বিখ্যাত অনুবাদ গল্প সমূহ
শিরোনাম: ভাঙা কলস
লেখক: ব্রুনো ফেরেরো (Bruno Ferrero, ইতালিয়ান ছোটগল্পকার)
একদিন এক তরুণ পানি বহনকারী কাঁধে একটি বাঁশের লাঠিতে দুটি বড় কলস ঝুলিয়ে পানি আনছিল।
দুটি কলসের মধ্যে একটি ছিল ফাটলযুক্ত, আর অন্যটি ছিল একদম পরিপূর্ণ। যখনই সে উৎস থেকে মালিকের বাড়ি পৌঁছাত, ফাটলযুক্ত কলসটি সবসময় আধা খালি থাকত।
এইভাবে দুই বছর চলতে থাকে। নিখুঁত কলসটি নিজের প্রতি গর্ব বোধ করত, আর ফাটলযুক্ত কলসটি লজ্জায় কুঁকড়ে যেত।
একদিন ফাটলযুক্ত কলসটি ছেলেটিকে বলল:
— আমি লজ্জিত! আমি পথেই সব পানি ফেলে দেই, আমি একেবারেই নিরর্থক…
ছেলেটি হেসে বলল:
— তুমি কি খেয়াল করেছো? পথের তোমার পাশে শুধুই ফুল ফুটে আছে? আমি ওখানে বীজ বপন করেছিলাম, কারণ জানতাম তুমি পানি ফেলে দাও। তুমি প্রতিদিন ফুলগুলো পানি দিয়েছো—নিজের অজান্তেই! এখন আমি সেই ফুল মালিকের ঘরে সাজাতে পারি। তুমি যেমন, ঠিক তেমনটাই থাকো — কারণ তোমার মধ্যেই আছে সৌন্দর্যের একটি বিশেষ উপহার।
🧠 গল্পের শিক্ষা:
- আমরা সকলেই কোনও না কোনও দিক থেকে "ভাঙা কলস" — কিন্তু এই অসম্পূর্ণতাগুলো দিয়েই আমরা অজান্তে অন্যের জীবনে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিই।
অপূর্ণতা মানেই দুর্বলতা নয়, বরং এটি একটি বিশেষ ভূমিকা।
..................................................................................................................................................................
শিরোনাম: ঘটনার শেষ ভালো না খারাপ — কে জানে?
লেখক: চীনা লোককাহিনি (Chinese Folktale)
চীনের উত্তরের সীমান্ত অঞ্চলে এক বৃদ্ধ থাকতেন। সবাই তাঁকে “সাই ওং” বলে ডাকত।
একদিন হঠাৎ করে তাঁর ঘোড়া পালিয়ে পাশের শত্রু জাতি “হু” দের দেশে চলে যায়। প্রতিবেশীরা এসে দুঃখ জানাল,
— “আপনার তো বড় ক্ষতি হয়ে গেল!”
বৃদ্ধ শান্তভাবে বললেন,
— “কে জানে, এটা আসলেই খারাপ কিছু কি না?”
কয়েক মাস পরে সেই ঘোড়াটি ফিরে আসে — সঙ্গে নিয়ে আসে আরেকটি দুর্লভ হু জাতির ঘোড়া!
সবাই এসে অভিনন্দন জানায়।
বৃদ্ধ আবার বললেন,
— “কে জানে, এটা সত্যিই সুখকর কিছু কি না?”
এরপর একদিন বৃদ্ধের ছেলে নতুন ঘোড়াটিতে চড়তে গিয়ে পড়ে যায় এবং পা ভেঙে ফেলে।
সবাই আবার এসে সহানুভূতি জানায়।
বৃদ্ধ একইভাবে বলেন,
— “এটাও হয়তো ভবিষ্যতের ভালো কিছুর ইঙ্গিত।”
কিছুদিন পর সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়। সব তরুণদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকেই আর জীবিত ফিরে আসেনি।
কিন্তু বৃদ্ধের ছেলে পা ভাঙা থাকায় তাকে নিতে আসেনি কেউ — সে বেঁচে যায়।
গল্পের শিক্ষা:
এই গল্প থেকে এসেছে চীনা প্রবাদ:
“塞翁失马,焉知非福”
অর্থাৎ: “ঘোড়া হারানো কি সত্যিই অমঙ্গল? কে জানে — সেটাই হয়তো একদিন আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। জীবনে ভালো-মন্দ যা ঘটে, তার প্রকৃত মানে হয়তো আমরা তখনই বুঝতে পারি না। সময়ই সত্যের আসল ব্যাখ্যা দেয়।
.……...........................................
শিরোনাম: শেষ পাতা (The Last Leaf)
লেখক: ও. হেনরি (O. Henry)
অনুবাদ: মোঃ জয়নাল আবেদীন
ওয়াশিংটন স্কোয়ারের পশ্চিমে একটি ছোট্ট এলাকায় রাস্তাগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কিছু রাস্তা নিজেই নিজের সঙ্গে জুড়ে গেছে। সেখানকার এক শিল্পী বলেছিলেন, এমন অদ্ভুত জায়গায়ও শিল্প বেঁচে থাকতে পারে।
সু ও জনসি, দুই তরুণী চিত্রশিল্পী, একটি তিনতলা ইটের বাড়ির চূড়ায় একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। এক নভেম্বর মাসে জনসি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। সে বিছানায় শুয়ে দিন কাটাত, একটুও না নড়ে, জানালার বাইরে পাশের ভবনের দেয়ালে তাকিয়ে থাকত। সেই দেয়াল বেয়ে উঠেছিল এক লতার উপর ভর করে থাকা আইভি পাতাগুলো।
একদিন জনসি ফিসফিস করে সু-কে বলল,
— "যেদিন শেষ পাতা পড়বে, সেদিনই আমিও চলে যাব।"
সু আতঙ্কিত হয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বেহরমানকে ডাকে। বেহরমান এক সময় চিত্রশিল্পী ছিলেন, তবে তিনি কখনো তার “মাস্টারপিস” আঁকতে পারেননি। জনসির কথাগুলো শুনেও তিনি কিছু বললেন না।
রাতে ঝড় ওঠে। প্রবল বাতাসে গাছের পাতা উড়ে যেতে থাকে।
পরদিন সকালে জনসি চোখ মেলে জানালায় তাকায় — শেষ পাতাটি এখনও সেখানে।
একদিন, দুদিন… পাতা পড়ে না। দেয়ালে লেগে থাকে।
তা দেখে জনসি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তার জীবনীশক্তি ফিরে আসে।
একদিন সু তাকে সত্যি কথা জানায়:
— "বেহরমান নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন গত রাতে। তিনি দুই দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। যে পাতাটি তুমি দেখেছিলে... সেটি তিনি এঁকেছিলেন সেই রাতেই, যখন আসল পাতাটি পড়ে গিয়েছিল।"
গল্পের শিক্ষা:
ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, ও মানবতার এক অনন্য উদাহরণ এই গল্প। একজন শিল্পী তাঁর জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে একটি পাতার ছবি এঁকে বাঁচিয়ে দেন এক তরুণীর জীবন।
.................................................................................
গল্পের নাম: The Death of Ivan Ilyich
লেখক: লিও তলস্তয় প্রকাশকাল: ১৮৮৬
ধরণ: দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ছোটগল্প
সংক্ষিপ্ত সারমর্ম (বাংলায়):
ইভান ইলিচ, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর জীবন বাইরের দিক থেকে সফল মনে হলেও আসলে সেটা ছিল নিষ্প্রাণ, কৃত্রিম এবং সমাজের প্রত্যাশা পূরণের এক যান্ত্রিক প্রয়াস।
একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক মৃত্যুযাত্রা। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি তাঁর মনে জাগে গভীর প্রশ্ন—
-
-
-
“আমি কি সত্যিই বেঁচেছিলাম?”
-
“এই জীবন কি সঠিক ছিল?”
-
“সবাই এত উদাসীন কেন আমার যন্ত্রণার প্রতি?”
-
-
শেষ মুহূর্তে, তিনি উপলব্ধি করেন যে তাঁর গোটা জীবনটাই ছিল ভান, সামাজিক মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতা। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে তিনি বুঝতে পারেন "সত্যিকারের জীবন" বলতে কী বোঝায়—যেখানে থাকে ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং আত্মিক শান্তি।
মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আত্মিক মুক্তি লাভ করেন। তাঁর যন্ত্রণাময় মুখে তখন প্রশান্তির ছাপ।
মূল বার্তা:
মানুষ অনেক সময় মৃত্যুর কাছাকাছি না পৌঁছানো পর্যন্ত জীবনকে সত্যিকারে উপলব্ধি করতে পারে না।
তলস্তয় এখানে প্রশ্ন তুলেছেন: "সফল জীবন" মানেই কি সত্যিকারের জীবন?"