কাজের প্রতি অটল থাকা
কাজের প্রতি অটল থাকা
-
মোঃ জয়নাল আবেদীন
মানুষের জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণগুলোর মধ্যে একটি হলো অটলতা। আমরা যেকোনো কাজ শুরু করি, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা, ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া—এটাই আসল চ্যালেঞ্জ।
কাজ করতে গিয়ে বাধা আসবেই। কখনো ক্লান্তি, কখনো ব্যর্থতা, কখনো সমালোচনা, আবার কখনো নিজের ভেতরের অলসতা আমাদের নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু যে ব্যক্তি দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ চালিয়ে যায়, তার জন্য সাফল্য নিশ্চিত হয়ে যায়।
অটল থাকার মানে শুধু একগুঁয়ে হওয়া নয়, বরং লক্ষ্য ঠিক রেখে ধৈর্যের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া। যেমন নদী শত বাধা পেরিয়ে সাগরে পৌঁছায়, তেমনি পরিশ্রমী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ মানুষ একদিন তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
তাই জীবনে যে কাজই করি না কেন, শুরু করার চেয়ে অটল থাকা অনেক বেশি জরুরি। কারণ অটল থাকাই স্বপ্ন পূরণের মূল চাবিকাঠি।
জীবনে বড় হতে হলে শুধু স্বপ্ন দেখাই যথেষ্ট নয়, বরং সেই স্বপ্ন পূরণের পথে অটল থাকা সবচেয়ে বড় গুণ। শুরুটা সহজ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা কঠিন। অনেকেই কোনো কাজ শুরু করে দারুণ উদ্যম নিয়ে, কিন্তু মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়। অথচ সাফল্য তাদেরই হাতে ধরা দেয়, যারা বাধা, ক্লান্তি আর ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে অবিচল থাকে।
কাজের প্রতি অটল থাকা মানে হলো—বারবার চেষ্টা করা, হোঁচট খেলেও উঠে দাঁড়ানো, অন্যদের সমালোচনায় ভেঙে না পড়া। জীবনের প্রতিটি সাফল্যের গল্পের পেছনে লুকিয়ে আছে এমন অটলতা।
ভাবুন তো, যদি একটি বীজ মাটির নিচে অন্ধকারে থেকেও আলো দেখার জন্য লড়াই না করত, তবে কি সে গাছ হতে পারত? তেমনি আমরাও যদি লক্ষ্য পূরণের জন্য কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে না থাকি, তবে সাফল্য আমাদের কখনো ধরা দেবে না।
অনেকেই জীবনের পথে এক-দু’বার ব্যর্থ হলে হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, যে মানুষ অটল থেকেছে, তার কাছেই এসেছে প্রকৃত বিজয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন।
লিঙ্কনের জীবন ছিল এক কথায় সংগ্রামের গল্প। ছোটবেলায় তিনি দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে নিয়মিত যেতে পারতেন না। তবুও তিনি বই ধার করে এনে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন। জীবনে পা বাড়াতেই তাকে একের পর এক ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়—
-
ব্যবসায় হাত দিলেন, কিন্তু প্রথমেই ক্ষতির মুখে পড়লেন।
-
প্রেমে পড়লেন, কিন্তু বিয়ের আগেই প্রিয় মানুষটি মারা গেল।
-
রাজনীতিতে নাম লেখালেন, বারবার নির্বাচনে পরাজিত হলেন।
একজন মানুষ এতবার ব্যর্থ হলে স্বাভাবিকভাবেই হয়তো হাল ছেড়ে দিতেন। কিন্তু লিঙ্কন হাল ছাড়েননি। তিনি প্রতিবারই নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়াতেন, নতুনভাবে লড়াই শুরু করতেন। অবশেষে বহু ব্যর্থতার পর ১৮৬০ সালে তিনি নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
তার অটল পরিশ্রম ও ধৈর্যই তাঁকে শুধু মহান নেতা বানায়নি, বরং দাসপ্রথা বিলোপের মতো ঐতিহাসিক কাজও সম্ভব করে তুলেছে।
লিঙ্কনের জীবন আমাদের শেখায়—ব্যর্থতা কোনো শেষ নয়, অটলতার মাধ্যমে ব্যর্থতাকেও জয় করা যায়।
মানুষের জীবনে অটল থাকার অন্যতম অনন্য উদাহরণ হলেন থমাস এডিসন, বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক।
এডিসন ছোটবেলায় স্কুলে ভালো করতে পারেননি। শিক্ষকরা তাঁকে বলেছিলেন—“তুমি পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত নও।” কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের মায়ের উৎসাহে তিনি বাসায় বসেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।
আবিষ্কারের পথে তিনি অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের জন্য তিনি প্রায় এক হাজারেরও বেশি বার ব্যর্থ হন। অনেকে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত, অনেকেই বলত—“এ কাজ অসম্ভব।”
কিন্তু এডিসন কখনো হাল ছাড়েননি। তাঁর এক বিখ্যাত উক্তি—
- “I have not failed. I’ve just found 10,000 ways that won’t work.”
(“আমি ব্যর্থ হইনি। আমি কেবল ১০,০০০টি অকার্যকর উপায় খুঁজে পেয়েছি।” )
অবশেষে তাঁর অটল পরিশ্রম সফল হয়। বৈদ্যুতিক বাতি মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
শিক্ষা:
এডিসনের জীবন আমাদের দেখায়, অটলতা ছাড়া কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়। প্রতিটি ব্যর্থতা আসলে সাফল্যের পথে নতুন অভিজ্ঞতা মাত্র।
জীবনে সাফল্য পেতে শুধু প্রতিভা যথেষ্ট নয়, বরং অটলতা ও ধৈর্য সবচেয়ে বড় শক্তি। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলেন আমাদের গর্বের মানুষ সত্যজিৎ রায়।
কলকাতার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্যজিৎ ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ও গল্প পড়তে ভালোবাসতেন। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ করা তার জন্য সহজ ছিল না। অর্থের অভাব, সুযোগের অভাব—সবকিছু মিলিয়ে বারবার তাকে নিরুৎসাহিত হতে হয়েছে।
তিনি যখন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” বানানোর পরিকল্পনা করেন, তখন অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি, প্রযোজকরা বিশ্বাস করেননি। অনেকে বলেছিলেন—“এমন ছবি দিয়ে কোনোদিন সাফল্য আসবে না।” এমনকি শুটিংয়ের মাঝপথে টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সত্যজিৎ হাল ছাড়েননি। তিনি নিজের সামর্থ্য মতো টাকা জোগাড় করে আবার শুটিং শুরু করেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়—যেখান থেকে পেরেছেন সাহায্য নিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে ছবিটি সম্পূর্ণ করেন।
ফলাফল?
“পথের পাঁচালী” শুধু ভারতেই নয়, পুরো বিশ্বে সমাদৃত হয়। ছবিটি ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর একের পর এক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতে, আর সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি।
শিক্ষা:
সত্যজিৎ রায়ের জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায়—
- প্রতিভার চেয়ে বড় হলো অটলতা।
- ব্যর্থতা সাময়িক, কিন্তু অটল প্রচেষ্টা মানুষকে স্মরণীয় করে তোলে।
কিভাবে কাজের প্রতি অটল থাকা যায়
শুধু জানাই যথেষ্ট নয় যে কাজের প্রতি অটল থাকতে হবে—বরং এটাকে জীবনে অভ্যাসে পরিণত করতে হয়। নিচে কয়েকটি কার্যকর উপায় দেওয়া হলো :
1️⃣ স্পষ্ট লক্ষ্য ঠিক করুন
যে কাজ করবেন, তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার না হলে মাঝপথে আগ্রহ হারাবেন। তাই শুরুতেই নির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করুন।
2️⃣ ছোট ছোট ধাপে কাজ করুন
বড় লক্ষ্যকে ছোট অংশে ভাগ করুন। এতে কাজ সহজ মনে হবে এবং প্রতিটি ধাপ শেষ করার পর আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
3️⃣ ধৈর্য অনুশীলন করুন
ব্যর্থতা এলে হাল না ছেড়ে নতুনভাবে চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, ব্যর্থতা হলো শেখার সুযোগ।
4️⃣ সময়ের সঠিক ব্যবহার করুন
প্রতিদিন কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় বের করুন। নিয়মিত অনুশীলন অটলতার মূল শক্তি।
5️⃣ নিজেকে অনুপ্রাণিত রাখুন
প্রেরণাদায়ক বই পড়ুন, সফল মানুষের জীবনী জানুন, নিজের অগ্রগতি লিখে রাখুন। এতে মনে হবে আপনি এগোচ্ছেন।
6️⃣ ভালো সঙ্গ বেছে নিন
যারা আপনাকে নিরুৎসাহিত করে তাদের থেকে দূরে থাকুন। বরং ইতিবাচক মানসিকতার মানুষের সঙ্গে সময় কাটান।
7️⃣ আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন
নিজেকে বারবার বলুন—“আমি পারব।” এই বিশ্বাসই আপনাকে কঠিন মুহূর্তে শক্তি জোগাবে।
সহজভাবে বললে, অটল থাকা মানে প্রতিদিন একটুখানি এগোনো, যত ছোটই হোক না কেন। ছোট ছোট ধাপ মিলেই একদিন আপনাকে বড় সাফল্যের দরজায় পৌঁছে দেবে।
আমরা যদি মনিষীদের বাণী দেখি, তারা কিভাবে বিষয়টিকে দেখেছেন।
🔹 স্বামী বিবেকানন্দ
- “জীবনে বড় হতে চাইলে, এক কাজে মন দাও, এবং তাতে অটল থাকো।”
🔹 আব্রাহাম লিঙ্কন
- “আমি ধীরে হাঁটি, কিন্তু কখনো পিছু হটি না।”
🔹 থমাস এডিসন
- “আমার ব্যর্থতা নেই। আমি কেবল হাজারো উপায় খুঁজে পেয়েছি যা কাজ করে না।”
🔹 উইনস্টন চার্চিল
- “সাফল্য চূড়ান্ত নয়, ব্যর্থতা মারণ নয়; আসল বিষয় হলো এগিয়ে চলার সাহস।”
🔹 কনফুসিয়াস
- “তুমি যত ধীরেই চল না কেন, যদি থেমে না যাও, তবে একদিন ঠিকই পৌঁছে যাবে।”
🔹 নেপোলিয়ন হিল
- “অধিকাংশ মানুষ হাল ছেড়ে দেয় ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন সাফল্য তাদের দরজায় কড়া নাড়ে।”
তাই আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করুন—যা-ই হোক না কেন, কাজের প্রতি আপনি অটল থাকবেন। মনে রাখবেন, বাধা সাময়িক, কিন্তু অটলতা স্থায়ী বিজয় এনে দেয়।
জীবনে সাফল্য পেতে শুধু প্রতিভা যথেষ্ট নয়, বরং অটলতা ও ধৈর্য সবচেয়ে বড় শক্তি। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলেন আমাদের গর্বের মানুষ সত্যজিৎ রায়।
কলকাতার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্যজিৎ ছোট থেকেই ছবি আঁকতে ও গল্প পড়তে ভালোবাসতেন। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ করা তার জন্য সহজ ছিল না। অর্থের অভাব, সুযোগের অভাব—সবকিছু মিলিয়ে বারবার তাকে নিরুৎসাহিত হতে হয়েছে।
তিনি যখন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” বানানোর পরিকল্পনা করেন, তখন অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি, প্রযোজকরা বিশ্বাস করেননি। অনেকে বলেছিলেন—“এমন ছবি দিয়ে কোনোদিন সাফল্য আসবে না।” এমনকি শুটিংয়ের মাঝপথে টাকার অভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সত্যজিৎ হাল ছাড়েননি। তিনি নিজের সামর্থ্য মতো টাকা জোগাড় করে আবার শুটিং শুরু করেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়—যেখান থেকে পেরেছেন সাহায্য নিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে ছবিটি সম্পূর্ণ করেন।
ফলাফল?
“পথের পাঁচালী” শুধু ভারতেই নয়, পুরো বিশ্বে সমাদৃত হয়। ছবিটি ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর একের পর এক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতে, আর সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি।
শিক্ষা:
সত্যজিৎ রায়ের জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায়—
- প্রতিভার চেয়ে বড় হলো অটলতা।
- ব্যর্থতা সাময়িক, কিন্তু অটল প্রচেষ্টা মানুষকে স্মরণীয় করে তোলে।
কাজের প্রতি অটল থাকা শুধু ফলাফলের দিকে নয়, বরং প্রক্রিয়ার প্রতি নিষ্ঠা এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রতিফলন। যুক্তি অনুযায়ী, যখন একজন মানুষ নিয়মিত, মনোযোগী এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার কাজ সম্পাদন করে, তখন তা কেবল ব্যক্তিগত দক্ষতা ও সাফল্যই বৃদ্ধি করে না, বরং আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও দৃঢ় হয়।
অটলতা মানে কোনো কাজকে সময়মতো, সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে করা। এটি মানুষকে বাধা, ব্যর্থতা বা নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হতাশা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। কাজের প্রতি ধারাবাহিক অটলতা সাফল্যের প্রমাণ এবং জীবনে স্থায়ী উন্নতির ভিত্তি।
কাজের প্রতি অটল থাকা আমাদের ব্যক্তিত্ব, মানসিক শক্তি এবং দক্ষতা উন্নত করে। ধারাবাহিক নিষ্ঠা ও সততা জীবনে সাফল্য, সম্মান এবং স্থায়ী সুখ অর্জনের মূল চাবিকাঠি।