ছেলেটা যে হার মানেনি
গল্পের নাম: ছেলেটা যে হার মানেনি
লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন
নাম তার ইমরান। গ্রাম বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম। বাবা কৃষিকাজ করেন, মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইমরান বড়। ছোট থেকেই মুখচোরা, চুপচাপ, কিন্তু চোখে ছিল স্বপ্ন—একদিন বড় হবে, পরিবারের কষ্ট দূর করবে।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তার কাছে নতুন জামা ছিল না, পুরনো বই ছিল অন্যের দেওয়া। কিন্তু তার চোখে ছিল জেদ—"আমাকে পারতেই হবে"।
প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ইমরান চুপচাপ থাকত, কোনোদিন কোনো পুরস্কার পায়নি। একবার ক্লাসে শিক্ষক তাকে বললেন,
“ইমরান, তুমি যদি মনোযোগ দিয়ে পড়ো, তুমি পারবে। একদিন প্রথমও হতে পারো।”
সেই কথাটি যেন তার মনে গেঁথে গেল। সেদিন রাতে মা-বাবার পাশে বসে সে প্রতিজ্ঞা করল—
“এই দারিদ্র্য আমার পরিণতি হবে না। আমি হবো সেরা। পড়াশোনাতেই আমার মুক্তি।”
চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় সে বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় হলো। পুরো স্কুলে সবাই অবাক! ইমরান? দ্বিতীয়?
পরের বছর সে আর থামেনি—পঞ্চম শ্রেণিতে সে প্রথম হয়ে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষাতেও মেধা তালিকায় স্থান পায়।
সেই দিনই তার বাবা বলেছিলেন,
“তুই তো আমাদের মুখ উজ্জ্বল করলি রে। আমাদের কষ্ট এবার সার্থক।”
ইমরানের চোখে পানি চলে এসেছিল। সে জানত, এ শুধু শুরু।
মাধ্যমিক স্কুলে উঠেই শুরু হয় বড় চ্যালেঞ্জ। বই কেনার টাকা নেই, কোচিংয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। অনেকে বলত,
“দারিদ্র্যের কারণে তোরা কতদূরই বা যাবি?”
কিন্তু ইমরান কারো কথায় কান দেয়নি। সে স্কুল শেষে মসজিদে বাচ্চাদের পড়াত, সেই টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালাত। রাতের বেলা গ্রামের বিদ্যুৎ না থাকলে মোমবাতি জ্বেলে পড়ত।
এক রাতে তার মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই এত কষ্ট করিস, কখন বিশ্রাম নিবি?”
ইমরান বলেছিল,
“যেদিন আমি আবারও প্রথম হবো, সেদিন শান্তিতে ঘুমাবো।”
দশম শ্রেণির এসএসসি পরীক্ষায় সে বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান পায়। সেই সংবাদ পেয়ে গ্রামের মসজিদে দোয়া হয়, স্কুলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ইমরান হয়ে ওঠে গ্রামের গর্ব, দেশের সম্ভাবনা।
একজন সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“তোমার এই সাফল্যের রহস্য কী?”
ইমরান হেসে বলেছিল—
“আমি শুধু হাল ছাড়িনি। শুরুর দারিদ্র্যই ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।”
গল্পের বার্তা
ইমরান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পাশে টিউশন করে, আর সময় পেলে লেখে—অন্যদের জন্য।
তার গল্প আজ অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরও অনেক ছাত্রের কাছে।
সে আজও বিশ্বাস করে—
“শুরুর দারিদ্র্য নয়, মনোভাবই মানুষকে গড়ে তোলে।”
“পড়াশোনায় প্রথম হওয়ার পেছনে দরকার লক্ষ্য, আত্মবিশ্বাস, আর প্রচণ্ড পরিশ্রম।”
“যারা ছোটবেলায় জিততে শেখে, তারা জীবনেও হার মানে না।”
শেষ কথা
ইমরানের মতো হয়তো অনেকেই আছে এই দেশে—যারা নীরবে স্বপ্ন দেখে, নীরবে লড়াই করে।
তাদের জন্য এই গল্প, তাদের জন্য এই বার্তা:
“তুমি যেখান থেকেই শুরু করো না কেন, যদি মন থেকে চাও এবং পরিশ্রম করো—তবে তোমার দ্বারাই হবে।"