প্রথমের পথ

26 Jul 2025 08:38:18 PM

 

গল্পঃ- প্রথমের পথ

লেখক: মোঃ জয়নাল আবেদীন

 

ছেলেটার নাম শাওন। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা, বাবা একজন ছোট কৃষক, মা গৃহিণী। তাদের সংসারে অভাব যেন প্রতিদিনের সঙ্গী। কিন্তু শাওনের চোখে ছিল অদ্ভুত এক আগুন—সে চেয়েছিল নিজের কষ্ট, পরিবার, সমাজকে ছাড়িয়ে যেতে।
সে নিজেই নিজেকে বলত,
“জীবনের শুরুতে যদি কিছু করে দেখাতে পারি, তবে সব বদলে যাবে। আমি প্রথম হবো—যেকোনোভাবে।”

 

প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় তার হাতে না ছিল জুতার জোড়া, না ভালো জামা। ক্লাসে অন্যরা বই নিয়ে আসত রঙিন ব্যাগে, আর শাওন এক পুরনো থলিতে।
তবে এক জিনিস ছিল, যেটা অনেকেরই ছিল না—অসীম আগ্রহ।

শাওন বাড়ি ফিরে তার মায়ের আঁচলের নিচে বসে হোমওয়ার্ক করত। মাটির ঘরে যখন বাতি জ্বলত না, তখন সে কেরোসিনের কুপির আলোয় পড়ত। অনেকে হেসে বলত, “ওর দ্বারা কীই বা হবে?”

কিন্তু শাওনের দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে জানত, পড়াশোনা ছাড়া তার জীবন বদলাবে না।

 

তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় শাওন স্কুলে প্রথম হলো। হেডমাস্টার মঞ্চে ডেকে একটি সার্টিফিকেট দিলেন আর মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুই একদিন অনেক বড় হবি রে।”

সেই দিনের সন্ধ্যায় শাওনের মা প্রথমবার চোখের জল ফেললেন খুশিতে। তাদের ঘরে কোনোদিন কোনো পুরস্কার ঢোকেনি। সেই দিনটি শাওনের জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হয়ে রইল। সে বুঝে গেল—
“আমি পারি। আমি চেষ্টা করলে প্রথম হতে পারি।”

 


 

সময় গড়াতে লাগল। মাধ্যমিক স্কুলে উঠে পড়া কঠিন হতে লাগল। বাবার ফসল ভালো হচ্ছিল না, অনেক সময় বই কেনার টাকাও থাকত না। বন্ধুরা যখন কোচিংয়ে যেত, শাওন তখন স্থানীয় লাইব্রেরির পুরনো বই পড়ে পড়া চালাত।

একদিন স্কুলের এক শিক্ষক বললেন, “তুমি চাইলে আরও ভালো করতে পারো, শুধু সাহস ধরে রাখো।”
তখন থেকেই শাওন নিজেকে বলত—
“যা কিছুই হোক, আমি হাল ছাড়বো না। আমি আবারও প্রথম হবো।”

 

দশম শ্রেণির পরীক্ষায় সে দিনরাত পরিশ্রম করল। রাত ৩টা পর্যন্ত পড়াশোনা করত, ফজরের নামাজ পড়ে আবার বই নিয়ে বসত। রেজাল্টের দিন পুরো গ্রামে আনন্দের বন্যা বইয়ে গেল—
শাওন শুধু প্রথম নয়, সে উপজেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে।

সেই দিন তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো, পত্রিকায় নাম উঠল—
“অভাবের সঙ্গে লড়েই উপজেলায় প্রথম—শাওন”
বাবা মা'র চোখে পানি, গর্বে ভরা। শিক্ষকরা বললেন—"এ ছেলে অনেক দূর যাবে।"

 

শাওন একদিন বন্ধুর সঙ্গে বসে বলছিল,
“জানিস, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী?”
বন্ধু: “কি?”
শাওন:
“যদি কেউ জীবনের শুরুতেই পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়, নিজের জায়গায় সেরা হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে জীবনের অনেক কঠিন দরজাই খুলে যায়। আমি আজ যেটুকু হয়েছি, তার শুরু হয়েছিল ক্লাসে প্রথম হওয়ার সেই স্বপ্ন থেকে।”

 

শাওন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে। সে স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হওয়ার। কারণ সে জানে, গ্রামের আরও অনেক শাওনের দরজা তখনই খুলবে, যখন একজন শিক্ষক বলবে—
“তুই পারবি। তোর দ্বারাই হবে।”

শাওন জানে, প্রথম হওয়া মানেই শুধু নাম নয়—এটা এক আত্মবিশ্বাস, যেটা আজীবন পথ দেখায়।
সে ভাবে, যদি জীবন আবার শুরু করতে পারত, আবারও সে সেই আগুন নিয়ে শুরু করত—
পড়াশোনায় প্রথম হয়ে জীবন বদলানোর যাত্রা।

 

শিক্ষণীয় বার্তা

 ছোটবেলায় পড়াশোনায় সিরিয়াস হওয়াটা ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে দেয়।

প্রথম হওয়া মানে শুধু অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়া নয়, বরং নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।


বাধা থাকবে, উপহাস থাকবে—কিন্তু যার লক্ষ্য পরিষ্কার, তার পথ একদিন খুলবেই।