একমুঠো শান্তি চাই

23 Jul 2025 05:01:03 PM


একমুঠো শান্তি চাই

লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন

 

       আজ আমি পুলিশ অফিসে নিজ কক্ষে বসে দৈনন্দিন ফাইলপত্রের কাজ করছিলাম। হঠাৎ আমার অফিস সহকারী দরজায় কড়া নাড়ল। সে জানালো, একজন ভিজিটর দেখা করতে এসেছেন এবং তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিল। কার্ডে লেখা ছিল—ডা. মাহবুব হাসান, এমবিবিএস, এফসিপিএস (সার্জারি)। আমি অনুমতি দিলাম দেখা করার।

ডাক্তার সাহেব ঘরে ঢুকে আমাকে বিনয়ের সাথে সালাম দিলেন, আমি তাকে বসতে বললাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর ধীরে ধীরে তিনি বলতে শুরু করলেন তাঁর জীবনের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের কথা। একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, মার্জিত মানুষ কেমন করে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন, তা আমি তাঁর চোখের ভাষা থেকেই অনুভব করতে পারছিলাম।

 

প্রেম, বিশ্বাস ও এক ছলনার শুরু

ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয় হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৬ বছর আগে, একটি ডাক্তারি সম্মেলনে। সম্মেলনে তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রথম দেখেন, এবং কিছুদিন পর ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। একসময় মেসেঞ্জারে আলাপ জমে ওঠে। তিনি সরাসরি জানতে চান, মেয়েটির কোনো অতীত সম্পর্ক ছিল কি না। মেয়েটি (বর্তমানে তাঁর স্ত্রী) তখন সরলভাবে বলে, "না, আমি কখনো কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াইনি।"

সত্যতা যাচাই না করেই তিনি সেই কথায় বিশ্বাস করেন। সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি অনুসরণ করে দুই পরিবার এক হয়ে তাদের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করে।

 

বিয়ের পর সত্যের মুখোমুখি

বিয়ের কিছুদিন পরই শুরু হয় সত্যের উন্মোচন। স্ত্রীর পূর্বে একটি গভীর সম্পর্ক ছিল, যা তিনি গোপন রেখেছিলেন। ডাক্তার সাহেব তা জানার পরও মনের বড়ত্ব দেখিয়ে বলেন, "পূর্বে যা ঘটেছে, তা অতীত। আমি চাই তুমি বর্তমানে আমার প্রতি একনিষ্ঠ থাকো। আমরা নতুন করে শুরু করি।"

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

 

অশান্তির সংসার ও একাকীত্বের আর্তনাদ

স্ত্রী তার মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল। যখনই তাঁর মা-বাবা বাড়িতে আসতেন, স্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করতেন, কথা বলতেন না, এমনকি অপমানজনক আচরণ করতেন। ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে বলতেন, “আমার নামে কিনতে হবে।” ডাক্তার সাহেব ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন, এই সংসারে ভালোবাসার জায়গা নেই, আছে হিসেব-নিকেশ, সন্দেহ ও দম্ভ।

 

যদিও তিনি ভেবেছিলেন, একটি সন্তান হলে হয়তো সংসারে স্থিতি আসবে, কিন্তু সন্তান জন্মের পরও অশান্তি অব্যাহত থাকে। প্রতিদিনের ঝগড়া, তিক্ততা, অপমান তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলতে থাকে।

 

একটা দিন, একটা ভাঙন

সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে তখন, যখন তাঁর স্ত্রী কিছু ভাড়াটে লোকজন নিয়ে তাঁর চেম্বারে এসে ভাঙচুর করে। চেম্বারের আসবাব ভেঙে ফেলে, তাঁকে মারধর করে এবং তাঁর পাসপোর্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে যায়। এসবের পর ডাক্তার সাহেব বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নেন এবং আদালতে মামলা করেন।

 

এর প্রতিক্রিয়ায় স্ত্রীও তাঁর বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা ঠুকে দেন, যেটি এখন তাঁকে আরও সামাজিক ও মানসিক চাপে ফেলেছে।

 

একজন ভদ্রলোকের একমুঠো শান্তির আকুতি

ডাক্তার সাহেব আজ আমার কাছে এসেছেন আইনি পরামর্শ নিতে। তিনি বলেন, “স্যার, আমি কিছু চাই না, আমি আর যুদ্ধ করতে পারছি না। আমি শুধু একমুঠো শান্তি চাই।”

তাঁর এই কথা শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গেলাম। একজন শিক্ষিত, সফল, সম্মানিত মানুষ কেমন করে এমন এক অবসাদে পৌঁছে যেতে পারেন, যেখানে 'শান্তি' শব্দটাও যেন স্বপ্নের মতো হয়ে পড়ে!

 

এই ঘটনার শিক্ষা কী?

১. টাকা, ডিগ্রি, বড় পদ—সব কিছু থাকতে পারে, কিন্তু তাতে সুখের নিশ্চয়তা নেই। সুখ আসে সম্পর্কের আন্তরিকতা থেকে, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকে।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় যতই মধুর হোক, বাস্তব যাচাই ছাড়া জীবনসঙ্গী নির্বাচনে ঝুঁকি অনেক। মেসেঞ্জারের মিথ্যা কথায় প্রভাবিত হয়ে ভবিষ্যতকে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক নয়।

 


বিয়ে মানে শুধু দুটি মানুষ নয়, দুটি পরিবারও এক হয়। যদি একজন সঙ্গী পরিবারকে সম্মান না করে, তাহলে সম্পর্কের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়।

 


একটি সন্তানের ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যায় যখন মা-বাবা একে অপরকে অবিশ্বাস করে। এ সমাজে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু শিশুরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভিকটিম।

 

 

 

উপসংহার:

এই গল্পটি একক কোনো মানুষের নয়। আমাদের চারপাশে এমন হাজারো মানুষ আছেন যারা বাহ্যিকভাবে সফল, কিন্তু ভেতরে চরমভাবে বিধ্বস্ত। তারা প্রকাশ করতে পারেন না, বলতে পারেন না। তারা শুধু চুপ করে থাকেন—একটুকরো শান্তি খুঁজে ফেরেন।

আসুন, সম্পর্ককে হালকাভাবে নিই না। প্রতারণা, মিথ্যা, অহংকার কোনো সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারে না। আর যদি কোনো সম্পর্কে শান্তি না থাকে, তবে সেটাকে জোর করে বয়ে নিয়ে চলাও অমানবিক।

আমরা সবাই জীবনে যেটুকু চাই, তা হলো—"একমুঠো শান্তি"।

 

– মোঃ জয়নাল আবেদীন
(লেখক, চিন্তাশীল পর্যবেক্ষক ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী একজন কণ্ঠস্বর)