আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
মানুষ শুধুমাত্র সামাজিক জীবই নয়, মানসিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারীও। প্রতিটি মানুষের জীবনে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা তার ব্যক্তিত্বের ভিত্তি রূপে কাজ করে। এগুলো ছাড়া মানুষ সহজেই অসহায়, অনিশ্চিত ও আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। আত্মসম্মান হলো নিজের যোগ্যতা, চরিত্র ও সঠিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস, আর আত্মমর্যাদা হলো অন্যের কাছে নিজের মর্যাদা ও সম্মানের ধারণা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এগুলোই মানুষকে সঠিক পথ দেখায়, কঠিন সময়ে দৃঢ়তা দেয় এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সমৃদ্ধি আনে। তাই আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, সমাজে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মসম্মান এবং আত্মমর্যাদা মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল স্তম্ভ। একজন মানুষের জীবনমান ও সামাজিক অবস্থান অনেকাংশে নির্ভর করে তার আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার ওপর। আত্মসম্মান হলো নিজের মর্যাদা এবং নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজের কাছে একটি ইতিবাচক ধারণা, আর আত্মমর্যাদা হলো অন্যের কাছে নিজের মর্যাদা ও সম্মানের ধারণা। এগুলো সঠিকভাবে গড়ে ওঠা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল ও সৎ করে তোলে।
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার জন্য প্রথমে নিজের প্রতি সৎ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া, ভুল স্বীকার করা এবং তার থেকে শেখা একজনকে আত্মসম্মানপূর্ণ করে তোলে। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় সততা, বিনম্রতা ও নৈতিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতা বিকাশও আত্মসম্মান বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিক্ষা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও সময়ের মূল্য বোঝা একজনকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। জীবনের প্রতিটি ছোটো অর্জনও আত্মমর্যাদা গড়তে সাহায্য করে। একই সঙ্গে, নিজের জন্য সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা ও নিজের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার আরেকটি মূল উপায় হলো অন্যকে সম্মান দেওয়া। যখন আমরা অন্যের মতামত, অনুভূতি এবং স্বাধীনতা সম্মান করি, তখন আমাদের সামাজিক সম্পর্ক ও নিজের মূল্যবোধও শক্তিশালী হয়। এটি আমাদের নিজের মর্যাদা বোঝায় এবং অন্যকে প্রভাবিত করে।
আজকের প্রতিযোগিতামূলক সমাজে আত্মসম্মানহীনতা মানুষকে দুর্বল এবং আত্মবিশ্বাসহীন করে তোলে। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনে মানসিক শক্তি অর্জন করে, সমাজে প্রভাবশালী হয় এবং জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, এটি সামাজিক জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। নিজের প্রতি সততা, নিজের যোগ্যতা বিকাশ, অন্যকে সম্মান এবং নৈতিকতা রক্ষা—এই সব মিলিয়ে একজন মানুষ নিজের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে পারে। একজন ব্যক্তি যখন নিজের প্রতি বিশ্বাসী এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তখন সে সত্যিকারের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা অর্জন করে এবং সমাজে তার স্থান সুদৃঢ় হয়।
মানব জীবনে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রয়োজনীয়তা
-
আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে:
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা মানুষকে নিজের প্রতি বিশ্বাসী করে। যখন একজন ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়, তখন সে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ় মনোবল অর্জন করে। -
নৈতিক ও সামাজিক জীবনের ভিত্তি তৈরি করে:
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা মানুষের নৈতিকতা ও আচরণকে প্রভাবিত করে। নিজের মর্যাদা বোঝা এবং অন্যকে সম্মান দেওয়া সমাজে সুসম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। এটি মানবসম্পর্ককে সুদৃঢ় ও বিশ্বাসভিত্তিক করে তোলে। -
জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়:
আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি সহজে ভুল পথে ভ্রান্ত হয় না। সে নিজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। -
সাহস ও সাহসিকতা বৃদ্ধি করে:
আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান মানুষকে সাহসী করে তোলে। জীবনের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, সামাজিক বা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হয়ে ওঠে। -
সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করে:
একজন ব্যক্তি যার আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা শক্তিশালী, সে সমাজে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। এটি তার সামাজিক অবস্থান ও প্রভাব বৃদ্ধি করে। -
আত্মসম্মানহীনতা থেকে মুক্তি দেয়:
আত্মসম্মানহীন মানুষ সহজেই হতাশা, অপরাধমূলক আচরণ বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা থাকলে এসব নেতিবাচক প্রভাব কমে যায়।
সংক্ষেপে বলা যায়, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা মানুষকে মানসিকভাবে শক্তিশালী, নৈতিকভাবে সচেতন এবং সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলে। এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য ও স্থায়িত্বের মূল চাবিকাঠি।
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপ:
-
নেতিবাচক আত্মচিন্তা:
নিজের যোগ্যতা ও মূল্যকে কম মনে করা বা নিজের ওপর সন্দেহ করা আত্মসম্মান বৃদ্ধির প্রধান বাধা। অনেক সময় অতীতের ব্যর্থতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসহীন করে তোলে। -
সমাজের চাপ ও সমালোচনা:
সমাজের মানদণ্ড, অন্যের মন্তব্য বা সমালোচনা আত্মমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কেউ চাইলে নিজের মূল্যহীন মনে করতে পারে, যা আত্মসম্মানকে দুর্বল করে। -
অসফল তুলনা:
অন্যের সাফল্য বা অবস্থার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা মানুষকে মানসিকভাবে হীনমন্য করে এবং নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে। -
অভ্যাসগত অসততা বা নৈতিক দুর্বলতা:
সৎভাবে কাজ না করা, প্রতারণা করা বা নিজের মূল্যবোধকে অবমূল্যায়ন করা আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নষ্ট করে। -
ভীতিসহ সামাজিক পরিস্থিতি:
অনেকে ভয়ের কারণে নিজের মত প্রকাশ করতে বা সঠিক কাজ করতে পারে না। ভয় ও অসহায়তা আত্মমর্যাদা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে। -
অজ্ঞতা ও অভাবিত দক্ষতা:
নিজের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অজ্ঞতা বা দক্ষতার অভাব আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়, যা আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করে।
সংক্ষেপে, নিজের মান-মূল্য বোঝা, সমাজের চাপ সামলানো, আত্মনির্ভরতা গড়ে তোলা এবং নৈতিকতা বজায় রাখা হলো প্রধান চ্যালেঞ্জ। এগুলো পার করে একজন মানুষ সত্যিকারভাবে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা অর্জন করতে পারে।
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়
-
নেতিবাচক আত্মচিন্তা দূর করা:
-
নিজের শক্তি ও যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।
-
নিজের সাফল্য এবং অর্জনকে ছোট করে দেখবেন না।
-
দৈনন্দিন ধন্যবাদ এবং ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তোলুন, যেমন নিজেকে প্রেরণা দেওয়া বা ছোটো লক্ষ্য অর্জন করার আনন্দ নেওয়া।
-
সমালোচনা ও সমাজের চাপ সামলানো:
-
সব সময় অন্যের মন্তব্যকে ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না।
-
সমাজের চাপকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করুন এবং নিজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নিন।
-
অসফল তুলনা এড়ানো:
-
নিজের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করুন, অন্যের সঙ্গে নয়।
-
নিজের অগ্রগতি ও ব্যক্তিগত উন্নতির দিকে মনোযোগ দিন।
-
সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে অহেতুক তুলনা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
-
নৈতিকতা ও সততা বজায় রাখা:
-
সব কাজে সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখুন।
-
ভুল স্বীকার করা এবং তা থেকে শেখা আত্মসম্মান গড়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
-
প্রতারণা বা অন্যকে ঠকানো থেকে বিরত থাকুন।
-
ভয় ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করা:
-
নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন এবং ছোটো ছোটো সাহসী পদক্ষেপ নিন।
-
নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করুন।
-
ধৈর্য ও ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক স্থিরতা অর্জন করুন।
-
দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব পূরণ করা:
-
শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করুন।
-
নতুন জ্ঞান, হবি বা কাজে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ নিন।
-
আত্মউন্নতির জন্য নিয়মিত পড়াশোনা ও অনুশীলন চালিয়ে যান।
এই উপায়গুলো অনুসরণ করলে একজন মানুষ মানসিকভাবে শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী এবং সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
নিশ্চয়! এখানে “আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা” শিরোনামে কিছু মনীষীর জীবন থেকে প্রেরণামূলক গল্প দেওয়া হলো:
মনিষীদের জীবন থেকে গল্প
-
আব্রাহাম লিঙ্কন
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন অত্যন্ত দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শিক্ষা সীমিত ছিল, কাজের প্রতি কঠোর পরিশ্রম ছিল। অনেকেই তাকে ব্যর্থ মনে করত, কিন্তু তিনি নিজের যোগ্যতা ও নৈতিকতা বিশ্বাস করে অবিরত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তার সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং নিজের মূল্যবোধের প্রতি অটল থাকা তাকে একটি মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে তুলেছিল। এই গল্প আমাদের শেখায়, নিজের মর্যাদা ও নৈতিকতার প্রতি দৃঢ় থাকা মানেই আত্মসম্মান গড়ে তোলা। -
মহাত্মা গান্ধী
মহাত্মা গান্ধী তার জীবনে “সত্য ও অহিংসা”কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। ইংরেজ শাসনের সময়ও তিনি কখনো অন্যায় বা অহিংসার পথে যাননি। নিজের নৈতিক মূল্যবোধ, সৎ জীবন ও মানুষের প্রতি সম্মানই তাকে একটি আদর্শ নেতা ও আন্তর্জাতিক মনীষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। গান্ধীর জীবন দেখায় যে, আত্মমর্যাদা শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের প্রতি সম্মান প্রকাশ করেও অর্জিত হয়। -
হেলেন কেলার
হেলেন কেলার জন্মের পর দৃষ্টিহীন ও শ্রবণশক্তিহীন ছিলেন। কিন্তু তিনি হতাশ হননি। অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং নিজের মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস তাকে শিক্ষা ও সমাজসেবার মাধ্যমে বিশাল সফলতা এনে দেয়। তার জীবন প্রমাণ করে, যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস ও মর্যাদা থাকে, কোনো শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা মানুষকে আটকাতে পারে না। -
সুব্রত বোস (Subrahmanyan Chandrasekhar)
পদার্থবিজ্ঞানের মনীষী চন্দ্রশেখর অসীম অধ্যবসায় এবং নৈতিকতা বজায় রেখে কাজ করেছেন। তিনি কঠোর সমালোচনা ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নিজের গবেষণার প্রতি অটল ছিলেন। তার সাফল্য আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার সাথে যুক্ত অধ্যবসায়ের এক চমৎকার উদাহরণ।
এই গল্পগুলো প্রমাণ করে যে, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে ওঠে সততা, অধ্যবসায়, নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং নৈতিকতা বজায় রাখার মাধ্যমে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন থেকে গল্প
নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত নেতৃবৃন্দ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ-শ্রমিক-বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকারী মনীষী। তিনি ২৭ বছর কারাবন্দি ছিলেন। কারাবন্দি থাকা অবস্থায়ও তিনি কখনো নিজের মর্যাদা বা নৈতিকতার প্রতি কমপক্ষে আপস করেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল—“নিজেকে হীন মনে করা কখনোই সমাধান নয়, বরং ন্যায় ও সততার পথে অটল থাকা চিরন্তন মর্যাদা দেয়।”
ম্যান্ডেলার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা অর্জন করতে হলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সততা, ধৈর্য এবং নৈতিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। কারাবন্দি অবস্থাতেও তিনি অন্যদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন এবং স্বাধীনতা ও সমতার জন্য অটল ছিলেন। পরে, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট হন এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এই গল্প আমাদের শেখায় যে—নিজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রতি দৃঢ় থাকা হলে, সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষ মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করতে পারে এবং সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।
আপনি কি জানেন, জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো নিজের প্রতি বিশ্বাস? আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা আমাদের সেই শক্তির উৎস। যখন আমরা নিজের যোগ্যতা ও নৈতিকতার প্রতি দৃঢ় থাকি, তখন জীবনের কোন বাধাই আমাদের থামাতে পারে না।
প্রতিদিন আমাদের সামনে আসে ছোট-বড় চ্যালেঞ্জ। কখনো কেউ আমাদের সমালোচনা করে, কখনো আমরা নিজের সীমাবদ্ধতায় হতাশ হই। ঠিক তখনই মনে রাখতে হবে—আপনার মর্যাদা আপনার নিজের হাতে। অন্যের মন্তব্য বা সমাজের চাপ আপনার মূল্যকে কখনো নির্ধারণ করতে পারে না।
নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। নিজের ছোট ছোট অর্জনকে সম্মান করুন। সততা, ধৈর্য এবং নৈতিকতার সঙ্গে জীবন যাপন করুন। মনে রাখবেন, যারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করে, তারা কেবল নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও উদাহরণ তৈরি করে।
সফলতা কখনোই সহজে আসে না, কিন্তু আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে যারা এগিয়ে যায়, তাদের পথ চিরস্থায়ী হয়ে যায়। তাই আজ থেকেই নিজের মূল্যবোধকে শক্ত করুন, নিজের যোগ্যতায় বিশ্বাস রাখুন, এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজের মর্যাদা রক্ষা করুন। মনে রাখবেন—আপনি নিজেই আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
এখানে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কিত কিছু মনীষীর বাণী দেওয়া হলো, যা আপনার জীবনে প্রেরণা যোগাবে-
মনীষীদের বাণী
-
রালফ ওয়াল্ডো এমারসন:
“যে ব্যক্তি নিজের প্রতি বিশ্বাসী, তার কাছে অন্যদের সমালোচনা কোনো শক্তি রাখে না।” -
কনফুসিয়াস:
“নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে পারা সবচেয়ে বড় শক্তি।” -
মহাত্মা গান্ধী:
“নিজের মর্যাদা হারানো কখনোই ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে না। সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকা মানেই আসল মর্যাদা।” -
নেলসন ম্যান্ডেলা:
“আমি নিজের মর্যাদা কখনো হারাইনি, কারণ আমি জানি নিজের প্রতি সততা এবং অন্যের প্রতি সম্মানই চিরস্থায়ী শক্তি।” -
অব্রাহাম লিঙ্কন:
“নিজের যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাসই আপনাকে জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে।” -
ডেল কার্নেগি:
“নিজের মূল্যবোধ জানলে, আপনি অন্যের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবেন এবং আত্মবিশ্বাসী জীবনযাপন করতে পারবেন।”
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির ধাপে ধাপে উপায়
ধাপ ১: নিজের মূল্য ও যোগ্যতা বোঝা
-
নিজের শক্তি, দক্ষতা ও সীমাবদ্ধতা চিনুন।
-
নিজের অর্জন ও সফলতাকে ছোট করে দেখবেন না।
-
আত্মসমালোচনার ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ থাকুন, কিন্তু অতিরিক্ত হীনমন্যতা এড়ান।
ধাপ ২: ইতিবাচক চিন্তা ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করা
-
নেতিবাচক চিন্তা দূর করুন।
-
প্রতিদিন নিজের জন্য ছোটো প্রেরণামূলক লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
-
ধ্যান, স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা ও মনোযোগ বৃদ্ধির অনুশীলন করুন।
ধাপ ৩: সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখা
-
সব কাজে সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখুন।
-
ভুল হলে তা স্বীকার করুন এবং শেখার মনোভাব রাখুন।
-
প্রতারণা বা অন্যকে ঠকানো থেকে বিরত থাকুন।
ধাপ ৪: আত্মবিশ্বাসী আচরণ ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা
-
নিজের মতামত প্রকাশ করতে শিখুন।
-
অন্যের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে নিজের সীমাবদ্ধতা ও নীতিমালা মেনে চলুন।
-
সাহসী পদক্ষেপ নিন, নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন।
ধাপ ৫: নিজের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা
-
নতুন জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করুন।
-
পড়াশোনা, হবি বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে সবসময় উন্নত রাখুন।
-
নিজের অগ্রগতিকে নিয়মিত মূল্যায়ন করুন।
ধাপ ৬: অন্যকে সম্মান এবং সম্পর্ক গড়ে তোলা
-
অন্যের মতামত, অনুভূতি ও স্বাধীনতাকে সম্মান করুন।
-
সম্পর্কের মধ্যে সততা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা বজায় রাখুন।
-
সমাজে ইতিবাচক প্রভাব তৈরির চেষ্টা করুন।
ধাপ ৭: ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও ধৈর্য রাখা
-
আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা একদিনে তৈরি হয় না।
-
নিয়মিত ছোটো পদক্ষেপে অগ্রগতি করুন।
-
নিজের উন্নতি ও মর্যাদা রক্ষায় ধৈর্যশীল থাকুন।
স্টিভ জবস, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রযুক্তি জগতের একজন কিংবদন্তি, তার জীবনের মাধ্যমে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রকৃত মূল্য প্রমাণ করেছেন। স্টিভ জবস মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং শুরুতে তাকে শিক্ষাজীবন ও ক্যারিয়ারে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
তার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—আত্মবিশ্বাস হারানো এবং সামাজিক সমালোচনা। কাজের সময় তার অনেক আইডিয়া অন্যরা ব্যর্থ বা অপ্রয়োজনীয় মনে করত। কিন্তু জবস কখনো নিজের মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ও স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন—“নিজেরintuition এবং নিজের নৈতিকতা মেনে চললে, সাফল্য অবশ্যই আসবে।”
স্টিভ জবস তার কোম্পানি থেকে বরখাস্ত হলেও হতাশ হননি। বরং তিনি আত্মসম্মান বজায় রেখে নতুন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে তিনি আবার অ্যাপলে ফিরে এসে আইফোন, আইপ্যাড ও ম্যাকবুকের মতো বিপ্লবী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন, যা গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি জগৎকে বদলে দেয়।
তার জীবন আমাদের শেখায়—যদি নিজের মর্যাদা, নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতি অটল থাকি, তবে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও সাফল্য অর্জন সম্ভব।
মানব জীবনে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা কেবল ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রতীক নয়, এটি মানসিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং জীবনে সফলতার অন্যতম ভিত্তি। আত্মসম্মান ছাড়া মানুষ সহজেই আত্মবিশ্বাসহীন, হতাশ এবং সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়ে। আবার আত্মমর্যাদা না থাকলে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান অর্জন করা কঠিন হয়ে যায়।
প্রত্যেকটি ছোটো সিদ্ধান্ত, প্রতিটি আচরণ এবং প্রতিটি মূল্যবোধ—সবকিছুর সঙ্গে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা জড়িত। যারা নিজের যোগ্যতা ও নৈতিকতার প্রতি দৃঢ় থাকে, তারা কঠিন পরিস্থিতিতেও সততা ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। আব্রাহাম লিঙ্কন, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা বা স্টিভ জবসের জীবন প্রমাণ করে, নিজের মর্যাদা ও নৈতিকতার প্রতি অটল থাকা জীবনে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য, সম্মান এবং সমাজে প্রভাব নিশ্চিত করে।
অতএব, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা গড়ে তোলা কেবল নৈতিক দিক থেকে নয়, মানসিক এবং সামাজিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। এটি অর্জন করা সম্ভব সততা, অধ্যবসায়, নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং অন্যকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে। যে ব্যক্তি এই মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে, সে শুধু নিজের জীবনে নয়, সমাজে ও মানুষের জীবনেও স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।