না। আমার কাজ শেষ হলে আমি চলে যাব। কিন্তু আমার আত্মা বেঁচে থাকবে, তোমাদের প্রতিটি হৃদয়ে।”
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে, তিনি নিয়মিতভাবে ধ্যান করতেন, শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন, আর মাঝে মাঝে বলতেন—“আরও মানুষকে জাগাও। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দাও। মানুষকে বোঝাও, সে নিজেই ঈশ্বরের মন্দির।”
তিনি নিজের মৃত্যুর দিনটি যেন আগেই জানতেন। ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই সকালে তিনি স্বাভাবিকভাবেই স্নান করলেন, ভক্তদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করলেন, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে ধ্যানে বসে পড়লেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। নীরব মঠের আকাশে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। সেই সময়ই, গভীর ধ্যানের মধ্যে, স্বামী বিবেকানন্দ মহাসমাধি লাভ করলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর।
তাঁর দেহ চলে গেল, কিন্তু তাঁর বাণী যেন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। “উঠ, জাগো, আর লক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত থেমো না”—এই আহ্বান ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে, সারা বিশ্বে।
যুবকরা তাঁকে দেখল আদর্শ হিসেবে, দুঃখীরা দেখল আশার আলো হিসেবে, চিন্তাবিদরা দেখল এক নতুন যুগের পথপ্রদর্শক হিসেবে। রামকৃষ্ণ মিশন তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে লাগল— অসহায়কে সেবা, অজ্ঞকে শিক্ষা, সমাজে ঐক্যের বাণী প্রচার।
আজও যখন কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, দুঃখীর পাশে গিয়ে বসে, নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনে নেয়— তখন স্বামী বিবেকানন্দের সেই অমর বাণী কানে বাজে—“তুমি দুর্বল নও। তুমি ঈশ্বরের সন্তান। নিজের শক্তিকে চিনে নাও, আর পৃথিবী বদলে দাও।”
তিনি শিখিয়েছিলেন— ধর্ম মানে ভয় নয়, ভালোবাসা; দেশপ্রেম মানে ঘৃণা নয়, মানবসেবা;
আর সত্যিকারের শক্তি আসে আত্মবিশ্বাস থেকে।
তাই তিনি নেই, অথচ সবখানেই আছেন— যে তরুণ নিজের স্বপ্নের জন্য লড়ছে, যে শিক্ষক শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, যে মানুষ দুঃখীর মুখে হাসি ফোটাচ্ছে—
সেই প্রতিটি হৃদয়ে আজও জ্বলে বিবেকানন্দের চিরজাগরণের আলো।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন শুধু এক সন্ন্যাসী নন,
তিনি ছিলেন জাগরণের দূত, যিনি শেখালেন— “নিজেকে চেনো, নিজের ভেতরের আলো জ্বালাও,
তবেই তুমি বিশ্বকে আলোকিত করতে পারবে।”
তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, মানুষের সেবা মানেই ঈশ্বরের সেবা, আর আত্মবিশ্বাসই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।আজও যখন কেউ হতাশ হয়, ভয় পায়,
তখন বিবেকানন্দের সেই একটাই আহ্বান কানে বাজে—“জাগো, উঠো, লক্ষ্য না পাওয়া পর্যন্ত থেমো না।”