সুখী রাজপুত্র

13 Aug 2025 05:15:12 PM

গল্প- সুখী রাজপুত্র 
মূল লেখক– অস্কার ওয়াইল্ড।
অনুবাদ- মোঃ জয়নাল আবেদীন 

একটা শহরের মাঝখানে ছিল একটি উঁচু স্তম্ভ। সেই স্তম্ভের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল এক রাজপুত্রের মূর্তি—সুখী রাজপুত্র। পুরো মূর্তিটি পাতলা সোনার পাত দিয়ে ঢাকা, চোখে নীলকান্তমণি, আর তলোয়ারের হাতলে ঝলমলে লাল রুবি। দূর থেকে তাকে দেখে সবাই বলত, “কী চমৎকার! কী মহিমাময়!”

কিন্তু রাজপুত্র আসলে সুখী ছিলেন না। জীবদ্দশায় তিনি এক প্রাসাদে থাকতেন, যেখানে দুঃখ-দুর্দশা ঢুকতে পারত না। তাঁর জীবনে ছিল কেবল উৎসব, হাসি আর আনন্দ। তাই তাঁকে বলা হতো ‘সুখী রাজপুত্র’। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর মূর্তিকে শহরের ওপর উঁচু করে বসিয়ে দেওয়া হয়। এখন তিনি চারপাশের সব দেখতে পান—শহরের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শিশুদের কান্না, মানুষের হতাশা। তাঁর হৃদয় যদিও সীসার তৈরি, তবু যেন ব্যথায় ভরে ওঠে।

একদিন সন্ধ্যায় এক ছোট্ট গাঙচিল উড়ে আসল। শীতের আগে সে মিশরের পথে যাচ্ছিল। রাতের বিশ্রামের জন্য সে রাজপুত্রের মূর্তির নিচে বসল। হঠাৎ তার ওপর কয়েক ফোঁটা জল পড়ল। আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টি নেই—তাহলে জল কোথা থেকে এলো? উপরে তাকিয়ে গাঙচিল দেখল, রাজপুত্র কাঁদছে।

রাজপুত্র বললেন, “দূরে ওই গলিতে এক গরিব দর্জিনী বসে আছে। তার ছেলে অসুস্থ, জ্বরে কাঁপছে। খাবার নেই, ওষুধ নেই। কিন্তু সে এক ধনী মহিলার পোশাক শেষ করার জন্য সারা রাত সেলাই করছে। আমার তলোয়ারের হাতলের রুবিটি নিয়ে তুমি ওদের কাছে দাও।”

গাঙচিল প্রথমে দ্বিধা করল—কারণ তার মিশরে যাওয়ার তাড়া ছিল। কিন্তু রাজপুত্রের করুণ মুখ দেখে সে রাজি হলো। রুবি নিয়ে উড়ে গিয়ে তা দর্জিনীর ঘরে রেখে এল। পরের দিন বালকের শরীরে ওষুধ পৌঁছল, আর মায়ের মুখে হাসি ফুটল।

এরপর রাজপুত্র আরও অনুরোধ করলেন। তিনি তাঁর এক চোখের নীলকান্তমণি পাঠালেন এক দরিদ্র নাট্যকারের কাছে, যে শীতে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে, কিছু লিখতেও পারছে না। অন্য চোখের নীলকান্তমণি পাঠালেন এক ছোট্ট দেশলাইওয়ালির কাছে, যার দেশলাই ভিজে গেছে বলে বাবা তাকে মারতে যাচ্ছিল।

এখন রাজপুত্র অন্ধ। গাঙচিল তাকে ছেড়ে যেতে পারল না। সে দিন-রাত রাজপুত্রের সঙ্গে থাকল, শহরের নানা দুর্দশার খবর এনে দিল। রাজপুত্র বললেন, “আমার সোনার পাতগুলো তুলে শহরের গরিবদের দিয়ে দাও।” গাঙচিল সোনা তুলে নিয়ে গেল—ফলে মূর্তিটি ধূসর ও জীর্ণ হয়ে গেল।

শীত এল, তুষার পড়তে লাগল। গাঙচিল ঠান্ডায় দুর্বল হয়ে পড়ল। এক সকালে সে রাজপুত্রকে বিদায় চুমু দিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে মারা গেল। সাথে সাথে রাজপুত্রের সীসার হৃদয় দু’টুকরো হয়ে গেল।

পরদিন সকালে মেয়র ও কাউন্সিলরা মূর্তিটি দেখে বলল, “এটা এখন কুৎসিত লাগছে, নামিয়ে গলিয়ে ফেলো।” কিন্তু সীসার হৃদয়টি আগুনে গলল না, তাই তারা তা ফেলে দিল গাঙচিলের মৃতদেহের সঙ্গে।

স্বর্গে ঈশ্বর তাঁর ফেরেশতাদের বললেন, “শহরের সবচেয়ে মূল্যবান দুটি জিনিস আমাকে এনে দাও।” ফেরেশতারা নিয়ে এল সীসার হৃদয় আর মৃত গাঙচিল। ঈশ্বর বললেন, “তোমরা চিরদিন আমার বাগানে থাকবে, যেখানে সুখ ও ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না।”

 

গল্পের বার্তা:
সত্যিকারের সুখ আসে না ধন-সম্পদ বা বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে—এটি আসে ভালোবাসা, ত্যাগ ও সহানুভূতি থেকে।