মায়ের হাতে তৈরি মিষ্টি থেকে মিলিয়ন ডলার: ডেবি ফিল্ডসের সাফল্যের গল্প

06 Oct 2025 03:40:22 PM

মায়ের হাতে তৈরি মিষ্টি থেকে মিলিয়ন ডলার: ডেবি ফিল্ডসের সাফল্যের গল্প

  • মোঃ জয়নাল আবেদীন 

 

  ১৯৫৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া শহরে জন্ম নেয় এক মিষ্টি-স্বভাবের মেয়ে—ডেবি ফিল্ডস। তার পরিবার ছিল সাধারণ, বাবা ছিলেন একজন নেভি মেকানিক, মা ছিলেন গৃহিণী। সংসারে অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও, মা সবসময় চেষ্টা করতেন ঘরকে ভালোবাসা ও মিষ্টির ঘ্রাণে ভরিয়ে রাখতে।

ছোটবেলা থেকেই ডেবি মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। মা যখন চুলায় কুকি বেক করতেন, তখন ছোট ডেবি মুগ্ধ হয়ে দেখতেন সেই প্রক্রিয়া—কীভাবে ময়দা, চিনি আর ভালোবাসা মিলে এক টুকরো মিষ্টি সুখ তৈরি হয়।

ডেবি ফিল্ডস তখন ছোট্ট এক মেয়ে—বয়স মাত্র ৮ বছর (১৯৬৪ সাল)। বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে সে ছুটে যেত রান্নাঘরে।সেখানে মা, মিসেস নরিন, এপ্রোন পরা অবস্থায় ব্যস্ত থাকতেন— ময়দা ছেঁকে নিচ্ছেন, মাখন গলাচ্ছেন, আর মিষ্টি কুকির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ঘরে।

রান্নাঘরটা যেন ছিল ছোট্ট এক জাদুর রাজ্য।  ডেবি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত— কীভাবে সাধারণ উপকরণ একসঙ্গে মিশে এক অপূর্ব জিনিসে পরিণত হয়। চুলা থেকে যখন কুকিগুলো বের হতো, তখন তাদের ওপর মাখনের চকচকে স্তর আর গরম ভাপ যেন বলত— “ভালোবাসা দিয়েই তৈরি হয় মিষ্টির আসল স্বাদ।”

একদিন ডেবি মাকে জিজ্ঞেস করল,  — “মা, তোমার কুকি এত সুস্বাদু হয় কেন?” মা হেসে বললেন,“কারণ আমি তাতে ভালোবাসা মেশাই, ডেবি। মনে রেখো, যেকোনো কাজের আসল উপাদান হলো ভালোবাসা।”

সেদিনের এই কথাগুলো ডেবির মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য।তার কাছে কুকি আর কেবল খাবার ছিল না— এটা ছিল মায়ের মমতা, জীবনের শিক্ষা, আর মিষ্টির ভেতর লুকানো প্রেরণার গল্প।

যখনই সে হতাশ হতো বা নিজেকে তুচ্ছ ভাবত,
সে চোখ বন্ধ করে মনে করত সেই ঘ্রাণ—
মায়ের হাতে তৈরি গরম গরম কুকির ঘ্রাণ।
সেই ঘ্রাণ যেন তাকে বলত,“তুমি পারবে, ডেবি। ঠিক যেমন আমি পারি প্রতিদিন নতুন মিষ্টি বানাতে।”

এইভাবেই, মায়ের হাতের মিষ্টি থেকেই জন্ম নেয় এক অদম্য বিশ্বাস— যে ভালোবাসা, অধ্যবসায় ও বিশ্বাস দিয়েই তৈরি হয় জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি সাফল্য।

একদিন, বয়স তখন মাত্র ১০ বছর (১৯৬৬ সাল), মা তাকে প্রথমবার বললেন, “ডেবি, কুকি বানানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো—ভালোবাসা।”

এই একটি বাক্য যেন তার জীবনের দর্শনে পরিণত হয়। ছোট্ট মনের ভেতর তখনই এক বীজ রোপিত হলো—“একদিন নিজের নামে কুকির দোকান খুলব।”

স্কুলজীবনে বন্ধুরা যখন ডাক্তার, শিক্ষক বা গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখত, ডেবি তখনও স্বপ্ন দেখত নিজের কুকি ব্র্যান্ডের। বন্ধুরা হাসত, কেউ বলত, “কুকি বেক করে বড় কিছু হয় নাকি?”  কিন্তু ডেবি নীরবে হাসত। সে জানত, ছোট স্বপ্নও একদিন বড় হয়ে ওঠে, যদি তাতে মায়ের শেখানো ভালোবাসা মিশে থাকে।

এই সাধারণ মেয়েটির সেই ছোট্ট স্বপ্নই পরে তৈরি করবে এক মিলিয়ন-ডলার সাম্রাজ্য—Mrs. Fields Cookies।

 ১৯৭৫ সাল। তখন ডেবি ফিল্ডসের বয়স মাত্র ১৯ বছর। সদ্য হাইস্কুল শেষ করেছেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। পরিবারের সামান্য আয় দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিল।

তবুও তিনি হাল ছাড়লেন না। তিনি চাকরি নিলেন একটি বেসবল টিমে “বল গার্ল” হিসেবে, ঘণ্টায় মাত্র ৫ ডলার বেতনে। সবাই অবাক হলো—একটা সাধারণ মেয়ে, যাকে কোনো বড় চাকরি দেওয়া হয়নি, সে কি করে বড় স্বপ্ন দেখছে!

এই ছোট্ট বেতনের টাকায় তিনি প্রতিদিন কিছু অংশ জমাতে লাগলেন। ওভেন, ময়দা, চিনি, চকোলেট চিপ—এক এক করে জোগাড় করতে লাগলেন নিজের কুকির দোকান খোলার জন্য।

১৯৭৬ সালের দিকে, ডেবি ব্যাংকে গেলেন ঋণ নিতে, মাত্র ২৫,০০০ ডলার চেয়েছিলেন ব্যবসা শুরু করার জন্য। কিন্তু ব্যাংকের কর্মকর্তারা হাসলেন। একজন তো সরাসরি বলেছিলেন, “একটা মেয়ের কুকির দোকান সফল হবে? এটা তো শিশুর খেলা!”

তবুও ডেবি থামলেন না। প্রত্যাখ্যান তাকে আরও শক্ত করে তুলল। তিনি বাড়িতে বসেই নতুন নতুন রেসিপি তৈরি করলেন, বন্ধুদের কুকি খেতে ডাকতেন, তাদের মতামত নিতেন, নোট করতেন।

১৯৭৭ সালের শুরুর দিকে, ডেবি সিদ্ধান্ত নিলেন—চাকরি নয়, নিজের ব্যবসাই হবে তাঁর ভবিষ্যৎ। নিজের সঞ্চিত সামান্য অর্থ এবং স্বামী র‌্যান্ডি ফিল্ডসের সহায়তায় তিনি ভাড়া নিলেন ছোট্ট এক দোকান—পালো অল্টো, ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেই দোকানের নাম রাখলেন ভালোবাসা ভরা এক নামে — “Mrs. Fields Cookies”

প্রথম দিন দোকান খোলার সময় কেউ এল না। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি অপেক্ষা করলেন। অবশেষে এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন — রাস্তায় বেরিয়ে নিজের হাতে বানানো কুকি মানুষকে খেতে দিলেন, বিনামূল্যে।হাসি মুখে বললেন, “একবার খেয়ে দেখুন, তারপর না হয় কিনবেন।”

মানুষ অবাক হলো, কিন্তু প্রথম কামড়ের পরেই হাসল — “এ কুকি তো অসাধারণ!” এভাবেই ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে, ডেবির মায়ের শেখানো ভালোবাসা আর নিজের আত্মবিশ্বাসে শুরু হলো এক মিষ্টি সাম্রাজ্যের যাত্রা।

  ১৯৭৮ সাল। ডেবি ফিল্ডস তখনও তরুণী—বয়স মাত্র ২২। তার ছোট দোকান Mrs. Fields Cookies ধীরে ধীরে মানুষের নজর কাড়তে শুরু করেছে। প্রথম দিকে প্রতিদিনের বিক্রি হতো মাত্র ৭৫ ডলার, যা দিয়ে দোকানের ভাড়া তোলাও কষ্টকর ছিল।

তবুও ডেবি হাল ছাড়লেন না। তিনি প্রতিটি কুকি বানাতেন নিজ হাতে, আর প্রতিটি গ্রাহককে হাসিমুখে আপ্যায়ন করতেন। তার বিশ্বাস ছিল— “মানুষ কুকি কিনতে আসে না, তারা ভালোবাসা খুঁজে আসে।”

এই ভালোবাসাই তার ব্যবসার গোপন রহস্য হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে, Palo Alto-এর মানুষ তার কুকির ভক্ত হয়ে যায়। স্থানীয় সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়— “এক তরুণীর কুকিতে মিশে আছে জাদু!”

 ১৯৮০ সালের মধ্যে, তার দোকান থেকে বিক্রি বাড়তে বাড়তে মাসে কয়েক হাজার ডলারে পৌঁছে যায়। মানুষ শুধু কুকি কিনতে আসত না, তারা অনুভব করতে আসত “Mrs. Fields”-এর উষ্ণতা।

১৯৮১ সালে, ডেবি দ্বিতীয় শাখা খোলেন সান ফ্রান্সিসকোতে। একই বছর, তিনি ব্যবসার নীতি হিসেবে লিখে রাখলেন তিনটি মূল কথা —

  1. Quality (গুণমান)

  2. Friendliness (বন্ধুসুলভ আচরণ)

  3. Love (ভালোবাসা)

তিনি কর্মীদের বলতেন, “যদি হাসি মুখে কুকি না দাও, কুকির স্বাদও মিষ্টি লাগবে না।” ১৯৮২ সালের শেষে, “Mrs. Fields Cookies” ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পরিচিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়।

১৯৮৩ সালে, তার দোকানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০টির বেশি।ডেবি তখনও প্রতিদিন অন্তত একটি দোকানে যেতেন, কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন, নতুন কুকির রেসিপি ট্রাই করতেন।

১৯৮৪ সালে কোম্পানির বিক্রি প্রথমবারের মতো এক মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
মিডিয়া তখন তাকে “The Cookie Queen of America” নামে ডাকতে শুরু করে।

১৯৮৫ সালে, “Mrs. Fields Cookies” ৩০টির বেশি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং শত শত মানুষ সেখানে কাজ করতে থাকে।একটি সাধারণ গৃহিণী, যিনি একসময় ব্যাংক থেকে ঋণও পাননি, এখন হয়ে উঠেছেন সফল নারী উদ্যোক্তার প্রতীক।

ডেবি ফিল্ডসের এই সময়ের জীবনের মূল বার্তা ছিল—“সাফল্যের গোপন উপাদান হলো ভালোবাসা, গুণমান, এবং মানুষের প্রতি আন্তরিকতা।” তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একটি কুকিও যদি ভালোবাসা দিয়ে বানানো হয়, সেটি পৃথিবীর মন জয় করতে পারে।

১৯৮৬ সালে, Mrs. Fields Cookies যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টিরও বেশি রাজ্যে পৌঁছে যায়। তখন ডেবি ফিল্ডসের বয়স মাত্র ৩০। একসময় যাকে ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে অস্বীকার করা হয়েছিল, সেই ডেবি এখন আমেরিকার ব্যবসা দুনিয়ার অনুপ্রেরণার নাম।১৯৮৭ সালে তিনি কোম্পানির সদর দপ্তর স্থানান্তর করেন পার্ক সিটি, উটাহ-তে। সেই সময়েই তিনি ব্যবসায় নতুন ধারণা আনেন — “প্রতিটি দোকান যেন একইভাবে হাসে, একইভাবে স্বাদ দেয়।”

এজন্য তিনি প্রথমবারের মতো কম্পিউটারাইজড বেকিং সিস্টেম চালু করেন, যাতে প্রতিটি কুকির গুণমান একই থাকে। এটি তখনকার সময়ে ছিল এক বিপ্লবী উদ্যোগ।

 ১৯৯৩ সালে, বাজারের চাপে এবং ব্যবসার দ্রুত বিস্তারের কারণে ডেবি ফিল্ডস কোম্পানির নিয়ন্ত্রণমূলক শেয়ার বিক্রি করে দেন, তবে তিনি থেকে যান ব্র্যান্ডের মুখপাত্র হিসেবে।তিনি বলেন— “আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম অর্থের জন্য নয়, ভালোবাসার জন্য। এখন আমার কাজ মানুষকে অনুপ্রেরণা দেওয়া।”

১৯৯৬ সালে তিনি নিজের আত্মজীবনী প্রকাশ করেন — “One Smart Cookie”,
যেখানে তিনি লিখেছেন কিভাবে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর অধ্যবসায় দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তব করা যায়।

  ২০০০ সালের পর ডেবি ফিল্ডস ধীরে ধীরে ব্যবসা পরিচালনা থেকে সরে গিয়ে প্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায় সম্মেলন এবং নারীদের উদ্যোক্তা সভায় বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন— “আমি মিষ্টি বিক্রি করিনি, আমি হাসি বিক্রি করেছি।”

২০২০ সালের দিকে, Mrs. Fields Cookies ৩০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে, এবং অনলাইন বিক্রয়ের যুগেও ব্র্যান্ডটি টিকে আছে তার প্রাথমিক মূলনীতি ধরে রেখে— ভালোবাসা, মান, ও আন্তরিকতা। ডেবি ফিল্ডস সবসময় বলতেন— “সফল হতে হলে নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে, এমনকি যখন পুরো পৃথিবী তোমার বিপক্ষে।”

তিনি প্রমাণ করেছেন— একজন সাধারণ গৃহিণীর হাতের তৈরি মিষ্টিও একদিন হয়ে উঠতে পারে মিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য, যদি তাতে থাকে অধ্যবসায়, সাহস, এবং হৃদয়ের মমতা।

আজও মানুষ যখন Mrs. Fields Cookies খায়,
তখন কুকির মিষ্টির সঙ্গে তারা অনুভব করে এক নারীর সংগ্রাম, সাহস আর ভালোবাসার গল্প।ডেবি ফিল্ডস আমাদের শেখান— “স্বপ্ন ছোট হোক, মন যদি বড় হয়, সাফল্য একদিন দরজায় কড়া নড়বেই।”