কাজকে ছোট করে দেখা: মানসিকতা বদলালেই সফলতা
কাজকে ছোট করে দেখা: মানসিকতা বদলালেই সফলতা
✍️ লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন
আমরা এখনো একটি জাতি হিসেবে শ্রমের সঠিক মর্যাদা দিতে শিখিনি। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের মানসিকতা এবং একটি জাতিগত ব্যর্থতা। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি কী করো?” সে যদি বলে, “ব্যবসা করি, কৃষিকাজ করি, বা মাছ চাষ করি,” তখন অনেকে মুখে না বললেও মনে মনে ভাবে — “এই ছেলে বোধহয় লেখাপড়ায় ভালো ছিল না, তাই কোনো চাকরি পায়নি।” সমাজ যেন ধরে নিয়েছে, শিক্ষিত মানেই সরকারি চাকরি কিংবা কর্পোরেট অফিসে চাকরি। অথচ সবাই তো ক্লাসের প্রথম হতে পারে না, সবাই তো এক পথ দিয়ে চলতে পারে না।
আজকাল প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করে। কিন্তু আমাদের দেশের চাকরির বাজারে আসন সীমিত। যেটুকু পদ আছে, তার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি আবেদন পড়ে প্রতিটি সার্কুলারে। ফলে, অনেকেই যোগ্য হয়েও চাকরি পায় না। তখন কেউ কেউ ছোট চাকরি করতে চায়, কিন্তু সেটাও সমাজ মেনে নেয় না।
❝তুমি তো মাস্টার্স পাস, মাস্টারি করছো কেন? ডিসি-এসপি হতে পারলে না? বেতন কত? নিজে খাবে, নাকি মা-বাবাকেও দেখবে?❞
এই প্রশ্নগুলো যেন তীরের মতো বিদ্ধ করে দেয় একজন তরুণ-তরুণীর আত্মবিশ্বাসে।
অনেকে সমাজের এই কটাক্ষের ভয়ে পছন্দের কাজ শুরু করতে পারে না। কেউ গরুর খামার দিতে চায় না, কেউ দোকান খুলে বসতে চায় না, কেউ মাছ চাষ করতে লজ্জা পায় — যদি লোকে কিছু বলে! আর এই লজ্জার কারণে অনেকে পরিবার থেকে জায়গা-জমি বিক্রি করে বিদেশে চলে যায় — এক টুকরো সম্মানের আশায়।
❝কিন্তু বিদেশে গিয়েও তারা যে ধরনের কাজ করে, সেটা বাংলাদেশে করলে সমাজ তাকে তুচ্ছ করত।❞
আমার কলেজের এক সহপাঠী এখন লন্ডনে। শুরুতে সে বরফ ঠান্ডা পানিতে দাঁড়িয়ে মাছে বরফ দেওয়ার কাজ করত। আজ সে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার — নিজের গাড়ি আছে, স্বাধীনভাবে আয় করছে। আরেক বন্ধু নিউইয়র্কে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সেলসম্যান। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে। কিন্তু সেখানে কেউ তাকে ছোট করে না, বরং গর্ব করে বলে — সে নিজের পরিশ্রমে জীবিকা নির্বাহ করছে।
ফ্রান্সে এক ছেলে খাবার ডেলিভারির কাজ করে। প্রতিদিন শত শত বাসায় গিয়ে খাবার পৌঁছে দেয়। সেখানে তাকে কেউ “ডেলিভারি বয়” বলে তুচ্ছ করে না, বরং বলে — “ইনি একজন কর্মঠ মানুষ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে।”
আমাদের দেশে একজন শিক্ষিত যুবক চাকরি না পেয়ে ব্যবসা করলে সমাজ তাকে “ব্যর্থ” বলে, অথচ সিলেটে আমার এক ভাই ছাত্রজীবন শেষ করেই ব্যবসা শুরু করেন। আজ তিনি সফল ব্যবসায়ী। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা দান-সদকা করেন। আমি চাকরি করেও তার মতো দান করতে পারি না, কারণ আমার বেতন সীমিত। বাস্তবতা হলো — ব্যবসা কিংবা পরিশ্রম দিয়ে মানুষ অনেক বড় হতে পারে, যদি মানসিকতা থাকে।
আমরা শুধু চাকরির জন্য পড়ে থাকলে চলবে না। আমাদের নিজেদের চাকরি দেওয়ার ক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। যদি আমরা চাই, তাহলে নিজেরাই একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি, যেখানে অন্যরাও কাজ পাবে।
তাই আসুন — কাজকে ছোট করে না দেখি। পেশা যাই হোক না কেন, তা যদি সততা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়, তাহলে সেটা গর্বের বিষয়। আমরা বেকার না থেকে কাজকে আপন করে নেই। যে কাজেই হোক, মন দিয়ে করলেই একদিন সফলতা ধরা দেবেই।
সমাজ বদলাবে, যখন আমরা নিজেকে বদলাতে পারবো।
শ্রমকে সম্মান করি, পরিশ্রমে গড়ি নিজের ভবিষ্যৎ।