শেষ ভোরের আলো
গল্পের নাম: শেষ ভোরের আলো
লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন
রাহাত নামের এক যুবক ছিল, যে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। তার বাবা ছিলেন দিনমজুর, আর মা একটি প্রাথমিক স্কুলে রান্নার কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই রাহাতের স্বপ্ন ছিল, সে বড় হবে—একজন বিজ্ঞানী হবে, নতুন কিছু আবিষ্কার করবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নিষ্ঠুর। বিদ্যুৎ ছিল না ঘরে, রাতের পড়া চলতো কেরোসিন বাতিতে। কখনো কেরোসিন ফুরিয়ে গেলে, সে চাঁদের আলোয় বই খুলে বসতো।
সারা গ্রামে কেউই তার স্বপ্নকে গুরুত্ব দিত না। সবাই বলতো, “বাড়ির হাল তো সামলাতে পারিস না, বিজ্ঞানী হবি?” এমনকি তার এক আত্মীয় একবার বলেছিলেন, “পেটের ক্ষুধা মেটা আগে, পরে স্বপ্ন দেখিস।”
তবুও রাহাত থামেনি।
রাহাত মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করল, কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা ছিল না। সে দিনরাত কাজ করলো—কখনো মাঠে ধান কেটেছে, কখনো দোকানে মাল তুলেছে। ধীরে ধীরে সে কলেজে ভর্তি হলো, পুরনো বই, ধার করা খাতা—সব দিয়েই সে লড়ে গেল।
এভাবে দিনে দিনে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার ভাড়া জোগাড় করা তার কাছে তখন পাহাড়সম। সে নিজের সাইকেল বিক্রি করল, বন্ধুরা সাহায্য করলো—অবশেষে সে ঢাকায় পৌঁছালো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। অনেকে আধুনিক পোশাক পরে, দামি মোবাইল ব্যবহার করে, রাহাতের শুধু এক জোড়া জামা, একজোড়া জুতো। একসময় তার মনে হয়েছিল—এ জীবন আমার জন্য না।
কিন্তু একদিন, একজন অধ্যাপক তার প্রজেক্ট দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন: “তুমি নিজেকে ছোট মনে করো না। তুমিই হবে ভবিষ্যতের উদ্ভাবক।”
এই একটি বাক্য রাহাতের জীবন বদলে দিল। সে আরও পরিশ্রমী হয়ে উঠল। রাতভর গবেষণা, দিনের আলোতে ক্লাস। ধীরে ধীরে সে একটি নতুন প্রযুক্তি তৈরি করল—একটি সাশ্রয়ী সৌর-ভিত্তিক পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র, যা গ্রামের দরিদ্র মানুষদের জন্য কার্যকর।
এই আবিষ্কার নিয়ে সে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রথমে জাতীয়, পরে আন্তর্জাতিক পর্বে পৌঁছে যায়। আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্কলারশিপ অফার করে গবেষণার জন্য।
গ্রামের সেই ছেলেটি, যার বিদ্যুৎ ছিল না, এখন আলো তৈরি করছে। বিশ্ববাসী তার কাজের প্রশংসা করছে। রাহাত আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন প্রযুক্তি পরামর্শক।
তার সাফল্যের পর, সে কখনো নিজের শিকড় ভুলে যায়নি। নিজ গ্রামের জন্য স্কুল তৈরি করেছে, সৌরবিদ্যুৎ চালু করেছে, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ ফান্ড তৈরি করেছে।
একদিন এক কিশোর তাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, আপনি কীভাবে এত বড় হতে পারলেন?”
রাহাত হেসে বলল,
“আমি কখনো হাল ছাড়িনি। আমি অন্ধকারে আলো খুঁজেছি। আর বিশ্বাস করতাম, শেষ ভোরের আলোটা সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়।”
গল্প থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা:
স্বপ্ন দেখো, তা যত বড়ই হোক।
চেষ্টা কখনো বিফলে যায় না।
নিজেকে ছোট ভাবো না—তুমি পারবে।
অন্ধকার যতই গভীর হোক, আলো আসবেই।