সততার মূল্য
গল্পের নাম: সততার মূল্য
লেখক:মোঃ জয়নাল আবেদীন
নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন বৃদ্ধ মুদি দোকানি। তার ছোট্ট দোকানটি ছিল কুমিল্লার একটি মফস্বল এলাকায়। সামান্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করেই তার সংসার চলত। স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট পরিবার ছিল। ছেলেটি শহরে পড়তো, আর মেয়েটি স্থানীয় স্কুলে।
নুরুল ইসলাম ছিলেন অসম্ভব সৎ। দোকানে কেউ বাড়তি টাকা দিলে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিতেন। কোনো পণ্যে দাগ থাকলে আগে থেকেই বলে দিতেন, “ভাই, এইটার একটু সমস্যা আছে, কম দামে দিয়ে দিচ্ছি।”
লোকজন হাসতেন, বলতেন, “এই যুগে এমন সৎ মানুষ আর কয়জন আছে!”
কিন্তু সবাই তার মতো চিন্তা করত না।
একদিন এক কোম্পানির সেলসম্যান এলেন। নাম তার আসিফ। সে বলল, “চাচা, আপনার দোকানটা একটু বড় করি না? আমি আপনাকে পণ্যের অতিরিক্ত বোনাস দিব, শুধু একটু চোখ বন্ধ করে কয়েকটা পণ্য বেশি দামে বিক্রি করবেন।”
নুরুল ইসলাম রাগে গর্জে উঠলেন, “তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমি লোক ঠকিয়ে টাকা রুজি করতে শিখিনি।”
আসিফ হেসে বলল, “চাচা, সততায় পেট চলে না। সময় বদলে গেছে।”
নুরুল ইসলাম গম্ভীর গলায় বললেন, “সময় বদলালেও মূল্যবোধ বদলানো ঠিক না।”
এক রাতে দোকানে চুরি হলো। যা কিছু ছিল, সব নিয়ে গেল চোর। বাড়িতে বসে স্ত্রী বললেন, “এই বয়সে আর দোকান সাজাবেন কিভাবে?”
তিনি চুপচাপ ছিলেন। মেয়েটি কান্না করল, “বাবা, আমার স্কুলের ফি?”
সেই রাতটা নুরুল ইসলামের জীবনে সবচেয়ে অন্ধকার ছিল। তিনি আল্লাহর কাছে বললেন, “হে আল্লাহ, আমি যদি কারও টাকা মেরে থাকি, আমার শাস্তি দাও। কিন্তু তুমি জানো, আমি যতটুকু পেরেছি, সৎ থাকার চেষ্টা করেছি।”
দুই সপ্তাহ পর এক গাড়ি থামল তার ঘরের সামনে। একজন ভদ্রলোক নামলেন। সঙ্গে সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান।
তিনি পরিচয় দিলেন, “আমি রেজাউল করিম, একটি বড় সংস্থার পরিচালক। আপনি কি মনে করেন, ১৮ বছর আগে এক ছাত্রকে আপনি ৫০ টাকা ঋণ দিয়েছিলেন বই কেনার জন্য?”
নুরুল ইসলাম বিস্মিত হয়ে বললেন, “অনেককে দিয়েছি, মনে নেই।”
রেজাউল করিম হেসে বললেন, “আমি সেই ছাত্র। আপনি দোকানে বলেছিলেন, ‘ছেলে, বই কিনো, ভালো মানুষ হও, টাকা ফেরত দিতে হবে না।’ সেই সময়টাতে আমি দরিদ্র ছিলাম, আজ আমি প্রতিষ্ঠিত।”
তিনি আরও যোগ করলেন, “আপনার সততা আমাকে শিখিয়েছে কেমন হওয়া উচিত। আজ আমি এসেছি আপনার ঋণ শোধ করতে। শুধু টাকা না, আমি চাই, আপনার মতো মানুষের গল্প সবাই জানুক।”
সংস্থাটি তার দোকান নতুন করে বানিয়ে দিল। তার মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্বও তারা নিল। চারদিকে ছড়িয়ে গেল—“নুরুল চাচা সৎ মানুষ, যার সততা আজ তাকে সম্মান এনে দিয়েছে।”
একদিন এক ছোট ছেলেকে তিনি বললেন,
“সততার ফল তাৎক্ষণিক না হলেও, তা একদিন ফিরে আসে। ঠিক সূর্য যেমন সব সময় দেখা যায় না, কিন্তু সে থাকেই—পেছনে আলো নিয়ে।”
গল্প থেকে শিক্ষা:
সততা ধীর গতির হলেও শক্তিশালী।
আপনার প্রতিটি সৎ কাজ কাউকে না কাউকে বদলে দেয়।
সততার ফল একদিন ঠিকই ফিরে আসে।
সৎ মানুষকে সময়ের সঙ্গে সম্মানও খুঁজে নেয়।