নিজেকে জানো, নিজেকে বদলাও
নিজেকে জানো, নিজেকে বদলাও
- মোঃ জয়নাল আবেদীন
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় জয় হলো নিজেকে জয় করা। আমরা অনেক সময় বাইরের পৃথিবীকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করি, কিন্তু সত্যিকারের পরিবর্তন শুরু হয় নিজের ভেতর থেকে। এজন্য প্রথম শর্ত হলো—নিজেকে জানা।
নিজেকে জানা মানে হলো—
-
আমি আসলে কী চাই?
-
আমার শক্তি ও দুর্বলতা কোথায়?
-
কোন অভ্যাস আমাকে এগিয়ে দেয় আর কোন অভ্যাস আমাকে পিছিয়ে দেয়?
যখন আমরা নিজের ভেতরের এই প্রশ্নগুলোর সৎ উত্তর খুঁজে পাই, তখনই আমাদের জীবনের প্রকৃত দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হয়।
কিন্তু শুধু জানাই যথেষ্ট নয়, বরং সেই জ্ঞানের আলোকে নিজেকে বদলানোই হলো উন্নতির মূল চাবিকাঠি। খারাপ অভ্যাসকে বাদ দিয়ে ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা, সময় নষ্ট না করে নিয়মিত কাজ করা, নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা—এসবই নিজেকে বদলানোর অংশ।
স্মরণ রাখতে হবে—
- পৃথিবীকে বদলাতে চাইলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে।
- সাফল্য পেতে চাইলে আগে নিজের ভেতরের সীমাবদ্ধতাগুলো জয় করতে হবে।
নিজেকে জানা = দিক নির্দেশনা
নিজেকে বদলানো = উন্নতি
এভাবেই একজন মানুষ নিজের জীবনকে সুন্দর, সফল ও অর্থবহ করে তুলতে পারে।
জীবনে সাফল্য ও শৃঙ্খলা অর্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজেকে চেনা এবং নিজের ভেতরের দুর্বলতা ও শক্তিকে স্বীকার করা। আমরা প্রায়ই বাইরের পৃথিবীকে বদলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয় তখনই, যখন আমরা নিজের ভেতরের জগৎকে গভীরভাবে অনুধাবন করি।
নিজেকে জানা মানে হলো নিজের চিন্তা, অনুভূতি, লক্ষ্য, শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। যখন আমরা নিজের ভেতরকার প্রশ্নগুলোর সৎ উত্তর খুঁজে পাই—যেমন, আমি আসলে কী চাই, আমার কোন অভ্যাস আমাকে এগিয়ে দেয় এবং কোন অভ্যাস আমাকে পিছিয়ে দেয়—তখনই আমরা জীবনের প্রকৃত দিকনির্দেশনা পেতে সক্ষম হই।
কিন্তু শুধুমাত্র নিজেকে জানা যথেষ্ট নয়। সেই জ্ঞানের আলোকে নিজেকে বদলানোই হলো বাস্তব উন্নতির মূল চাবিকাঠি। নিজেকে বদলানোর মানে হলো খারাপ অভ্যাসকে বাদ দিয়ে ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা, সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা, নেতিবাচক চিন্তা ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
আত্মউন্নয়নের জন্য এই দুই ধাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ—প্রথমে স্বচ্ছন্দে নিজের বাস্তবতা চেনা এবং পরে সেই বাস্তবতা অনুযায়ী নিজের আচরণ ও চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করা। যারা এই প্রক্রিয়ায় সফল হন, তারাই জীবনে সত্যিকারের শান্তি, সফলতা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারেন।
স্মরণ রাখতে হবে—নিজেকে জানা মানে হলো দিকনির্দেশনা, নিজেকে বদলানো মানে হলো উন্নতি। কেউই বাইরের পৃথিবীকে পুরোপুরি বদলাতে পারে না, কিন্তু নিজের ভেতরের সীমাবদ্ধতা জয় করতে পারলে মানুষ নিজে থেকেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে।
নিজেকে জানাই হলো আত্মউন্নয়নের প্রথম ধাপ। নিজের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে চেনে আমরা সেই অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে পারি। এবং এই পরিবর্তনই জীবনে স্থায়ী সাফল্য এবং মানসিক শান্তি আনে। তাই আমাদের প্রতিটি দিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত—নিজেকে চেনা, নিজেকে মূল্যায়ন করা এবং ধারাবাহিকভাবে নিজেকে বদলানো।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের কথাই বলা যায়।
সত্যজিত রায়—বাংলা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি—একজন মানুষের জীবনের অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ, যিনি নিজের দুর্বলতা চেনেন এবং অটল প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা জয় করেছেন।
সত্যজিত ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল ছিলেন। তিনি ছবি আঁকতে এবং গল্প লিখতে ভালোবাসতেন। কিন্তু পরিবারে অর্থের অভাব এবং শিল্পকলা নিয়ে মানুষের সীমিত ধারণা তার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি চাকরিতে যোগ দেন, কিন্তু চলচ্চিত্রে কাজ করার আগ্রহ কখনো কমেনি।
যখন তিনি প্রথম চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” বানানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ বা কোনো বড় প্রযোজক ছিল না। শুটিং চলাকালীন নানা সমস্যা—টাকা অভাব, অভিনেতাদের সমস্যা, সময়সীমার চাপ—সবকিছু ছিল। অনেকেই বলেছিলেন, “এ ছবিটি কখনো সফল হবে না।”
কিন্তু সত্যজিত হাল ছাড়েননি। তিনি নিজের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা চেনেন এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য পরিকল্পনা করেন। বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়দের সাহায্য নিয়ে তিনি শুটিং চালিয়ে যান। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, ধৈর্য ও পরিশ্রমের সঙ্গে তিনি কাজ চালিয়ে যান।
ফলাফল: “পথের পাঁচালী” শুধু ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নয়, বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর একের পর এক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতে এবং সত্যজিত রায় হয়ে যান বাংলা ও ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি।
অনেক দিন পূর্বে এক গ্রামে জন্ম নেয় রাহুল, ছোটবেলা থেকেই চতুর ও কৌতূহলপূর্ণ ছেলে। কিন্তু সে সবসময় নিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান থাকত। স্কুলে সে ভালো ফলাফল করতে পারত না, আর খেলাধুলায়ও অন্যদের মতো দক্ষ ছিল না। অনেকেই তাকে বলত—“তুমি কখনো বড় কিছু হতে পারবে না।”
একদিন গ্রামের এক বৃদ্ধ শিক্ষক তাকে বললেন—
"রাহুল, যদি তুমি নিজেকে চাও এবং নিজের দুর্বলতা চেনো, তবে তুমি যা চাও তা অর্জন করতে পারবে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।"
রাহুল প্রথমে এই কথা বিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করল—কোন বিষয়ে সে ভালো, কোন বিষয়ে তাকে আরও চেষ্টা করতে হবে। সে জানল যে তার শক্তি হলো ধৈর্য, মনোযোগ এবং ধারাবাহিক চেষ্টা।
রাহুল প্রতিদিন ছোট ছোট কাজ শুরু করল। প্রথমে পড়াশোনায় নিজেকে উন্নত করতে শুরু করল, তারপর খেলার অভ্যাসে মনোযোগ দিল। ব্যর্থতাও এলো, কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। ধীরে ধীরে সে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগোতে লাগল। কয়েক বছর পর, গ্রামের সবাই অবাক হয়ে দেখল—যে ছেলে আগে নিজের উপর বিশ্বাস করতে পারত না, আজ সে হয়ে গেছে গ্রামের একজন সফল ও সম্মানিত ব্যক্তি।
রাহুলের গল্প আমাদের শেখায়—নিজেকে চেনা মানে নিজের সীমাবদ্ধতা ও শক্তি বোঝা, আর নিজেকে বদলানো মানে সেই জ্ঞানের আলোকে ধারাবাহিক চেষ্টা চালানো। যারা এই পথে অটল থাকে, তারাই জীবনে সত্যিকারের সাফল্য অর্জন করে।
“নিজেকে জানো, নিজেকে বদলাও” বিষয়কে কেন্দ্র করে কিছু মনীষীর অনুপ্রেরণামূলক বাণী নিচে দিলাম যাহা তোমার জীবন কে অনুপ্রেরণা দিবে।
মনীষীদের বাণী
🔹 সক্রেটিস
"নিজেকে জানাই হলো সত্যিকারের জ্ঞান লাভের প্রথম ধাপ।"
🔹 আব্রাহাম লিঙ্কন
"আমি ধীরে হাঁটি, কিন্তু কখনো পিছু হটি না।"
🔹 থমাস এডিসন
"আমি ব্যর্থ হইনি। আমি শুধু ১০,০০০টি উপায় খুঁজে পেয়েছি যা কাজ করে না।"
🔹 গান্ধী
"নিজেকে জয় করো, তবেই তুমি বিশ্বের পরিবর্তন আনতে পারবে।"
🔹 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"নিজেকে চিনে নিজেকে গড়ে তোলাই হলো জীবনের প্রকৃত শিক্ষা।"
🔹 উইনস্টন চার্চিল
"সাফল্য চূড়ান্ত নয়, ব্যর্থতা মারণ নয়; আসল বিষয় হলো এগিয়ে চলার সাহস।"
🔹 বুদ্ধ
"নিজের মনে যা আছে তা চেনো; নিজেকে পরিবর্তন করো—এভাবেই জীবনে শান্তি আসে।"
“নিজেকে জানো, নিজেকে বদলাও” এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সফলতার জন্য ধাপে ধাপে উন্নতির পরিকল্পনা করুন। একটি ভালো পরিকল্পনা সফলতার অর্ধেক।
ধাপ ১: নিজেকে চিনুন
-
নিজের শক্তি, দুর্বলতা, আগ্রহ এবং অপ্রিয় বিষয়গুলো লিখে নিন।
-
নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি আসলে কী চাই? কোন বিষয়ে আমি উন্নতি করতে চাই?
-
নিজের অনুভূতি এবং আচরণের প্রতি সতর্ক থাকুন।
ধাপ ২: লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
-
ছোট ও বড় লক্ষ্য দুটোই ঠিক করুন।
-
লক্ষ্যটি বাস্তবসম্মত ও পরিমাপযোগ্য হোক।
-
লক্ষ্য নির্ধারণ করলে মনোবল বাড়ে এবং অগ্রগতি মাপা সহজ হয়।
ধাপ ৩: পরিকল্পনা তৈরি করুন
-
লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ধাপগুলো তালিকাভুক্ত করুন।
-
সময়সীমা নির্ধারণ করুন।
-
ব্যর্থতার সম্ভাবনা বিবেচনা করে বিকল্প পথ ঠিক করুন।
ধাপ ৪: ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন
-
বড় লক্ষ্য একসাথে অর্জন করা কঠিন, তাই ছোট ছোট পদক্ষেপে কাজ করুন।
-
প্রতিদিন অন্তত একটি কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করুন।
-
অগ্রগতি ধাপে ধাপে পরিমাপ করুন।
ধাপ ৫: নিজেকে পরিবর্তন করুন
-
খারাপ অভ্যাস বাদ দিন।
-
ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন।
-
নিজের চিন্তা ও আচরণে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনুন।
ধাপ ৬: ব্যর্থতা ও প্রতিবন্ধকতাকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখুন
-
ব্যর্থতা মানসিক শক্তি বাড়ায়।
-
শেখার দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলগুলো মূল্যায়ন করুন।
-
প্রতিটি ব্যর্থতা নতুন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা দেয়।
ধাপ ৭: ধারাবাহিকতা বজায় রাখুন
-
নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যান।
-
অনুপ্রেরণামূলক বই পড়ুন, মনিষীদের জীবন থেকে শিক্ষা নিন।
-
নিজেকে সময় দিন এবং ধৈর্য ধরে অগ্রগতি চালিয়ে যান।
ধাপ ৮: অগ্রগতি মূল্যায়ন করুন
-
প্রতি সপ্তাহ বা মাসে নিজের অর্জনগুলো পর্যালোচনা করুন।
-
যেসব জায়গায় উন্নতির প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করুন।
-
সফলতা উদযাপন করুন এবং পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করুন।
সারসংক্ষেপ:
নিজেকে জানার মাধ্যমে লক্ষ্য স্থির করুন → পরিকল্পনা তৈরি করুন → ছোট পদক্ষেপ নিন → নিজের অভ্যাস ও চিন্তাভাবনা বদলান → ব্যর্থতাকে শিক্ষার সুযোগ হিসেবে দেখুন → ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যান → অগ্রগতি পর্যালোচনা করুন।
এই ধাপগুলো মেনে চললে, আপনি ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে পারবেন এবং জীবনকে অর্থপূর্ণ ও সফল করে তুলতে পারবেন।
নিজেকে জানা হলো জীবনের প্রথম ধাপ; নিজের শক্তি, দুর্বলতা, আগ্রহ ও সীমাবদ্ধতাগুলো বোঝার মাধ্যমে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত, লক্ষ্য ও আচরণকে আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারি। যুক্তি অনুযায়ী, যখন আমরা নিজের স্বভাব, চিন্তাভাবনা এবং অভ্যাসকে গভীরভাবে বুঝি, তখন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো সনাক্ত করা সহজ হয়। আত্ম-জ্ঞান ছাড়া কোনো স্থায়ী পরিবর্তন বা উন্নতি সম্ভব নয়।
নিজেকে বদলানো মানে কেবল বাহ্যিক পরিবর্তন নয়, বরং মনোভাব, অভ্যাস এবং জীবনধারার ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং সচেতন অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা নেতিবাচক অভ্যাস দূর করে ইতিবাচক অভ্যাস স্থাপন করতে পারি, যা আমাদের ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক এবং সাফল্যকে সমৃদ্ধ করে।
নিজের পরিচয় বোঝা এবং নিজেকে ইতিবাচকভাবে বদলানো হলো সুখী, সুশৃঙ্খল এবং অর্থপূর্ণ জীবনের চাবিকাঠি। আত্ম-জ্ঞান এবং সচেতন পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি এবং স্থায়ী আনন্দ অর্জন করতে পারি।