বাবার ভালোবাসা

23 Jul 2025 04:59:54 PM


বাবার ভালোবাসা

লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন

 

     সেদিন আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায়। এক মামলার প্রেক্ষিতে একজন বয়স্ক মানুষ থানায় আসেন। চেহারায় চাপা ক্লান্তি, চোখে গভীর বেদনা। জিজ্ঞাসা করতে জানতে পারলাম, তার ছেলেই এই মামলার মূল আসামি। অথচ বাবা নিজেই এখন মামলার ঘেরাটোপে বন্দি।

ছেলেটি এলাকায় পরিচিত এক বখাটে। কথায়, আচরণে, চলাফেরায় একজন পাতি মাস্তান—যার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ছিল। নেশা, মারামারি, চাঁদাবাজি সবই তার চরিত্রের অংশ হয়ে উঠেছিল।

 

বাবার শেষ চেষ্টা—সন্তানকে মানুষ করার যুদ্ধ

ছেলের বখে যাওয়া জীবনকে রক্ষা করতে বাবা প্রথমে বহু চেষ্টা করেন। অনেক অনুরোধ, অনেক পরামর্শ, শাসন সবই ব্যর্থ হয়। শেষে একমাত্র ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। নিজের সঞ্চয় ভেঙে, ধার-দেনা করে প্রায় চার লক্ষ টাকা খরচ করে ছেলেকে প্রবাসে পাঠান।

কিন্তু এই স্বপ্ন যাত্রা এক মাসের মধ্যেই ভেঙে পড়ে। ছেলেটি বিদেশে গিয়ে কাজের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ফিরে আসে। বাবা তখন তাকে বুঝিয়ে কিছুদিন বাড়ি থেকে আলাদা রাখেন—প্রায় দুই মাস।

তবুও, বাবার মনের ভেতর থেকে ছেলেকে মুছে ফেলতে পারেন না। হয়তো রাগে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, কিন্তু ভালোবাসায় বুক ফিরিয়ে থাকেননি কখনো।

 

যখন পুলিশ ছেলেকে খুঁজছে, বাবা তখন...

ঘটনার মোড় ঘুরে যায় তখন, যখন পুলিশ ছেলেটিকে গ্রেফতার করতে মাঠে নামে। খবর পেয়ে বাবা নিজেই থানায় আসেন এবং যা বললেন, তা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

তিনি বললেন—


“স্যার, আমি আমার ছেলেকে এনে দিব। কিন্তু একটাই অনুরোধ, আপনারা আমার ছেলেকে মারবেন না। যদি মারতেই হয়, আমাকে মারুন।”

 

একজন বাবা নিজের সন্তানের জন্য এমন কথা বলতে পারেন! সন্তান যতই ভুল করুক, যতই বিপথে যাক—একজন বাবা তার ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে যান। এমন মুহূর্তে কোনো মা হয়তো চোখের জলে ভেঙে পড়তেন, কিন্তু বাবা দাঁড়িয়ে থাকেন পাহাড় হয়ে।

আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম—


“চিন্তা করবেন না, এখন আর পুলিশ কাউকে মারে না। আপনার ছেলেকে আইনগত প্রক্রিয়ায় নেয়া হবে। আমি নিজে দেখব, সে যেন কোনো অমানবিক আচরণের শিকার না হয়।”

 

বাবা তখন ছেলেকে ফোন দিলেন। আমি ভাবছিলাম, হয়তো ছেলে আসবে না। কিন্তু মাত্র চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ছেলেটি থানায় এসে হাজির। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

 

বাবা—একটি শব্দ, এক সমুদ্র ভালোবাসা

এই পুরো ঘটনাটি আমাকে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে বাধ্য করল। বাবা আসলে কে?
একজন পুরুষ, যিনি কোনো দাবি ছাড়াই কাঁধে পরিবার টানেন। যার ভালোবাসা হয়ত কম প্রকাশিত, কিন্তু সর্বাধিক গভীর। সন্তানের জন্য জীবন, সম্মান, এমনকি নিজের মুক্তির প্রশ্নেও তিনি আপস করেন না।

আমরা অনেকেই ভাবি, মা মানেই ভালোবাসা, আর বাবা মানেই শাসন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।


মা যেখান থেকে কাঁদতে শুরু করেন,
বাবা সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন—ভাঙা বুক নিয়ে, হাসি মুখে।

 

এই ঘটনার শিক্ষা কী?

১. সন্তান যতই বিপথে যাক, বাবা তাকে ত্যাগ করেন না।
২. পিতা একজন নীরব যোদ্ধা—যিনি শুধু দায়িত্বই নেন না, ভালোবাসাও লুকিয়ে রাখেন।
৩. আমরা সন্তানেরা হয়তো বুঝতে পারি না, কিন্তু বাবার চোখে সবসময়ই আমাদের জন্য গভীর আশঙ্কা আর অশেষ মমতা কাজ করে।
৪. বাবা কখনো 'ভালোবাসি' বলেন না, কিন্তু তার প্রতিটি কাজেই সেই ভালোবাসা প্রকাশ পায়।

 

উপসংহার

এই ছোট্ট অথচ গভীর ঘটনা আমাদের চোখে জল এনে দিতে পারে, যদি আমরা একটু মন দিয়ে ভাবি। আজ যে সন্তান হয়তো বাবার মুখ দেখে বিরক্ত হয়, কাল সেই সন্তানই হয়তো বিপদে পড়লে বাবার বুকেই ফিরে আসবে।

তাই আসুন, বাবার ভালোবাসাকে অবহেলা না করি। তাকে সময় দিই, তাকে বুঝি, তাকে অনুভব করি। কারণ মা যেমন হৃদয়ের ভাষা, বাবা হচ্ছেন আত্মার নিরব শক্তি।

 

– মোঃ জয়নাল আবেদীন
(লেখক, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মানবিক বিষয়কে লেখায় তুলে ধরার এক সচেতন কলম)