কপালে সুখ সইলোনা
কপালে সুখ সইলোনা
লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন
মানুষ সুখের আশায় কত কিছুই না করে! কেউ দেশের ভেতর পরিশ্রম করে, কেউ আবার বিদেশের মাটিতে গিয়ে ঘাম ঝরায়। তবে সবাই যে সেই কাক্সিক্ষত সুখটা পায়, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ শত চেষ্টা করেও কপালে একফোঁটা সুখও জোটাতে পারে না। সম্প্রতি আমি এমনই এক নারীর জীবনের হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনলাম, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। তিনি আমার কাছে আইনি সহায়তার আশায় এসেছিলেন, আর তাঁর কান্নাভেজা কণ্ঠে শোনা সেই গল্প আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।
বিদেশ যাত্রার শুরুটা ছিল স্বপ্নময়
তিন বছর আগে, বিয়ের মাত্র কিছুদিন পর, এক গৃহবধূ মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান গৃহকর্মীর ভিসায়। তাঁর স্বপ্ন ছিল—স্বামীকে সুখে রাখবেন, সংসারে শান্তি আনবেন, অভাব নামক শব্দটা চিরতরে মুছে ফেলবেন। সেখানকার কঠিন বাস্তবতা, অমানবিক পরিশ্রম, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা—সব কিছু মাথা পেতে সহ্য করেও তিনি প্রতি মাসে স্বামীর জন্য টাকা পাঠাতে থাকেন।
স্বামী দেশে বসে আয়েশে জীবন কাটান, কোনো কাজকর্ম করতেন না। স্ত্রীর পাঠানো টাকায় চলছিল সব। এরপর একদিন স্বামী বায়না ধরলেন—“একটা মোটরসাইকেল কিনে দাও!”
স্ত্রী কষ্ট করে টাকা পাঠালেন, স্বামী কিনলেন চকচকে একটি বাইক। অথচ, স্ত্রী কখনো সেই বাইকে চড়েও দেখেননি।
ফিরে এসে স্বপ্নভঙ্গের পরিণতি
তিন বছরের মাথায় স্ত্রী দেশে ফেরেন, বুকভরা আশা নিয়ে। ভাবেন, এবার হয়তো সংসারে সুখ ফিরবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মম। বাড়িতে এসে দেখেন—স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং নতুন বউ নিয়ে সুখের সংসার করছেন।
চোখের সামনে বিশ্বাসভঙ্গের দৃশ্য দেখে হতচকিত হলেও, তিনি মন শক্ত করে পুরনো সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তিনি নতুন স্ত্রীকেও মেনে নেন, কারণ তাঁর একটাই লক্ষ্য—সংসারটা ভেঙে যাক না। কিন্তু তবুও তাঁর সেই আত্মত্যাগের কোনও মূল্য দিল না তাঁর স্বামী।
একদিন হঠাৎ স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে অসহায় অধ্যায়।
আইনি সহায়তার আবেদন
তালাকপ্রাপ্ত এই নারী এখন ন্যায়বিচারের আশায় পথে পথে ঘুরছেন। তিনি কিছুই চান না—স্বামীর বাড়িতে থাকার অধিকার না হোক, অন্তত বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে আনা ফার্নিচার, বিদেশে উপার্জিত অর্থ দিয়ে স্বামীকে উপহার দেওয়া মোটরসাইকেল, এবং তাঁর মোহরানার টাকা যেন ফেরত পান। তিনি বলেন—
“আমি তিন বছর যা পাঠিয়েছি, সেসব ফেরত না পেলেও চলবে, অন্তত আমার প্রাপ্যটুকু পাই।”
বিষাদ আর বিদ্রোহের একসাথে বয়ে চলা স্রোত
এই ঘটনা শুনে আমার মনে পড়ে গেল একটি গানের লাইন—
“পরাণের বন্ধুরে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে...”
একজন নারী তাঁর যৌবনের সোনালী সময়টি উৎসর্গ করলেন একটি ভালোবাসাহীন সম্পর্কে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সুখের, অথচ সে সুখ যেন তার কপালে সইল না।
এই ঘটনা আমাদের কী শেখায়?
১. ভালোবাসা যদি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধহীন হয়, তবে তা দুঃখ ছাড়া কিছু দেয় না।
২. নারী যেন কেবল ত্যাগের প্রতীক নয়, তাঁরও অধিকার রয়েছে সম্মান ও সম্পত্তির উপর।
৩. বিদেশে থাকা লক্ষ লক্ষ নারীর কষ্ট ও অবদান আজও মূল্যায়িত হয় না। বরং তাদের পাঠানো টাকাই কখনো কখনো হয় সর্বনাশের হাতিয়ার।
৪. বিয়ে শুধু সামাজিক চুক্তি নয়, এটি বিশ্বাস ও দায়িত্বের ভিত্তিতে টিকে থাকে। একতরফা ত্যাগ দিয়ে একটি সম্পর্ক কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
উপসংহার:
এই গল্পটি নিছক একটি ব্যক্তির নয়—এটি হাজারো, লক্ষো নারীর প্রতিচ্ছবি, যারা পরিবারের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেয়। তারা ত্যাগ করে মা-বাবা, স্বামী-সন্তান, নিজের স্বপ্ন; কিন্তু ফিরতি পথে অনেকেই পায় না সম্মান, পায় না ভালোবাসা, পায় না নিজের প্রাপ্য।
এই সমাজে এখনও অনেক পুরুষ আছে, যারা স্ত্রীকে “উপার্জনের যন্ত্র” ভাবেন, দায়িত্ব নয়। তাই আমাদের সামাজিক ও আইনি সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজন হলে নারীরা যেন সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারে, সেই শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা—সুখ যেন কপালের লেখা না হয়ে, কর্ম ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ফল হয়।
– মোঃ জয়নাল আবেদীন
(লেখক, সমাজ পর্যবেক্ষক এবং বাস্তব জীবনের গল্প লেখায় আগ্রহী একজন চিন্তাশীল কণ্ঠ)